চরিত্রহীন মেয়ে
গল্প #নিষিদ্ধ #পল্লী…প্রথম পর্ব।
আমি নিষিদ্ধ পল্লীর শেফালী, আজকাল খদ্দের তেমন আসেনা।
ভাবতাছি খুব শিঘ্রী এমন একটা কিছু করমু যাতে ধান্দাটা ভালো হয়।
কাইল রাইতে কই থাইক্কা এক ব্যাটা আইসে, না তার নাম কয় না তার পদবী।
হায়রে পুরুষ জাত!!
সে আইসাই কয়, ওই আমারে টান টান কইরা বিছানা কইরা দে। দিলাম কইরা।
ব্যাটায় দিলো একটা ঘুম।
এখন বাজে সকাল দশটা। সে উঠেও না। আমার খিদায় জান বাইর হইয়া যাইতাছে। তারে ফালাইয়া যাইতেও পারতাছি না।
হ্যালার ব্যাটা আইছোস ধান্দায় আর ঘুমের মধ্যে নাম কস মনের মানুষের। জেরিন আবার কেডা?
আমি তো আছি আমার চিন্তায়, ব্যাটা আমারে টাকা পয়সা কিছু তো দিবো।
ধান্দা না হয় না করলো, কিন্তু এক রাইত তো তারে জায়গা দিছি। সেই হিসাবেও কিছু পামু।
ইশশিরে কি নাক ডাইক্যা ঘুম…..
নাহ, বাইরে দিয়া তালা দিয়া যাই। মালেকের দোকান থাইক্যা চা আর পরোটা খাইয়া আসি।
“ওই মালেইক্কা, এক কাপ মালাই চা আর দুইডা মচমইচা ভাজা পরোটা দে..”
“কি শেফালী বুবু রাইতে তো দেখলাম, গাড়িওয়ালা খদ্দের তোমার ঘরে!! মাল তো ভালই কামাইছো?”
“চুপ থাক পোলা!
হালায় একটা ভাদাইম্মা আইছে।
না বাতচিত না অন্যকিছু। সিধা ঘুম। অহনো ঘুম। তালা মাইরা আইছি।”
“যাইরে, উইঠ্যা আবার কি ক্যাচাল করে, আল্লাই জানে.
আমি ঘরে আইসা দেখি, তাজ্জব ব্যাপার
সে পুরাই এক রাজপুত্র। রাইতে কারেন্ট আছিলো না। আন্ধাইরে কিছুই দেহি নাই।
ব্যাটা উইঠা, আমার হাতে এক বান্ডিল টাকা দিয়া কয়, আমি রাতে আবার আসবো, আপনি এটা রাখেন।
আজব আদমি! এতো টাকা! আবার কয়, আসবো। আমি তো টাস্কি লাইগ্যা গেলাম।
তার পিছে পিছে তারে ফলো করলাম, আছাই তো! মালেইক্কা তো ঠিক কইছে, বড় এক গাড়ি লইয়া আইছে।
আমি আমার ঘরে আইসা টাকা গুইণ্যা দেখি দশ হাজার টাকা!!
খুব তাজ্জব ব্যাপার!!
আবার ডর লাগতে শুরু করলো। কোনো খুনের আসামি না তো? রাইতে এইখানে পলাইয়া থাকে।
যাউক গিয়া আইজ রাইতে আইলে আগে জিগাইয়া লমু।
দুপুরবেলা নুরানি বিরিয়ানি হাউজ থাইক্যা চিকেন বিরিয়ানি আইন্ন্যা ঠাইসা পেট ভইরা খাইয়া, দিলাম একটা লম্বা ঘুম। রাইতে ওই ব্যাটা নাক ডাইক্কা আমার ঘুম হারাম করছে।
সন্ধ্যা হয় হয় আৎকা আমার ঘরের দরজায় ধাক্কা!!
এই যে শুনছেন? দরজা খোলেন। আমি ধড়ফড় কইরা উইঠ্যা দরজা খুইল্লা দেখি, এক জোয়ান মর্দ ব্যাটা, মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি পুরাই হুজুর টাইপ।
চোখ টিইপ্প্যা হাসি দিয়া কইলাম, হুজুর সাহেবগোর কি আমাগোর কাম লাগে?
হুজুর মাথা নিচু কইরা কয়, নাউজুবিল্লা!!, আর আমারে কয়,
আপনি আমার সাথে চলেন। আমার সাহেব গাড়িতে বসা।
আমি কইলাম, আচ্ছা তাই কন তো আপনের সাহেব দিনের আলোতে আইতে কি ডরায়? হুজুরে চুপ।
আমি কইলাম, হুজুর আপনে যান আমি আইতাছি।
দিলাম একটা হেব্বি সাজ। আয়নায় দেখি আমারে মাধুরী দিক্ষীতের মতোই লাগে। সবাই তো তাই কয়।
দূর কি সব ভাবতাছি। তাড়াতাড়ি যাই শেষে দেরি হইলে ওই ব্যাটায় আবার আর কেওরে লইয়া লইবো।
দূর কি সব ভাবতাছি।
আমি গাড়ির সামনে যাইতেই ওই ব্যাটা দরজা খুইল্ল্যা দাঁড়াইয়া আমারে গাড়ীর দরজা খুইল্ল্যা দিলো।
একবারো আমার দিকে চাইলো না। মনে মনে ভাবলাম, ব্যাটা বেশি ভাব দেখায়।
আমি গাড়িতে বইস্যাই কইলাম, ও বুঝছি,সাহেবের বুঝি বড় হোটেলে নিয়া যাউনের ইচ্ছা?
স্যার আমি কিন্তু ওই ফাইভ ইষ্টার না কি জানি কয় ওইখানে যামু।
জীবনেও যাই নাই।
ওইদিন আমাগো সুমাইয়ারে এক বড়লোকের পোলা নিয়া গেছিলো। হের কাছে শুনছি। আমার খুব শখ ওইখানে যাওনের।
আমি বকবক করতেই আছি ব্যাটা কিছু কয় না। তাজ্জব!!!
ইলিয়াস থামো। সাহেবের গম্ভির আওয়াজ। গাড়ী থামলো। বুঝলাম হুজুরের নাম ইলিয়াস।
একটা ছোট হোটেলের মতো। আমারে দরজা খুইল্যা দিয়া বলে, নামেন।
আমি অবাক হইয়া নামলাম।
এই লোকের মতলবটা কি?
তার পিছে পিছে আমি যাইতে থাকলাম।
সব কম বয়সের পোলাপাইন আর মাইয়্যারা বইসা আড্ডা দিতাছে।
উনি আমারে নিয়া এক কোণায় বসলো।
কইলো, কি খাবেন?
আমি গলগল কইরা কইতে লাগলাম, চিকেন ফ্রেরাই, নান রুটি কাবাব আর মিষ্টি আর ঠান্ডা ফানটা। ঢোক গিইল্লা কইলাম, কফিও খামু।
উনি বাবুর্চিরে ডাইকা কইলো, সব নিয়া আসতে।
মাইয়্যাগুলি আমারে দেইক্ষ্যা হাসাহাসি করতাছে। মনডায় কয়, যাইয়া একটা চটকানা দিয়া আসি।
হেরা যেই সাজ দিছে দেইক্ষ্যা আমার রাগে গা কিড়মিড় করতাছে।
দিলাম এক ভেংচি!!!!
উনি বললেন, শুনুন, ঠিক হয়ে বসুন। আর আমার কথাগুলি মন দিয়ে শুনুন।
আমি পোড়া পোড়া মুরগীর ঠেঙ এ কামড় দিয়া কি যে মজা পাইতাছিলাম।
এখন আমি সেইটা রাইখা মানুষটার দিকে ভালো কইরা দেখলাম, তার মাঝে কোনো খারাপ পুরুষের কিছু দেখলাম না।
সে কি চায়? কি কইবো আমারে?
আপনি ঠিক করে বলুন আপনার নাম আসলে কি? আমার স্ত্রী বললো, আপনার নাম রেশমি।
আমার খাওয়া সব মাথায় উইঠ্যা গেলো।
হায়রে আমাগো আবার নাম, কয়বার যে নাম বদল হইছে। কি কমু উনারে?
আমি কড়া কইরা কইলাম, আপনের কেইসটা কি কন তো? পত্রিকার লোক? আমাগোরে লইয়া লেখবেন? এইরম কত লেখা হইছে। ছবি তুইলা নিছে। কি লাভ? আমাগোর কোনো দাম কি আপনেরা দিতে পারছেন?
কত বড়লোকের আয়েসের ফসল ওই বস্তিতে অমানুষ হইতাছে। কি হইবো এইসব দিয়া?
যান ভাগেন, আর আমারে টাকা দেওয়া লাগবো না। যা দিছিলেন, কিছু খরচ হইছে বাকিটা লইয়া ফুটেন মিয়াঁ!!
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ কইরা থাইক্যা কইলো
,
আমি এসব কিছুই না।
আপনি আগে খেয়ে নেন।
আমি আপনাকে একজনের কাছে নিয়ে যাবো সেই আপনাকে যা বলার বলবে।
ও এতক্ষণে বুঝচ্ছি কেইস কি!! আপনে হইলেন দালালের দালাল। আমারে গতরাইতে তুই তোকারি করলেন মালের নেশায়।
অহন ভদ্র কইরা আপনি আপনি। ওই ব্যাটা ফুটবি? না পুলিশ ডাকমু?
আমি উইঠা দাঁড়াইতেই উনি খুব শান্ত গলায় কইলেন, আমাকে বিশ্বাস করুন। আপনারই লাভ হবে। আমরা আপনার হক আপনাকে ফিরিয়ে দিবো।
উনার কথা শুইন্যা আমি খুব আশ্চর্য হইলাম, তারে বিশ্বাস করলাম।
খাওয়া আর খাইতে পারলাম না। আমি চুপ মাইরা গেলাম।
উনি হোটেলের বিল দিয়া আমারে নিয়া গাড়ীতে উঠলেন।
অনেক সময় লাগালো আমাদের উনার বাড়ীতে আইতে। দুই ঘন্টার বেশী। এই দুই ঘন্টায় উনি আমার কাছে জানতে চাইলো আমার নাম আসলেই রেশমি নাকি?
আমি কইলাম, দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি আমার মায়ের কাছে ছিলাম আমার মা আমারে রেশমি নামেই ডাকতো। এর বেশি আর কিছু কমুনা।
গাড়ী আইসা বিরাট এক বাড়ীর সামনে থামলো। বাড়ী দেইখ্যা আমি তো টাস্কি লাইগ্যা গেছি।
আমি কইলাম, এইটা কার বাড়ী?
সাহেব বলেন, আমাদের বাড়ী।
বইলাই উনি ভিতরে চইলা গেলেন।
এক মহিলা মনে হয় এইখানে কাজ করে সে আমারে বাড়ীর ভিতরে নিয়া গেলো।
গদিওয়ালা সোফায় বসাইয়া সে ভিতরে গেলো।
আমি অবাক হইয়া বাড়ীর ভিতর দেখতে লাগলাম।
সিনেমায় যেমন দেখায় রাজা জমিদারগো বাড়ী এইটাও ঠিক তেমন।
অনেকক্ষণ বাদে এক মহিলা উপর থাইক্যা সিঁড়ী বাইয়া নাইম্যা আসলো।
মহিলা প্রায় আমার বয়সের।
দেখতেও অনেকটা আমার মতো। আমি হা হইয়া চাইয়া থাকলাম।
ভাবতে লাগলাম, আমি হইলাম কমজাত, কেমনে এই রাজরানীর চেহারার সাথে আমার মিলে?
যাউক গা আল্লাহ হইলো বড় কারিগর হেই জানে সব!!
উনি আমার পাশে বসলেন।
আমারে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কইলেন,
আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?
আমি কি কমু উনার কথায়? উনার ভাবে মনে হয় উনি আমারে যুগ যুগ ধইরা চিনে।
আমি খালি চাইয়্যাই থাকলাম।
তবে উনারে দেইক্ষ্যা মনে হইতাছে, উনি খুব অসুস্থ!!
এবার মহিলা কইলো, আমার নাম জেরিন। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে। আমিও তোমাকে রেশমি বলেই ডাকবো।
উনার পাশে দাঁড়ানো এক মহিলারে কইলো, জোসনা ওকে ওর রুমে নিয়ে যা।
আমি তাড়াতাড়ি কইলাম, ম্যাডাম আমি আমার বাসায় যামু আমারে বিদায় দেন।
উনি বললেন, বাসা মানে? ওই নোংরা জায়গায়?
উনি খুব আন্তরিকতার সাথে আমার কাছে আসলেন, আমার কাঁধে হাত রাইখ্যা মায়া কইরা কইলেন,
তুমি এখানেই থাকবে। এখন রাত হয়েছে, রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ডিনারে আসো। তোমাকে জোসনা সব বুঝিয়ে দিবে। কাল সকালে আমি তোমার সাথে কথা বলবো।
আমি কেন জানি উনার কথার উপর আর কথা কইতে পারলাম না। খুব মায়া হইলো উনার জন্য।
আমি আশ্চর্য রকম ভাবে খেয়াল করলাম উনার চোখের রং আর আমার চোখের রং একি রকম নীল ।
আখড়াতে আমারে সবাই কইতো, তুই মনে হয় কোনো রাজা জমিদারের পয়দা তাই তোর চোখের রং এমন। কি যানি?
আমারে জোসনা ঘরে নিয়া গেলো। বিরাট ঘর। কি নরম বিছানা। দেয়ালে লাগানো বড় বড় আলমারি।
জোসনা আমারে একটা খুইল্যা দিয়া কইলো, এসব আপনার কাপড়। ম্যাডাম কিনে রাখছে।
কি আশ্চর্য উনি আমার মাপ জানে কেমনে?
জোসনা বললো, আপনি রেডি হয়ে এই বেল টিপ দিবেন আমি এসে আপনাকে ডাইনিং এ নিয়ে যাবো।
বিরাট খাওয়ার ঘর মানুষ দুইজন আর টেবিল দশজনের।
জেরিন বসার আগে সব দেখে নেয়, তার স্বামীর বসার জায়গা, জমিদার বাড়ির খাবার টেবিলের কিছু রিতীনিতী থাকে।জেরিন সব দেখশুনে তারপর তার স্বামী আসার পর বসলো। আমি জেরিনের পাশে বসলাম।
সাহেব বসার আগে জেরিনরে ঔষধ খাওয়াইলো, কপালে হাত দিয়া দেখলো জ্বর আছে নাকি। আমার দিকে একবারো তাকায় নাই।
সাদা টুপি পড়া এক ব্যটা আইসা খাবার দিতে শুরু করলো। একটা শেষ হয় প্লেট বাটি নিয়া যায় আবার আরেকটা দেয়।
আমি তো কিছুই খাইতে পারি নাই। জেরিন বারেবারে কয়, খাও খাও।
জেরিন ওই সাহেবরে বললো, ফয়সাল কাল আমি আর রেশমি একটু বের হবো।
খাওয়া শেষ আমারে জেরিন কইলো, রেশমি তুমি তোমার রুমে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে নাস্তার পর তোমার সাথে কথা হবে।
আমি আমার রুমে চইলা আসলাম।
এতো নরম বিছানায় আমার ঘুম ধরতাছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা কইরাও ঘুম আসলো না। নিচে বিছানা পাতলাম।
ঘুম আসে কিন্তু বারবার মনে হইতে লাগলো কই আসলাম? কেন আসলাম?
এই জেরিনের জন্য এতো মায়া কেন লাগে?
না আমি এই মায়াজালে কিছুতেই আটকামু না। সকালে জেরিনরে বইলা আমি চইলা যামু। এখন ঘুম আসতেছে,ঘুমাই।
বড়লোকের এতো মায়া হয়? জানতাম না। জীবন কত রকমের হয়!! সিনেমায় দেখি কিন্তু বাস্তবে এইসব দেখমু তা কি
কোনোদিন ভাবছি?
পৃথিবীতে কিছু ভালো সময় মানুষ তার কর্ম ফলের জন্য পায়।
স্রষ্টা মানুষকে সেই সুযোগ দেন। কেও কেও তার দুর্বল মুহূর্তে এই ব্যাপারগুলি
অনুধাবন করতে পারে…..
প্রকৃতী সব ভালো মন্দের সাক্ষী হয়ে থাকে এবং সময় মতো তার প্রতিদান দেয়। আর সময়মতো কারো কারো জীবন পুরোটাই বদলে দেয়।
ভোর ছয়টায় জেরিনের ঘুম ভেংগে যায়।
অনেক কষ্টে ফয়সালের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে আসে।
জানালার কাছে যায়। বাহিরে এ সময় খুব সুন্দর লাগছে। রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। গাছের পাতাগুলি কি সবুজ সতেজ। আহ কি শান্তি লাগছে।
গত এক বছর থেকে রেশমিকে খোঁজ করছে এতোদিনে পেলো!! এর জন্য ফয়সালকে কত রকমের অভিনয় করতে হয়েছে। ফয়সালের মতো লোক সাধারণ মানুষ সেজে বিভীন্ন নিষীদ্ধ পল্লীতে গিয়েছে।
সেকি পারবে রেশমিকে ঠিকমতো তার হক ফিরিয়ে দিতে? তার যে সময় অনেক কম। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। ফয়সাল তাকে অনেক হেল্প করবে জানে। রেশমি থেকে জেরিন এই পরিবর্তন কি সম্ভব?
জেরিন আসলো রেশমির রুমে। ও মাটিতে এলোমেলো ভাবে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখের দিক তাকিয়ে থাকলো, কি যে মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য।
ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। এই মেয়েকে তার মতো বানাতে অনেক সময় লাগবে। সময় যে কম!!!
থাক রেশমি ঘুমাক।
জেরিন তার রুমে এলো, ফয়সাল ঘুমাচ্ছে, ও ঘুমালে ওকে একটা বাচ্চার মতো লাগে। জেরিনের বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে। না তাকে শক্ত হতে হবে।
সে ওয়াস রুমে গেলো, গোসল সেরে ফয়সালের পছন্দের কাপড় পড়লো।
আটটায় ব্রেকফাস্ট করবে ফয়সাল। ওর কাপড় রেডি করে জেরিন রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে গেলো।
রমজান বাবুর্চি নাস্তা বানাচ্ছে। জেরিন নিজ হাতে অরেঞ্জ জুস বানায় ফয়সালের জন্য, এটা সে রোজ করে।
জোসনাকে ডেকে বললো, রেশমি যেনো গোসল করে ভালোভাবে ড্রেসআপ করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসে।
ফয়সাল আর জেরিন ব্রেকফাস্ট এ বসা ফয়সাল পত্রিকা পড়ছে। জেরিন ওকে জুস ঢেলে দিলো ফয়সালের চোখ পত্রিকায়, জুস মুখে দিচ্ছে আর জেরিনের দিকে তাকিয়ে ওকে দেখছে। ফয়সালের মনে হলো জেরিনকে আজ আগের থেকে ফ্রেস লাগছে। ওর মনটা খুশি হয়ে গেলো।
আজ এক বছর থেকে জেরিনের অসুস্থতা তাকে অনেক বিমোহিত করছে। কি ভাবে জেরিনকে ভালো রাখবে এর জন্য সে কি চেষ্টাই না করছে। যাক রেশমিকে পাওয়াতে জেরিন অনেক খুশি। ওর খুশিই তো ফয়সালের শান্তি।
রেশমি এলো ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওর পড়নে নীল রংয়ের পিউর চিনন সিল্ক সাথে মিলানো ব্লাউজ। হালকা মেকাপ।
ফয়সাল খুব অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো, আশ্চর্য পরিবেশ মানুষকে এতো তাড়াতাড়ি বদলে দেয়?
গতকালের শেফালী আজকে জমিদার বাড়ীর মেয়ের মতো লাগছে!!
জেরিন ওকে দেখে বেশ আশ্বস্ত হলো, যাক একদিনে এতো চেঞ্জ কাজেই বেশি সময় লাগবে না ওকে বানাতে।
জেরিন…. রেশমি তোমার নাস্তা শেষ হলে তুমি ওখানে বারান্দায় গিয়ে বসো।
ফয়সাল অফিসে যাবে ওকে বিদায় করে, আমি আসছি। আমাদের চা ওখানে দিয়ে আসবে, তুমি চা খেতে থাকো।
আমি কিছুই কইলাম না। নাস্তা শেষ কইরা বারান্দায় বসলাম। বারান্দা যে ওতো সুন্দর হয় তা খালি সিনেমাতেই দেখছি।
কি সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। বসার চেয়ার আবার চেয়ারের মতো দোলনাও আছে।
বারান্দা দিয়া নিচে তাকাইলে পুরাটাই ফুলের বাগান।
কিন্তু আমার এসব কিছুই ভালো লাগতাছে না। আমারে এরা কেন আনছে? এইটা জাইন্যা আমি এইখান থাইক্যা চইল্যা যামু।
কাকের গায়ে ময়ূর পুচ্ছ যেমন বেমানান আমিও ঠিক এইখানে এমন বেমানান।
ওইতো জেরিন আসতেছে কিযে সুন্দর আর মায়াবতী লাগতাছে ওরে।
ওর পিছে ফয়সাল সাহেব, জেরিন দরজা পর্যন্ত গেলো, সাহেব তার গালে চুমা দিয়া আদর দিলো তারপর গেলো। আমি মুখ ঘুরাইয়া অন্যদিক তাকাইয়া থাকলাম।
এইসব স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার এইগুলি আমাদের দেখতে নাই…..আকাশে মেঘ করছে মনে হয় বৃষ্টি হইবো!!!
জেরিন.. কি রেশমি বোর হচ্ছো?
রেশমি… না আমাদের আবার বোর!!
আমি খুব চেষ্টা করতাছি ওর সাথে
ভালো কইরা কথা কইতে।
জেরিন… এসব বলবে না। তুমি আর আমি একই মানুষ।
রেশমি… আপনি অনেক ভালো ম্যাডাম।
তাই এসব বলেন।
জেরিন… তোমার নিশ্চয় জানতে মন চাইছে এভাবে তোমাকে কেনো নিয়ে এলাম?
রেশমি… জি জি ম্যাডাম!”
জেরিন…. আমি বলবো সব বলবো কিন্তু তুমি যদি আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করো তবে তো কিছুই বলবো না। আমি বললাম না?
আমাকে নাম ধরেই ডাকবে। যদিও তুমি আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট!!! কিন্তু আমি চাই আমরা দুই বন্ধুর মতো থাকবো।
রেশমি… তুমি যা বলো শুনবো কিন্তু আমারে আর এই ভেজালে কয়দিন রাখবা?
জেরিন… তুমি সব জানলে এখান থেকে যেতে চাইবে না।
রেশমি… জেরিন তুমি যা বলার জলদি কও। আমি আর এই ভার বইতে পারতেছি না।
জেরিন এসে রেশমির পাশে বসলো খুব মমতার সাথে রেশমির হাত ধরলো এবং বলতে শুরু করলো….. আমি অনেক একটা বড় অসুখ শরিরে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
একটা মেয়ে কতটুকু অসহায় হলে তার স্বামীকে পতিতালয় পাঠায় তোমার খোঁজে?
রেশমি…. তোমার অসুখটা কি?
জেরিন…. তুমি কোনো প্রশ্ন করবে না, কথার মাঝে। আমি সব বলে শেষ করলে তুমি সিদ্ধান্ত নিবে তুমি কি করবে? জেরিন বলতে শুরু করলো…..
আমাদের আব্বাজী জীবনে একটা অনেক বড় পাপ করেন।
উনি মারা যান গত বছর। মারা যাবার আগে উনি আমাকে একটা চিঠি লিখে যান।
যেখানে উনার এবং আমাদের জমিদার বংশের সব পাপ, নিষ্ঠুরতা, লোভ আর অংহকারের কথা লিখে যান। এবং আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যান, উনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।
সেটা হলো একজনকে খুঁজে বের করে তার হক তাকে বুঝিয়ে দিতে। উনি বেঁচে থাকতেই আমার বিয়ে হয়। আগামি সপ্তাহে আমাদের বিয়ের তিন বছর হবে।
রেশমি বিধাতা আমাকে ফয়সালের মতো এতো ভালো একজন স্বামী দিয়েছেন…
আমার বাবার বংশে এতো মানুষের অভিশাপের ভিতর এটা একটা বড় পূণ্যি আমার জন্য।
কিন্তু পাপ তো কাওকেই ছাড়েনা। আমাদের আব্বাজী বেঁচে থাকতেই এবং আমার বিয়ের ছয় মাস পরই আমার ক্যান্সার ধরা পরে।
ফয়সাল পাগলের মতো আমাকে নিয়ে বিদেশের অনেক বড় বড় জায়গায় ট্রিটমেন্ট করায়। কিন্তু কিছুই হয়নি।
আমার আয়ু আর এক বছর। এই এক বছরে আমাকে আমার সব কাজ শেষ করতে হবে। আমাদের আব্বাজী আমার এই অসুখের পর থেকেই নিজেকে বদলে ফেলেন। হজ্ব করেন। এবং প্রচুর দান খয়রাত আর নামাজ কালাম নিয়েই থাকতেন।
কিন্তু আমি আব্বাজীকে বলি, আব্বাজী আপনি যতই এসব করেন কোনো লাভ নেই। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিজের পাপের জন্য অনুতাপ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার মাফ নেই।
আমাদের আব্বাজী এর কদিন পর আমাকে ডেকে বলেন, জেরিন এই বাক্সটা রাখো। এর ভিতর একটা চিঠিতে আমি আমার সব কিছু লিখে গেছি.. আমার মৃত্যুর পর এটা খুলবে এবং চিঠিটা পড়বে আর ওর ভিতর যা আমানত আছে তা তাকে বুঝিয়ে দিবে।
এবার জেরিন একটু থামলো এবং বেশিক্ষণ কথা বলার জন্য হাঁপাতে লাগলো।
রেশমি… তুমি এতক্ষন যা বললা জেরিন তা তো পুরাই সিনেমার কাহিনী। কিন্তু এইখানে তো আমার কোনো ভুমিকা নাই। তাইলে
আমারে কেন এর মাঝে টানলা?…
জেরিন হাত নেড়ে রেশমিকে থামিয়ে বললো
…. তুমিই তো এই কাহিনীর মুল ভূমিকা!!
রেশমি খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলো জেরিনের দিকে!!………চলবে।
…………
…………..
চরিত্রহীন মেয়ে
ক্যাটাগরি—সামাজিক
তিন পর্বের গল্প — #নিষিদ্ধ #পল্লী…….. দ্বিতীয় পর্ব
জেরিন আর রেশমি তখনো বারান্দায় বসা। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। জেরিন কাঁদছে।
আমি ভাবছি, মেয়েটা এই ভাবে কেন কাঁনতেছে? আমার খুব মন খারাপ হইতেছে। আমার কি করনীয়? আমি উঠে জেরিনের কাছে গেলাম। ওর হাত ধরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, জেরিন তুমি এভাবে কেনো কানতেছো? জেরিন আমার দিক ফিরে বললো, রেশমি তুমি কি সত্যি সব জানতে চাও?
আমি বললাম … হুম চাই।
জেরিন…. কিছু কথা আছে খুব অল্প করে বললেই হয়। বাকিটা কথার মাঝেই বুঝে নিতে হয়। আমি বেশি কথা বলিনা। যা বলবো তার মাঝেই বুঝে নিবে।
জেরিন একটু দম নিয়ে বলতে লাগলো,
….রেশমি, তুমি যেই পরিবেশে বড় হয়েছো , যে সব পুরুষরা তোমাদের কাছে যায় শুধু বিনোদনের জন্য। সেখানে তাদের শরীর জাগে মন জাগেনা। তাদের কাছে তোমাদের মনের কোনো দাম নেই।
শরীর আর মন একসাথে তখনই জাগে যখন ভালোবাসার বন্ধনের সাথে হয় প্রেমের গভীরতা।
আগে মনকে জাগাও তবেই ভালোবাসা আসবে।
আমি খুব আশ্চর্য হই জেরিনের কথায়!! জেরিন কেনো এসব বলতেছে?
আমার কথা.. জেরিন,আমি হইলাম সোজাসাপ্টা কথার মানুষ আমি এতো কিছু বুঝিনা আমারে সহজ ভাবে বলো। আমি টিউব লাইটের মতো, দেরিতে জ্বলি!
জেরিন… আমাদের দাদাজান আর আব্বাজীর পাপের শাস্তি কেনো আমরা ভোগ করছি?
ফয়সাল আমাকে এতো ভালোবাসে তাকে তো আমি শুধু মনটাই দিয়েছি আর আমি এখন কিছু দিতে পারিনা।
ও তো পুরুষ মানুষ ওর কি কোনো চাহিদা নেই?
আমি কইলাম… উনি তো একজন ফেরেশতা! । আমারে এই গত দুইদিনে শরীরে ছোঁয়া তো দুরের কথা ভালো কইরা তাকায়ও নাই!
জেরিন… সেই জন্যই তো আমার এতো কষ্ট। ফয়সালও তো জমিদার বংশের ছেলে ওরা তো এমন না। ওর মতো কেনো আমার বাপ দাদারা হয় নাই।
আমি বললাম.. সব পুরুষরা তো একরকম না।
জেরিন…. আমি চলে গেলে ফয়সালের কি হবে রেশমি? আমি যে ওকে বড্ড বেশি ভালোবাসি…
আর তোমার কি হবে রেশমি? আমাদের বাপ দাদাদের পাপের শাস্তি কেনো আমরা ভোগ করবো?
আমার কথা.. ধুর জেরিন, এসব নিয়া ভাইবোনা।
সময়ে ফয়সাল সাহেব ঠিক হইয়া যাইবো।
আর আমি আমার ধান্দায় আবার ফিইরা যামু।
জেরিন এক চিৎকার দিয়ে উঠলো… না কিছুতেই না তুমি আমার বাবার বংশের মেয়ে তুমি কিছুতেই আর ওখানে যাবেনা। আমাদের দাদাজানের কারনে তোমার আর তোমার মায়ের এই ভাগ্য…!
আমি অবাক হইয়া জেরিনের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়ে থাকলাম!
আমি কিছু বোঝার আগেই জেরিন আমারে হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়ীতে বসালো। ড্রাইভারকে বললো, শাহবাজপুর চলো।
গাড়ী শাহবাজপুর যেতে থাকলো।
জেরিন গাড়ীতে কাদঁতে থাকলো আর আমি ওর হাতের উপর হাত রাখলাম। আশ্চর্য! আমার চোখেও পানি!!
এ পানি কার চোখের!? শেফালী!? মিরা!? নয়ন!?বিউটি!? নাকি জমিদার বংশের রেশমির!?
প্রায় ঘন্টা চারেক বাদে গাড়ী এসে থামলো পুরাণো বিরাট এক জমিদার বাড়ীর সামনে। বাড়ীটা পুরাণ হলেও দেখতে সুন্দর।
বাড়ীর এক অংশে কোনো পরিবার থাকে আর বাড়ীর মূল অংশে তালা দেয়া।
জেরিনকে দেখে একজন লোক এগিয়ে এলো।
জেরিন বললো, রশিদ চাচা তালা খুলে দেন, আর আমারা রাতে থাকবো, রাতে ফয়সালও আসবে। আমাদের সবার খাবার ব্যাবস্থা করেন।
আমাকে নিয়ে জেরিন ভিতরে গেলো। কি রাজকীয় বাড়ী। বোঝাই যায় অনেক পুরানো সব আসবাবপত্র। কিন্তু সব খুব যন্তে রাখা। আমার এই বাড়ীতে ঢুকেই কেমন লাগতে থাকলো। কেমন একটা মায়া মায়া গন্ধ!! যা আমার শরীর মন দুই ছেঁয়ে যাইতেছে।
আমি আর জেরিন সিঁড়ী দিয়ে উপরে গেলাম। করিডোরে বিরাট বিরাট বাঘের চামরা, হরিণের চামরা ঝুলানো। নানা রকম শ্বেত পাথরের মূর্তি। করিডোরের দুইপাশ জুড়ে নানান রুম একদম শেষের রুমে আমরা ঢুকলাম।
কেমন সিনেমা সিনেমা অনুভূতি আমার!
রুম তো না যেনো খেলার মাঠ। বিরাট ঝালর দেয়া খাট। খাটের ডান পাশের দেয়ালে তিন জন মানুষের ছবি যারা রাজা বাদশাহদের মতো পোষাক পরা।
আমি জেরিনকে বললাম, এইটা কার বাড়ী? জেরিন বললো, তোমার বাড়ী!!
আমি খুব অবাক হইলাম! ভাবলাম ও আমার সাথে মজা করতেছে….!!
দেয়ালের ওইপাশে কিছু পারিবারিক ছবি।
জেরিন আমাকে বললো, চলো তোমাকে আমাদের বংশধরদের ছবি দেখাই…!
এই যে দেখছো ইনি আমাদের বড়বাবা মানে আমাদের দাদার বাবা খান আকবর আলী ।
উনি ছিলেন নবাবদের সরাসরি বংশধর এর পর আমাদের দাদাজান খান জাহান আলী আর সবশেষে আমাদের আব্বাজী খান ইমরান আলী।
আর এইদিকে আমাদের ছবি এইটা আমার বড় বোন, আয়না, মেজোবোন আজমেরি, এইটা আমি আর মায়ের কোলে আমাদের একমাত্র ভাই খান আকবর আলী! আমাদের বড়বাবার নামে ওর নাম।
আমি জেরিনকে বললাম, ওরা সবাই কোথায়?
জেরিন… অভিশাপ বুঝলে সব অভিশাপ! শুধু আমি আর আমার ভাই খান আকবর আলী বেঁচে আছি। বাকি সব মরে গেছে। হায়রে বংশ, হায়রে বংশধর !
আমি কইলাম..আকবার কোথায়?
জেরিন.. আকবরের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন খেলতে যেয়ে ছাদ থেকে পরে যায়। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। এখন এই বাড়িতেই থাকে বিছানার সঙ্গী হয়ে।
কাওকে চিনেনা। রশিদ চাচা ওকে দেখশুন করে।
এই বাড়ীর পাপমোচন হবেনা শাপমোচনও হবেনা।
ছেলে ছাড়া বংশ হয়না তার জন্য কত অন্যায় আমার মায়ের উপর আর তোমার মায়ের উপর করা হয়েছে।
হায়রে বংশধরের জন্য সব ধংস …..!!!
আমি খুব অবাক হইয়া জেরিনের কথাগুলি শুনি।
আমাদের মতো মেয়েরা সংসার কি তা দেখিও নাই জানিও না। এসব আমাদের কাছে অলিক চিন্তা!
কাজেই এসব শুনে অনুভূতির দরজায় শুধু কৌতূহলই উঁকি দেয়। আমার অনুভূতি এখন কৌতূহলে পরিনত হইতেছে। আমি ধিরে ধিরে এক অজানা জগতে যাইতেছি। এর কি পরিনতি আমি নিজেও জানিনা।
আমি এবার জানতে চাইলাম, তুমি যে বললা আমি এই বংশের মেয়ে তার কি প্রমণ? সেই প্রমাণ দাও।
জেরিন বললো.. আমি তোমাকে সব প্রমাণ সহ দিবো তার আগে তুমি এই বাড়ীর সব কিছু দেখো জানো। তুমি যে এই বাড়ীর মেয়ে এটা জানার পর তোমার মাঝে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, সেটা হতে পারে লোভ, হিংসা,ঘৃণা, অপমান,প্রতিশোধ বা বড় কোন ত্যাগের ইচ্ছা। সিদ্ধান্তগ্রহণে তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা।
জেরিনের কথা শুনে আমার মনে হইলো, সে খুব বুদ্ধিমতী এবং দুরদৃষ্টিসর্ম্পনা মেয়ে। কিন্তু তার মাঝে খুব মায়া এবং সততা আছে।
আমি বললাম, ঠিক আছে কি করতে হবে বলো?
জেরিন বললো, চলো তোমাকে এই বাড়ীটা ঘুরে দেখাই।
আমি বললাম, আগে আমি তোমার ভাই আকবরকে দেখতে চাই।
জেরিন আমাকে নিয়ে পাশের যে অংশের বাড়ী সেটাতে নিয়ে গেলো।
জেরিন বললো, এটা রশিদ চাচার বাড়ী।
এখানেই আকবর থাকে। আমাদেরকে রশিদ চাচা উনার রুমে নিয়ে গেলেন।
একটা বড় খাট সেই খাটে আমার বয়সের একটি ছেলে শুয়ে আছে তার দৃষ্টি একদিক। আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। জেরিন রশিদ চাচাকে জিজ্ঞেস করলো, মাসে মাসে ডাক্তার ঠিকমতো আসে কিনা। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আমি দেখলাম ওখানে আরো কয়েকটা এমন বাড়ী।
আমি বললাম এইগুলি কার বাড়ী?
জেরিন বললো, এইগুলি জমিদার আমলে দাস দাসিদের বাসা ছিলো। এখানে সব ওদের বংশধররা থাকতো এখন আর জমিদারি নেই তাই ওরা এদিক ওদিক চলে গেছে।
আমি বললাম, দাস দাসির বংশধর মানে?
জেরিন বললো, জমিদারদের কিছু নিয়ম নিতী ছিলো, এই বাড়ীর বউরা যখন বিয়ে হয়ে আসতো তখন তারা বাপের বাড়ী থেকে দাসি নিয়ে আসতো। সেই ভাবেই আমার দাদীজান উনার বিয়ের সময় ময়ূরি নামে কম বয়সি এক দাসি নিয়ে আসে। এরপর আমাদের বড়বাবা এইখানের এক দাসের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। এভাবেই সময় সময়ে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। এখানে কিছু কিন্তু আছে!!!
। অনেক সময় অনেক দাসি বাড়ির জমিদারদের লালসার শিকার হতো তারাও জমিদারের সন্তান কিন্তু পরিচয় থাকতো না। এই যে রশিদ চাচাকে দেখলে উনি কিন্তু এই জমিদার বংশের লালসার শিকার।
আমার তখন খেয়াল হলো আকবর আর রশিদ চাচার চেহারায় অনেক মিল!!
আমি মনে মনে ভাবলাম, হায়রে দুনিয়া!!
নিষিদ্ধ পল্লী আর জমিদার বাড়ীর মাঝে কি তফাৎ? জমিদারদের এইসব থাকে গোপন আর নিষিদ্ধ পল্লীতে হয় খুল্লাম খুলিয়াম!!
আমি জানতে চাইলাম, রশিদ চাচার বউ বাচ্চা নাই?
জেরিন বললো, না উনি বিয়ে করেন নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
জেরিন… সে অনেক কাহিনী, আমাদের এক ফুফুর সাথে উনার প্রেম ছিলো গভীর প্রেম। আমার দাদাজান তা জানতে পারে এবং আমার ফুফু গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যান। দাসির ছেলের সাথে জমিদারের মেয়ের বিয়ে কিছুতেই না। অথচ দেখো এই ছেলে কিন্তু এই বংশের, কিন্তু গোপন। হায়রে বংশের ধারা নিয়মনীতি !
বিকেলবেলা আমি আবার বললাম, জেরিন আমি কিন্তু আমার প্রমাণ এখনো পাইনি।
জবাবে জেরিন বললো,চলো আমরা চা খাই। রাতে ফয়সাল আসবে ডিনার করে তোমাকে তোমার রুমে নিয়ে যাবো সেখানেই সব পাবে। আমি ভাবলাম, ও কেনো বারবার আমাকে ঘুরাচ্ছে?
রাতে আমরা একসাথে খেলাম। জেরিন আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলো রুমটা সুন্দর আধুনিক ধাঁচে সাজানো। জেরিন বললো, আমাদের আব্বাজী এই রুমটা তোমার জন্য সাজিয়ে রেখেছিলেন।আমি একটা সোফায় বসলাম এবং খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম আমার প্রমাণের জন্য।
এবার জেরিন একটু দূরে একটা সিন্ধুক খুললো সেখান থেকে একটা লাল রঙের কারুকাজ করা বাক্স বের করে আনলো। আমার বুকের ভিতর ধকধক করতে থাকলো! কারণ এই বাক্সটা আমার কেমন জানি পরিচিত মনে হইতে লাগলো আমি কোথায় জানি দেখছি…..!!!
জেরিন বাক্সটা খুললো, ভিতর থেকে একটা কাগজে মোড়ানো একটি দলিল ও সেটা আমার হাতে দিয়ে বললো, আমাদের আব্বাজী এই বাড়ী তোমার নামে হেবা করে গেছেন। উনি বোধহয় ভাবছেন এতে উনার পাপমোচন হবে আর এই বংশের শাপমোচন হবে।
আর এই যে গহনার বাক্স এটা তোমার মায়ের গহনার বাক্স আর কিছু কাপড়, এইগুলি উনার।
জেরিন এবার একটা ছবির ফ্রেম বের করলো আর আমাকে বললো, এই ছবিটা তোমার মা আর বাবার। ছবিটা দেখে আমার মাকে অল্প অল্প মনে পড়লো কিন্তু বাবা বলে যাকে দেখলাম তিনি জেরিনের আব্বাজী খান ইমরান আলী!! আমি নির্বাক!
আমি কাঁদবো না কি করবো বুঝতেই পারছিনা। আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। জেরিন বুঝতে পেরে আমাকে বললো, তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে এখনো আরো কঠিন জিনিষ তোমার সামনে। এটা বলে ও আমার হাতে একটা চিঠির খাম দিয়ে বললো, এই সেই চিঠি যা আব্বাজী তার মৃত্যুর আগে আমাকে লিখে গিয়েছিলো। তুমি কি পড়তে পারো? আমি মাথা নেড়ে হ্যা জবাব দিলাম।
জেরিন বললো, তাহলে তুমি দরজা বন্ধ করে এটা মন দিয়ে পড়ো। এখানেই তোমার জন্মের ইতিহাস আর এই বংশের অভিশপ্ত কাহিনী। যা উনি অপকটে স্বীকার করে উনি উনার পাপের বোঝা কিছুটা কমিয়ে গেছেন হয়তো বা।পাপের বোঝা কমানো কি নিজের ইচ্ছায় হয়? পাপ বাপকেও ছেড়েনা।
মনকে শক্ত করে মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ো রেশমি। এই বলে, জেরিন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।…..
চলবে……..
…………..
………..
চরিত্রহীন মেয়ে
ক্যাটাগরি—সামাজিক
#গল্প #নিষিদ্ধ_পল্লী….তৃতীয় পর্ব
জেরিন আমার হাতে চিঠিটা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বাহিরে প্রকৃতির আলো নিভে গেছে, ঘরে মানুষের জ্বালানো আলো জ্বলছে। বিধাতা আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা তার ইচ্ছা!
আমি দরজা বন্ধ করে ভালো ভাবে বসলাম, নিজের মনকে শক্ত করে চিঠিটা খুললাম। সুন্দর ঝকঝকে লিখা চিঠি…! আমার বুকের ভিতর এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে। জেরিন আমার সেই শক্তি! এখন আমি রেশমি ! আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম…..!
মা জেরিন,,
এই চিঠি যখন তুমি পড়িবে তখন আমি না ফেরার দেশে ।আমার পরকাল কি আমি জানিনা মা।
আমি বড় গুণাহগার। শুনিয়াছি সন্তান তাহার বাবা মায়ের গুণাহর জন্য মাপ চাইলে সাদাকা করিলে আল্লাহ মাফ করিয়া দেন। তোমরা আমাকে মাফ করিয়া দিও। বাকি আল্লাহর বিচারে থাকিবে।
এই চিঠির কাহিনীর সময়কাল দেশ ভাগের আগে হইতে আজ পর্যন্ত।
মানুষের শিখার শেষ নাই। আমার জীবনের শেষ প্রান্তে আসিয়া তোমার নিকট যাহা শিখিয়াছি। তাহা যদি আমাকে ছোটকাল হইতে কেহ শিখাইতো তবে এই বংশ এই ভাবে শেষ হইতো না।
আসলে শিক্ষা আর পরিবেশ এই দুই মানুষকে মানুষও বানায় আবার অমানুষও। বংশ রক্ত শুধু নাম মাত্র। এসব মানুষের বানানো।
সব মানুষের রক্তের রঙ লাল।
পাপ করা যা না পাপ, তাহার চাইতে বড় পাপ হইলো অনুতপ্ত না হওয়া। বিধাতা নিজেই বলেন, পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়।
এইসব এই বয়সে আসিয়া তোমার ও ফয়সালের কাছে থাকিয়াই আমি ইহা অনুধাবন করিলাম।
তুমি ঠিক তোমার মায়ের মতো হইয়াছো।
বুদ্ধিমতী, দুরদৃষ্টিসর্ম্পনা, সৎ এবং মায়াবতী।
আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় যাহা বুঝি তাহা হইলো এই গুণগুলি যাহার ভিতর আছে সে দুনিয়া এবং আখেরাতে দুই জায়গাতেই ভালো থাকে।
তোমার এই গুণের কারণেই তুমি ফয়সালের মতো এমন একজন স্বামী পাইয়াছো। আমার এখন মনে হয় পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তানের তফাৎ কেনো আমরা এতো করিয়াছিলাম। শুধু তিনটা কন্যা নিয়াইতো আমরা ভালো থাকিতে পারিতাম।
কত মানুষইতো সন্তানের পিতামাতা হইতে পারেনা।
যাইহোক যাহা হইবার তাহা তো হইয়াই গিয়াছে।
আজ তোমাকে আমি একটি বড় দায়িত্ব অর্পণ করিবো, তাহা হইলো একজনকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাহাকে এই লালবাক্স খানি এবং এই বাড়ির দলিলখানা ফেরত দিবে এবং নিজের বোন বলিয়া মানিয়া লইবে। ইহাতে আমার পাপমোচন হইবে কিনা জানিনা তবে বংশের শাপমোচন হইলেও হইতে পারে!
পাপপুণ্যের বিচার তো বিধাতার হাতে!
আমি জানি তুমি তাহা পারিবে। কিন্তু তোমার অসুস্থতা হয়তো তোমার অনুকূলে থাকিবে না। এই ব্যাপারে ফয়সালের সাহায্য তুমি পাইবে।
কাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিবে তাহা জানিতে হইলে তোমার কাছে আমার নিজের এবং আমাদের বংশের পাপের কথা স্বীকার করিতে হইবে। মনে করো ইহাই আমার অনুতাপ। তুমি শক্তমনের মেয়ে তুমি পারিবে।
শুনিয়াছি সৎ কর্মে মানুষের পাপমোচন হয়, যদি স্রষ্টা চান। আমি আমার কাজ করিয়া গেলাম বাকি উপরওয়ালা জানেন।
আমার পূর্ববর্তী বংশধর দাদা খান আকবর আলী, দেশ বিভাগের পর মুর্শিদাবাদ হইতে তাহাদের জমিদারি বিক্রি করিয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর অঞ্চলে জমিদারি কিনিয়া লন। আমার আব্বাজানেরা ছিলেন চার ভাই ।
আমার আব্বাজান মানে তোমার দাদাজান একসময় কুমিল্লা অঞ্চলের এই জায়গায় জমিদারি কিনিয়া এইখানে চলিয়া আসেন। তখন এইসব ছিলো হিন্দু জমিদারি তাহারা চলিয়া যায় হিন্দুস্থান।
জমিদারদের পারিবারিক নিয়ম নিতী যাহা ছিলো তাহা হইলো তাহারা উচ্চ বংশের মেয়েদের বিবাহ করিয়া আনিতো। এবং স্ত্রী হইলো বংশধর পয়দা করিবে আর জমিদারের ভিতর বাড়ী সামলাইবে। ইহাতেই তাহারা অভ্যস্ত ছিলো।
জমিদার সাহেবদের বিনোদনের তাহারা কোনো অংশেই ছিলো না। জমিদার সাহেবদের বিনোদন ছিলো, বাঈজী,পরনারী, মুজরা, মদ আর জুয়া। এইসবের জন্য বাড়ীতেই থাকিতো নাচঘর, আমোদখানা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতে বাড়ীর মহিলাদের কোনো ভূমিকা ছিলোনা।
তবে আমার এখন মনে হয় গভির রাতে বাঈজীদের ঘুঙুরের শব্দ জমিদার গিন্নীদের বুকের ভিতর শেলের মতো বিঁধিত।
জমিদারগন প্রজাদের নিকট হইতে অন্যায়ভাবে খাজনা আদায় করিয়া সেইসব টাকা দিয়া নিজেদের মৌজমাস্তি করিবার আরেক প্রয়াস ছিলো বজরা। প্রায় সময়ই তাহারা বিভিন্ন নদীতে বজরা লইয়া যাইতো সেইখানে নানান দেশ হইতে নামকরা সব বাঈজীরা আসিতো।
আমি ছোটকাল হইতেই দেখিয়াছি আমার আব্বাজানের এইসব খারাপ কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন।
আমার ভিতরে এই নেশা হওয়া কোনো ব্যাপার নয়।
আমার দাদাজান বংশ বৃদ্ধির জন্য চার পাঁচ বিবাহ করেন। আজ সেইসব বংশধর কে কোথায় আছে তা ভালো ভাবে জানিওনা। এদের অনেকেই শুনিয়াছি খুব কষ্টের জীবন ভোগ করিতেছে। কেহ কেহ ভিক্ষাবৃত্তি করিতেছে! এখন বুঝিতেছি ইহা অন্যায়।
হায়রে উচ্চবংশ….!!!
আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স উনিশ কি বিশ বছর। তোমার মায়ের বয়স ছিলো তেরো বছর। তোমার মা নিজেও জমিদার বংশের মেয়ে। তাহার বাবা মানে আমার শ্বশুর ছিলেন অন্যরকম তিনি নামাজ কালাম দান খয়রাত খুব করিতেন।
যাইহোক দাসীপ্রথা বলিয়া যে প্রথা তাহা হইলো জমিদার বাড়ীর মেয়েরা বিবাহের সময় একজন করিয়া দাসী লইয়া আসে। সেই দাসী এইখানেই থাকিয়া যায় তাহাকে এইখানে বিবাহ দেওয়া হয়। ধিরে এইখানে তাদে বংশধর হয়।
তোমার মা কমলা নামে একজন দাসী আনে। সে দেখিতে এতো সুন্দরি ছিলো একেবারে কমলার কোয়ার মতো।
আমার আব্বাজানের নজড়ে সে পড়িয়া যায়। মানে তোমার দাদাজান।
একদিন সে তোমার দাদাজানের লালসার শিকার হয়। কমলা গর্ভবতী হইলে তাহাকে এই বাড়ির কুঠুরি ঘরে রাখা হয় এরপর তাহার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আর কমলার মৃত্যু হয়।
সেই সন্তানই তোমার রশিদ চাচা। যাকে দাসের পরিচয়ে আজীবন থাকিতে হইলো।
অভিশাপ সব অভিশাপ। হায়রে বংশ…!
তোমার মায়ের অতি বুদ্ধিগুণ থাকায় অল্প বয়সেই সবার মন জয় করিয়া লইলো। আমিও তাহার প্রতি খুব আকৃষ্ট হইলাম। তোমার দাদাজান ছাড়া বাকি সবাই তাহার কথা মানিতো।
আমাদের প্রথম সন্তান হয় কন্যা। এতে তোমার দাদাজান খুব অসন্তুষ্ট হয়। আমি তাহার এই ঘরের একমাত্র ছেলে সন্তান। আর আমার একবোন।
বংশের বাতি কে দিবে? আবার সন্তান হইলো তাহাও কন্যা। এবার তোমার দাদাজান আমাকে আবার বিবাহ করিতে চাপ দেয়। আমি রাজী হই না। আমাদের আবার সন্তান হয় কন্যা, যে হইলা তুমি। এবার তোমার মা তোমাকে লইয়া তাহার বাবার বাড়ীতে চলিয়া যায়। এই ভয়ে যে, তোমার দাদাজান তোমাকে যদি কোনো দাসীর ঘরে দিয়া দেয়…!!!
আমি তোমার মাকে খুব ভালোবাসিতাম। আমি মনের দুঃক্ষে গৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই। আমাদের উত্তর অঞ্চলের জমিদার বাড়ীতে।
সেইখানে আমার বেপয়ারা জীবন যাপন শুরু করি। একবার পদ্মায় বজরা লইয়া যাই সেইখানে মুর্শিদাবাদ হইতে এক নামকরা অপরূপ সুন্দরি বাঈজী আনা হয় তাহার নাম নূরজাহান। তাহাকে আমি নূর বলিয়া ডাকিতাম।
সেই বজরায় আমরা বেশ কিছুদিন থাকি। তখন আমার গুটি বসন্ত রোগ হয়। ওই রোগ ছিলো খুব ছোঁয়াচে এবং ওই রোগ হইলে মানুষ সহজে বাঁচিতো না। সবাই ভয়ে বজরা হইতে চলিয়া যায় শুধু সেই নূরজাহান বাঈজী আমাকে নিয়া থাকিয়া গেলো আমার সেবা করিয়া আমাকে ভালো করিয়া তুলিলো। সবই বিধাতার ইচ্ছা।
মানুষ তাহার দুর্বল সময় মানুষ চিনে। আমি বুঝিলাম সে খুব ভালো মেয়ে। আমি তাহার প্রেমে পড়িয়া গেলাম। খাঁটি প্রেম মানুষকে মানুষের রূপ দেখায়!
আমি নূরের মধ্যে একজন ভালো নারীর রূপ দেখি।
এদিকে তোমার মায়ের জন্য আমার মন কেমন করিতো। কিন্তু তোমার দাদাজানের কারণে ঘরে ফিরতে মন চাইতো না। আমি নূরকে বিবাহ করি এবং তাহাকে সব খুলিয়া বলি। নূর আমাকে বললো, আপনি বাড়ী যান আর আপনার স্ত্রীকে ফিরাইয়া নিয়া আসুন। এইটা অন্যায়! শুধু কন্যা সন্তান হওয়ার জন্য উনার এই শাস্তি হইতে পারে না।
সে আপনার স্ত্রী তার উপর আপনার অধিকারআছে
আমি নূরের কথায় বাড়ী যাইয়া তোমার মাকে ফিরাইয়া নিয়া আসি।
এবং তোমার মাকে নূরের কথা বলি, সে বললো, আপনি উনাকে এই বাড়ীতে নিয়া আসেন, আমরা দুইবোনের মতো থাকিবো। এই বংশে পুত্র সন্তান দরকার, আল্লাহ চাইলে নূরের ঘরে পুত্র সন্তান হইতেও পারে। একজন নারী একজন পুরুষকে যেমন নেক মানুষ বানাইতে পারে তেমনি পারে পাপের রাজ্যে নিতে। একজন পুরুষের বেলায়ও তাই হয়!
ইহা গুণিজনেরা বলিয়া গেছেন। তোমার দুই মা ছিলো প্রথম দলের নারী।
আমি নূরকে নিয়া আসিলাম। তোমার দাদাজান পুত্র সন্তানের আশায় নূরকে দেখিয়া খুশি হইলো।
কিন্তু যখন জানিলো সে একজন বাঈজী তখনি ঘটিলো বিপদ তিনি কিছুতেই তাহাকে মানিয়া লইবেন না। শেষে আমি যখন আবার গৃহত্যাগের হুমকি দিলাম তখন উনি এক শর্তে রাজী হইলেন,নূরের যদি পুত্র সন্তান হয় তবে সে এইখানে থাকিবে। তোমার মা তার বুদ্ধিমত্তা আর মায়া দিয়া নূরকে আপন করিয়া নিয়া ভালো ভাবেই থাকিতে লাগিলো।
কিছুদিন পর দুইজনই গর্ভবতী হইলো। তোমার মা তাহার কন্যা সন্তান হইবে ভাবিয়া ভয়ে তাহার বাবার বাড়ী চলিয়া গেলো।
মানুষ ভাবে এক আর বিধাতা করেন আরেক। ভাগ্যে যার যা নির্ধারণ করা তাই হয়। ইহাই প্রকৃতির নিয়ম!
প্রথম নূরের সন্তান হয় সেইটা কন্যা সন্তান, কিন্তু তাহাকে দেখিয়া আমি এতো খুশি হই ঠিক যেনো পরী। একদম রেশমের মতো নরম তাই ওর নাম আমি রাখি রেশমি…!!!
দশদিন বাদে তোমার নানার বাড়ী হইতে খবর আসে তোমার মা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়াছে।
জমিদার বংশের প্রথম বংশধর। তোমার দাদা নিজে যাইয়া তাহার নাতিকে নিয়া আসে। তাহার নাম তোমার বড়দাদার নামে রাখা হয় খান আকবর আলী
যে পাঁচ বছর হইতে এই নির্মম জীবনভোগ করিতছে।
হায়রে পুত্রদ্বারা বংশের এই নির্মম পরিহাস!
তাহার নামকরণ অনুষ্ঠানে সাতদিন সাতরাত জমিদার বাড়ীতে প্রজারাদের মহাভোজ খাওয়ানো হয়। রেশমি আর খান আকবর আলী ছিলো দশদিনের ছোট বড়। কন্যা সন্তানদের নামের বেলায় তাহা হয় নাই।
এইদিকে নূর তাহার কন্যাকে নিয়া এই বাড়ী ত্যাগ করার উদ্যোগ নেয় কিন্তু তোমার মা জোর করিয়া তাহাকে রাখে। তোমার দাদাজান তাহাকে এক শর্তে রাখে সে উপরতলায় না, নিচে ওই কুঠুরি ঘরে তাহার কন্যা সন্তান নিয়া থাকিবে। নূর নিরবে সব মানিয়া লইলো। সে হয়তো আশা করিয়াছিলো, আমি ধিরে ধিরে সব ঠিক করিয়া ফেলিবো। সে আশায় আশায় দিন কাটাইলো।
তাহার সঙ্গ না পাইয়া আমি বুঝতে পারিলাম
ভালোবাসার মূল্যায়নে সে ছিলো আমার মোহ।
হৃদয়ের গভিরে ভালোবাসা ভুলিয়া যাওয়া কঠিন কিন্তু মোহের ভালোবাসা সহজেই মানুষ ভুলিয়া যায়। আমার বেলায় নূরের ব্যাপারে তাই হইলো।
প্রায় ছয়মাস পার হইলো আমার মন নূরের উপর থাকিয়া উঠিয়া যাইতে লাগিলো।
একদিন আমাকে নিয়া, তোমার দাদাজান নূরের ঘরে রাতের বেলা যায়, এবং তাহাকে বলে, তোমাকে কিছু সম্পত্তি লিখিয়া দিয়াছি এবং এই তার দলিল তুমি ইহা লইয়া আর তোমার কন্যা সন্তান লইয়া এই বাড়ী হইতে চলিয়া যাও। নূরের যে এতো সাহস তাহা আমার জানা ছিলোনা।
নূর দলিল খানি তোমার দাদাজানের মুখের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিলো, যে বাড়ীতে আমার কন্যার দাম নাই সেই বাড়ীর কিছুই আমি নিবোনা।
বংশ শুধু কি ছেলে দিয়া ? আমি অভিশাপ দিচ্ছি… এই বংশে একদিন এই কন্যা দিয়াই বংশের খোঁজ হইবে। এই বলিয়া সে তার এই লাল বাক্সখানি আর রেশমিকে নিয়া বাহির হইয়া গেলো। তখন রেশমির বয়স ছয় মাস। সে শুধু যাইবার সময় এমন ভাবে আমার দিক তাকাইলো, আমি সামনে থাকিয়া কেনো কিছু করিলাম না। এইটা তো আমারি সন্তান..!! ইহা আমি অনেক বড় অন্যায় করিয়াছিলাম।
তুমি হয়তো জানিতে চাইবা আমি কি করিয়া এই লাল বাক্স আর রেশমির মার গহনা পাইলাম?
তবে শোন, আজ হইতে প্রায় বারো বছর আগে রহিমা নামে এক মহিলা আসে, সে আসিয়া বলে নূর আর এই দুনিয়াতে নাই।
সে এই বাক্সখানি আর নূরের একটি চিঠি আমাকে দেয় তাতে রেশমির দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা ছিলো।
রহিমা রেশমিকে লইয়া এইখনে আসার জন্য ট্রেনে উঠে। অনেক রাত সে ঘুমাইয়া যায় এবং ঘুম থাকিয়া উঠিয়া দেখে রেশমি নাই। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করিয়া তাহাকে পায় নাই। অবশেষ সে এইগুলি নিয়া আমার নিকট আসে।
জেরিন তুমি হয়তো ভাবিবে, আমি কেনো রেশমির খোজ করি নাই?
ওই যে বংশের অংহকার,মর্যাদা সমাজের দুর্নাম এসবের জন্য।
যখন বুঝিলাম ভুল করিয়াছি তখন সব শেষ সময় শেষ।
রেশমির দায়িত্ব তোমাকেই দিলাম। বিধাতা যদি চায় তবে ওর পাওনা ওকে দিলে হয়তো এই পরিবারের পাপমোচন আর শাপমোচন হইতেও পারে।
ইতি
তোমাদের গুনাহগার আব্বাজী
৬/১১/১৯৮০
আমি চিঠিটা পইড়া থম মাইরা বসে থাকলাম। লালবাক্সটা আবার খুললাম, মা বাবার ছবিটা বাহির করতে গিয়া দেখি আমার দশ বছর বয়সের একটা ছবি।
হয়তো মা দিছিলো খান ইমরান আলী যাতে চিনে!! যাক মরার আগে জমিদার সাহেব তার একমাত্র বাইচা থাকা বংশধর দেইখা গেছে….
আমার মায়ের ছবিটা ভালো কইরা দেখালাম। আহারে আমার দুখিনী মা..!! আমার ধিরে ধিরে সবকিছু মনে হইতে লাগলো……….
চলবে
………….
……………
চরিত্রহীন মেয়ে
ক্যাটাগরি……সামাজিক
#গল্প_নিষিদ্ধ_পল্লী…. শেষ পর্ব
চিঠিটা পড়ার পর জেরিনের আব্বাজীকে আমি আমার বাবা মেনে নিতে পারতেছিনা। তবে আমার জন্মদাতার পরিচয় জেনে আমি যেমন কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি ঠিক তেমনি মনটা খারাপ লাগছে নিষিদ্ধ পল্লীর জন্মের পরিচয় বিহীন বাচ্চাগুলার কথা মনে করে। আমি নূরজাহান বাঈজীর মেয়ে এই পরিচয় নিয়েই আমি আমার বাকি জীবনের সফর করে যাবো। আমার মায়ের খাঁটি ভালোবাসাকে জমিদার খান ইমরান আলী অপমান করেছে। এটার প্রতিশোধ আমার নেয়া উচিত। শুধু জেরিনের উদারতা আর মমতা আমার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার একটু একটু মনে হইতে লাগলো, মা আমারে রাতে ভাত মাইখা খাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইতো। তারপর কই যানি চইলা যাইতো। রাইতে রহিমা খালা পাশে শুইয়া থাকতো। মা আমারে ভালো স্কুলে ভর্তি করছিলো। এরপর মায়ের কি জানি অসুখ হইলো, তখন আর রাইতে বাহিরে
যাইতো না। আমরা তখন খুব কষ্ট কইরা চলতাম। রহিমা খালা মারে কইতো, এতো গহনা দিয়া কি করবা?এইগুলি বিক্রি কইরা তোমার চিকিৎসা করো।
মা কইতো, না এইগুলি আমার রেশমির কাজে লাগবো। আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো।
কয়দিন পর রহিমা খালা আমারে বলে, চলো তোমারে তোমার বাবার কাছে দিয়া আসি। আমারে নিয়া রাতে ট্রেনে উঠলো।
একটু পরে উনি ঘুমাইয়া পড়লো। আমি বইসা বইসা গল্পের বই পড়তাছি এর মাঝে এক লোক আমার কাছে আইসা কয়, বাবু কি পড়ো? এরপর আমি ঘুম।
উইঠা দেখি এক মহিলার কোলে, আর ওই লোক কয়, খালা একদম খাঁট জিনিষ, নুরজাহান বাঈ এর মেয়ে। ওই মহিলা ওই লোকেরে অনেক টাকা দিলো।
এর পর আমি ওইখানে লাইলি নামে অনেক নামকরা বাঈজী হইলাম।
ঢাকা থাইকাও লোক আসতো ওই উওর অঞ্চলে। একদিন এক লোক বলে, এইসব আর এখন চলেনা। সিনেমায় বেশি টাকা তোমারে সিনেমার নায়িকা বানামু। আমি তার সাথে চইলা আসি। কতদিন ঘুরলাম এফ,ডি,সি তে এক্সট্রার কাজ করতে হইলো। নায়িকা তো হইলামি না শুধু শুধু নিজের শরীরটারে আরো কলঙ্কীত করলাম। এরপর আইজ এই আখড়া তো কাইল ওই আখড়া আইজ নাম বিউটি কাইল শেফালী। হায়রে জীবন..!!!
ভাগ্য মানুষরে তাড়ায়ে নিয়া বেড়ায়। কারো হয় রাজ কপাল কারো হয় বদ কপাল।
জেরিন আর আমি একি জমিদারের মেয়ে ভাগ্য দোষে সে কই আর আমি কই? জেরিনরে হিংসা হইতাছে ওর মতো তো আমিও হইতে পারতাম! ফয়সাল তো আমার স্বামী হইতে পারতো।
জেরিন কইছিলো, আমি এইসব জানার পর আমার মোধ্যে লোভ, হিংসা, কতকিছু হইতে পারে তাইলে কি আমার লোভ ইংসা এইসব আসতেছে মনে?
আমি চাইলে এই বাড়ীর মালকিন হইয়া। কতকিছু করতে পারি। জেরিন তো মইরাই যাইবো…!!
হঠাৎ জমিদার বাড়ীর ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বাজতে লাগলো। আমি হুশে আসলাম। আমি নূরজাহান বাঈজীর মেয়ে।
বসে থাইকাই একটু ঘুমায় গেলাম।
ভোর চারটার ঘন্টা বাজতেছে। আমি জানালার কাছে গেলাম। রাতে বৃষ্টি হইছে।
ওইতো রশিদ চাচা জমিদার বাড়ির লণ্ঠনগুলি নিবাইতেছে।
এই বংশেরবাতি… মনে মনে হাসলাম, উনারেই জমিদার সাহেব সব দিয়া যাইতো তাইলেই বংশের পাপ কাটতো!!
গতকাল জেরিন আমারে পুরাটা বাড়ী দেখাইছে, তখন আমার মায়ের কুঠুরি ঘরটা দেখছিলাম, যেখানে আমারে নিয়া মা ছয়মাস ছিলো.. এই জমিদার বাড়ীর কোনো এক জায়গায় আমার নাড়ী পোঁতা আছে।
আমি দরজা খুইলা বাহিরে আসলাম, সিঁড়ীঘর দিয়া নাইমা সেই কুঠুরি ঘরের দিকে যাচ্ছি, আশ্চর্য ওই ঘর থেকে কোরআন শরিফ পড়ার আওয়াজ খুব মিষ্টি মেয়ের কন্ঠে… কে? আমি ভিতরে ঢুকে দেখি জেরিন। আমি ওর পাশে বসে থাকলাম। ও আমার মায়ের বিছানায় বসে কোরআন পড়ছে। ওর পড়া শেষ করে আমার দিক তাকিয়ে বুঝলো আমি সারারাত ঘুমাইনি এবং কাঁনছি।
জেরিন আমাকে জড়ায়ে ধরে রাখলো আমার সব রাগ হিংসা এক মুহুর্তে পানি হয়ে গেল।
জেরিন কাদঁতেছে আর বলতেছে, রেশমি প্লিজ তুমি এই বংশকে বাঁচাও। আমি মরে গেলে এই বংশ শেষ আকবর তো বেঁচে থেকে মৃত।
খান ইমরান আলীর চিঠিতে লেখা আমার মায়ের অভিশাপের কথা মনে হইল…মানুষের মনের গভির কষ্ট এইভাবেই বুমেরাং এর মতো ঘুরে আসে
আজকে সেই নূরজাহান বাঈজীর মেয়ে দিয়াই জমিদার বংশের বংশ রক্ষার আকুতি। অহংকারের পতন এভাবেই হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
আমি রাগে বললাম, কেন রশিদ চাচা? আরো কত দাসী বান্দীর সন্তান আছে তাদের দেখো। আমি নুরজাহান বাঈজীর মেয়ে আমি আর কেও না।
হঠাৎ দেখলাম জেরিন কেমন খিঁচতে লাগলো এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলো আমি কি করমু?
এক দৌড়ে উপরে যাইয়া ফয়সাল সাহেবরে গায়ে ধাক্কা দিয়া ডাকতে লাগলাম, জেরিন অজ্ঞান হয়ে গেছে। উনি ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বের করে দৌড়াইয়া নিচে গেলো ওইটা জেরিনরে দিলো আর আমারে বললো, এক্ষন গাড়ীতে উঠেন ঢাকায় যাবো। উনি জেরিনরে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ী ছুটে চললো ঢাকার পথে.. আমি কি করবো?
রাস্তায় জেরিনের জ্ঞান ফিরে এলো ও আমার হাত চেপে ধরে আছে অসহায় ভাবে তাকায়ে আছে।
আমরা বাসায় চলে আসলাম। ফয়সাল আইসাই ডাক্তার কল করলো। ডাক্তার বললো, সেইরম কিছুনা উনি খুব চিন্তা করছে। উনার সাথে সব সময় কেও না কেও থাকবেন। যে কদিন আছে হাসিখুশি ভাবেই রাখবেন।
আমি আমার রুমে চইলা আসলাম, জেরিন বলছিলো চিঠি পড়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে।
আমি কি করমু? একদিকে আমার মায়ের অপমান আরেকদিক জেরিনের জন্য মায়া। একটা অসুস্থ মানুষকে রাইখা এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হবেনা।
এরপর থাইকা আমি ওদের সাথে খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকলাম।
ওদের ম্যারেজ ডে ছিলো গত সপ্তাহে জেরিনের শরীর খারাপ থাকায় কিছু করা হয় নাই।
শুনতেছি ওরা মালএশিয়া যাইবো সেইখানে ওদের নিজেদের বাসা আছে। জেরিন আমারে ছাড়া কিছুতেই যাইবো না। গেলাম ওদের সাথে। আমরা সাতদিন ছিলাম এই সাতদিনে ওদের সাথে আমার সাতজনমের মায়ার সর্ম্পক হইলো।
ধিরে ধিরে জেরিন আমারে তার মতো করে সব শিখাইতে আরাম্ভ করলো। বাসায় মাষ্টার রাইখা আমারে পড়া শিখাইলো। আমার কথা আমার চালচলন সব জেরিনের মতো হতে থাকলো। আমি এখন ওদের সাথে বিভিন্ন পার্টিতে যাই। জেরিন আমারে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার ছোট বোন।
সময় কারো জন্য থেমে থাকেনা।
আমি এখন জানি ফয়সাল কি কি ভালবাসে।
ওর শখ মজার মজার খাবার আর দাবা খেলা। যখন জেরিনের শরীর বেশী খারাপ লাগে তখন আমি ফয়সালের পছন্দের রান্না রান্ধি, জেরিন আমাকে সব শিখাইছে। সকালে নাস্তায় উনার অরেঞ্জ জুস বানাই। জেরিন ওইটা কাওকে বানাতে দিতো না শুধু আমাকে দিতো।
আমরা ওর সামনে বসে খেলি জেরিন শুয়ে শুয়ে বলে, রেশমি ফয়সাল কিন্তু অনেক কাইন্ঠা।
আমি হাসি। জেরিন ঠিক ওরমতো করে আমাকে সাজিয়ে দেয়। আমি এখন সব বুঝি।
কিন্তু ওর খুশির জন্য কিছু বলিনা।
ও যে কদিন আছে আমিও সেইকদিন থাকবো এটা ওকে বলিনা।
জেরিন বসে বসে ওদের বিয়ের ছবি দেখছে। আর ওর চোখে পানি। সেই ফয়সাল যাকে ও ছোট থেকে ভালোবাসতো। ওর খালাতো ভাই। নানার বাড়ীতে একসাতে কত স্মৃতি ওদের। তাকে ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে সে কখনো ভাবেনি। ওর জীবন এভাবে শেষ হতে দিবোনা আমি। আজই ওকে আমি বলবো, আমার মনের ইচ্ছা।
রাতে খাবার পর ফয়সাল বারান্দায় বসে এককাপ কফি খায়.. জেরিন কফিটা ওর
হাতে দিয়ে ওর পিঠে হাত রাখে, ফয়সাল হাত টেনে ওকে কাছে বসায়। জেরিন আদুরে গলায় বলে, তুমি আমাকে কতদিন আদর করো না। আজকে আমাকে আদর করো। ফয়সাল হাসে।
কি পাগল বউ আমার..! কি বলবে বলো,
জেরিন বললো, জান তোমার কাছে একটা অনুরোধ আমার শুনবে তো?
..তোমার কোনো কথা বা অনুরোধ আমি কখনো ফেলেছি? বলো।
জেরিন বল্লো, আগে আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দাও।
… কিযে করো তুমি জেরিন আচ্ছা দিলাম।
জেরিন… দেখো আমি রেশমিকে ঠিক আমার মতো করে গড়ে তুলেছি আর আমি জানি তুমি জাত বংশ এগুলি মানোনা একজন মানুষ এটাই তার বড় পরিচয়। তাই এইদিক থেকে রেশমিকে নিয়ে সমস্যা নেই। আর ও এই জমিদার বংশেরি মেয়ে। আমার মনের ইচ্ছা, আমি চলে যাবার পর তুমি রেশমিকে বিয়ে করবে।
ফয়সাল বল্লো, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তোমার জায়গায় আমি কাওকেই বসাতে পারবো না। আর যদি এসব বলো আমি বাসায় থাকবো না।
জেরিন কান্না শুরু করলো, আর ও বেশি কান্না করলেই শরীর খারাপ হয়।
ফয়সাল বল্লো, আচ্ছা যখনেরটা তখন দেখা যাবে।
জেরিন ফোঁফাতে ফোঁফাতে বল্লো, তুমি কিন্তু আমার মাথায় হাত দিয়েছো।
ফয়সাল চুপ করে থাকলো। রাতে জেরিনের সাথে কোনো কথাই বললো না
ব্রেকফাস্ট টেবিলে জেরিনের বানানো জুস খেলোনা। তাড়াতাড়ি অফিস চলে গেলো। জেরিন জানে এই ব্যবহার করে ফয়সাল থাকতে পারবে না। ঠিকই অফিস থেকে আবার বাসায় আসবে তাকে আদর করবে….!!
আজ জেরিন একাই বাহিরে গেছে। খুব বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে।
আমার খুব টেনশন হচ্ছে ও কোথায় গেলো।
আমি ফয়সালের কাপড় গুছাচ্ছি হঠাৎ ফয়সাল অফিস থেকে বাসায় আসে ও জানেনা জেরিন বাসায় নেই।
আমি পিছন হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাজ করে রাখছি।
ফয়সাল আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলছে, শরীর কেমন লাগছে ?সকালের জন্য সরি জান। ঔষধ খেয়েছো?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে আমার চুলে ঘাড়ে আদর করতে লাগলো। আমি এখন কি করবো!?
আমি ওকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ফয়সাল আমাকে দেখে এতো লজ্জা পেলো যে সে প্রায় দুদিন আমার সামনে আসেনি। অজানা ভালোবাসার আগুন তাকে যেমন দিয়েছে লজ্জা আমাকে দিয়েছে উষ্ণ পরশ। আশ্চর্য।
এক আগুনের দুই রূপ আমার জানা ছিলোনা।
আমি আমার ঘরে এসে হাঁপাতে লাগলাম। এ এক অন্যরকম অনুভূতি!!
তবে কি আমার মন ফয়সালের জন্য জাগছে? আমার কি ভালোবাসা সৃষ্টি হচ্ছে ওর জন্য? জেরিন কি ইচ্ছা করেই এই সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের? অসম্ভব!
না কিছুতেই না এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবেনা…! আমি নুরজাহান বাঈজীর মেয়ে….!!
এভাবেই সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন জেরিনের প্রতিচ্ছায়া। ঠিক ওর মতো কথা বলি ওর মতো ড্রেসআপ করি। ফয়সালকে ওর মতো করে খাবার সার্ফ করি। বাসার কাজের লোকরা জেরিনকে বড় ম্যাডাম আর আমাকে ছোট ম্যাডাম বলে। জেরিন ওদের বলে দিছে।
জেরিন ধিরে ধিরে আরো অসুস্থ হতে থাকলো। ও কিছুতেই ডাক্তারের কাছে আর হাসপাতালে যেতে চায়না। সে বলে আমাকে তোমাদের মাঝে থেকে শান্তিতে মরতে দাও।
সময় আর পরিবেশ মানুষকে কত বদলে ফেলে।
দেখতে দেখতে রোজার মাস চলে এলো।
আমি এই প্রথম রোজা রাখা শুরু করলাম। জেরিন আমাকে নামাজ পড়া শিখিয়েছে। কোরআন শরিফ পড়া শিখিয়েছে। আমি রোজ সবার জন্য ইফতার বানাই। ফয়সাল তারাবী পড়তে যায় মসজিদে তখন আমি আর জেরিন বাসায় তারাবী পড়ি। জেরিন রোজা রাখতে পারে না। ওর জন্য কাফফারা দেয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ পল্লীতে কত রোজা নামাজ বাদ যায়
কাফফারা কি তাই জানিনা।
এর মাঝে আমরা বেশ কবার শাহবাজপুর যাই।
আকবরের হাত ধরে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। ও কিছুই বুঝেনা। আশ্চর্য ও আর আমি মাত্র দশদিনের ছোট বড়।
রশিদ চাচাকে দেখি, উনার আর আমার মাঝে অনেক মিল খুঁজে পাই। খুব মায়া হয় উনার জন্য। উনি আমাকে ছোট আম্মা বলে ডাকে। জেরিন বড় আম্মা।
মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ আমাকে আকবরের মতো করতো আর আকবরকে আমার মতো। তাহলে তো জেরিন খুশি থাকতো হয়তো আমাকে খুঁজে বের করতো না।
ঈদ আমরা সবাই শাহবাজপুর করবো।
জেরিন তাই বললো।
২৭সে রোজায় যাবো ওখানে গরিবদের ইফতারি খাওয়ানো হবে আর নতুন কাপড় দিবে।
সময় চলে আসছে এবার সব পরিবর্তনের পালা।
২৭সে রমজানে আমরা শাহবাজপুর এলাম। জেরিনের অনেক কষ্ট হইছে আসতে তবুও সে জোর করেই আসলো।
সারাদিন গরিবদের কাপড় আর টাকা দেয়া, হাজার হাজার মানুষে ইফতারি খাওয়ানো। কিভাবে সবাই মিলে করলো আমি অবাক হয়ে দেখলাম।
রাতে খুব ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘুমাতে যাবো এমন সময় জোসনা দৌড়ে এসে আমাকে বলছে, ছোট ম্যাডাম জলদি চলেন, বড় ম্যাডামের শরীর খুব খারাপ উনি আপনারে ডাকে। আমি বেহুশের মতো ছুটে গেলাম।
যেয়ে দেখি জেরিনকে ফয়সাল বুকে জড়িয়ে আছে আর তার চোখে পানির বন্যা।
জেরিন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আমাকে হাত ইশারার কাছে ডেকে বললো,ঘর থেকে সবাইকে বের করে দরজা বন্ধ করে দাও। আমি তাই করলাম। জেরিন আমাকে ওর কাছে বসতে বললো আমি বসলাম, এবার ও যা করলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ও আমার হাত আর ফয়সালের হাত একসাথে করে অনেক কষ্টে বলতে লাগলো, রেশমি আমি ফয়সালকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। আমি তোমার মাঝেই থাকবো। আমার ফয়সালকে কখনো কষ্ট দিওনা। ওযে একটা অমুল্য রতন। আমি ওকে সন্তান দিতে পারিনি তুমি দিবে। এই সংসারকে ধরে রাখবে। প্লিজ তুমি আমাকে নিরাশ করোনা।
আমি হতভম্বের মতো বসে থাকলাম কিছুই বললাম না।
কেনো এমন হয়? আমি কেনো এসবে জড়ালাম?
এবার জেরিন বললো, তুমি এখন যাও আমি ফয়সালের বুকে শুয়েই মরতে চাই। এটা যে কি শান্তির মৃত্যু তুমি তা বুঝবে না। তুমি এখন যাও। ও এখনো আমার।
আর যাবার সময় দরজা বন্ধ করে যাবে।
আমি তাই করলাম। আমি আমার রুমে চলে এলাম। এই প্রথম আমি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ে কারো জন্য দোয়া চাইলাম স্রষ্টার কাছে। বাহিরে আজানের আওয়াজ। আমার প্রতিশোধের আগুনে পানি ঢেলে জেরিন দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।
আজ প্রায় সাতদিন হয় জেরিন মারা গেছে। ফয়সাল এখান থেকে যেতে চাচ্ছেনা। জেরিনকে ওদের পারিবারিক গোড়স্থানে কবর দেয়া হয়েছে। ফয়সাল প্রায় সারাক্ষণ ওখানেই থাকে।
এখন রাত এই এতো বড় বাড়ীতে আমি আর ফয়সাল একা উপরতলায়। নিরব নিঝুম চারিদিক। বাহিরে মেঘ ডাকছে। ফয়সাল আমার ঘরের দরজায় নক করলো, আমি দরজা খুললাম, ওর চোখমুখ ফোলা মনে হয় অনেক কেঁদেছে।
আমাকে বললো, তোমাকে কিছু কথা বলতাম একটু বাহিরে আসো। আমি বের হলাম। বসার ঘরে ও আর আমি। ফয়সাল আমার হাত ধরলো, সেই হাত খুব মমতার হাত। সে বল্লো, রেশমি আমি কোনোদিন জেরিনের কথার খেলাপ করিনি। তাই তোমাকে বিয়ে করতে রাজী আছি।
কিন্তু আমি তোমাকে জেরিনের জায়গায় কোনোদিন বসাতে পারবো না।
এটা মেনে তুমি যদি আমার সাথে থাকতে চাও সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। আমি তোমাকে তোমার সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিলাম। এই বলে সে উঠে চলে গেলো।
আমি হতভম্বের মতো বসে থাকলাম। আমি তাকে কি করে বলি, এতোদিনে আমি যে তাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।
বাহিরে প্রবল বৃষ্টি.. আমার সারা দেহ মনে এ কোন শিহরণ? আমার শরীর মন দুই জাগতে শুরু করলো…
দূরে ফয়সালের ঘরের দরজা খোলা.. আমি উঠে দাঁড়ালাম….ফয়সালের ঘরের দিকে আগালাম.. একি আমি কি করছি?
একদৌড়ে বারান্দায় গেলাম প্রচুর বৃষ্টি.. সারা শরীর মন বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে নিজেকে শক্ত করলাম। ফিরে এলাম আমার ঘরে দরজা ভাল করে বন্ধ করলাম। কাপড় পালটালাম। আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিলাম। কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ করলাম।
জেরিন আমাকে শিখিয়েছে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পুরোনো কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা। এতে করে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। আমি তাই করবো।
এখন আমি জেরিনের প্রতিচ্ছায়া ফয়সালকে বিয়ে করলে আমার অনেক লাভ কিন্তু ফয়সাল? ওতো সমাজের কাছে অনেক হেয় হবে। আমি তো ওকে ভালোবাসি ভালোবাসার মানুষকে হেয় করা যায়না।
আমি আমার আলমারি খুলে আমার মায়ের সেই লালবাক্সটা নিলাম। নিচে নেমে আসলাম।
আমার মায়ের কুঠুরি ঘরে গেলাম। ওখান নামাজ পড়লাম। স্রষ্টার কাছে মাফ চাইলাম জেরিনের কথা না রাখার জন্য।
আমি বের হয়ে আকবরের ঘরে গেলাম তার জন্য দোয়া চাইলাম, বিধাতা তো সব পারে তার অলৌকিক শক্তি দ্বারা এই ছেলেটাকে ভালো করে দিক।
এরপর রশিদ চাচার হাতে একটা খাম দিলাম বললাম, চাচা এটা ফয়সালকে দিয়ে বলবেন আমি দিয়েছি রশিদ চাচা কাঁদছে আর বলছে, ছোট আম্মা আপনি কই যান? আপনের মাও ঠিক এইভাবেই একদিন রাতের অন্ধকারে চলে গেছিলো। আপনে যাবেন না।
আমি আমার মায়ের লালবাক্সটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। জমিদার বাড়ির দিকে তাকালাম, আকাশের দিক তাকিয়ে বললাম, মা আমি তোমার মেয়ে তুমি যেমন এই বাড়ির কিছুই নাওনি। আমিও কিছুই নেইনি যেই বাড়ীতে তোমার কোনো দাম নেই সেখানে আমি কি ভাবে থাকি?
আমি পথে নামলাম জানিনা কোথায় যাবো? পথে নামলে পথই পথ দেখায়….!!!
সকালে ফয়সাল নাস্তার টেবিলে, রশিদ চাচা রেশমির দেয়া খামটা ওকে দিলো।
ফয়সাল বল্লো, এটা কি?
রশিদ চাচা বল্লো, ছোট আম্মা দিছে।
ফয়সাল খামটা খুলে দেখে, এই বাড়ির দলিল আর একটা চিঠি। ফয়সাল চিঠিটা খুল্লো, এলোমেলো হাতের লেখা চিঠি।
ফয়সাল,
যেদিন আপনি আমাকে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে আসলেন, সেদিন থেকে আমি আপনাকে আমার দেবতা মানি। দেবতাকে মানুষ উচ্চস্থানে রাখে। তার সম্মানহানি হোক এটা কেও চায় না। আমি তার ব্যাতিক্রম হলাম না।
আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি তাই ভালোবাসার মানুষকে ছোট করতে চাইনা। জেরিনের কথা না মানার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই নিয়তি। যার যা জায়গা তার সেখানেই থাকতে হবে। ভালো থাকবেন।
আর বাড়ির দলিলটা দিয়ে গেলাম ওটা রশিদ চাচার প্রাপ্য। তাকে বুঝিয়ে দিবেন। আমি শুধু আমার মায়ের স্মৃতি লালবাক্সটা নিয়ে গেলাম।
ইতি
রেশমি
চিঠিটা পড়ে ফয়সাল রশিদ চাচাকে জিজ্ঞেস করলো, রেশমি কই?
…চইল্লা গেছে।
চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?
.. জানিনা।
ফয়সাল সাথে সাথে গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেলো রেশমির খোঁজে।
ওর বারবার মনে হতে লাগলো, জেরিন বলেছিলো, তুমি যদি ওকে জায়গা না দাও তবে মেয়েটা আবার নিষিদ্ধ পল্লীতে চলে যাবে। এটা অনেক বড় অন্যায় হবে।
ফয়সাল গাড়ীর স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো। রেশমিকে যেমন করেই হোক তার খুঁজে বের করতেই হবে….!
সমাপ্তি