কলমে #রেহানা_পুতুল
দাদী,চাচী, আরু সবাই কই?
সকাল না ফুরাতেই ঘরের ভিতর পুরুষালী ভরাট চেনা কন্ঠের ডাক শোনা গেলো। নদী লজ্জায়,সংকোচে,ভয়ে রুম থেকে লুকানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তার বুকের ভিতরে ধুকপুক করছে মানুষটার গলা শুনেই। ছোটবেলা থেকেই নদী তাকে ভয় পেয়ে আসছে।
আরেহ শ্রাবণ যে। আসো বাবা আসো। কালতো তোমার নির্বাচন। চাচী মন থেকে দোয়া করি তোমার জন্য। এই পরিবারের সবার বড় তুমি। মান যেনো থাকে আমাদের।
দরদের সুরে বলল নাহার বেগম।
ইনশাআল্লাহ চাচী।
হাফসা বিবিও নাতির মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলো। কলেজ জীবন থেকেই নানাভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত এই চেয়ারম্যান পদের পার্থীর নাম ইশতিয়াক দেওয়ান। ডাক নাম শ্রাবণ। নদীর বড় চাচা রফিক দেওয়ানের বড় ছেলে সে। অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সচ্ছল তাদের। তাই বাড়ি থেকে একটু দূরে নিজেদের ধানি জমি বাঁধাই করে পাকা দোতলা বাড়ি করেছে রফিক দেওয়ান।
শ্রাবণ অনেকটা শখের বশে ও এলাকার বন্ধুদের উৎসাহেই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবারের সবার সাপোর্ট।
নাহার বেগম তোড়জোড় শুরু করলো নাস্তা দেওয়ার জন্য। শ্রাবণ তাড়া আছে বলে চাচীকে থামিয়ে দিলো ব্যস্ত গলায়। নাহার বেগম ঘরের কাজে মন দিলো অন্যদিকে গিয়ে।
শ্রাবণ দাদী, চাচীকে মুখে সালাম দিয়ে পা বাড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। তিন পা এগিয়ে পুনরায় পিছিয়ে এলো পা ঘুরিয়ে।
কিরে ভাই মোবাইল থাইকা গ্যাছে?
নাহ। দাদী,শুনলাম নদী পরিক্ষা দিবে নাকি এখানে থেকেই ? বইপুস্তক নিয়ে একবারেই চলে এসেছে?
হ। হাঁচাই হুনছস ভাই। পোড়া কপাল ছেমরির। যাইবো কই আর।
কই এখন নদী?
মনে হয় রুমের ভিতরেই আছে। হাফসা বিবি টেনে টেনে নদী সম্পর্কে আরো কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। শ্রাবণ বলল,
দাদী নির্বাচনের পরে ওর বিষয়ে সব আলোচনা করবো বসে। এখন আমার জরুরী কাজ চারদিকে। যেতে হবে।
আইচ্ছা ভাই। তাইলে চইলা যা।
তাকে দেখেই যাচ্ছি দাদী।
নদী রুমের দরজায় পা রাখতেই শ্রাবনের মুখোমুখি হয়ে গেলো। শ্রাবণ দরজার দু’পাশে দু’হাত রাখলো। নদীর বের হওয়ার সুযোগ নেই। সে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিচু মাথায়।
শ্রাবণ দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা এনে নদীর দিকে চাইলো।গম্ভীর কন্ঠে শাসনের সুরে বলল,
চোরের মতো পালাচ্ছিস কেন? মায়ের মুখে যেটা শুনলাম, তার শাস্তি পাওনা তুই।নির্বাচন শেষ হোক তারপর। ভিতরে গিয়ে পড়তে বোস। ফাজিল কোথাকার।
নদী নিরব রইলো। মেলানো ঠোঁট ফাঁক করলো না। বিরস মুখে খাটের এক কোনায় গিয়ে দপ করে বসে পড়লো।
আরু চেয়ারে বসা থেকে মুখ টিপে টিপে হেসে যাচ্ছে। শ্রাবণ তার দিকে চেয়েই হালকা মেজাজে ধমকে উঠলো,
এই? তোর আবার কি হলো? জ্বীন ভর করেছে নাকি? তোরও পানিশমেন্ট আছে কিন্তু।
মুহূর্তেই আরুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। মাথা নিচু করে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটতে লাগলো।
শ্রাবণ ঘর থেকে বের হয়ে উঠান ডিঙিয়ে কাচারিঘরের সামনের দিকে চলে গেলো।
পিছন দিয়ে আরু শব্দ করে হেসে উঠলো । তার সঙ্গে চাপা হাসি দিয়ে উঠলো নদীও।
হুহ! আইছে দেওয়ান বাড়ির দেওয়ান ঘরের বড় দেওয়ান। কর্তাগিরি ফলায় সবার উপরে।
কপাল ভাঁজ করে ঠাট্টাচ্ছলে বলল কিশোরী আরু।
পাশ থেকে নদী ভারকন্ঠে আরুর দিকে চেয়ে বলল,
বড় ভাইয়া যদি চেয়ারম্যান হয় তাহলে আমরা নির্যাতিত হবো বেশি। বাইরের ক্ষমতা ভিতরে দেখানো শুরু করবে উনি।
আপা একদম ঠিক বলছিস। তবে তুই সবচেয়ে বেশি সাফারার হবি। কারণ তুই বেশী ডরাস বড় ভাইয়াকে।
আমি ডরাই আর তুই কি করিস?
ইসসইরে..আমি কি ডরাই তাকে?
তাতো একটু আগেই দেখলাম। কেমন বিলাই হয়ে গিয়েছিলি? বলল নদী।
আমি বিলাই হয়ে এককোনায় ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। আর তুই? তুইতো ইন্দুর হয়ে গর্তে ঢুকে গিয়েছিলি। হিঃহিঃহিঃ!
মিটমিটিয়ে হেসে বলল আরু। এবং নদীর কানে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
আপা শোন, মিস্টার ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ ভাই যদি নির্বাচনে হেরে যায়। আমি মিষ্টি খাওয়াবো তোকে। নামাজ পড়ে দোয়া কর তুই। আল্লাহ অভাগীর প্রার্থনা কবুল করবে। দেখিস। তোর ভালোর জন্যই বলছি আমি।
নদী নাক কুঁচকে আরুর মুখপানে চাইলো। এরপর দাদীর ডাকে রুম থেকে বেরিয়ে নদী।
নাহার বেগমের মোবাইল বেজে উঠলো। নদীর মা রুবিনা ফোন দিলো। একমাত্র মেয়ের খবর নেওয়ার জন্য ফোনকল ছাড়া বিকল্প কোন মাধ্যম নেই তার কাছে। দুই গ্রামের দূরত্ব অনেক। চাইলেই কাউকে পাঠিয়ে খবর নেওয়া যায় না। অপরদিকে তার বাবার বাড়ির কাউকে দেখলে হাফসা বিবি ক্ষেপে উঠে অকারণেই। এদিকে নদী ছোট। তাই তার হাতে মোবাইল নেই। নদীর দাদীর বয়স্কা মহিলা। তার হাতেও কোন মোবাইল নেই। আরুর বাবা শফিক থাকে শহরে। নদীর বড় চাচার পরিবারের বাস ওদের নতুন বাড়িতে। সুতরাং মেজো জা নাহারের মোবাইলের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হয় রুবিনার। নাহার বেগম কোনরকমে দায়সারাভাবে রুবিনার সালামের জবাব দিলো। এবং ছলছলিয়ে উঠলো। অসহিষ্ণু স্বরে ঝাড়তে লাগলো নদীর মাকে।
এত ঘন ঘন ফোন করা লাগে? সময় অসময়ে ফোন দেস ক্যান? ঢং দেখলে বাঁচি না! এতই যখন মেয়ের জন্য দিল পুড়ে তাহলে কাছে রাখতি পারলি না? আমার মাথার উপরে পাঠায়া দিলি ক্যান? পরের মাথায় নুন রাইখা বরই খাইতে খুব স্বাদ লাগে নাহ?
ফোনের ওপাশ থেকে আর কোন কথা প্রবেশ করল না নাহারের কর্ণকুহরে। পট করেই মোবাইল রেখে দিলো রুবিনা। নাহার বেগম মোবাইলকে চোখের সামনে এনে দেখলো। পরক্ষণেই ঠোঁট উল্টিয়ে ভেংচি কেটে বলল,দেমাগ কি তার!ঠাস করে আমার মুখের উপর লাইন বন্ধ কইরা দিলো?
রুবিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার কোন অভিযোগ নেই কারো উপরে। সমস্ত অভিযোগ নিয়তির উপরে। নয়তো কেন তাকে ভুলভাল ছুতোয় বাবার বাড়ি এক কন্যাসহ তাড়িয়ে দিলো স্বামী ও শ্বাশুড়ি।
আজ দেওয়ান পরিবারে খুশীর উপচে পড়া আমেজ। উপলক্ষ নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ। তার বাবা মা সহ গোটা পরিবার পুরনো বাড়িতে চলে এসেছে আনন্দ ভাগ করে নিতে। সঙ্গে এনেছে ভ্যান ভর্তি বাহারি পদের মন্ডা মিঠাই। তার দুই ফুফু, নানা নানি, খালারাসহ নিকটাত্মীয়ের ভীড় ঘরভর্তি। উচ্ছাসে মেতে আছে সারাঘর। রজত ও উপস্থিত রয়েছে। মামাতো ভাইয়ের জন্য কম খাটেনি নির্বাচন নিয়ে। মোবাইলে, সামনে,যার যার মতো করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সকলে। একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে। সারা বাড়ি ও পাশাপাশি বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। দুই হাঁড়িতে ভাগ করে দুধ চা ও মসলা চা তৈরি হলো। চা পরিবেশন হচ্ছে।
মোরশেদা ছেলেকে আদেশ দিয়ে বলল,
বাবা তোর দাদীকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দে।
শুধু দাদী কেন মা,সবাইকেই খাইয়ে দিব আমার হাতে। এই বলে শ্রাবণ মা,বাবা,দাদী সহ একে একে সবাইকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। বাকি গেল না রজতও। রজতকে বুকে জড়িয়ে থ্যাংকস জানালো।
রজতের দুচোখ নদীকে খুঁজে ফিরছে। এছাড়া নদীকে কেউই খুঁজছে না। সবাই সবার মতো উপভোগ করছে মুহূর্তগুলোকে। এই খুশীর কলরবে নদী অনুপুস্থিত। এটা রজতের খারাপ লাগলো। তার ভিতরটা ভারাক্রান্ত হলো নদীর কথা ভেবেই। সে নদীকে খুঁজে বের করলো। নদী রান্নাঘরে জলচৌকির উপরে বসে আছে অবাঞ্চিতের মতো।
কিরে নদী এখানে বসে আছিস কেন? নে ধর খা। বলেই সাদা একটা মিষ্টি নদীর মুখে তুলে ধরলো রজত।
নদী রজতের এক হাত ধরলো। মিষ্টিতে কামড় বসিয়ে কিছুটা মুখে পুরে নিলো। অমনি দেখে রান্নাঘরের দরজায় শ্রাবণও এলো। তার হাতেও একটি সাদা মিষ্টি।
নদী অপ্রস্তুত হলো ভীষণভাবে। শ্রাবণও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখেই। শ্রাবণের প্রাণবন্ত চেহারা রুক্ষ হয়ে গেলো কিছু একটা ভেবেই। সে কিছু বলল না রজত ও নদীকে। নিঃশব্দ পায়ে সরে গেলো সেখান হতে।
নদীর বড় ফুফু রাফিয়াকে বেশ ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে। কিছুটা অন্যদের চেয়ে বেশী। সে রঙ চায়ের কাপে, হাতে ভাজা মুড়ি মিশিয়ে নিতে নিতে বলল,
আমাদের ঘরে আজ মহাৎসোব। আজকার এই সময়ে আমি বড় ভাইজানের কাছে ও মেজোভাবির কাছে একখান প্রস্তাব রাখতে চাই। বাকিরাতো আছেনই।
তারা অবাক চোখে কিহ বলে রাফিয়ার দিকে চাইলো।
সে দরদ মাখা সুরে বলল,
আরুকে রজতের জন্য আমার ঘরে নিতে চাই। তবে এখন না। তার পড়াশোনা শ্যাষ হইলে।
নাহ ফুফু। রজতের বিয়ে হবে নদীর সঙ্গে।
দ্বিতীয় কেউ কিছু বলার আগেই ভারি গলায় কথাটা বলে উঠলো নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান।
#চুপিসারে #রোমান্টিক ( কাজিন রিলেটেড)
চলবে…২