#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৩ ]
” উজ্জ্বল তোর মাথায় কি সমস্যা আছে?”
” না।”
“আমার তো মনে হচ্ছে তোর মাথায় সমস্যা আছে।”
” আমার মাথায় সমস্যা থাকলেও তোর আগাগোড়া পুরোটাতেই সমস্যা।”
” আমি তোর বউয়ের বড় আমি তোকে দুলাভাই ডাকবো?তুই আমাকে শালা ডাকবি?একটুতো রেস্পেক্ট কর।”
উজ্জ্বল যেন মজা পেল মুহূর্তে এক ঝলক হেসে থেমে গেল।
” তুই বয়সে বড় তবে বিচার বুদ্ধিতে না।তুই যদি বড় হতি তাহলে এসব ঝামেলার সমাধান চাইতি অন্যদের উস্কে দিতি না।”
” উজ্জ্বল মুখ সামলে কথা বল,ভদ্রতা শেখায়নি তোকে।”
” আমাকে কেউ ভদ্রতা শেখায়নি আর তোকে শিখিয়েও ভদ্র বানাতে পারেনি।পার্থক্যটা বুঝেছিস?”
” তুই বের’হ আমার বাড়ি থেকে।”
” বউ দিয়ে’দে চলে যাব।”
” কে বউ?কে তোর বউ?”
” নাটক করছিস কেন?”
” আমি নাটক করছি না।”
উজ্জ্বল রুদ্ধশ্বাস ছাড়ে।এসব ঝগড়া ঝামেলা আর মানা যাচ্ছে না।রাশেদ যে ভাঙবে তবু মচকাবে না তা বেশ ভালো করেই জানা আছে।
” রাশেদ তোর কাছে রিকুয়েষ্ট করছি ঝামেলা না বাড়িয়ে কমাতে চেষ্টা কর।”
” আমি ঝামেলা করেছি?নাকি তুই করেছিস?কে বলেছে আমার বোনকে বিয়ে করতে?তুই জানতি তোদের সাথে আমাদের সখত্য নেই তাহলে বিয়ে করলি কেন আমার বোনকে?”
” এমন ছ্যাত ছ্যাত করছিস কেন?তোর বোন রাজি ছিল বলেই বিয়েটা করেছি এমনি এমনি তো করিনি।”
” উজ্জ্বল তোকে পুলিশে দিতে মন চায়।”
” তো দে।মানা করেছি?”
” আব্বার কারণে এসব দাঁত খিচে আছি না হলে থানায় তোরে পার্মানেন্ট থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম।কুত্তার বাচ্চা কোথাকার।”
“খবরদার মা বাবা তুলে গালি দিবি না।”
” হাজার বার দিব কি করবি তুই?”
উজ্জ্বল চমৎকার হাসল।এগিয়ে এলো রাশেদের মুখোমুখি,
” ঝামেলা বাড়াতে চাই না আমার বউকে ফিরিয়ে দে।”
” আমার বোনের দায়িত্ব তুই নিয়েছিলি এখন যখন আমার বোন নিখোঁজ তখনি আমাদের দিকে আঙুল তুললি!ব্যপারটা এমনো তো হতে পারে তোর হাত থেকে বাঁচতে সে পালিয়েছে।না মানে আমি বুঝাতে চাইছি তোর মতো ছেলের সাথে অন্তত সংসার করা যায় না।”
উজ্জ্বল মুহূর্তে রেগে গেল।কালবিলম্ব না করে খুবলে ধরল রাশেদের শার্টের কলার।রাশেদ যেন আরো সুযোগ পেল উজ্জ্বলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলে দিল মেঝেতে।উজ্জ্বলের বন্ধুরা এগিয়ে আসতে উজ্জ্বল হাত ইশারায় থামতে বলে।শার্টের কলার ঠিক করে রাশেদ উজ্জ্বলের একপাশে বসে বলে,
” রুমু কোথায় আছে আমি জানি।যেখানেই আছে তোর রুমু ভালো নেই বুঝলি।তোর কাছে দুটো অপশন দিলাম,তুই রুমুকে ডিভোর্স দিবি কাবিনের সব টাকা শোধ করবি।”
” মরে গেলেও ছাড়বো না।ছাড়তে বিয়ে করিনি।”
” আহ পুরো কথাটা তো শোন।যদি ডিভোর্স না দিস তাহলে তোর বাপ মা আমার মায়ের এবং আমার পা ধরে মাপ চাইবে এই এলাকার সবার সামনে।”
উজ্জ্বল গাল ভরতি থুথু ছুড়ে দিল রাশেদের মুখে।অপমানে থমথমে হয়ে গেল রাশেদের মুখ।
” আমার বাবা মা মাপ চাইবে তাও কি না তোর মতো অসভ্য বর্বরের কাছ থেকে!এই কথা শোনার আগে তোর জিহ্বাটা পুড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল।তাছাড়া তোরা কোন ফেরেশতা যে আমার বাবা মা তোদের মতো দুইটা অমানুষের কাছে মাপ চাইবে?আমার বউকে আমি খুঁজে নেব যদি না পাই তোর বউ সামলে রাখিস বলা তো যায় না হঠাৎ দেখা গেল আমার বউয়ের মতো তোর বউও মিসিং।”
.
নিস্তব্ধ কক্ষে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে উজ্জ্বল।মাথা ভরতি দুশ্চিন্তা থেকে থেকে হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে।বিছানার এক কোণে তাকিয়ে উজ্জ্বলের চোখ ভিজে উঠে।নিজের অনুভূতির কাছে নিজেরি নিয়ন্ত্রণ নেই।কন্ট্রোললেস উজ্জ্বলের যখন হাসতে মন চায় হেসে ফেলে কাঁদতে মন চাইলে কেঁদে ফেলে যখন রাগ উঠে তখন লণ্ডভণ্ড সবকিছু।রুমুর বালিশটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির উজ্জ্বল।চাচা জানের নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে অথচ নাম্বারটা বন্ধ।এই ছাড়া কোন নাম্বার উজ্জ্বলের কাছে নেই।সময়টা বড্ড স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছে একবার,
শুধু একবার যদি সৈয়দ শামসুল সাহায্যের হাত বাড়াতো উজ্জ্বল একটা না একটা রাস্তা ঠিকি খুঁজে পেত।
নিদ্রাহীন উজ্জ্বলের সারাটা রাত কাটে দিনের আলো ফুটতে উজ্জ্বল আবার ব্যস্ত হয়ে যায় রুমুকে খুঁজতে।হিমেলের বাড়িতে গিয়েও উজ্জ্বল তল্লাশি চালায় তবে রুমুর খোঁজ নেই আশ্চর্য মেয়েটা কি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল!
উজ্জ্বলের অসময়ের সময়টা কেটে গেল আরো দুদিন।আজ তিন দিন হলো রুমুর খোঁজ পেল না উজ্জ্বল রাশেদের পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছে অথচ রাশেদের আচরণে তেমন কিছুই কারো চোখে পড়লো না।
.
সৈয়দ ইসমাইল ব্যবসায়ীক কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে আজ।তপ্ত গরমে জন জীবন অস্থির।আনিকা লেবুর শরবত এনে গ্লাসটা রাখল টেবিলে।
” কিরে মা কেমন আছিস?”
” ভালো আব্বা।আপনি ভালো আছেন?কাজ সব ঠিকঠাক ভাবে সেরেছেন?”
” হুম, সব ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে।আমি গোসলে যাব তুই লুঙ্গি গামছা নিয়ে বাথরুমে রেখে আয়।”
শ্বশুরের ভীষণ ভক্ত আনিকা।এত বছরে মেয়েটা অন্তত বুঝে ফেলেছে এই সংসারে যদি কোন মানুষ থেকে থাকে তবে তিনি হলেন সৈয়দ শামসুল বাকি দুজন তো অমানুষের কাতারে পড়ে।রুমুর কথা ভাবতেও তার গায়ে কাটা তুলে,নিজের সংসার বাঁচাতে রুমুকে ঠেলে দিল অন্ধকার জগৎটায় অথচ এমন ননদ কজনে পায়?রুমুর মাঝে কোন হিংসা বিদ্বেষ নেই,তর্কবিতর্ক নেই। মেয়েটা আনিকাকে নিজের বড় বোনের মতোই ভালোবাসে।গত কয়েকদিনে অপরাধবোধে নিংড়ে যাচ্ছে আনিকা।আর এসব মানা যায় না উজ্জ্বলকে সব কথা জানানো উচিত কিন্তু আনিকার কাছে কোন ফোন নেই, বাইরে বের হওয়ার সুযোগো নেই সব মিলিয়ে অপরাধবোধের পাল্লাটা ক্রমশ ভার হচ্ছে।
আনিকা যখন শ্বশুরের কক্ষে প্রবেশ করল তখনি তার হাত চেপে ধরল রাবেয়া।দ্রুত দরজা ভিড়িয়ে কড়া গলায় বলেন,
” খবরদার তোমার শ্বশুরের কাছে কিচ্ছু প্রকাশ করবে না।কিচ্ছু বলবে না তাকে বুঝতেও দেবে না এসবে তুমি জড়িত।”
” আ..আমি কিচ্ছু বলব না আম্মা।কিন্তু…”
” কি কিন্তু? “
” রুমুকে কাল দুপুরে খাবার দিয়েছেন আর তো..”
” চুপ কর।এত দরদ দেখাতে হবে না আমার মেয়ে আমি বুঝবো।খুব তো গায়ের জোর দেখিয়েছিল খা** এখন গায়ের জোর বের হবে।”
এক ধমকে আনিকা চুপসে যায়।মেয়েটা কোন মতে লুঙ্গি গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সময় গড়ায় উজ্জ্বল অপেক্ষায় থাকে সৈয়দ ইসমাইলের তিনি যে বাড়ি ফিরেছেন তাও উজ্জ্বলের জানা নেই।নিদ্রাহীন,অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া দুশ্চিন্তা সব মিলিয়ে ছেলেটার জীবনটা অন্ধকারে গোলকধাঁধাঁয় ডুবে গেছে।
রুমুদের আত্মীয় স্বজনদের উজ্জ্বলের চেনা আছে কিন্তু রুমুর খোঁজ কেউ দিতে পারলো না।উজ্জ্বলের জেদ জন্মে গেল আনিকার উপর শুধু একবার আনিকাকে একা পাওয়া যাক তারপর হাড়ে হাড়ে সব বের করবে।
রাশেদ রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে।ইদানীং থেকে থেকে বাতের ব্যাথাটা বড্ড বেশি জ্বালাতন করছে এর মাঝে মাঝ রাতে জ্বর, সব মিলিয়ে শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে তাই বাধ্য হয়ে আজ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেই হলো।যাওয়ার আগে অবশ্য আনিকাকে হুমকি ধামকি দিতে ভুলেননি।সৈয়দ ইসমাইল তখন ঘুমে বিভোর সন্ধ্যার পর তপ্ত আবহাওয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো দেখে শিউরে উঠছে আনিকার দেহ।আকাশ গর্জনে ভূমি কাঁপিয়ে বাজ্রপাত হচ্ছে। আনিকার মনে প্রশ্ন জাগে,রুমু নিশ্চয়ই একা ভয় পাচ্ছে?আনিকার দু’চোখ ছলছল করে দরজার চাবিটাও তার কাছে নেই যদি থাকতো অন্তত কিছু একটা করা যেত।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস আনিকার কখনো হয়নি রাশেদের ভালোবাসায় সর্বদা বুদ সে কিন্তু আজ যেন নিজের বিবেক তাকে প্রশ্ন তুলছে রুমুর বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?শরীরের চামড়ায় জ্বলন ধরছে কি করবে না করবে সব মিলিয়ে মানসিক ভাবে ভীষণ চাপে পড়ে গেল আনিকা।আচমকাই হুহু করে কেঁদে উঠে সে।মেয়েটা জানলায় কপাল ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদছে ভেবেছিল বৃষ্টির শব্দে রুমের বাইরে নিশ্চয়ই তার কান্না শব্দ যাবে না কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সৈয়দ ইসমাইলের কানে ঠিকি কান্নার শব্দ গেলো।তিনি ছুটে এসে আনিকার কক্ষে প্রবেশ করলেন,
” কিরে মা ভয় পাচ্ছিস?কাঁদিস না এদিকে আয় জানলা বন্ধ কর।”
” আমি একটা অন্যায় করেছি আব্বা।”
” কি অন্যায়?”
” আমি আমি…”
কান্নার দাপটে আহাজারি করতে থাকল আনিকা নিজেকে সামলে হেঁচকি তুলে বলে,
” আব্বা রাশেদের কথায় রুমুকে মিথ্যা বলে এই বাড়িতে এনেছি।আপনার ছেলে আর আম্মা মিলে মেয়েটাকে অনেক মেরেছে।মেরে বেঁধে রেখে দিয়েছে ছাদের চিলেকোঠার ঘরটায়।চারদিন হয়ে গেল দিনে এক বেলা খেতে দেয়। গতকাল থেকে খেতে দেয়নি, আব্বা মেয়েটা খুব কষ্টে আছে।আমি আমার সংসার বাঁচাতে অন্যায় করেছি আব্বা আমাকে আপনি শাস্তি দিন।”
চলবে…