#অবন্তিকা_তৃপ্তি
কালচারাল প্রোগ্রামের আয়োজনের কাজে জুনিয়ররা মিলে ধ্রুবকে ধরেছে। সকল কাজে ধ্রুব ওদের গাইড দিবে আজ। ধ্রুব প্রথমে মানা করেছিল। কিন্তু একটাপর্যায়ে রাজি হয়ে যায়। জুনিয়রদের ধ্রুব বরাবর অন্য চোখে দেখে। ওর নিজের মধ্যে কোনো বিকাশ, যোগ্যতা খুঁজে না পেলেও ওই ছোট ছোট ছেলেপেলেগুলোকে দেখলেই ওর ভালো লাগে; ওদের চোখে ভাসা স্বপ্নগুলো ধ্রুবকে একবার হাসিয়ে তুলে নিজের ভাগ্যের প্রতি, তো আরেকবার কোথাও না কোথাও নিজেকেও স্বপ্ন দেখতেও শেখায়।
ধ্রুব কাজ শেষ করে সবে এসে বসেছে।আজ ইমন, বাকিরা কেউ নেই। ওরা রেডি হতে হোস্টেলে ফিরেছে। ধ্রুব তাই একাই একটা ছোট মাফিন কেক নিয়ে খেতে খেতে বসেছে বেঞ্চের উপর। হঠাৎ কয়েকটা জুনিয়র দৌঁড়ে এসে ধ্রুবর সামনে দাঁড়ালো, ধ্রুব তাকাল ওদের দিকে। একেকজন বললো- ‘ধ্রুব ভাই, রেডি হবেন না? প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে তো।’
ধ্রুব নরম কেকে কামড় বসাতে বসাতে বলল —‘ওসব রেডি হওয়ার ঝামেলায় আমি নেই। আমি আমার জিন্স-টিশার্টেই ঠিক আছি।’
জুনিয়ররা শুনলো না। বরং সবাই ধ্রুবকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জোড়াজোড়ি করতে লাগলো-‘ভাই, প্লিজ! আজকের দিনটা নিজেকে তৈরি করেন। হিরো লাগবে আপনাকে পাঞ্জাবিতে ভাই।’
‘পাঞ্জাবি? দূর হ বে, আমার পাঞ্জাবি নেই।’ —-ধ্রুব বিরক্ত হলো এবার।
জুনিয়র এবার একে অন্যের দিকে চেয়ে কাঁচুমাঁচু করতে করতে বলল —‘ভাই , আপনরা আপনার জন্যে কিছু এনেছিলাম। যদি রাগ না করেন—‘
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে চাইলো। সবার দিকে একবার চেয়ে গম্ভীর স্বরে চাপা রাগ দেখিয়ে বললো—-‘তোরা পিচ্চি ছেলেপেলে টাকার গাছ লাগাস নাকি? পাগলামি যত্তসব; দূর হ।’
ধ্রুবর কথা কেউই মানলো না। কেউ পা বাড়ালো না সামনে। জুনিয়র একটাকে সবাই মিলে ইশারা করলো। ছেলেটা ধ্রুবর দিকে ভয়েভয়ে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। ধ্রুব কেকের প্যাকেট দলাই-মলাই করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে ময়লা হাত জিন্সের উপরেই মুছে প্যাকেট হাতে নিল। প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এলো একটা ভীষণ সুন্দর কালো কুর্তা, আর সাদা পায়জামা।
ধ্রুব এসব দেখে ওদের দিকে কড়া মেজাজ নিয়ে তাকাল, বাকিরা ধ্রুবর এমন চাওনি দেখে গুটিয়ে গেছে ততক্ষণে। ধ্রুব রেগে গিয়ে বলল —‘এগুলা কি বাল-ছাল এনেছিস? আমাকে এগুলা পরতে দেখেছিস কোনোদিন? বাপের জন্মেই আমি পরিনা এসব। নিয়ে যাহ।’
ধ্রুব প্যাকেটের সবকিছু এলোমেলো করে আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে প্যাকেট বাড়িয়ে দিল জুনিয়র ছেলেটার দিকে। সবাইকে এড়িয়ে চলে যাবে বলে, উঠে দাঁড়াতে গেলে সবাই জেদ করে প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে রইল, অনুনয় করে বললো–‘নিয়ে নিন না ভাই। আমরা অনেক শখ করে এনেছি। আজ একবার অন্তত পড়েন।’
একটা ছেলে ধ্রুব সম্পর্কে তখনও তেমন কিছু জানে না। ও এবার পাকনামি করে সস্তা মস্করা করে বসলো ধ্রুবর সঙ্গে। টিপ্পনি কেটে বললো —‘ ভাই পরে নিন এটা, ভাবিও আজকে আপনার উপরে ক্রাশ খাবে একদম পাক্কা।’
ছেলেটা কথাটা বলে ফিক করে হাসল। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলল! বাকি জুনিয়রদের তখন মাথায় হাত পরলো। হতাশ চোখে, ভয়ভয় চোখে ধ্রুবকে দেখতে লাগলো ওরা। সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। ধ্রুব রেগে যাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ধ্রুব রেগে যাওয়ার আগে এখন থেকে কেটে পরাই উত্তম। ওরা প্যাকেটটা কোনরকমে বেঞ্চের উপর রেখে বোকার মতো হেসে বললো—
‘মাফ করে দিয়েন ভাই। ও নতুন, বুঝে নাই। সরি ভাইইই।’
বলেই দাঁত কেলিয়ে, তারপরই এক ভো দৌঁড়। ধ্রুব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ওর ভেতরে এতক্ষণ হাসি এলেও, ছেলেপেলেদের একটু ভয় দেখাতে ইচ্ছে হয়েছে বিধায় ওমন যমের মতো মুখ বানিয়ে ছিলো। ছেলেগুলো যেতেই ও কপালে দু-আঙুল চেপে হেসে উঠল নিঃশব্দে । প্যাকেটে রাখা কুর্তা বের করে গায়ের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো-
‘সত্যি কি এসব ভদ্র সমাজের পোশাক পরলে তুমি আমার প্রেমে পরবে, অদিতি? হাহ; যতসব ছেলেমানুষী কথা।’
________________
অদিতি শাড়ির কুচি সামলে তানিয়ার সঙ্গে এগুচ্ছিল। তানিয়া ওকে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিলো কিভাবে আজ সবার সামনে পারফর্ম করলে পুরো বিষয়টা সুন্দর দেখাবে। অদিতিও মন দিয়ে সেসব শুনছিলো। গেইট দিয়ে ঢোকার সময় দেখে প্রধান অথিতির গাড়ি এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে। তানিয়া সেটা দেখে ওকে দ্রুত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সামনে।
পারফরম্যার আরেকটা জায়গায় সবাইকে একসাথে রাখা হয়েছে। এখন সাহিত্যিক পারফরম্যান্স হবে, তারপরেই গানের পালা। অদিতি বসে বসে অপেক্ষা করছে। ওর চেয়ারে ঠেস দিয়ে রাখা ধ্রুবর গিটার। ও আশেপাশে চোখ দিয়ে খুঁজছে ধ্রুবকে। আজ একবার এখন অব্দি ওই ছেলেকে দেখা গেলো না। কোথায় সে কে জানে?
অদিতি আশপাশে ধ্রুবকে দেখতে না পেয়ে দোনামনা করে পাশে থাকা তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো -‘তানিয়া, তাকে দেখেছিস?’
তানিয়া স্ক্রিপ্ট পরছে, ও ছোট গল্পে অভিনয় করবে আজ। অদিতির কথা শুনে স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তেই মিটমিট হেসে জবাব দিল -‘কাকে দেখার কথা বলছিস? আমি তো কখন থেকেই কাউকেই দেখিনা।’
অদিতি তানিয়ার এমন টিটকারি করায় বিরক্ত হলো যেমন। চাপা গলায় গিটারের দিকে ইশারা করে বললো—-‘এই গিটারের মালিককে। আমাকে এটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেই লাপাত্তা। একটু পরেই আমার পারফরম্যান্স আসবে। তখন এটা যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়? তখন আবার আমাকেই ধরবে।’
তানিয়া সব শুনে স্ক্রিপ্টে মন দিয়ে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দিলো—‘ডোন্ট ওরি অদিতি। ধ্রুব ভাইর গিটার তো? কেউ চুরি করবে না। রিল্যাক্স।’
অদিতি শুনলো। ও তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। হাফ ছেড়ে মুখ বেজার করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর কি মনে করে আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল, গিটার হাতে এবার হেঁটে হেঁটে খুঁজতে লাগলো ধ্রুবকে। আশপাশে ওর চোখ দুটো খুঁজতে লাগল ওই বখাটে, গুন্ডা, একঘুঁয়ে মানুষটাকে। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ‘অ্যাই ধ্রুব’ বলে ডেকে উঠে। অদিতি ডাকের উৎস অনুসারে সামনে তাকাল।
ওটা কি ধ্রুব? ধ্রুব ইয়ামিন? অদিতির বুক ধপাস করে যেন লুটিয়ে পরলো। গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল সম্ববত।
ধ্রুব ইয়ামিন আজ কালো রঙের কুর্তা পরেছে। আজ অবাক করা ব্যাপার হিসেবে অত্যন্ত ডিসেন্ট ভঙ্গিতে ওর এলোমেলো চুল জেল দিয়ে সেট করা, কুর্তার হাত ফোল্ড করে রাখা; যার দরুন হাতের পুরুষালি লোম-ভেইনস দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর দেখতে লাগছে সেগুলো!
অদিতি চোখ বড়বড় করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইল বেহায়া-চুড়ান্ত নির্লজ্জের মতো। ধ্রুব আসছি বলে বড়বড় পা ফেলে এগুচ্ছিল। অদিতির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর নাকে ধ্রুবর ম্যান পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ ভেসে আসে।অদিতি মুহূর্তের মধ্যেই মোহে পরে যায় যেন। নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে পেছন ঘুরেও আবারো তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব কথা বলছে, কথা বলার ফাঁকে হাত নাড়াচ্ছে নিজস্ব ভঙ্গিতে, মাঝেমধ্যে কপাল চুলকে নিঃশন্দে হাসছে। আশেপাশে যেতে যেতে অনেকেই সালাম দিচ্ছে তাকে, সে হাত উঁচু করে ওদের ইশারা করে দেখাচ্ছে।
সব কিছুই অদিতির নজরে এলো। পুরোটা সময় ও অদ্ভুত ভাবে নির্লজ্জের মতোই চেয়ে রইল ধ্রুব ইয়ামিনের দিকে। অদিতি ভুলেই গেলো, ওর পারফরম্যান্স আছে।সঙ্গে এও ভুলে গেল, ও কেমন ফ্যামিলি থেকে এসেছে, কি ওর পরিচয়। জাত-মান-পরিচয় ভুলে কখন যে অদিতি হঠাৎ-একদম আচমকা ওই বখাটে, একঘুঁয়ে ধ্রুবর প্রেমে আ/হত—-ক্ষ/তবি/ক্ষত হয়ে গেল সেটা ও নিজেও বুঝতে পারেনি।
অদিতির ডাক আসবে আর দুজন পরেই। তানিয়া দৌঁড়ে এলো ডাকতে ওকে। অদিতি তখনও সম্মোহনের ন্যায় চেয়ে ছিলো ধ্রুবর দিকে। তানিয়া এসে অদিতিকে ধাক্কা দিল, এবার এতক্ষণে ধ্যান ফিরল যেন ওর। চমকে তাকাল ও তানিয়ার দিকে।
তানিয়া বিরক্ত হয়ে বলল -‘তোর পারফরম্যান্স আছে আর দশ মিনিট পরেই। দৌঁড়ে যা সামনে।’
অদিতি লজ্জায় পরে গেল। এভাবে ও একটা বাইরের ছেলের দিকে চেয়ে ছিলো এতটাসময়। ছিঃ; ভাবতেই গায়ে কাটা দিল যেন! অদিতি মুখটা অপরাধবোধে লুকিয়ে ফেলল, গিটার দেখিয়ে বললো–‘ এটা দিয়ে আসি আমি, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো প্লিজ।’
‘দ্রুত যা।’ -তানিয়া তাড়া দেখালো।
অদিতি শাড়ির কুঁচি একহাতে সামলে,অপরহাতে গিটার নিয়ে এগিয়ে গেল ধ্রুবর দিকে।যতই ধ্রুবর দিকে একপা এগুচ্ছে, ওর বুকের ধুকপুকানি ততই বাড়ছে। যেন হৃদপিন্ড ফেঁটে বেরিয়ে আসবে এখনি। ওর মনের মধ্যে যেন ভয়াবহ ঝড় বইছে। যেকোনো মুহূর্তেই ও এখানেই, এই অবস্থাতেই লুটিয়ে যাবে। অদিতি নিজেকে সামলাতে পারছে না আজ। ধ্রুবকে যতবার দেখছে, ও অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে শুধু।
অদিতি তবুও নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে গেল। ধ্রুবর পেছনে দাঁড়িয়ে ডাকলো—-
‘শুনুন।-‘ অদিতির গলা কাঁপছিল।
ধ্রুব কথা বলার মধ্যে ফিরে তাকাল। নীল শাড়ি পড়া অদিতিকে আপাদমস্তক দেখে ওর চোখ হঠাৎ করে ছানাবড়া হয়ে গেল। বুকটা যেন ধ্বক করে উঠলো। ধ্রুব তবুও নিজেকে সামলে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল —‘ হু, বলো।’
অদিতি গিটার বাড়িয়ে দিল। ধ্রুব সেটা দেখে গিটার নিতে নিতে বললো- -‘ঠিক করে ফেলেছো?’
ধ্রুব যদি খেয়াল করতো, দেখতো অদিতির হাতও কাঁপছিল। ধ্রুব সেটা লক্ষ করেনি তখনও। ও গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। নিজের দিকে আড়চোখে একবার চেয়ে তারপর আবার অদিতির দিকে তাকাল। অদিতি কি ওকে লক্ষ্য করেনি? ধ্রুব ইয়ামিন আজ কালো কুর্তা পরেছে? এতক্ষণে হাজারটা প্রশংসা শোনা শেষ ওর, সবাই বলেছে ধ্রুবকে নাকি আজ মারাত্মক লাগছে। অথচ অদিতি ওকে খেয়ালই করেনি?হঠাৎ করেই যেন ভীষণ আফসোস হলো ধ্রুবর।
অদিতি দাঁড়িয়ে আছে দেখে, ধ্রুব নিজের হীনমন্যতা লুকিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো -‘কিছু বলতে চাও, অদিতি?’
অদিতি মাথা তুলে তাকাল। দুজনের চোখে চোখ পরলো।আজ দুজনের মনই বেইমানি করছে বারবার। একে অপরকে দেখলেই দেখলেই অসভ্য হয়ে যাচ্ছে শুধু। শুরুতেই অদিতি বহু কষ্টে চোখ ফেরালো ধ্রুবর নেশালো চোখ-দুটো থেকে। মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল – ‘কিছু বলার নেই, আমি আসি।’
অদিতি ছুঁটে পালিয়ে এলো সেখান থেকে। ধ্রুব আহাম্মক হয়ে চেয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে। একটাসময় নিজেই নিজের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল -‘ও কি আমাকে লক্ষ্যই করলো না?’
#চলবে