কলমে #রেহানা_পুতুল
আজ শুক্রবার। নদীসহ সবাই তৈরি হয়ে নিয়েছে শ্রাবণের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে বলে। রজতের আসার কথা থাকলেও কোন এক কারণে রজত আসেনি।
পাত্রীর বাড়িতে সবাই পৌছালো। খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে নিলো। শ্রাবণ পাত্রীকে আংটি পরাতে যাবে,অমনি মেয়ের বড়বোন বাধা দিলো। বলল,
দুঃখিত। থামেন বলছি। এইমাত্র পাত্র সম্পর্কে আমরা কিছু বাজে মন্তব্য শুনলাম প্রমাণসহ।
শ্রাবণসহ উপস্থিত সবাই অবাক চোখে পাত্রীর বড়বোনের দিকে চাইলো।
রফিক দেওয়ান বলল,
কি বলছ মা তুমি? কি শুনলে পাত্র সম্পর্কে?
সেটা আপনাদের মুরুব্বীদের সামনে বলা যাবে না। আপনারা অপমানিত বোধ করবেন।
পাশ থেকে মোরশেদা বেগম বলে উঠলেন,
না বলে ফেলো। আমরা সত্যিটা শুনতে চাই।
হ্যাঁ কও বইন কইয়া ফালাও। বলল শ্রাবণের দাদী হাফসা বিবি।
আপনার চেয়ারম্যান নাতির চরিত্র ভালো না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেক মেয়েকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই নাম্বার কাজ করেছে। আর উনি খুব বদ মেজাজী।
শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। মার্জিত স্বরে বলল,
আমিও আপনাদের মতো কান কথায় বিশ্বাস করা লোকদের সাথে সম্পর্ক করবো না। এই বলে পাত্রীদের ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। রফিক দেওয়ান তিরিক্ষি মেজাজে তাদের বলল,
এসবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে? রাজনীতি করে। অনেকের সাথেই তার সঙ্গত কারণে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। তারা তার নামে দূর্নাম রটাবে। এটাই স্বাভাবিক। সে মন্দ হলে ভোটে জয়লাভ করতো? তবে আফসোসের বিষয় হলো আপনারা তা গিলে ফেললেন। আবার হজম ও করলেন। অদ্ভুত!
এক দুই কথায় দুই পক্ষ তর্কে জড়িয়ে গেলো।
হাফসা বিবি চটুল গলায় বললেন,
এই রফিক চইলা আয়। যার বিয়া হ্যায় যখন বিয়া করব না,আর কথা প্যাঁচায়া লাভ আছে?
রফিক,মোরশেদা,সারথি,আরু,নদী,হাফসা বিবি,শ্রাবনের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেঁটে পাত্রীদের বাড়ির কাচারি ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
রফিক দেওয়ান পুত্রকে উদ্দেশ্যে করে বলল, আমি বুঝলাম না হচ্ছে টা কি? কেমন যেন গোলমেলে লাগছে৷ এর আগের বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। পাত্রীর নাকি রিলেশন আছে। এই বিয়ে ভেঙ্গে গেলো তোর স্বভাব খারাপ বলে। বিয়েই ত করা যাবে না দেখছি।
আমার কি দোষ বাবা। বিরক্তিকর কন্ঠে বলল শ্রাবণ।
মোরশেদা শাশুড়ীকে বলল,
আম্মা, বিয়ে করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলে এর পর বউ ছাড়া নাকি ঘরে ফিরলে অকল্যাণ হয়?
সেইটাই ত ভাবছি বউ। ঘোর অকল্যাণ ও অশুভ এইটা। যেই নিয়তে ঘর থেইকা বাইর হইলো,সেই নিয়ত পুরা না কইরা খালি হাতে ঘরে ঢুকন ঠিক হইবে না। এইটা বহুত খারাপি হইয়া যায়।
তাহলে কি করা যায় এখন? উদ্বিগ্ন স্বরে বলল রফিক দেওয়ান।
হাফসা বিবি বলল,
এগো বাড়িত খাড়ায়া থাইকা কি লাভ? ল একটা নিরিবিলি যায়গায় গিয়া খাড়াই আমরা। হেরবাদে চিন্তা করি।
মায়ের কথামতো তারা কয়েক রিকশায় ভাগ হয়ে একটা নিরিবিলি স্থানে গেলো। শ্রাবণের এক বন্ধু বলল,
এই শ্রাবণ, আমার চাচাতো বোন নিশিতাকে বিয়ে করবি? তারাও বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে। এবার অনার্সে পড়ে। তোর সঙ্গে বেশ মানাবে।
শ্রাবণ বলল,বিয়েই করব না। বিয়ের চিন্তা আপাতত বাদ।
নদী আপুর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে পড়িয়ে দেন।
আচম্বিতে সারথির মুখ ফসকে কথাটি উগরে বের হয়ে এলো। সবাই হতচকিত হয়ে সারথি’র মুখপানে চাইলো। সারথি ভুল কিছু বলে ফেলছে ভেবে নিজের জিভে কামড়ে ধরলো। নদী লজ্জায় কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সবার থেকে।
শ্রাবণ সারথিকে মারতে উদ্যত হলো। হাফসা বিবি বাধা দিলো আগ বাড়িয়ে। বলল,
ও ছোড়ু মানুষ। বাদ দে। তবে ভাইভা দেহন যায় এইটা, যদি তোগো আপত্তি না থাকে। নদীর বাপ নাই,আপনা কোন ভাই নাই মায়ের পেটের। কার হাতে গিয়া পড়ে আর জিন্দেগীটা বইনের তেজপাতা হইয়া যায়।
শ্রাবণ খিটখিটে মেজাজে দাদীকে বলল,
তার জীবন যেন তেজপাতা না হয় সেটা ভাবো। কিন্তু তাকে বিয়ে করলে যে আমার জীবন বাঁশপাতা হবে, সেই খেয়াল আছে বুড়ি?
আমার কথা কি বেদবাক্য তোর হুনতে হইবো যে? আন্দাজে হুট কইরা না জাইনা না শুইনা এখন ভালা মাইয়া কই পাবি তুই? আমার দিলে কইলো, পরিস্থিতি যেইটা খাড়াইছে,নদীই তোর লাইগা ঠিক আছে৷ পড়াশোনা করতাছে। এম এ পাশ দিবো। বড় চারকি করবো। গান শিখতাছে। নামকরা গানের শিল্পী হইবো। দেখতেও সুন্দর আছে। এখন বয়স অল্প। কয়দিন পর গায়ের রঙ ও তার যৌবন গাঙের পানির লাহান ফুইলা ফাইঁপা উঠবো। তহন বেদিশা হইয়া যাইবি তুই। মনে রাহিস। ঠকবিনা কইলাম। বরং জিত্তা যাইবি। কোন দিক দিয়া নদী তোর অযোগ্য? কতো দেহি?
মোরশেদা ও রফিক দেওয়ান এতক্ষণ মন দিয়ে মায়ের কথা শুনলো। রফিক দেওয়ান সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। শ্রাবণকে আদেশ দিলেন,
তুই ঘরে ঢুকিস না। উঠানে বসে থাক। বউ নিয়েই ঘরে ঢুকবি। আমি বউর ব্যবস্থা করতেছি। নদীসহ অন্যরা ঘরে ঢুকে গেলো। সুরমা কয়েকটা চেয়ার এনে উঠানে রাখলো। মোরশেদা একপাশে গিয়ে নদীর মা রুবিনাকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত বলল। এবং নদীকে শ্রাবণের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায় প্রস্তাব দিলো। রুবিনা আগেপিছে ভাবল না। আনন্দে টগবগ করছে তার অন্তরখানি। সাতপাঁচ না ভেবেই প্রস্তাবটা লুফে নিলো।
নদী তার মাকে ফোনে জানালো সে রাজী না বলে। তার মা অনেক অনুনয় বিনয় করে মেয়েকে বুঝালো জীবনের সুখের সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করে। নদী নিমরাজি হলো তার ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
রফিক দেওয়ান শ্রাবণের বন্ধুদের বললেন,
বাবা তোমরা মসজিদের হুজুর ও কাজির ব্যবস্থা করে ফেলো। মিষ্টি, আংটিতো রেডিই আছে। আর কিনতে হবে না।
শ্রাবণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আকস্মিক ঘটনায় তার মুখ পাংশুটে আকার ধারণ করলো। সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো সবার উপরে। সুরমাকে দিয়ে মা, বাবাকে উঠানে ডাক দিলো। তারা ব্যস্ত পায়ে পুত্রের সম্মুক্ষে এলো।
মা,বাবা এটা কি হতে যাচ্ছে?
শেষমেষ নদী হবে তোমাদের পুত্রবধূ?
সমস্যার তো কিছুই দেখছি না। বরং উপকার হবে। সে ঘরের মেয়ে। আমাদের মান্য করে চলবে। অন্য কাউকে বিয়ে করলে বছর না গড়াতেই সংসার ভাঙ্গার উপক্রম হবে হয়তো।
নদীর মত নেওয়ার প্রয়োজন নেই?
না নেই। কারণ ওর মেইন অভিভাবক তার মা। সে বিনাবাক্যে খুশিমনে রাজী হয়েছে। নদী হয়তো মানা করবে এখন। কিন্তু বিয়ে হলে কয়মাস যেতেই ঠিক হয়ে যাবে। বয়স বাড়তে বাড়তে পড়াশোনাও কমপ্লিট হয়ে যাবে। ঠিক সংসারিও হয়ে যাবে তখন। দেখিস।
বলল তার মা।
কিন্তু আমি ওকে বিয়ে করতে চাইনা বাবা,মা।
কিন্তু আমরা যে চাই। বুঝতে চাসনা কেন? হেয়ালি করিস কেন অবুঝের মতো?
তাহলে এনগেজমেন্ট হয়ে থাকুক এখন। বিয়ের কি দরকার? ভারকন্ঠে বলল শ্রাবণ।
না একবারে বিয়েই হয়ে যাক বাবা। তাহলে ধীরে ধীরে সে তোর দিকে আকৃষ্ট হবে।
পাশ থেকে হাফসা বিবি বলল,
ও কলেজে পড়ে। এর পর বড় কলেজে পড়বে। অন্য পোলার লগে লাইন হইয়া যাইতে পারে। বিয়াটা হইলে আর সেই রিস্ক নাই।
তোমার কল্লা। গ্যাঞ্জামটাতো তুমি লাগাইছো। সারথি বীজ লাগালো। আর তুমি যত্ন করে বটবৃক্ষ বানিয়ে দিলে। আমার লাইফে যদি তারে দিয়ে সুখ না পাই তোমার কবরে আগুন লাগিয়ে দিব আমি।
আগুন ঝরা কন্ঠে দাদীকে বলল শ্রাবণ।
তোর যা মনে লয় দিস। আমি আন্ধার কব্বরে থাইয়া কি দেখুমরে ভাই। তাও বিয়াটা তুই করো। আশাতো ছিলো রজত তারে বিয়া করবো।
প্রায় দুপুর গড়িয়ে এলো। উঠান জুড়ে খাঁ খাঁ রোদের প্রখরতা ছড়িয়ে আছে। ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। রোদ্রতাপে শ্রাবণের কপালে বিন্দু বিন্দু চিকন ঘাম জমে গিয়েছে। মাথার উপরে একটি সাদা কবুতর ডিগবাজি খাচ্ছে। একঝাঁক চড়ুই কিচিরমিচির করে ডাকছে ডালিম গাছের ডালে বসে।
বিয়ে পড়ানোর জন্য সমস্ত আয়োজন শেষ। নদী যেভাবে ছিলো সেভাবেই আছে। হাফসা বিবি কেবল মাথায় ঘোমটা দিয়ে এনে শ্রাবণের মুখোমুখি বসিয়ে দিলো তাকে। নদী অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে ফেলছে। সবার সম্মতিক্রমে শ্রাবণ নদীর অনামিকায় সোনার আংটিটি পরিয়ে দিলো। তিন কবুল বলে দু’জন দুজনকে বিয়ে করে নিলো। সবাই হাত তুলে মোনাজাত ধরলো। ভিডিও কলে নদীর মা ও মামা মামীরা ছিলো। নাহার বেগমও এলো খবর দেওয়া হলে তাকে। সে ভীষণ খুশী। কারণ রজতের পথ এবার ক্লিয়ার হলো আরুর জন্য।
নদী ও শ্রাবণ তার বাবা মাকে পা ধরে সালাম দিলো। নদীর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন তারা দুজন।
আরু,সারথি,সুরমা মিলে কাঁচাফুল যোগাড় করে বাসর ঘর সাজালো সাদামাটাভাবে। ভরদুপুরে উঠানে দাঁড়িয়ে বসে সবাই ঘেমে যাচ্ছে। তাই সবাই ঘরে চলে এলো। হাফসা বিবি শ্রাবণকে বলল,
বউর হাত ধইরা ঘরে নিয়া চল ভাই।তারপর তোর রুমে নিয়া যাইস ওরে।
শ্রাবণ দাদীর কথায় তাই করলো। ঘরে গিয়ে নদীকে রুমে নিয়ে ঢুকলো। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। নদী সবার সামনে কোন সিংক্রিয়েট করল না।
ঘরের ভিতর উৎসবমুখর পরিবেশ। রফিক দেওয়ান বোনদের,ও নিকটজনদের দাওয়াত দিলেন পরেরদিন আসার জন্য। তিনি কাঁচা বাজারে চলে গেলেন মাছ মাংস কিনতে৷
একা রুম। রোমাঞ্চকর অনুভূতি শ্রাবণের মাঝে। নদীর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে বিছানায় রেখে দিলো। নদীর কোমরের দুপাশ চেপে ধরলো নিজের বলিষ্ঠ দুহাত দিয়ে। বলল,
কি করবো বল। তুই আমি পরিস্থিতির শিকার। যেহেতু বিয়ে হয়েই গিয়েছে,তাহলে উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিজেদের ঠকিয়ে লাভ কি বল। বুকে আয় বলে নদীকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো।
অবিশ্বাস্য কিছু ঘটে যাওয়ায় নদী জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। শ্রাবণের বুকে মাথা এলিয়ে ঢলে পড়লো।
নদীইই…এই নদীইই…কি হলো তোর? কথা বলছিস না কেন?প্লিজ কথা বল?
চলবে ১৭ #রোমান্টিক #জীবনমুখী ভালোবাসার গল্প কাজিন রিলেটেড #রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক, ফলো,গল্পে মন্তব্য ও শেয়ার দিয়ে প্রেরণা দেওয়ার প্রত্যাশা রইলো।