#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_২৪
সকাল সাড়ে আটটা। ঘরের জানালা ফাঁকা থাকায় সোনালি রোদ্দুর এসে বিছানায় পড়েছে। উষ্ণ আলোর স্পর্শে চিত্রার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে, শরীরের ওপর সাদা কম্বল টানা। একটু নড়েচড়ে পাশ ফেরার পরই টের পায় বিছানার ওদিকটা ফাঁকা। ফারাজ নেই। চিত্রার কপালে ভাঁজ পড়ে। এত সকালে তো তার ওঠার কথা নয়! দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা নিশ্চিত হয় সে। হঠাৎ দেরি হয়ে যাওয়ার অনুভূতি তাকে তাড়াহুড়া করতে বাধ্য করে। দ্রুত উঠে চুল খোঁপা করে বাঁধে। তারপর চোখ যায় টেবিলের দিকে। সেখানে রাখা একটি লাল গোলাপ। পাশে একটি চিরকুট। চিত্রার ভ্রু কুঁচকে যায়। গোলাপটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে। নরম একটা মন ভালো করার মতো গন্ধ। তারপর চিরকুটটা খুলে,
“শুভ সকাল প্রিয় ফুল।”
চিত্রা মুচকি হাসে। সে ফুল? এই ফারাজটাও না। একটা আজব লোক। চিত্রা আড়ম্বর ভেঙে খাট থেকে নামতেই ঘরের দরজায় কেউ একজন কড়া নাড়ে। চিত্রা গা থেকে কম্বল সড়িয়ে দেখে অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। তাই সে জলদি ওয়াশরুমে যাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু তার আগেই মিতালি রুমে ডুকে যায়। চিত্রা ততক্ষণে গায়ে শাড়ি জড়িয়ে নিয়েছিল।
“আপা খালু আপনারে জলদি তৈয়ার হইতে কইছে। সারপেরাজ আছে আপনার জন্য। “
“আমার জন্য?”
“হ।”
“আপনার কোনো সাহায্য লাগবো? দেন আমি সাহায্য করি। বিছানাডা গুছাইয়া দেই।”
“উঁহু। তুমি যেতে পারো।”
“আইচ্ছা।”
চিত্রা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে আসে। ইশরে গলাটা দাগে জর্জরিত। এসব নিয়ে নিচে কি করে যাবে? মিতালি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চিত্রা তাকে ডাকে,
“সাহায্য করতে পারবে?”
–
ফারাজকে দু’দিনের মধ্যে এক জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হবে। সকাল সকাল সে হলরুমের সোফায় বসে ফাইল ঘাঁটছে। পাশেই অভ্র, ক্লান্তিতে প্রায় আধমরা হয়ে পড়েছে। এতক্ষণ ধরে কাজ করতে করতে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, অথচ ফারাজের চোখে কোনো দয়া নেই। হলরুমের একপাশে রাজন আর রোশান বসে আছে। জোহান এখনো এসে পৌঁছায়নি। অভ্র একসময় আর সহ্য করতে না পেরে হতাশ স্বরে বলল,
“ভাই, আর কতক্ষণ কাজ করতে হবে? এটা বাসাবাড়ি, আপনার অফিস না!”
ফারাজ চোখ তুলল না, ফাইলের পাতা উল্টে যেতে যেতে সংযত কণ্ঠে বলল,
“ওহে কুদ্দুসের বাপ, আমি অন্ধ নই। আর আমার চোখদুটোও জনগণের ব্রেনের মতো পেছনে না।”
অভ্র আর সহ্য করতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলল,
“তো উঠেন। আমি আর কাজ করতে পারবো না। ক্ষুধা লেগেছে। বাল-ছাল না খেয়ে দেন আগে আপনার মাথাটা খাই।”
ফারাজ এবার ধীরেসুস্থে ফাইল বন্ধ করল। তারপর শান্ত গলায় বলল,
“সকাল সকাল মুখ খুলতে চাচ্ছি না, অভ্র। এমনিতেই ফারাজ এলাহীর দোষ বেশি! কথায় আছে না গু খায় সব মাছে আর দোষ পড়ে পাঙ্গাশের।”
বাড়ির বউয়েরা সকলে কাজে ব্যস্ত। রান্নাঘরে তো বেশ কয়েকজন কাজের মানুষ আছে, তবু রান্নার দায়িত্ব কাউকে দিতে পারেন না রুমানা। বাহিরের মানুষের হাতের রান্না খাওয়া তার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। চিত্রা সিঁড়ি দিয়ে মিতালির সঙ্গে নিচে নামছে। এত বড় ঘোমটা টেনেছে যে মুখটাই দেখা যাচ্ছে না। তবে শাড়ি সামলানো সে এখন মোটামুটি শিখে ফেলেছে, যদিও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। কিন্তু এ বাড়ির বিবাহিত নারীরা শাড়িই কেন পরে? শুধুই কি জমিদার বাড়ির বউ বলে? ফারিয়া, নিহানের সঙ্গে রুম থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে চিত্রাকে পেছন থেকে ডাকল। ঠিক তখনই ফারাজের চোখ গিয়ে পড়ল সিঁড়ির দিকে। পাশে থাকা অভ্রও তাকাল।
“যাক! ভাবী আসছে!”
অভ্র মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এখন অন্তত ভাবীই পারে ভাইয়ের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে!
“চিত্রা, উনি আমার স্বামী। নিহান শেখ,” ফারিয়া পরিচয় করিয়ে দিল।
নিহান বিনয়ের সঙ্গে চিত্রাকে সালাম জানাল। ভাবীর সঙ্গে হাত মেলানো কি ঠিক হবে? উনি আবার রাগ করবেন না তো? একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও সে হাত বাড়িয়ে দিল। ঠিক তখনই তার চোখ চলে গেল হলরুমের দিকে। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে ফারাজ এলাহী। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো তার দৃষ্টি। নিহানের বাড়ানো হাতের দিকেই স্থির হয়ে আছে সেই তীক্ষ্ণ চাউনি। যেন এখনই স্বর্পের মতো গিলে ফেলবে। মুহূর্তেই নিহান হাত সরিয়ে নিল। তারপর ফারাজের দিকে তাকাল। ফারাজ একবার চোখ তুলে চাইল। ঠোঁটের কোণে এক অস্পষ্ট হাসি ফুটল। সে ঠাণ্ডা গলায় শুধু বলল,
“দ্যাটস মাই বয়।”
নিহান ঠিক বুঝতে পারল না ফারাজ কী বলল। কারণ সে সিঁড়ির ধারে, আর ফারাজ হলরুমে। মাঝের দূরত্ব বেশ খানিকটা। তাছাড়া, ফারাজ শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে বলেছিল, তাই বোঝা কার্যত অসম্ভব।
চিত্রা নিচে নেমেই সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। নিরু সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। মোহনা চিত্রাকে দেখেই বলে উঠল,
“বিয়ের প্রথম প্রথম একটু দাগ তো হবেই। এত লুকানোর কী আছে? কই, আমি তো এখনো লুকাই না! ভালোবাসা লুকিয়ে লাভ কী? ভালোবাসার চেয়ে ভালোবাসা দেখানোতেই মজা বেশি!”
চিত্রা মোহনার কথার অর্থ বুঝতে পারল না। এ বাড়ির মানুষের বেশিরভাগ কথাই তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। সে কিছু বলার আগেই নিরু পাশে এসে খোঁচা দিয়ে বলল,
“বুঝলেন না ভাবী? এত বড় ঘোমটা দিয়েছে যাতে সবার নজরে উনিই থাকেন!”
মোহনা বিরক্ত হলো। এই মেয়েটার কথাবার্তা দিনকে দিন সীমা ছাড়াচ্ছে। যখন-তখন চিত্রাকে খোঁচা মারা যেন তার স্বভাব হয়ে গেছে। অথচ সে কি এখনো ফারাজকে ঠিকমতো চিনে না? জেনে-বুঝে আগুন নিয়ে খেলার কোনো মানে হয় না। পরিণামে তো শেষ পর্যন্ত সেই নারীকেই আগুনে পুড়ে ছাই হতে হয়। মোহনা শ্বাস ছাড়ল। মনে মনে শুধালো,
❝পুরুষ হচ্ছে অঙ্গার। নারীর ধ্বংস মন্ত্র। কখনো বা কেঁড়ে নেয়, কখনো বা ষড়যন্ত্র।❞
রান্নাঘর থেকে চিত্রা চায়ের ট্রে নিয়ে বের হয়। ট্রেতে সবার জন্য চা রাখা। চায়ের ভার সামলাতে গিয়ে মাথার কাপড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। ফারাজ কাজ থামিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন তাকিয়ে আছে, নিজেও জানে না। এই ট্রে ওর হাতে কে দিল? হয়তো সেই প্রশ্নটাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। তবুও চুপচাপ বসে দেখছে সব। চিত্রা রাজনদের দিকে চা নিয়ে এগোতেই ফারাজ আর বসে থাকতে পারে না। দ্রুত উঠে চিত্রার আগে গিয়ে সোফায় বসল। পায়ের ওপর পা তুলে। ইতোমধ্যে সুলেমান এলাহী আর জুনায়েদ এলাহীও এসেছে। আসেনি শুধু জোহান। ওর এত দেরি হচ্ছে কেন?
চিত্রা টেবিলের ওপর ট্রে রেখে প্রথম চায়ের কাপটা সুলেমান এলাহীর দিকে এগিয়ে দিল। ঠিক তখনই অভ্র এসে বসলো, সঙ্গে ছিল জোহান। চিত্রা একবার জোহানের দিকে তাকালো। তার ডান বাহুতে মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভ্রু কুঁচকে সে কাপ হাতে তুলে নিল এবং পরের কাপটি জুনায়েদকে এগিয়ে দিল।
ফারাজ কেবল চিত্রার দিকেই তাকিয়ে আছে, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চিত্রা যখন রাজনের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল, তখন সে সামান্য ঝুঁকল। সেই মুহূর্তে রাজনের চোখ পড়ল তার পেটের দিকে। যেখানে কাপড়ের ভাঁজ সরে গিয়ে একটুখানি ত্বক দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তবে সেই দৃষ্টি এক মুহুর্ত স্থির হতে পারল না। তার আগেই চিত্রার হাত থেকে ফারাজ কাপটা কেড়ে নিয়ে বলল,
“এটা আমার হাতে দাও। আর যাও আমার জন্য কড়া করে এককাপ ব্লাক টি বানিয়ে আনো।”
চিত্রা আজকে ফারাজের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছে না। এই যে হঠাৎ লোকটা তার জন্য মহিয়া হয়ে উঠে,হঠাৎ আবার তার ব্যবহার এমন ভাবে বদলে যায় যেন সব কিছুই ছলনা,অভিনয়। এক মুহুর্ত দেরি না করে চিত্রা আবারো রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায়। জুনায়েদ এতক্ষণ ছেলের হাতে ব্যান্ডেজ লক্ষ করে নি। চোখ পড়তেই তিনি বড় বড় করে তাকান,
“কিরে বাপ হাতে কি হইছে?”জোহান একটু চুপ থেকে বলে,
” বিপদ নিয়ে খেলি আব্বা, এসব আঘাত লাগা তো স্বাভাবিক।”
“নিজের খেয়াল রাখবি না তাই বইলা?”
“ভালো লাগছে না। আমি উঠলাম।” জোহান জুনায়েদের কথা উপেক্ষা করে উঠে যায়। সুলেমান এলাহীর সেদিকে পাত্তা নেই। সে নিজের মতো করে চা খাচ্ছে। আজকে অনেকদিন পর তারা সবাই একসঙ্গে। নিহান চায়ের কাপে পরোটা চুবিয়ে খেতেই ভালোবাসে। সে নিশ্চুপে বসে বসে গিলছে।
রাজন সবসময় পকেটে সিগারেট রাখে। ফারাজ চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বলল,
“সিগারেট দেন ভাই। আমি আবার চা সিগারেট একসঙ্গে খাই।”
পাশ থেকে অভ্র হুট করে বলে উঠল, “এতে ভালো বাথরুম হয়।”
ফারাজ পাশ ফিরে অভ্রর দিকে চাইতেই সে চুপ হয়ে গেল। রাজন একটা সিগারেট এগিয়ে দিল ফারাজের দিকে। ফারাজ নিঃশব্দে সিগারেটটা নিয়ে লাইটার ছুঁইয়ে ধরাল। এক গভীর টান দিয়ে গালভর্তি ধোঁয়া ছাড়ল রাজনের মুখের দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,
“আজ-কাল একটু এদিক-ওদিক নজরটা বেশি যাচ্ছে না ভাই?”
রাজন কুঁচকে তাকাল। চোখেমুখে অবাক করা দৃষ্টি। “নজর দেওয়ার মতো জিনিসের ওপর মানুষ তো নজর দিবোই।”
ফারাজ একরাশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল, “কিন্তু আপনি তো পশু ভাই। আপনি কেন নজর দিবেন?”
রাজন থম মেরে গেল। সঙ্গে বাকিরাও। এই ফারাজ হঠাৎ এত বদলে গেল কেমন করে?
” বুঝলাম না ফারাজ এইবার দেশে আসার পর তোর হইল টা কি? তুই তো এমন ছিলি না? ওই মাইয়া তোর মাথা খাইছে।” বলল রোশান।
ফারাজ গা ছমছমে এক শান্ত কণ্ঠে বলল, “হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মাইয়া? শি ইজ মাই লিগ্যালি ম্যারিড ওয়াইফ। শি ইজ মিসেস ফারাজ এলাহী। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? টেল মি ইফ ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড। আই নো হাউ টু এক্সপ্লেইন।”
রোশান বিরক্তির সুরে বলল,”কিন্তু তুই যা করতাছোত ঠিক হইতাছে না। তুই তো নিজেও বিপদে পড়বি, আমাগোরেও ফেলবি। তুই বাঘের মুখ থেকে শিকার থাবা দিছোত। আর এখন সেই শিকার নিয়ে আমাগো লগে ঝামেলা করতাছোত।”
“আমি শিকারী ভাই। থাবা দেওয়া আমার ধর্ম। লিসেন, আমাকে আমার কাজ করতে দেন, আপনারা আপনাদেরটা করেন। আমার কাজে আঙ্গুল ঢুকানোর চেষ্টা করলে আমি একেবারে হাত ঢুকিয়ে দিব। আরেকটা কথা,আমি কিন্তু আঙুল ছুঁই না গোটা হাতটাই ছিঁড়ে উপড়ে ফেলি।”
“ভাই এমন করে কয় না। ভুইলা গেলা? শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং যে?”
“শেয়ারিং ইজ মাই ফাক। এসব আমি বাল দিয়েও গুনি না। ভালো মানুষ হয়ে আছি সেভাবেই থাকতে দেন। উঠলাম।”
কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়াল। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সোজা রুমের দিকে পা বাড়াল। ভেবেছিল চিত্রাকে আজকে একটা সারপ্রাইজ দিবে। তবে মুড নেই এখন। সিড়ির কাছে পৌঁছে পেছন ফিরে কঠোর গলায় মিতালিকে বলল,
“তোর আপাকে বল, রুমে আসতে। জলদি।”
অভ্র শুষ্ক গলায় ঢোঁক গিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। ভাইয়ের মেজাজে বরফ থেরাপি দিতে হবে। সে ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ধপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার গায়ে। একটা কর্কশ, আতঙ্কিত কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল,
“কালুর বাপ হয়ার হউ গুয়িং। পিলিজ আমারে ছাড়া নো গুয়িং। বিকুজ আই লাভিং।”
চলবে?