#ডিভোর্স শেষ পর্ব
রায়হান বৈশাখীকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করতে লাগলো, এদিকে বৈশাখীর অবস্থা দিনদিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, ডাক্তাররা বারবার তাগাদা দিচ্ছে রায়হানকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করতে দেওয়া হয়েছে, শুধু বাকী ছিল টাকার। সেটাও আজকে পাওয়া গেল। রায়হান সুখবরটা দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গেল।
গিয়ে তো রায়হান অবাক, বৈশাখীর রুমে বসে আছে ফারহানা আর রুহী। বৈশাখীর মাথার কাছে বসে আছে রুহী,
বৈশাখী হাপাতে হাপাতে কথা বলছে, এই কদিনেই ও বিছানার সাথে মিশে গিয়েছে। ফারহানা বৈশাখীর হাত ধরে আছে। রায়হান ভিতরে ঢুকলো না।
বৈশাখী গল্প করছে, ওর জীবনের গল্প, ও যখন চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে তখন ওর মা মারা যায়, সবার চাপাচাপিতে বাবা আবার বিয়ে করে। কিন্তু সৎমা বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওর পরে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন চালাতো।ঠিকমত লেখাপড়া করতে দিত না, বাসার ভারী কাজ করাতো, এর ফাঁকে ফাঁকেই যেটুকু সময় পেত সে সময়ে পড়েই ও ভাল রেজাল্ট করতো। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। এসব শুনে ফারহানার চোখে জল চলে আসলো, ফারহানা বৈশাখীর হাতটা শক্ত করে ধরলো।
মানুষের জীবনে এত কষ্টও আছে? জীবনে কোনদিন এসবের মুখোমুখি হতে হয়নি তো, তাই জানেই না। বৈশাখী আবার বলতে শুরু করলো, যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো, তখন থেকেই রায়হান স্যারের ক্লাস সবচাইতে বেশী উপভোগ করতো, কারন স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন। ফার্স্ট সেমিস্টারে ও প্রথম হয়। তখন থেকেই রায়হান স্যার ওকে বিভিন্ন সময়েই আলাদাভাবে নোট দিয়ে সাহায্য করতো, এর মধ্যেই একদিন ও ক্লাসে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ওর মাথার সমস্যা তখনই ধরা পড়ে। রায়হান স্যার ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, ও নিষেধ করেছিলো, কিন্তু স্যার তখন বলে, আমার বোন থাকলে তার জন্যে করতো না? স্যারকে আমার ভাইয়ের মতই জানি, সত্যিই যদি আমার এমন একজন ভাই থাকতো? জানেন ম্যাডাম? স্যারের জন্যই আমি এখনও বেঁচে আছি। আবার শুনলাম কে যেন একজন ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। আসলে জগতে এখন অনেক ভাল মানুষ আছেন। বৈশাখী কথা বলতে বলতে দূর্বল হয়ে পড়লো, এমন সময় রায়হান ঢুকলো ঘরে।
ফারহানা বেরিয়ে গেল রুম থেকে, রুহী বললো বাবা তুমি? হ্যা মা, কিন্তু তোমরা কখন এলে, আর কেনই বা এলে?। মা আমাকে নিয়ে এসেছে, জানো বাবা, মা এর চিকিৎসার জন্য ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়েছে, যদিও কাউকে বলেনি। কি বললে, রুহী? এই টাকা তোমার মা দিয়েছে? হ্যা ক্যানো? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?।
রায়হান বেরিয়ে গেল ফারহানার খোঁজে, ফারহানা এক কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ছে, রায়হান ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ওর দিকে তাকাতে পারছেনা ফারহানা। রায়হান বললো, তুমি এতগুলো টাকা দিয়েছো? হ্যাঁ, তোমার স্ট্যাটাস দেখলাম ফেসবুকে, মেয়েটার চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে, তাই দিলাম। খুব ভাল করেছো, মেয়েটাকে হয়তো বাঁচানো যাবে।
রায়হান ফারহানাকে নিয়ে হাসপাতালের ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, বললো রায়হান। চুপ করে থাকলো ফারহানা, জানো? আমার জীবনটাও ঠিক এমনই।ছোটবেলা থেকে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি, মানুষের বাড়ী বাড়ী ঘুরে ছাত্র পড়িয়ে লেখাপড়া করেছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ও কাউকে বুঝতে দেইনি যে প্রতিদিন তিনটে কোচিং এ ক্লাস নিয়ে আমার লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। এমনকি তুমিও বুঝতে পারোনি, কারন যখন ক্লাস নিতাম তখন কোন না কোন অজুহাতে তোমাকে এড়িয়ে যেতাম।আর তাই যখন মেয়েটার জীবনের গল্প জানলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এই অভাগী মেধাবী ছাত্রীটিকে আমি সর্বস্ব দিয়ে সহযোগিতা করবো। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝলে। ভাবলে এই মেয়ের সাথে আমার কোন অস্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি তুমি ডিভোর্স পর্যন্ত ফাইল করলে,ফারহানা বললো কারন তুমি মেয়েটার সাথে পরিচয়ের কথা অস্বীকার করেছিলে। যাহোক আগে মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। পরে কথা হবে। রুহীকে পাঠিয়ে দাও, আমি বাসায় যাবো।
ফেরার পথে রুহী মাকে জিজ্ঞেস করলো, উনি কে মা? ফারহানা বললো উনি তোমার বাবার একজন প্রিয় ছাত্রী।
মনে হচ্ছে উনি আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। না মা এভাবে বলতে হয়না, আল্লাহর কাছে দোয়া কর, যেন সুস্থ হয়ে উঠে।
বাসায় এসে অস্থির হয়ে পড়লো ফারহানা। এতবড় একটা বড় ভুল কিভাবে করে ফেললো? এত সহজে রায়হানকে অবিশ্বাস করলো, তাহলে কি ওর ভালবাসার মধ্যে কোন ফাঁক ছিলো। রায়হান ওকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে কিন্তু ও কোন সুযোগই দেয়নি। একবারও ভাবেনি রায়হানতো ওকে কখনও সন্দেহ করেনি? ও অফিস, মিটিং , ট্যুর সবইতো করেছে অন্য পুরুষদের সাথে। আর ও কি না অল্পতেই রায়হানকে সন্দেহ করে বসলো? এখন কি করবে? রায়হান কি ওকে ক্ষমা করতে পারবে?।
ফারহানা রুহীকে ডিনার করে শুয়ে পড়তে বললো। তখনই রায়হানের ফোন, ফারহানার বুক কেঁপে উঠলো, কোন দুঃসংবাদ না তো? ফোন রিসিভ করতেই রায়হান বললো তোমার টাকাটা আর কোন কাজে লাগলো না। বৈশাখী এইমাত্র চলে গেল। নির্বাক হয়ে গেল ফারহানা, বললো আমি আসছি।
রায়হান সহ বৈশাখীর সহপাঠীরা হাসপাতাল ভরে গেছে, ফারহানা এসে দাঁড়ালো বৈশাখীর লাশের পাশে। রায়হানও ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফারহানা রায়হানের হাত ধরে বললো ক্ষমা করো আমাকে, রায়হান হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে, যেন হারিয়ে যেতে চায় জীবন থেকে।
ফারহানা নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো, দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র জলধারা।
সমাপ্ত
শওকত জাহিদ