#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩৫]
নিজ শরীরের ভারটা নিজেই নিতে হিমশিমে পড়তে হচ্ছে।শরীরটা বড্ড ভারী লাগছে কেন?হঠাৎ সবকিছু ধোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে কেন?পাপ পুণ্যের হিসাব হঠাৎ মাথা চড়া দিয়েছে কেন?হঠাৎ বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে কেন?আকাঙ্ক্ষা জাগছে মায়ের ভালোবাসা পেতে,আনিকাকে জড়িয়ে ধরে শান্তির ঘুম দিতে।হঠাৎ এসব কি হচ্ছে!
রাশেদ মুখ থুবড়ে পড়লো যেন হাত পা গুটিয়ে বসে আছে মেঝেতে।দরজা বাইরে থেকে বন্ধ রক্তাক্ত দা টা মেঝেতে পড়ে।সাদা মেঝেতে রক্তের ফোটায় কি বীভৎস লাগছে।
রাশেদ নির্বাক নিরুত্তর ভেতরের সত্তাটা বারবার ধমক দিচ্ছে শাসিয়ে যাচ্ছে তার কৃতকর্মে।রাশেদ বাক্যহারা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই গলাটা কেউ যেন অদৃশ্য হাতে চেপে ধরেছে।ভেতরের সত্তা কি তা মানে?সে তার উত্তরের আশায় বসে।রাশেদ আপন মনে ভেতরের সত্তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত হয়।
” কেন করলি এমন?তোর মাকে কেন মারলি?তুই ইতোমধ্যে যা করেছিস তা কি খুব ভালো?”
” আমি আম্মাকে মারতে চাইনি।আম্মাকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা আমি আনিকাকে…”
” আনিকাকে মারতে গিয়েছিস?মেয়েটা তোকে ভালোবাসেনি?নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছিল তোর জন্য কি না করেছে বলতো।”
” আমি আমি আসলেই ভুল করে ফেললাম।আমি নিজের অহংকারে এতটাই ডুবে ছিলাম ঠিক বেঠিক কিছুই বুঝতে পারিনি।”
” তোর সুখের দিন শেষ হলো বলে।আগে যতটা ঘৃণার পাত্র ছিলি এখন তার থেকে বহুগুনে তোকে সবাই ঘৃণা করবে।”
” আম্মা সুস্থ হোক আমি মাফ চাইব।আমি ভালো হয়ে যাব,হ্যাঁ আমি ভালো হয়ে যাব।”
” তোর আম্মা ফিরবে তো?”
” আম্মা ফিরবে না মানে?বাজে কথা বলছো কেন?”
” ফিরে আসার রাস্তা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে।”
রাশেদের কলিজা কেঁপে উঠলো প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু বলার আগেই ভেতরের সত্তা কোথায় উধাও হয়ে গেল তার হদিস নেই।
তখন ঘটনাটা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটেছিল কেউ বুঝে উঠতে পারিনি কি করবে।রাবেয়া মাথায় হাত রেখে ছিটকে পড়লেন মেঝেতে রক্তে ভেসে যায় তার সমস্ত দেহ।ইসমাইল স্ত্রীর এরূপ অবস্থায় কেঁদেই ফেললেন এতটা মর্মান্তিক ঘটনা তিনি এর আগে দেখেননি।আনিকা ছুটে গিয়ে ডাকল রুমুকে উজ্জ্বল তখন বাড়িতেই ছিল।আনিকার আহাজারি বিলাপে এলাকার সকল মানুষ এসে ভীড় জমায়।উজ্জ্বল দেরি করে না মাথা থেকে দা সরিয়ে রাবেয়াকে কোলে তুলে ছুটে চলে যায় রাস্তার দিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে রুমু ইসমাইল সহ অন্যরা।আনিকা বেরিয়ে যাওয়ার আগে থেমে যায় পেছন ঘুরে একবার তাকায় রাশেদের পানে।রাশেদের ভীতু মুখখানিতে থুথু ছুড়ে দেয়, রাশেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বাইরে থেকে দরজা লাগায়।যাওয়ার আগে উঠনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে দরজা যেন কেউ না খুলে রাশেদকে পুলিশে দেওয়া হবে।
রাবেয়ার নিথর শরীরটা টেনে হসপিটালে এসে থামল উজ্জ্বল।রাস্তায় যানজটের কারনে পাঁচ মিনিটের রাস্তায় তার বিশ মিনিটের উপরে লেগেছে।রিক্সায় থাকা কালিন রাবেয়ার শরীর দুইবার ঝাঁকুনি দেয় তার পরেই কেমন নিস্তেজ হয়ে যান তিনি তখনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছে উজ্জ্বল চাচি আম্মার কিছু হয়নি তো?
ইমার্জেন্সিতে রাবেয়াকে নেওয়া হলে তার পালস চেক করে ডাক্তার জানান রুগি তো বেঁচে নেই।বেঁচে নেই এই শব্দটা এতটা ভার যা একজন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন।
এম্বুলেন্সের সাইরেনে আশেপাশে সকলে এগিয়ে আসে সৈয়দ বাড়ির নিকট।সবাই এতক্ষণে নিশ্চিত নিশ্চয়ই মারা গেসে তাই তো এম্বুলেন্সে করে লাশ এনেছে।রাশেদ শুনতে পেল এম্বুলেন্সের শব্দ তবে বাইরে কি হচ্ছে কিছুই দেখতে পেল না জানলা থেকে উঠনের দিকটা একটুও দেখা যায় না।
রুমুর গায়ে রক্তে আর রক্ত
সেই সাথে উজ্জ্বলের শাটটা রক্তে ভিজে জবুথবু যেন রক্তের সাগরে গা ভাসিয়েছে।
যে উজ্জ্বলকে নিয়ে রাবেয়ার এত অভিযোগ এত হিংসা সেই উজ্জ্বল আজ তাকে বাঁচাতে হসপিটালে ছুটেছে।
এম্বুলেন্সের গাড়ির পেছনেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয় নিরিবিলি সৈয়দ বাড়িটা আজ লোক সমাগমে জমজমাট।
হসপিটাল থেকে ফেরার পথে আনিকা এবং ইসমাইল রাশেদের জন্য মামলার উদ্দেশ্যে থানায় যান থানায় মামলা করার পর পুলিশের সাথে সাথে তারাও এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়।
দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকায় রাশেদ।পুলিশ এসেছে দরজা খুলেই প্রথমে তার দিকে দৃষ্টি ফেলল তারা ভেবেছিল রাশেদ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে কিন্তু তাদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে অতি ঠান্ডা মাথায় রাশেদ এগিয়ে আসে এবং বলে,
” আমার আম্মা কি বেঁচে আছে?”
পুলিশ ভ্রু কুচকায় আসামি এত স্বাভাবিক কেন?পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছে না অদ্ভুত!
” না আপনার আম্মা বেঁচে নেই।তাকে হাসপাতাল নেওয়ার পথেই মারা যান।”
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
রাশেদ ঢোক গিলে।নিজের কৃতকর্মে নিজেই আজ লজ্জিত।ইসমাইল এগিয়ে এসে কষে চড় লাগান ছেলের গালে তাতেও হেলদোল হলো না রাশেদের।
ইসমাইল কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
” তোর এমন অবস্থা করব তোর ফাঁসির আদেশ হবে।ফাঁসি না হোক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।আপনারা জানোয়ারটাকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?”
পুলিশ রুমটা পর্যবেক্ষণ করছিল রাশেদ কিঞ্চিৎ হেসে হাত তুলে দাঁড়ায় এবং পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে,
” আমি আমার আম্মাকে খু ন করেছি সেচ্ছায় নয় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আমি এমন কাজ করেছি।যা করেছি তাতে আমি অনুতপ্ত তবে লাভ নেই জানি।এর আগেও আমি বেশকিছু ক্রিমিনাল মাইন্ডের কাজ করেছি আমার বোনকে বন্দী করে অত্যাচার চালিয়েছি তার সংসার ভাঙতে চেয়েছি।নিজের স্ত্রীর উপর শারিরীক মানসিক নির্যাতন চালিয়েছি।স্ত্রীর ভালোবাসাকে মর্যাদা না দিয়ে পরকীয়ায় জড়িয়েছি।”
রাশেদ থামলো পুলিশ অতিদ্রুত তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়াল।তাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনি এম্বুলেন্সের গাড়িটা ধরে বিলাপ দিয়ে কাঁদলো সে।রাশেদের স্বভাবের জন্য সবাই তাকে অপছন্দ করলেও রাবেয়া ভীষণ ভালোবাসতো তার একমাত্র ছেলেকে এক কথায় মাথায় তুলে রাখতো।প্রতিটা কাজে প্রতিটা ক্ষেত্রে রাশেদ রাশেদ বলে তার মুখে ফেনা ওঠার অবস্থা হতো।রাশেদের কখন কি চাই কি খাবে পরবে সব নিয়ে রাবেয়ার ছিল অত্যাধিক ব্যস্ততা।যার জন্য এত আয়োজন এত সময় ব্যয় সেই রাশেদের হাতে খু ন হলেন রাবেয়া এ যেনো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না কেউ।পুলিশের তো এত সময় নেই রাশেদকে যখনি টেনে নিয়ে যেতে চাইল তখনি সে উঠনের মাটি আঁকড়ে ধরল।তার কান্নায় ভারি হলো সৈয়দ বাড়ি।
” একবার উঠেন আম্মা শুধু একবার উঠেন।আমি ভালো হয়ে যাব সবার কথা শুনব।আনিকাকে নিয়ে সংসার করব বিশ্বাস করেন আনিকাকে ছাড়ব না।উঠেন না আম্মা ও আম্মা উঠেন।”
রাশেদের এত কান্না এত আহাজারি রুমুর কাছে নাটক মনে হলো সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল রাশেদের পানে।
” এত কাঁদছিস কেন?শান্তি লাগছে না তোর?শান্তি লাগার কথা।যা এবার বিয়ে কর এই সব সম্পত্ত নিয়ে যা আমার কিচ্ছু চাই না।”
” আমারো আর কিছু চাওয়ার নাই।”
রাশেদের আর সত্যিই কিছু চাওয়ার নেই।তাকে পুলিশ নিয়ে গেল সেই সাথে নেওয়া হলো রাবেয়ার লাশ।লাশকে পোস্টমর্টেম করা হবে সেই সাথে আইনি বেশকিছু নিয়ম রয়েছে।
.
সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলে মাকে খু ন করছে ছেলে এখন জেলে এই একটা কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।কেউ কেউ তো বলেছে মাথা নাকি শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছে।এলাকা সহ চারিদিকে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য সবাই ভীড় জমাচ্ছে সৈয়দ বাড়িতে।এই সংবাদ ময়নার কাছেও এসেছে সংবাদটি পাওয়া মাত্র ময়নার দাদির শরীরে কাটা দেয়, কত বড় জা নো য়ার এই ছেলেটা মানুষ খু ন করার সাহস রাখে!এই ছেলের কি ভয় ডর নাই?ময়না বিষণ্ণ মুখে বসে আছে দুচোখ তার ঝাপসা শরীর থেকে এখনো যেন রাশেদের গন্ধ আসছে।এই তো রাতেই মানুষটার সাথে থেকেছে সে এখন এসব কি শুনছে!ময়নার বিষণ্ণ মুখখানি দেখে দাদি সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,
” ময়না তোরে আল্লাহ বাঁচাইছে।শুকরিয়া কর।”
” সৈয়দ বাড়ির বউ হওয়ার স্বপ্ন রয়েই গেল দাদি।আমি কি আর বড়লোক হব না?বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন কি স্বপ্নই রইল।”
” চুপ কর মাতারি সবার আগে জীবন যদি বাইচা না থাকস বড়লোক হয়ে কি করবি?কষাইডারে বিয়া করতে কানতেছোস?”
” বাদ দাও দাদি আমার কপালটাই খারাপ।”
” মোটেই না।তোর বিয়া হইব বড় ঘরেই তোর বিয়া হইব।”
ময়না প্রত্যুত্তর করে না।চুপচাপ তাকিয়ে রয় আকাশ পানে।
রাতে জেলখানার বাইরে দাড়িয়ে আছে ময়না একবার রাশেদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা জেগেছে তার কিন্তু কি করে দেখা করবে?দেখা করার কি অনুমতি পাবে?যত দ্রুত সম্ভব তাকে কোটে তোলা হবে রাশেদের জামিন কখনোই হবে না তা সে জানে কেননা যে আপনজনরা রাশেদকে জেল থেকে মুক্তি করার কথা যারা লড়াই করার কথা তারাই আজ রাশেদের ফাঁসি চাইছে।হঠাৎ ময়নার চোখ পড়ল সিএনজি করে আনিকা এসেছে তার সাথে এসেছে অচেনা একজন ছেলে এবং মেয়ে।ময়নার নিকট ছেলে এবং মেয়েটাকে অচেনা মনে হতেই পারে কেননা সে আগে তো উর্মি আর তামিমকে দেখেনি কিন্তু আনিকাকে দেখেছে বহুবার রাশেদের ফোনে তাই তো চিনতে মোটেও সময় লাগল না।
আনিকাকে হঠাৎ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে ভেবেছিল তাকে হয়তো আনিকা চিনে ফেলবে তাই দ্রুত নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় তখনি ইটের সাহায্যে হোঁচট খেয়ে আনিকার সামনেই পড়ল ময়না।আনিকা সঙ্গে সঙ্গে তুলে দাড় করায় মেয়েটার বৃদ্ধা আঙুলের চামড়া ছিলে রক্ত ঝরছে আনিকার মায়া লাগলো দ্রুত হাতে থাকা টিস্যুটি চেপে ধরল ময়নার পায়ে।
” এত ছুটাছুটি করলে কেন?ইসস কত রক্ত ঝরছে।টিস্যুটা ধরে রাখো সামনে ফার্মেসি আছে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিও।”
ময়না কোন মতে ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে পালাল।আনিকা কি তাকে চিনতে পারলো না!মেয়েটার চোখে মুখে এত মায়া অথচ রাশেদ এই মেয়েকে ঠকাল!ময়না ভীষণ অবাক হলো সেই সাথে অবজ্ঞায় হাসলো।
আনিকা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশেদের সাথে আজকে এই মুহূর্তে শেষ দেখা করবে।দুজন দাঁড়িয়ে মুখোমুখি তবে সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলের শিকগুলো।শুরুতে কথা তুললো রাশেদ।
” আমাকে মাফ করে দাও আনিকা।আমি যা করেছি তাতে অনুতপ্ত।আম্মা আমার হাতে…. আমি ভাবতে পারছি না।”
রাশেদ কেঁদে ফেলল পুনরায় গলা ঝেরে বলে,
” বিশ্বাস করো আরেকবার যদি সুযোগ পাই নিজেকে পালটে ফেলবো।সংসারে মন দেব আম্মার সকল স্বপ্ন পূরণ করব।আব্বার মনের মতো ছেলে হব।তোমার চোখে দেখা সেরা স্বামী হব।”
আনিকা তাচ্ছিল্য হাসল।তার হাসিতে রাশেদ ঢোক গিলল এমনটা নিশ্চয়ই হওয়ার কথা ছিল।আনিকা দাঁত মুখ শক্ত করে বলে,
” নারী লোভী পুরুষ কখনো এক নারীতে তৃপ্তি পায়না।”
চলবে…