#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুব স্বভাবতই তার আড্ডাখানা ‘বট তলায়’ এসে দাঁড়িয়েছে, সঙ্গে আছে ওর থ্রি ইডিয়েটস গ্যাং। ধ্রুবর হাতে নষ্ট গিটারটা। ও সেটা বাইকের উপর রেখে এসে বেঞ্চে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেছে। দুহাত বেঞ্চের উপর ঠেস দিয়ে পিঠ পেছনের দিকে হেলিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে আশপাশে তাকাচ্ছে শুধু। ইমন এবং বাকিরা একে অপরের দিকে অবাক চোখে চেয়ে দেখছে। আজ ধ্রুবকে বড্ড অন্যরকম দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে- ওর মেজাজ ভীষণ ফুরফুরে আজ। ইমন ধ্রুবর দিকে চেয়ে খোঁচা দিয়ে বললো-
‘খোকাবাবু কি প্রেমে পরেছেন?’
ধ্রুব উত্তর দিল না। অথচ শিষ বাজানো বন্ধ করে দিয়ে ইমনের দিকে চেয়ে ভ্রু বাঁকাল। ইমন এবার ধ্রুবর দিকে চেয়ে নিজেও ভ্রু কুঁচকে কৌতুক গলায় শোধালো-
‘প্রেম; আহা! আশপাশে বইছে প্রেমের ধারা! কে জানে, এই প্রেম কখন ছড়িয়ে গেছে আমার, তোমার, বা আওয়ার রাফ টাফ ধ্রুবর মনেও। ‘
নিজের মনে কবিতা তৈরি আবৃত্তি করে বলল ইমন। কবিতা বলে বড্ড খুশিখুশি হয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল-‘দেখ, কেমন কবিতা বানায় তোদের ভাই। আমাকে যে কেন সাংস্কৃতিক ক্লাব থেকে রজেক্ট করলো, ওই ব্যাডাদের ধরে ধরে কাচা গু খাওয়ানো উচিত। ট্যালেন্ট চিনে না, অথচ বসে গেছে জাজ আসনে।’
বলে কলার ঝাঁকাল ইমন। ধ্রুব তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে, ইমনের কথা শুনে বাকিরা একে অপরের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে তারপর আচমকাই ধ্রুব ফিক করে হেসে উঠল। ধ্রুবর সাথেসাথে এবার হাসল বাকি দুজন। ইমন বোকার মতো ওদের হাসি দেখছে। ধ্রুব হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে ইমনের কাঁধে হাত রেখে ওর উপর শরীরের পুরো ভর ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পরলো। প্রচণ্ড মজা পেয়েছে যেন ইমনের কথাটায়, ধ্রুব হেসে বলল -‘এটা কবিতা আবৃত্তি ছিলো? মামা, গো এন্ড গেট সাম ব্যাসিক হিউমার বুকস।’
বাকিরাও একে একে শব্দ করে হেসে ইমনের গায়ে লুটিয়ে পরলো। ইমন মুখ ভার করে ওদের দিকে চেয়ে দেখল। তারপর ধাক্কা দিয়ে সবাইকে নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে ভারিক্কি গলায় বলল-
‘বন্ধু নামে তোর একেকটা কলঙ্ক। তোদেরতো জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত মানহানির মামলায়।’
ধ্রুব হাসি থামে, আবার বসল বেঞ্চে। সিগারেট ধরাল এবার একটা। ইমন ওদের সবাইকে অনেকটা এখনও কড়া মেজাজে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ ইমনের চোখ গেলো বাইকের উপর; গিটার বেঁধে রাখা যেখানে। ইমন গিটারের এত করুন অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে গিটার ছুঁয়ে হতভম্ব গলায় বলল -‘আই ধ্রুব; এই গিটারের এতো করুণ অবস্থা ক্যান?’
ধ্রুব হেলায় তাকাল গিটারের দিকে।পরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে গা-ছাড়া ভাবে বলল- ‘আমি করেছি।’
‘তুই?’ – ইমন এবার যারপরনাই অবাক। ধ্রুব নিজের হাতে তার এত শখের গিটারের এই করুন হাল করেছে!
ধ্রুব সিগারেটের ধোঁয়া উপরের দিকে ছাড়তে ছাড়তে নিজের মতো করেই জবাব দিল -‘হ্যাঁ, কারণ এটা কেউ ঠিক করে দিতে আসছে।’
‘ঠিক করে দি…’ ইমন বাকি কথা শেষ করতে পারেনি; তার আগেই রাজু ফিসফিস করে সবাইকে বলল –
‘ভাই, ভাবি এদিকেই আসছে।’
ধ্রুব সিগারেট মুখে নিয়ে তাকাল সামনে। অদিতি জোরোসরো ভঙ্গিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। এক পা এগুচ্ছে, তো আরেকবার আশপাশে তাকাচ্ছে। ধ্রুব মনেমনে হাসে; মেয়েটা ভরা ভার্সিটিতে ভয় পাচ্ছে, কেউ বুঝি ওর ছবি তুলে ফেলল, ওর ছেলেদের সাথে বলা কথাগুলো লিক করে দিল। অথচ বোকা মেয়ে এটা জানেনা: এটা ধ্রুবর ভার্সিটি। এখানে ধ্রুব যা চায়, যেভাবে চায়, সেভাবেই সব ঘটে এসেছে এবং ঘটে যাবে। ধ্রুব ইয়ামিনের কাউকে ভালো লেগেছে, কোনো শালার সাহস হবে না ধ্রুবর ওই জিনিসের দিকে নজর দেওয়ার! ছবি তোলা তো দূরের কথা।
অদিতি ধীরে ধীরে হেঁটে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ধ্রুব ততক্ষণে অদিতির থেকে চোখ সরিয়ে আনমনে সিগারেট ফুঁকছে। যেন সে অদিতিকে এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি। অদিতি ধ্রুবর সামনে দাঁড়াতেই, ইমন নিজের হতভম্ব ভাব কেটে স্বাভাবিক গলায় হেসে জিজ্ঞেস করল-
‘আরে ভা- অদিতি কেমন আছো? কোনো দরকার?’
অদিতি হাসার চেষ্টা করলো, ফাঁকা ঢোক গিলে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল-‘আপনার গিটারটা-‘
ধ্রুব এবার তাকাল অদিতির দিকে। অদিতি ওই তাকানোতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সেঁটিয়ে গেলো। ধ্রুব সেসবের ধার আজ ধারলো না। ইমনের দিকে ইশারা করে বলল -‘ইমন, গিটারটা ওকে দিয়ে দে।’
ইমন ধ্রুবর দিকে চেয়ে ভ্রু বাঁকালো, ধ্রুব নিজের মতো করে বসে আছে। হয়তো এটা ধ্রুবর কোনো প্ল্যান, তাই ইমন আর দুবার ভাবলো না। চুপচাপ গিটার খুলে অদিতির হাতে ধরিয়ে দিলো। অদিতি গিটার হাতে নিয়ে, ওটাকে দেখে রীতিমত হতবম্ব হয়ে অল্প আওয়াজ চেঁচিয়ে উঠল-‘আল্লাহ, এ কি অবস্থা এটার? আমি তো এটাকে এতটাও নষ্ট করিনি।’
ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। অদিতি ধ্রুবর ওই চাওনি দেখে বিড়াল ছানার ন্যায় মিনমিন করে থেমে গেলো। ও আলগোছে গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে বলল -‘আ…আমি ঠিক করে আনবো কালকে।’
‘ গুড গার্ল।’ — ধ্রুব আগের মতোই নির্বিকার!
অদিতি তারপর আর একবারও ভুলক্রমেও তাকালো না ধ্রুবর দিকে, গিটার হাতে চলে যাচ্ছে ও। ধ্রুব ও যেতেই সিগারেট রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ধরে উঠে দাঁড়ালো। ইমন পাশ থেকে বলল -‘অযথা মেয়েটাকে জ্বালাচ্ছিস। পছন্দ করলে ডিরেক্ট বলে দে না।’
ধ্রুব বাইকে চেপে বসে ইঞ্জিন চালু করতে করতে জবাব দিল শান্ত স্বরে-
‘যত জ্বলবে, তত ধ্রুবকে চিনবে। যতদিন না ধ্রুবকে চিনছে, ততদিন জ্বলুক না?’
________
সেদিনের কয়েকদিন পরেই আসে ‘কালচারাল প্রোগ্রামে ২০২৪’ এর ফাইনাল দিনটা।পুরো বিশ্ববিদ্যালয় যেন আজ নতুন রঙে সেজেছে।সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন বাতি দিয়ে সাজিয়ে রাখা,হরেক রকম ফুল দিয়ে সদর গেইট সাজানো হয়েছে, অতিথিদের বরণ করার জন্যে মালা আনানো হয়েছে, ফুল-চকলেটস এর ঢালা সাজানো হয়েছে। যাকে বলে হইহই-রইরই অবস্থা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে।
ওদিকে কাঠের পুরনো দিনের আলমারির সামনে ভ্রু কুঁচকে, কোমরের দু পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। ও আজ কি পরবে সেটাই এতক্ষণ ধরেও ভেবে পাচ্ছে না। ওর আজ পারফরম্যান্স আছে। গান গাইবে সে ওতগুলো মানুষের সামনে। তবে সেটা লুকিয়ে। তানিয়া কথা দিয়েছে ওকে, কেউ অদিতির ভিডিও করবে না, ছবি তুলবে না। এটা দেখার দায়িত্ব তানিয়ার নিজের।অদিতির বাবা কোনোদিন জানবে না, অদিতি আজ ওতগুলো লোকের সামনে গান গেয়েছিলো। অদিতি তানিয়ার কথায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছে এখন।
প্রথমে অদিতি ভেবেছিল, লাল রঙের আনারকলি জামা পরবে। কিন্তু তানিয়া কোথা থেকে একটা নীল শাড়ি এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। অদিতি মানাও করতে পারেনি, তানিয়া রীতিমত ধরেবেঁধে শাড়িটা পরিয়ে হালকা সাজিয়েও দিয়েছে। এতগুলো গনমান্য লোক আসবে, যে-সে ভাবে তো তাদের সামনে পারফরম্যান্স করা যায়না।
সাজ শেষে তানিয়া ঘড়ি দেখলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদের। তানিয়া তাড়া দেখালো এবার, অদিতি রুম থেকে বেরোনোর আগে ধ্রুবর গিটার তুলে নিলো হাতে। তানিয়া ধ্রুবর গিটার মুহূর্তেই চিনে ফেললো, অবাক হয়ে প্রশ্ন করল -‘অ্যাই, এটা ধ্রুব ভাইর গিটার না? এটা তোর রুমে কেন?’
অদিতি চাপা স্বরে মুখ লুকিয়ে বলল -‘অব…ঠিক করাতে এনেছিলাম।’
‘তুই ঠিক করাতে এনেছিস? ধ্রুব ভাই নিজে দিয়েছে ঠিক করাতে?’ —তানিয়া কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বললো।
অরিতি সরল মনে জবাব দিলো—-‘ আমি সেদিন এটা নষ্ট করে ফেলেছিলাম না? তাই আমাকে এরা ঠিক করানোর জন্যে জোর করে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এত বাজে অবস্থা ছিলো এটার, আমার কতগুলো টাকা গচ্ছা গেছে জানো?’
তানিয়া হা করে অদিতির বলা ধ্রুবর প্রতি অভিযোগগুলো শুনছিল। অদিতির কথা শেষ হতেই, তানিয়া এবার ফিক করে হেসে উঠলো। অদিতি বোকার মতো ওর হাসি দেখে বলল -‘হাসছো কেন?’
তানিয়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে এগিয়ে এসে দু-কাঁধ আগলে ধরলো অদিতির, ওর গালটা টেনে দিয়ে হেসে বলল —‘হাসছি কারণ তুই অনেক ভোলা। আহারে, কিভাবে যে সামনে তোর মতো একটা মেয়ে ওমন রাফ-টাফ মানুষকে সামলাবে, গড নোউজ।’
অদিতি ভ্রু বাঁকালো— ‘আমি আবার কাকে সামলাবো?’
তানিয়া হেসে উঠে অদিতিকে ঠেলতে ঠেলতে রুমের বাইরে নিতে নিতে বলল -‘সেটা সময় বলবে, গার্ল। এখন চল, দেরি হচ্ছে আমাদের।’
#চলবে