#অবন্তিকা_তৃপ্তি
অদিতি ধ্রুবর চোখে চোখ রাখছে না। মাথাটা নিচু করে অস্বস্তিতে কাধের ব্যাগের ফিতে চেপে রেখেছে। ধ্রুব এবার অদিতির নিচু করে রাখা মুখটার দিকে একটু ঝুঁকে মেয়েটাকে দেখল, তারপর অদিতির থরথর করে কেপে উঠা ঠোঁটের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
‘চোখে চোখ রেখে কথা বলো, আমি শুনছি।’
ওমন ভরাট কণ্ঠস্বর শোনে অদিতি থমকে রইলো। ছেলেদের সঙ্গে পূর্বে টু শব্দটি না করা অদিতির জন্যে এটুকু করাই বড় সাহসের পরিচয়। অদিতি কি করবে?আতঙ্কে ডুবে মাথাটা তুলে ধীরে ধীরে তাকাল ধ্রুবর দিকে, চোখ রাখল ধ্রুবর ওই নিরেট, গাঢ় চোখ-দুটোতে। ধ্রুব অদিতির চোখটা দেখল, চোখের ভেতরটা দেখার চেষ্টাও করল। অথচ কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল সামনে দাড়িয়ে থাকা ওই ভীতু মেয়েটিকে ধ্রুবর কাছে।
ধ্রুব নিজস্ব ভঙ্গিতে ভ্রু নাড়াল, অদিতির যেটুকু সাহস দেখিয়েছিলো, সব ওই ভ্রু নাড়ানোতেই নড়ে উঠল। অদিতি সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরিয়ে এলোমেলো চোখ সরাতে লাগল। মাঝেমধ্যে ধ্রুবর চোখে চোখ পড়ছে, লোকটা অদিতির দিকে তীক্ষ্ম চোখে তখনও চেয়ে। হয়তো সেও মজা নিচ্ছে অদিতির ভয়কে-আতঙ্ককে।
তাই অদিতি এবার শ্বাস টেনে সাহস সঞ্চার করলো মনের মধ্যে। একবার ধ্রুবর দিকে চোখ রেখেই, সরিয়ে ফেলল! তারপর কিছুটা ধীমে স্বরে বললো —-‘আ-আমি আসলে অপ্রস্তুত বোধ করছ-ছি কদিন ধরে।’
‘ হুয়াই?’ -ধ্রুবর অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বর, যেন ও কিছুই জানে না।
অদিতি কিছুটা লজ্জা-অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল- ‘আপনার না-নাম মেলানো হচ্ছে আমার নামের সঙ্গে। আসলে, আমি, আমি এসবে অভ্যস্ত নই। আপনি যদি একবার বলে দিতেন ওদের, যে আমাদের মধ্যে—‘
ধ্রুব ভ্রু বাঁকাল, অদিতির কথা আটকে গেল তক্ষুণি! পাশ থেকে সুমন ঠাট্টা করে বলে উঠল- ‘ভাবি আপনি না কি যে মশকরা করেন। ধ্রুব ভাই কি করবে এটাতে? এটা তো পুরো ভার্সিটি ছড়ায় গেসে, তাইনা? ধ্রুব ভাইর কথায় কেউ কি মেনে নিবে যে আপনি আর ভাই- বাদ দিন. হবে না ভাবি।’
এক বাক্যে দুবার ‘ভাবি’ বলা অদিতিকে ধ্রুবর সামনে বড্ড নার্ভাস করে দিচ্ছে। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ! তবুও বুকে সাহস নিয়ে এবার করুন চোখে তাকাল অদিতি ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব দেখল ওই টলমলে চোখ-দুটো। যা দীঘির মতো শান্ত, অথচ ভেতরটা চঞ্চল ভীষণ। অদিতি কাতর গলায় বললো-‘
‘প্লিজ! আমি বড় বিপদে পরে এসেছি। ভার্সিটির এসব শুনলে আমার বাবা আমাকে খু/ন করে ফেলবে, বিশ্বাস-‘
‘আই হ্যাভ নাথিং ইন ম্যাই হ্যান্ড। আমি তো ওগুলো ছড়াইনি, রাইট?’ -ধ্রুব অদিতির কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নিজের কথা তুলে উঠলো।
অদিতি কি বলবে? কথা তো সত্য! অদিতি এবার গলার স্বর আরও একটু নরম করে বললো-‘আপনি বললে হয়তো ওরা এসব থামাবে।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তখনও দেখছে অদিতিকে। অদিতির নরম কণ্ঠ ওর মনটা হয়তো কিছুটা নরম করেছে। তাই সে ভরাট স্বরে বললো-
‘ওকে, ফাইন! আমি সতর্কত করবো ওদের, বাকিটা ওদের ইচ্ছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।’ —অদিতি হাসার চেষ্টা করল।
ধ্রুব দেখল-ওই হাসি! মৃদু হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত হয়েছে, চোখ ছোট করা হয়েছে, গোলগাল গাল নড়ে উঠেছে- বড্ড উপভোগ্য লাগল দৃশ্যটা ধ্রুবর কাছে? কেন লাগল, ও জানে না। শুধু জানে- হাসিটা সুন্দর; বেশ মায়া-মায়া ভাব আছে ওতে।
ওই যে- অদিতি চলে যাচ্ছে। বলা যাচ্ছে- পালাচ্ছে! কার থেকে? ধ্রুব ইয়ামিনের থেকে? অদিতি এলো, ধ্রুবকে অনুরোধ করলো, আর অনেকখানি হাসল! তারপর আবার চলে গেল! পুরো ব্যাপারটা ধ্রুবর বন্ধুরা ভীষণ এনজয় করলো। ওদের একজন মেদহীন ধ্রুবর পেটে গুঁতো দিয়ে বললো-
‘ভাবি আমাদের সেই পছন্দ হয়েছে, কথাবার্তা একদম গোছানো। কিন্তু বাপরে ভয় পায় বেশি মনে হচ্ছে। এই মেয়ের দ্বারা জীবনেও প্রেম হবে না, ভাই।’
ধ্রুব এবার শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হলো। ওর দিকে চেয়ে সরাসরি বললো -তোরা? ওকে ভাবি ডাকবি না আর। মজা অনেক হয়েছে, আর না। এখানেই স্টপ কর সব।’
ধ্রুব কথাটা বলে বাইকের চাবি আঙ্গুলের ডগায় কৌশলে ঘুরাতে ঘুরাতে বাইকের দিকে এগুলো। পেছনে সবাই হতভম্ব হয়ে ধ্রুবর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। পাশ থেকে ইহান বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল- ‘ধ্রুব কি ওই মেয়েটাকে পছন্দ করতো না? এমনি-এমনি হুদাই এতকিছু রটে গেল?’
রাজন বলল- ‘ভাই তো ভাবিরে ভাবি ডাকতে মানা করে গেল। তার মানে কিছুই হয়তো ছিলো না।’
সুমন পাশ থেকে ওদের সব কনফিউশন দূর করে উত্তর দিল-‘ ধ্রুব ভাই আর প্রেম! মেয়েটারে সবাই বাথরুমে দেখছিল ধ্রুবর সঙ্গে। তাই ওগুলো রটে গেছে, তেমন কিছু না।’
‘ বাথরুমে?’- পাশ থেকে সবার থুতনি ঝুলে পড়েছে বিস্ময়ে।
সুমন সবার দিকে চোরা চোখে চেয়ে থতমত খেয়ে গেল, দ্রুত বলে উঠল-
‘আরে বাথরুম মানে, ওই বাথরুম না। বাথরুমের বাইরে ভাবি মুখ মুছতে এসেছিল, তখন দেখা হইসে। বা*, কিছু মুখ থেকে বাইর করতে পারি না, সবকিছুর ডাবল মিনিং বের করাই লাগবো তোদের।’
____________
ধ্রুব খাবার টেবিল বসে আছে। ওর সামনে কাচ্চি প্লেটে তুলে রাখা। পাশ থেকে একজন কাজের মহিলা ধ্রুব এবং ওর বাবার প্লেটে স্যালাড তুলে দিচ্ছে। ধ্রুব খাচ্ছে, ওর সামনে বসে আছেন ধ্রুবর বাবা সৌরভ ইয়ামিন।ধ্রুবর সামনে, টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট, তার পাশেই বাইকের কালো রঙের চাবি, তার পাশে সানগ্লাস! একটু আগেই একটা সিগারেট অর্ধেক খেয়ে সেটা ট্রে তে পিষে ফেলে খেতে বসেছে। সবকিছুই করেছে সৌরভ ইয়ামিনের সামনেই। সৌরভ সবই দেখেন! কিন্তু বাধা দেননি কোনোদিন। ছোটবেলায় ভেবেছিলেন শাসন করলে, ছেলে মানুষ হবে। ভুল ছিলেন সৌরভ! বরং মা হারা ছেলেটা উনার শাসনে জেদি-উশৃঙ্খল হয়ে গেছে। উচ্ছন্নে গেছে একদম!
একটাসময় ধ্রুব খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল-‘ কি বলবে, বলো। আমি খেয়ে একটু শুবো।’
টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটের থেকে চোখ সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। ছোট করে শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন- ‘ভার্সিটি ঠিকঠাক যাচ্ছে তো ধ্রুব?’
‘ হু।’ -ধ্রুবর ছোট উত্তর।
সৌরভ ভেবেছিলেন, ছেলের সঙ্গে কটা কথা বলবেন, গল্প করবেন। কিন্তু ধ্রুবর এমন ছোট উত্তরে উনি কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। এবার নিজে কথা তুললেন-
‘শুনলাম ভার্সিটিতে একটা মেয়ে-‘
‘ওগুলো গুজব; নাথিং সিরিয়াস।’- ধ্রুবর নির্বিকার উত্তর।
সৌরভ তবুও আশা ছাড়লেন না। ছেলেকে উষ্কে দিতে হাসিখুশি ভাবে বললেন-
‘যদি পছন্দ হয় বলতে পারো, ধ্রুব। কাউকে পছন্দ করা খারাপ কিছু না।’
ধ্রুব তাকালো সৌরভের দিকে। ওর চোখ-দুটো বরাবরের মতোই শান্ত-অনুভূতিহীন! বরাবরের সৌরভ বড় আশা নিয়ে বললেন বললেন-‘ ডু ইউ লাভ হার, ধ্রুব?’
ধ্রুব হাসল। বিশ্রী হেসে, বাবাকে আশাকে অপমান করে বলল- ‘তোমার কি মনে হয়? ধ্রুব ভালোবাসতে পারে কাউকে? ধ্রুবর মধ্যে ওমন উইয়ার্ড গুন আছে?’
ধ্রুবর টিটকারীর গলা। ধ্রুবর নিজের উপর উদাসিনতা যেন সৌরভ বাবা হয়ে মানতে পারলেন না। এসব মেয়ে ছেলেদের পাল্লায় ধ্রুব কখনোই পড়েনি। কিন্তু সৌরভ চান- ধ্রুব প্রেমে পড়ুক। আকাশ-বাতাস মিথ্যে করে এলোমেলো ধ্রুবও কাউকে ভালোবেসে গোছালো হোক! বাবা হিসেবে সৌরভ এটুকু লোভ বড় শখ করে করেন। সেজন্যে এর আগেও, অনেক নামিদামি লোকের মেয়ের নাম্বার এনে দিয়েছেন ধ্রুবকে। দেখা করার জন্য অনেক অনুরোধও করেছেন। কিন্তু ধ্রুব দেখা করেনি, উল্টো মেয়ে কল দিনে সেই ভেবে মেয়ের নাম্বার ব্লক করে রেখে দিয়েছে।
সৌরভ ভাবলেন, ওই মেয়েটা সম্বন্ধে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করবেন, তারপর দেখবেন ধ্রুবর রিয়াকশন কেমন? সে যা শুনেছে- সেই হিসেবে ধ্রুবর আচরণ ওই মেয়ের প্রতি কিছুটা আলাদা। মনের কোথাও আশা পুষেছেন সৌরভ! সৌরভ কিছুটা ভ্রু কুঁচকে ধ্রুবকে লক্ষ্য করেন। ধ্রুব আনমনে খাচ্ছে। সৌরভ একপর্যায়ে বলে উঠেন- ‘মেয়েটার নাম কি, একটু বলো। তোমার জন্যে এক মেয়ের চরিত্র নিয়ে গুজব রটে গেল, ব্যাপারটা তো সামলাতে হবে আমার।’
ধ্রুব সময় নিল না, বললো -‘আমি ওকে লক্ষ্য করিনি। আই ডোন্ট নো হার ফেইস এক্স্যাক্টলি।’
সৌরভ হতাশ শ্বাস ফেললেন! কি আর বলবেন তিনি! যা বলার, যা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার- ছেলে এক কথাতেই সব কিছুর ইতি টেনেছে।ধ্রুব খেতে খেতে বলল-‘যে কাজের জন্যে এনেছো বলে ফেলো। এসব ফাউল কথা বলে সময়টা নষ্ট করোনা।’
ধ্রুবর কাঠখাট গলায় সৌরভ এবার সরাসরি চলে গেলেন অন্য কথায়! বললেন-
‘মহাখালির দিকে আজ একবার যেতে হচ্ছে তোমার। ওদিকে পোলাপাইন ফ্যাক্টরিতে কিছু ঝামেলা করছে। মিটমাট করে আসো।’
‘ছবি-নাম পাঠিয়ে দিয়ো।’ -ধ্রুব তাচ্ছিল্য হেসে প্লেটেই হাত ধুয়ে উঠে গেল!
ধ্রুব চলে যেতেই সৌরভ ছেলের যাওয়ার দিকে মলিন চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ছোট করে শ্বাস ফেলে বললেন-
‘আমি হয়তো তোমাকে কখনোই বোঝাতে পারব না ধ্রুব, আমাদের বাবা-ছেলের সম্পর্কটা শুধু দেওয়া-নেওয়া কখনোই ছিলো না। ওসব তোমার মনের ভুল, রাগ, এরবেশি আর কিছুই না।’
#চলবে
গল্পটাকে অসম্ভব ভালোবাসা দেবার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।