কলমে #রেহানা_পুতুল
আরুকে রজতের জন্য আমার ঘরে নিতে চাই। তবে এখন না। তার পড়াশোনা শ্যাষ হইলে।
নাহ ফুফু। রজতের বিয়ে হবে নদীর সঙ্গে।
দ্বিতীয় কেউ কিছু বলার আগেই কথাটা বলে ফেলল চেয়ারম্যান ইশতিয়াক।
উপস্থিত সকলেই যেন শুকনো মাটিতে হোঁচট খেলো। তারা হতভম্ব চাহনিতে শ্রাবণের দিকে চাইলো। শ্রাবণের বাবা রফিক দেওয়ান বিরক্ত হলেন ছেলের উপরে। চট করেই বলে উঠলেন ছেলের উদ্দেশ্যে,
শ্রাবণ, তুমি যেমন আমাদের তিন পরিবারের বড় সন্তান। সবাই তোমার কথাবার্তার গুরুত্ব দেয়। কাজে কর্মে তোমার পরামর্শ চায়। তেমনি আমিও আমাদের পরিবারের বড় সন্তান। এখনো জীবিত আছি তোমার চোখের সামনে। তোমার ফুফু কথাটা বলেছে আমার কাছে ও তোমার মেজো চাচীর কাছে। সেখানে তুমি কর্তৃত্ব ফলানো অনুচিত। তুমি চেয়ারম্যান হয়েছো। নিঃসন্দেহে তুমি সর্বত্র মর্যাদাবান। কিন্তু পারিবারিক সব বিষয়ে তুমি হস্তক্ষেপ করবে না। জন্ম মৃত্যু বিয়ে আল্লাহর হাতে। এসব নিয়ে মর্জিমতে কিছু বলে ফেললেই হয় না।
হাফসা বিবি পুত্রকে থামালেন মৃদু ধমকে। বললেন,
থামতো শফিক। মুখ ফসকে তার মুখ দিয়ে একটা কথা বের হইছে তো কি হইছে? পোলাপাইন মানুষ ও।
শফিক দেওয়ান চুপ হয়ে গেলেন মায়ের কথাকে সম্মান দিয়ে।
শ্রাবণও পিতার মুখের উপরে কোন উচ্চবাচ্য করল না। অন্যকেউ হলে এতক্ষনে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতো। তবে সে অপমানিতবোধ করলো সবার সামনে। তার উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা করতে গেলেও সবাই ভুল বুঝবে। পিতাও ছোট হয়ে যাবে। সে শক্ত চোয়ালে বসে রইলো সোফার এক কোণায়।
রাফিয়া বড় ভাইয়ের উপর বেশ খুশী হলো। মনে মনে টিপ্পনী কেটে বলল,
ভাইজান ঠিকই কইছে। হারামজাদা কইলোটা কি। বান্দর কোথাকার। অমন ছন্নছাড়া মেয়েকে কে ছেলের বউ করেরে?তোর মায় করবে? তুই করবি? হুহ! যেই মাইয়ার জীবন যাযাবরের মতো। আইজ এইখানে কাল ওইখানে। আদব কায়দার নাই কোন বালাই। বড় হইতাছে শাসন ছাড়া। চেহারাসুরত ও আহামরি না। তারে আমার ঘরে তুইলা নিমু। জীবনেও না। মরনেও না।
আরুর মা আছে,বাবা আছে,পরিবারের সবার আদর শাসনে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে বড় হয়ে হইতাছে। তাকেই মানায় রজতের সঙ্গে।সেই রজতের যোগ্য পাত্রী।
পাশে বসা থেকে শ্রাবণের ছোট ফুফু জাকিয়া বলল,
কাজের কথায় আসি। ভাবি তুমি কি বলো বুবুর প্রস্তাবে?
নাহার বেগম টনটনে গলায় বলল,
রজত ভাইগনারে আমারে সবসময় ভালোলাগে। আমার কোন আপত্তি নাই বড় বুজানরে বেয়াইন বানাইতে।
আচ্ছা বুঝলাম। বড় ভাইজান আপনার কি মত?
তোদের সবার মত থাকলে আমার অমত হওয়ার কোন কারণ নেই। শফিকের মতামত জানাটা গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি। কারণ কন্যাটা তার।
তুমি কি বল শ্রাবণের মা?
স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো রফিক।
আমার বলার কি আছে এখানে? আরুর মা,বাবা ও বড় আপার মত মিলে গেলে কারো দ্বিমত থাকা সাজেও না। তবে দুলাভাইয়ের মত আছে কিনা। সেটাও জানতে হবে।
রাফিয়া বলে উঠলো,
আরেহ দূর বড় ভাবি। কি যে কও না। আমার ভাইজিরে আমার ঘরে নিমু। এতে হ্যার মতের তোয়াক্কা করিই আমি?
এটা ঠিক না রাফিয়া। সে বেকার হয়ে গেল বলে তুই তারে পাত্তা না দিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়।
বলল রফিক দেওয়ান।
পাশে থেকে নাহার বলল,
ভাইজান। আমি আপনের ছোট ভাইরে ফোন দিয়া বুঝায়া নিমু। আপনে টেনশন কইরেন না।
জাকিয়া বলল,
এই বুবু? রজত রাজি কিনা এটা জানেন?
মনে হয় রাজি। কয়দিন আগে কইলাম আর হেসে উঠলো।
বলল রাফিয়া।
হ আমিও বুজানের লগে একমত। সেদিন নদীরে নিয়া যখন বসলাম আমরা। তখনও আমি এই রকম কথা বললাম। কই রজত নাতো করলো না। তার মানে কি?
বলল আরুর মা।
মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। তবুও রজতরে সরাসরি জিজ্ঞেস করা দরকার।
বলল জাকিয়া।
মা আপনে ওকে জিজ্ঞেস কইরেন ত। গলা বাড়িয়ে বলল রাফিয়া।
আইচ্ছা জিগামুনি। আমি যাই। আযান দিল। নমাজ পড়ুম। অজু করুম।
এরা যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল,রজত তখন বাড়ির বাইরে ছিল। শুনতে পায়নি কিছুই। নদী ও আরু রান্নাঘরে ছিলো বলে তারাও শুনতে পায়নি বড়দের আলোচনার বিষয়টা।
পূবের আকাশে বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠে উড়িয়ে দেওয়া রঙিন ঘুড়ির নাটাইগুলো গুটিয়ে নিচ্ছে একদল দুরন্ত বালক। সন্ধ্যার গাঢ় আয়োজন শুরু করে দিলো প্রকৃতি।
সবাই উঠে যার যার মতো করে চলে গেলো। সেই সুযোগে আরু শ্রাবণের সামনে এসে আপাদমস্তক চাইলো।
মিটমিটিয়ে হেসে বলল,
ওরেব্বাস! এক্কেবারে নতুন বরের মতো লাগছে দেখি আমাদের চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান সাহেবকে। শর্ট পাঞ্জাবি, পায়জামা, গলায় কাঁচাফুলের মালা। দেখি মালাটা আমারে দেনতো। একটু ঘ্রাণ শুঁকি।
শ্রাবণ গলার মালাটা ঘুলেই আরুর হাতে দিয়ে দিলো। তারপর এলাকার লোকজনের ডাকে বেরিয়ে গেলো নিজেদের পুরোনো বাড়ি থেকে।
পিছনের উঠানে নলকূপের মধ্যে অজু করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে জাকিয়া। সে শিকারি চোখে এদিক ওদিক চাইলো। তারপর হাফসা বিবিকে বলল,
মা শুনেন, শ্রাবণ ট্রিকস করেই কথাটা বলল। কারণ নদীর বিয়ে সহজে হবে না। এটা সে নিজেও জানে। তাই ভাবছে সবাই যদি নদীকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। সেই ভয়েই নদীকে রজতের সাথে সেট করতে চায়। রাজনীতি করা ছেলে। মাথায় কেবল এগুলাই দৌড়াদৌড়ি করে।
হ তোরে কইছে। আমি জিগামু শাবুনরে। দেহি ক্যান কইলো ওই কথা।
শাবুন কি মা? শব্দটা শ্রাবণ। র ফলার উচ্চারণ হবে।
আমি অত শক্ত নাম কইতে পারি না। শাবন ই সুন্দর।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে রজতের সাথে শ্রাবণের দেখা হলো বাইরেই। রজত শ্রাবণকে বলল,
কিরে নদীকে মিষ্টি না খাইয়ে চলে গেলি কেন দরজা থেকে?
এতজনে খাওয়ালে ওর হজম নাও হতে পারে। তোর বিয়ে ফাইনাল করে এলাম নদীর সাথে?
রজতের পিঠ চাপড়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল শ্রাবণ।
কি ফাউল বলছিস তুই? কপাল ভাঁজ করে বলল রজত।
শ্রাবণ হাঃহাঃহাঃ করে হেসে ফেলল।
দুজন দুদিকে পা বাড়িয়ে প্রস্থান নিলো।
রজত গ্রামের আলো আঁধারির মেঠোপথ মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানাদের বাড়ি। যেতে যেতে ভাবতে লাগলো,
নানার পরিবারের বড় নাতি সে। সবার আদরের। তার শিশুকাল কেটেছে নানার বাড়িতেই। তাই ছোট মামী রুবিনা ও তার মেয়ে নদীর জীবনের বেদনার ইতিহাস তার কাছে দৃশ্যমান। সূর্যের আলোর মতো তীব্র। উজ্জ্বল।
তালেব দেওয়ানের তিনপুত্র ও দুই মেয়ে। সময়ের করাতলে অর্থবিত্তের জৌলুশ কমে গেলেও তার বনেদি পরিবারের ঐতিহ্য চোখে পড়ার মতো।
রাফিয়া বড় জাকিয়া ছোট। দুজনেই স্বামী,সংসার,সন্তানাদি নিয়ে ভালো আছে। বড় ছেলে রফিক দেওয়ান। তার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে শ্রাবণ। ছোট মেয়ে সারথী।
দ্বিতীয় ছেলে শফিক দেওয়ান। তার দুই মেয়ে। বড় আরু। ছোট নিরু।
ছোট ছেলে মোহন দেওয়ান। পরিবারের পছন্দেই ধুমধাম করে বিয়ে করে দূর গ্রামের অষ্টাদশী অনূঢ়া রুবিনাকে। বছর তিনেকের মাথায় রুবিনার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। যার নাম রুবিনা শখ করে রেখেছে নদী। রুবিনাদের বাড়ির পাশেই কলকল করে বয়ে চলে স্রোতস্বিনী মেঘনা নদী। নদী রুবিনার খুব প্রিয়। নদীর সাথে নারীর জীবনের অজস্র সাদৃশ্য খুঁজে পায় রুবিনা। নদী জন্মানোর সময় রুবিনা তার বাবার বাড়িতে ছিলো। তখন তার শারীরিক কন্ডিশনের অবনতি ঘটে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ধরা পড়ে রুবিনার জরায়ুতে সমস্যা। কেটে ফেলে দিতে হবে। তাই সে আর দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে পারবে না। জরুরী অপারেশন করে বের করে নেওয়া হয় তুলতুলে নদীকে। দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলো হাসপাতালে। এবং বিষয়টা প্রকাশ হয়ে গেলো।
নদী জন্মাবার বছর না গড়াতেই রুবিনা পরিবারের সবার অপ্রিয় হতে লাগল বিষফোঁড়ার ন্যায়। বিশেষ করে শ্বাশুড়ি হাফসা বিবি। খোঁটার অন্ত নেই রুবিনার প্রতি। মোহনকে ইন্দন দিতে লাগল পুত্র সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার। রুবিনার বিরুদ্ধে অহেতুক এটা সেটা বলে মোহনের কান ভারি করে তুলল।
রুবিনা লক্ষ করলো মায়ের কথায় তার স্বামী মোহন ধীরে ধীরে নরম হয়ে যাচ্ছে মাখনের মতন। কারণ হিসেবে খুঁজে পেলো,
সে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। এবং সেই কন্যা বাড়ির অন্য মেয়েগুলোর চেয়ে কমসুন্দর। আরেকদিকে সিজারের জন্য রুবিনা প্রায় অসুস্থ থাকে। বড় দুই জায়ের সাথে তাল মিলিয়ে স্বামীর সংসারে সমান তালে খাটতে পারে না। সন্তান গর্ভ ধারণেও অক্ষম হয়ে পড়লো।
যার ফলশ্রুতিতে নদীর দুই বছর গড়াতেই রুবিনার ঠাঁই হলো বাবার বাড়ি। কিছুদিন পর হাতে পেয়ে গেলো ডিভোর্স লেটার। রুবিনা কষ্টগুলোকে চুপিসারে পিষে ফেলল সাহস ও অদম্যতার যাঁতাকলে। শুরু করে পড়াশোনা। শেষ করে একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলো। নদী বড় হতে লাগল নানী খালার আদরে ও মামীর অনাদরে। এই ভিতরে গত হলো নদীর দাদা তালেব দেওয়ান।
সময় গড়ায়। নদীর বয়স যখন আট। তখন তার বাবা মোহনের দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক হয় তার দাদীর ইচ্ছেই। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বেই…
চলবে ৩