#গল্প
#ফিরে_আসা
••••••••••••••••
সংসার জীবনের চব্বিশটি বছরের বাঁধন ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পা বাড়ালাম যেখানে রয়েছে আমার নাড়ী পোতা।
রাত বারোটা বাজে। টার্কিশ এয়ারলাইনসের বিমানের উইন্ডো সিটে বসে জানালা দিয়ে টরেন্টোর বিশাল টার্মিনালের রানওয়ের অসংখ্য উজ্জ্বল বাতিগুলোর দিকে আনমনে তাকিয়ে রইলাম। এতো ঝলমলে আলো তবুও চোখের মণিতে শুধু অন্ধকারই দেখতে পাচ্ছি। আজকাল চারদিকে শুধু অন্ধকারই দেখতে পাই। শুধুই কালো অন্ধকার।
খানিকক্ষণ পরেই বিমানটা টেক-অফ করে আকাশে পাখা মেলে, বাতাস ভেদ করে গভীর অন্ধকারে ভেসে চললো উত্তরের দিকে। মনে হচ্ছে প্লেনটা এখন আমাদের বাড়িটার উপর দিয়েই উড়ে যাচ্ছে। ছেলেটা মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে আর মেয়েটা তো জানলোও না, মা তাদের ছেড়ে অজানা পথে পা বাড়িয়েছে। আর তাঁদের বাবা তিনি হয়তো নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
এই সব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল পেছনে ফেলে আসা সেই হাজারো স্মৃতিকথা।
বিবাহিত জীবনের চব্বিশটি বছর ধরে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার ছেয়ে গেছে আমার জীবন। তাঁর থেকে মুক্তির জন্যে আমার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জানিনা কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য?
**********
তখন আমি হাইস্কুলের ছাত্রী। সমবয়সী এক খালাতো বোনের মাধ্যমে পরিচয় হয় ইমরান ভাইয়ের সঙ্গে। সেই পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে ভালো লাগা তারপর ভালোবাসা।
তখন আমরা ছিলাম সরকারি কলোনির বাসিন্দা।
কতোদিন যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ইমরানের সঙ্গে হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছি তার ইয়াত্তা নাই। তারপর রিকশায় করে ঢাকা শহর চষে বেড়াতাম। এইভাবে চলতে চলতে এসএসসি পাশ করলাম।
আর ইমরান ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা যায়? একদিন বাবার কানে গেল। আমার এমন আচরণে বাবা মনেকষ্ট পেলেন।
তাই আমার জন্য বাবা ছেলে দেখা আরম্ভ করলেন। বাবা ব্যাংকের ক্যাশ অফিসারে নিয়োগ ছিলেন। ওনার অনেক দিনের স্বপ্ন ভালো একটা ছেলের কাছে একমাত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন। কিন্তু মেয়ে যে গোপনে এক ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রেম করছে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। অনেক আশা ছিল মেয়েকে নিয়ে। লেখাপড়া শেখাবেন। বিসিএস পরীক্ষা দেওয়াবেন। ম্যাজিস্ট্রেট বানাবেন।
তাই বাবা খুবই ভেঙে পড়লেন।
আমাদের প্রেম ভালোবাসার কথা পরিবারে জানাজানি হয়ে গেছে সেইটা ইমরানও জেনে গেছে।
বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছেন, সেটাও জানতে পারলো ইমরান। এরই মধ্যে একটা ছেলের সন্ধান পেলেন বাবা। ছেলে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সবেমাত্র পাস করে চাকরির সন্ধান করছে, আবার বিদেশে যাওয়ার চিন্তা ভাবনাও করছে।
বেকার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়েতে মত দিতে না চাইলেও বিদেশে যাওয়ার কথা শোনাতে বাবা রাজি হয়ে গেলেন। কোনভাবেই এই ছেলেকে হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ছেলের ফ্যামিলি খবরাখবর, আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ছেলের স্বভাব-চরিত্র না জেনেই আমার অমতে রাতের অন্ধকারে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন আমার বাবা।
ইমরান কিছুই জানতে পারলো না। বিয়ের পর ও ভেবেছিলাম ইমরানের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব। তাতেও ব্যর্থ হলাম, ইমরানের সঙ্গে দেখা হলো না। তাঁর সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা ভেস্তে গেল।
মন না চাইলেও বিয়ের তিন মাসের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লাম। এরমধ্যেই স্বামী শরিফের সু-খবর এলো কানাডায় ল্যান্ডেড ইমিগ্রান্টের ভিসা পেল। কিন্তু তিনি কানাডায় পাড়ি দিতে যাবতীয় খরচাপাতি ও প্লেনের ভাড়া সবকিছু বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। এতে বাবাকে বাঁধা দিলাম আমি।
শরিফ কে বললাম কেন আমার বাবা প্লেনের ভাড়া দেবেন? শরিফের উঃ বিয়ের সময় ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দেখে বিয়ে দিছে তোমার আব্বা। তখন তো কিছুই দেয় নাই? এখন প্লেন ভাড়া না দিতে পারলে, তুমি থাকো তোমার বাপের কাছে। আমি একাই যাই। অবশেষে বাবা আমার শান্তির জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে দুই লাখ টাকা লোন উঠিয়ে শরিফ কে দিলো।
তারপর সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমালাম কানাডায়। এখানে এসে সবকিছুই অন্ধকার মনে হতে লাগলো। একে তো প্রেগন্যান্ট তার উপর শারীরিক অবস্থা ও ভালো না।
স্বামীর মধ্যেও সামান্যতম ভালোবাসার স্পর্শ বা সহমর্মিতার আভাস দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আটমাস শেষের দিকে একবারে লাস্ট স্টেজে নড়তে চড়তে ওখুব কষ্ট হয়। তবুও রান্নাবান্নাসহ ঘরের কাজকর্ম নিজে হাতেই সামাল দিতে লাগলাম। বিদেশের মাটিতে কেউ একটু সাহায্য করার মতো নেই। নেই কোনো আত্মীয়স্বজন,কাজের লোক। স্বামীর কাছে থেকেও পাচ্ছিলাম না কোনো ধরনের সাহায্য সহানুভূতি।
নিজেকে খুব একা অসহায় লাগতো, আর মনে হতো স্বামী কী কখনো এরকমও হয়?
ওই অবস্থায় মার কথা খুব মনে হতো,আর কান্নাকাটি করতাম। দুঃখের এই সময়ে ইমরানের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ছোঁয়া মনে প্রাণে খুব অনুভব করতাম। এর মধ্যেই কোল জুড়ে আসলো আমার সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা।
মেয়েটা পৃথিবীতে আসলে ও শরিফ খুশি হতে পারেনি। কারণ তখনো নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে ভালো কোনো একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেনি।
তাঁর কিছুদিন পর অবশেষে একটা ফ্যাক্টরির মেশিন অপারেটরের কাজ জুটলো। বছর খানেক পর ফ্যাক্টরির থেকে লোন নিয়ে ছোটখাটো একটা বাড়িও কিনে ফেললো। তারপর থেকে দিনে দিনে তাঁর স্বভাবচরিত্র পাল্টাতে লাগলো। ওখানে এমনিতে হাতের নাগালেই সবকিছু পাওয়া যায়।
সপ্তাহ অন্ত অন্ত পে চেক পেয়ে, সে প্রথমে বিয়ার ধরলো। ধীরে ধীরে তাঁর আরও উন্নতি হলো, বিয়ার ছেড়ে হার্ড ড্রিংক পান করতে শুরু করলো।
এমন অবস্থায় গেল যে নেশার সময় সবকিছুই যেন হাতের কাছে পাওয়া যায়,তাই রেফ্রিজারেটরে বোতল রাখার ব্যবস্থা করে ঘরের লিভিং রুমের এক কোনায় ছোট খাট একটা ড্রিংক কাউন্টার বানিয়ে নিলো।
শত চেষ্টা করেও সেসব থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারলাম না। ওই পথ থেকে তাকে আর ফেরানো গেল না।
মেয়ের দুই বছর পর জন্ম নেয় আমাদের ছেলে। তখন বাচ্চাদের নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ে যাই আমি। অভাব অনটন দেখা দেয় সংসারে। ওসব ছাই পাশ গিলতে খরচা বেড়ে গেলো অনেক বেশি।
উপায়ন্তর না দেখে ছেলেটা একটু বড় হলে আমি টিম হর্টন নামের চা কফি ডোনাট বিক্রির দোকানে পার্ট টাইম একটা কাজ নিলাম। কিন্তু মাতালের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে অচিরেই অনেকটা হাঁপিয়ে উঠলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর সম্ভব না।
চলবে।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
লেখা-#Rozina Rose
#গল্প
#ফিরে_আসা ( পর্ব দুই ও শেষ )
••••••••••••••••
উপায়ন্তর না দেখে ছেলেটা একটু বড় হলে আমি টিম হর্টন নামের চা কফি ডোনাট বিক্রির দোকানে পার্ট টাইম একটা কাজ নিলাম। কিন্তু মাতালের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে অচিরেই অনেকটা হাঁপিয়ে উঠলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর সম্ভব না।
**************
একদিন দেশ থেকে খবর এলো আব্বা খুব অসুস্থ। আব্বাকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
তাই নিজের কিছু সঞ্চয় করা ডলার ও ক্রেডিট কার্ড ঘষে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আব্বাকে দেখতে দেশে আসলাম প্রায় এক যুগ পর। বুঝতেই পারিনি এটাই আব্বাকে শেষ দেখা।
আব্বার গলা ধরে অনেক কাঁদলাম। বিদেশের সংসার জীবনের কথা জিজ্ঞেস করায়, সবকিছুই খুলে বললাম। জামাইয়ের অধঃপতনের কাহিনি শুনে আব্বাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। আব্বা বলে উঠলেন সবই কপাল রে মা , না হলে একজন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত ছেলের কী এই অধঃপতন হয়? আমি তোর জন্য দোয়া করি মা, তোর সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
এদিকে ইমরান বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ভালো বেতনের একটা চাকরি করছে কয়েকবছর আগে থেকেই।
আমার দেশে আসার খবর শুনে ইমরান দেখা করতে এসেছিল। ছেলেমেয়ে দুটোকে অনর্গল ইংলিশে কথা বলতে দেখে অবাক হলো ইমরান এবং অনেক আদর করলো বাচ্চা দুটোকে।
ইমরান এখনো বিয়ে করেনি শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম! তারপর বিয়ে করার পরামর্শ দিলেও ইমরান বলে উঠলো, ওসব কথা বাদ দাও রিনা বিয়ে আমার কপালে নেই।
আর যদি কপালের লেখা থাকে, তবে হবে কোনো একদিন। দেখা যাক কবে সেই দিন আসে?
প্রায় চার সপ্তাহ দেশে থেকে আবার কানাডায় উদ্দেশ্য ফিরে গেলাম। যেয়ে দেখলাম আমার প্রাণের স্বামী ঘরের মধ্যে বাইজিখানা খুলে বসেছে। আমার অনুপস্থিতির দিনগুলিতে ফ্যাক্টরির কয়েকজন নারী সহকর্মীদের নিয়ে ভালোই আড্ডা জমিয়েছে।
এই নিয়ে একদিন প্রতিবাদ করতে গেলে একপর্যায়ে সে ধাক্কা মারলে, আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কপালটা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে থাকল।
মেয়েটা তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সিতে কল করলে মেডিকেল সার্ভিসের ডাক্তাররা অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলো। কপালে চারটি সেলাই লাগলো। কানাডা পুলিশ তখন জানতে চাইলো কি করে এমন অবস্থা হলো?
তখন নিছকই একটি দুর্ঘটনার কথা বলে স্বামীকে পুুলিশের হাত থেকে পার পাইয়ে দিলাম। কারণ আমার দুইটা সন্তান আছে সেইটা ভেবে।
কিন্তু দিনদিন স্বামীর বদভ্যাসের মাত্রা বছরকে বছর বেড়েই চললো। তাঁর এখন ঘরে মন বসে না।
সে এখন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ক্রুজে ভ্রমণ করতে যায়।
নয়তো মেক্সিকোর নয়নাভিরাম সি বিচে সময় কাটায় বিকিনি পরা মেয়েদের সঙ্গে। অথবা কানাডার সাউথে আমেরিকার ফ্লোরিডায় চলে যায় অবসর সময় কাটাতে। সঙ্গে থাকে সাদা চামড়ার গার্লফ্রেন্ড।
ইতিমধ্যে বাড়ির দুই দুইটা মর্টগেজ পেমেন্ট মিস হলো। ব্যাংক থেকে চিঠিও এলো তাগাদা হিসেবে। কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই শরিফের!
এদিকে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মেয়েটার মধ্যে উদয় হতে থাকলো। শাসন করেও মেয়েটাকে সামলাতে পারছিলাম না। এখনো ইউনিভার্সিটি শেষ হলো না, এরমধ্যে সেও লাইনচ্যুত হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির এক বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে ক্লাসও করে না। বাড়িতে ও ঠিকমতো আসে না। খবর নিয়ে জানলাম ছেলেটার নাম কেয়ালা।
তাঁর সঙ্গে লিভ-টুগেদার করে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে বলে জানতে পারলাম। মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে ও ঘরে আনতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো।
চারিদিক থেকে কালো অন্ধকার ঘিরে ধরতে লাগলো আমাকে। সেটাকে সরিয়ে বাইরের জগতে বের হয়ে আসতে চাইলেও পেরে উঠছি না।
কুচকুচে কালো অন্ধকার পেছন থেকে টেনে ধরতে থাকলো অনবরত। ঘুমের ভারে চোখের পাতা ঢলে পড়লেও সারা রাত ঘুমাতে পারি না। শুধু মনে হচ্ছে বহুদিন যেন ঘুমাই না।
বিষণ্নতায় ভারাক্রান্ত মনে কিছুই মনে থাকে না। মনে হচ্ছে মেমোরি লস হয়ে যাচ্ছে, স্বামী কে কাছে পাইনা কি করে মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে আনবো কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাইগ্রেনের মাথা ব্যথাটাও ভীষণ তীব্র হয় কখনো কখনো। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
মনে মনে আশা করে থাকি এই বুঝি মেয়েটার ফোন কল আসবে। কেউ যেন পেছন থেকে ডাকবে। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়, কাঙ্ক্ষিত ফোনকল আর আসে না।
একদিন রাতে মায়ের ফোন পাই, ওপাশ থেকে মা বললো তোমার আব্বা আর আমাদের মাঝে নেই।
খবরটা শুনে বুকের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে উঠলো হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম আমি।
আব্বা মারা যাওয়ার পরে আনমনে ভাবতে ভাবতে কী ভাবে যেন মনের মধ্যে একধরনের সাহস আসে।
মনে মনে ঠিক করি আমি যে করেই হোক এই অবস্থা থেকে আমাকে মুক্তি পেতে হবে। আমি একা আর পারছিনা। ছেলেটাকেও পড়াশোনার জন্য অনেক দূরে সরিয়ে দিলো, আমার থেকে।
ছেলেটার সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু হালকা লাগে।
হঠাৎ খুব জেদ চেপে গেলো মনে, আমি এখানে আর থাকবো না। কাদের জন্য এখানে পড়ে থাকবো আমি? তারপর জমানো শেষ সম্বলটুকু দিয়ে টার্কিশ এয়ার লাইনসের একটা টিকিট কেটে আনলাম কাউকে না জানিয়ে। শুধু ছেলেটা জানতো।
ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে তিন ঘণ্টার ট্রানজিট।
ঢাকা যাওয়ার কানেকটিং ফ্লাইটের অপেক্ষায় টার্মিনালে একা একা বসে আছি। পাশের এক সহযাত্রী জিজ্ঞাসা করলো আপনাকে কে রিসিভ করতে আসবে ঢাকায়? জানি না বলে মাথা নাড়ালাম।
তাই তো মাকেও তো জানাইনি এভাবে একা আসার কথা? তবে কি মাকে এখন ফোন করে জানাবো? নাকি খালাতো বোনটাকে জানাবো? ইমরান কে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়? সত্যিই বলতে জীবনের এতটা বছর পার হলেও আজও ইমরান কে ভুলতে পারিনি। তাতেই বা কি হবে জীবনের অর্ধেক বয়স পার হয়ে গেছে এখন আর তাকে নিয়ে ভাবা বৃথা, সে নতুন জীবন শুরু করলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো না।
কাকে ফোন করবো কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। মাথা কাজ করছে না। সেই আগের মতো সবকিছু কেমন যেন ভুলে যাচ্ছি। মেমোরি লস হচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা অনেক বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি একটা ঔষধ খেয়ে নিলাম।
দেখতে থাকলাম সেল ফোনটার সেভ করা নম্বরগুলো। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাই আন্দাজে ফোনের বাটনগুলো চেপে যাচ্ছি এটা কী খালাতো বোনের নাম্বার নাকি ইমরানের। ফোন দিলাম কিন্তু রিসিভ হলো কিনা বুঝতে পারলাম না।
মনে মনে ভাবলাম টার্কির একটা জায়নামাজ কিনবো। কেনার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
হেঁটে হেঁটে টার্মিনালের সব শপিং সেন্টারগুলোতে জায়নামাজ খুঁজেও কোথাও পেলাম না। শেষে ঢাকার প্লেনের সময় হয়ে এলে ফিরে আসলাম প্লেনে।
প্লেনটা ঢাকার কাছাকাছি চলে আসলে বাইরের দিকে তাকালাম জানালা দিয়ে, দেখা যাচ্ছে আকাশ কী সুন্দর ফর্সা হয়ে আসছে। কালো কালো ভেসে থাকা মেঘের দলগুলো সরে যাচ্ছে। আহ্ কতোদিন এমন ভোর হওয়া দেখিনি। বিয়ের পর এই প্রথম সুন্দর একটা ভোর হতে দেখলাম।
মুক্ত আকাশ দেখে খুব ভালো লাগছে।
ঢাকা এয়ারপোর্টে প্লেনটা ল্যান্ড করলো, লাগেজ না থাকায় শুধু ক্যারি অনটা নিয়ে তাড়াতাড়িই ইমিগ্রেশনের লাইনে এসে দাঁড়ালাম।
কানাডীয় পাসপোর্টে সিল-ছাপ্পড় মেরে ফর্মালিটিজ কাজগুলো শেষ হলে সামনে এগোতেই গ্লাসের ফাঁকা দিয়ে দেখতে পেলাম ইমরান আমার অপেক্ষায় একটু দূরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
কাছে এগিয়ে যাচ্ছি এমন সময় ছেলেটা ফোন করেছে, হ্যালো বলতেই বললো,
বেষ্ট অফ লাক,এন্ড লাভ ইউ মাম্মাম।
জানতে পারলাম ইমরানের সঙ্গে আমার সেই ছোট্ট ছেলেটা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে। মাকে অন্ধকার জগত থেকে মুক্ত করে, তাঁর কাছে সপে দিলো।
লাভ ইউ আমার কলিজার ধণ, তুই কবে এতো বড়ো হয়ে গেলি বাবা ?
তুমি এবার রাখো মা, আমি ও আসছি খুব তাড়াতাড়ি।
সমাপ্ত।
লেখা-Rozina Rose