ঈদানিং সবকিছুতেই লজ্জায় পড়ে যাই। বাড়ির সহকারী সকিনাকে খাবার দিলে সে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ১০ বছরের মেয়েটি স্কুলে যায়। তার বাড়ন্ত বয়স,পরিমিত খাবার প্রয়োজন। আগে গরুর মাংস তিন/ চার পিস দিতাম। এখন গরুর মাংস তেমন কেনা হয় না। কিংবা মাছ একটুকরা দিলে ডিমও থাকতো। আজকাল একপদের বেশি রান্না করা সম্ভব হয় না।
সে তো আর অভাব বোঝে না তাই আগের মতোই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমি না খেয়ে ওকে দিয়ে দেই। পাশের ফ্ল্যাটের এস,আই সাহেবের বউ প্রায়ই বিরিয়ানি রান্না করেন। হিন্দি গান আর মসলার গন্ধ মউ মউ ভাসতে থাকে।
সকিনা এসে বলে – আম্মা পুলিশের বাসাত খালি বিরানী রাঁন্দে, তুমি রাঁন্দো না ক্যা। আমি চুপ করে থাকি। অথচ তার বাবা- মাকে কথা দিয়ে এনেছি কোনকিছুর অভাবে রাখবো না।
মেয়ের বাবা কলেজের শিক্ষক। ৩০ হাজার টাকার মতো বেতনের উপর আমাদের সংসার চালাতে হয়। তার উপর লোন নেয়া আছে। বাসা ভাড়া দেই দশ হাজার টাকা। অথচ সবাই ভাবে মেয়ের বাবা চাকরি করে অনেক বেতন পায়। তারা বোঝে না সব চাকরি আয়েশী নয়। আগের রাজতন্ত্রের বদলে এখন দেশ চলছে আমলাতন্ত্রে,ব্যবসাতন্ত্রে আর নেতাতন্ত্রে।
পাড়ার এক ছাত্র, সারাদিন বাইকে ঘোরে। মাস্তান, বাওয়ালীর মতো চেহারা অথচ তার পকেটে হাজার টাকার বান্ডেল। ঠোঁটে বেনসন, চোখে দামী সানগ্লাস, হাতে সেলক্স ঘড়ি। কোথায় পায়, কে দেয় তাকে টাকা?
মেয়ের বাবার কাছে জানতে চাইলে বলে- রাজনীতি করে, আমার কলেজেই পড়ে। তুমি আবার কিছু বলেছ নাকি? বুঝলাম সেও ভয় পায়।
গতবছর শাশুড়ীর পাইলসের অপারেশন করাতে শুধুমাত্র সার্জন তার ফী রেখেছে ৪০ হাজার। আমার কিছুটা অবাক লেগেছে। একঘন্টায় একজন ডাঃ এতো টাকা ফী নেয় আর একজন শিক্ষক বেতন পায় পুরো মাসেও তার থেকে অনেক কম। অথচ পৃথিবীর সব জায়গায় শিক্ষকদের বেতন সবথেকে বেশি। ডাঃ কে অনুরোধ করার পরও একটাকাও কম নেয়নি। এরপর এনেস্থিসিয়া ডাঃ এর ফী, ডাঃ এর সহকারীর ফী, ক্লিনিক সহকারীর ফী, ওষুধের এন্টিবায়োটিক মূল্য, ক্লিনিক ভাড়া, ক্লিনিকের ওটির ভাড়া, ক্লিনিং চার্জ,বকশিস, গাড়ি ভাড়া সবমিলিয়ে রাজকীয় খরচ। একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরের জন্য বেমাতাল অবস্থা।
শাশুড়ী বিকেলের নাস্তা চাইলেও আমায় লজ্জায় পড়তে হয়। বুড়ো মানুষ কয়েকপদের ফল কেটে দুধে ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করেন। আমি দিতে পারি না। ৪০/ ৫০ টাকা কলার হালি বাকি ফল তো আকাশ ছোঁয়া। শাশুড়ীর বয়স হয়েছে হয়তো বাজারদর বোঝেন না। চা বিস্কুট দিলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। হয়তো ভাবেন,আমি মেয়ে থেকে বউ হয়ে যাচ্ছি। আমার তখন ভীষন মন খারাপ হয়। চোখের পানি লুকাতে চলে আসি। কাপ ফেরত আনতে গেলে দেখি বিস্কুট না খেয়ে তিনি শুয়ে আছেন।
বাসায় বিয়ের পর থেকেই দেখছি এক বৃদ্ধা খালা আসেন। শাশুড়ী মায়ের সহকারী ছিলেন। তাকে খেতে দিলেই ভাত মাখাতে মাখাতে গল্প করেন।
– তোমার শাশুড়ীর রান্নার হাত ভীষণ ভালো ছিল। খাসি/ গরু খুব ভালো রাঁধতেন। আমাকে কাজের মানুষ নয়, বোনের মতো দেখতেন। নিজে যা খাইতেন আমার পাতেও তাই থাকতো। আচ্ছা মা, তুমি খাসি/ গরু এসব রান্না করো না? শুধু এসব মাছ দাও। ইলিশ মাছ রান্না করো না। কতোদিন ইলিশের ডিম খাই না।
আমি বুঝতে পারি। বয়স হলে বুড়ো মানুষের দাঁত পড়ে যায় তবুও মাংসের স্বাদ নিতে ভোলে না। তাকে বলা হয় না বাসায় আত্মীয় না এলে মাংস তেমন একটা রান্না হয় না। আর ইলিশ মাছ কেনা সাধ্যের বাইরে।
বিয়ের সময় আমি ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছি। বলা যায় মেয়ের বাবার স্টুডেন্ট। এই অমায়িক মানুষটাকে দেখলে বিয়েকে না করা যায় না। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় মেয়ের জন্ম হলো। আমার আর পড়াশোনা হলো না। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষাটাও দেয়া হলো না।
শাশুড়ী মা বললেন – বাবা যা বেতন পায় তাতে আমাদের ক’জনের সংসার চলে যাবে। তুমি আমার আর মেয়ের সাথে থাকো বৌমা! তখন অবশ্য এতো খারাপ অবস্থা ছিল না। এই তো ক’ বছর আগে। ফেব্রুয়ারিতে শাশুড়ী সব প্যাক করে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন ঘুরতে। আমাদের দুজনেরই ঠান্ডার সমস্যা। মায়ের ভয়ে দুজন ঠান্ডায় বাইরে না গিয়ে সারাদিন ঘরে থেকে সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরলাম।
আর এরপর থেকে প্রতি বছর বেড়াতে যাবো এমন প্ল্যান করলাম। বিয়ের পরের বছর শুধু বেড়াতে গিয়েছি, তারপর আর যাওয়া হয়নি। সময় আছে, সাধ্য নেই। প্রায় মাসেই মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই এস,আই সাহেবের বউ এর কাছে টাকা ধার নিতে হয়। কচকচে বান্ডেল থেকে তিনি টাকা দেন। মাসের শুরুতে তাকে শোধ দিয়ে শেষকদিন আর কাটতেই চায় না। তখন অন্যকারও কাছে ধার করতে হয়।
শাশুড়ী প্রায়ই বলে, একটা ছেলে হলে ভালো হতো। দুজনে একসাথে মানুষ হতো। মেয়ের বাবা আর আমি মুখ চাওয়া চাওয়ী করি। কারণ দ্রব্যমূল্যের হু হু করা বাজারে চারজনের সংসারই অনেক কষ্টে চলছে সেখানে আর বাচ্চা প্ল্যান করা অসম্ভব।
প্রায় বিকেলে মানুষটা ক্লান্ত হয়ে বাসায় আসে। আমার নিজেকে ভীষন অসহ্য মনে হয়। মানুষটাকে সামান্য পয়সার সাহায্য করতে পারিনা। অথচ বসে বসে তার কষ্ট হজম করি। মেয়ে ঘুমিয়ে গেলেও আমি নির্ঘুম রাত কাটাই। হঠাত মেয়ের বাবা বুকে এসে মুখ গুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাকে বুকে চেপে আমার ভীষন লজ্জা হয়। স্বামীকে সাহায্য করতে না পেরে মন অস্হির হয়। বেশ বুঝতে পারি সে আমাকে কিছু বলতে পারে না কিন্তু ভবিষ্যত ভেবে ভীষন শংকিত!যদি আমাদের কেউ অসুস্থ হয়ে যাই কি হবে? কোথায় টাকা পাবো?
অথচ বিয়ের পর আমরা দুজনেই ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ির ছবি ডাউনলোড করে করে ফোন ভরিয়ে ফেলেছিলাম। ভালো সময় আসবে, আমাদের নিজের বাড়ি হবে। তার নামও ঠিক করেছিলাম “মেঘালয়”। যখন দেশে হু হু করে কোটিপতি বাড়ছে, বিদেশেও তাদের একের পর এক বাড়ি হচ্ছে তখন আমাদের খেয়ে পরে বাঁচাই দায়। তাই স্বপ্নের বাড়ির ছবিগুলো ডিলিট করে ফেলেছি, রেখে কি লাভ!
মাঝে মাঝে ভাবি, মেয়ে আর একটু বড় হলে স্কুলে দিয়ে উবার চালাবো কিংবা নাক- মুখ ঢেকে রিকশা চালাবো কিংবা কিছু একটা করা দরকার। লোকে কি চিনবে আমি শিক্ষকের বউ! কিছু টাকা অন্তত আসবে। ঊদ্ধগতির জীবন একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলবে। কিংবা আবার পড়াশুনা শুরু করবো। তখন পড়লে আজ কিছু একটা করতে পারতাম। একজনের বেতনে এখনই সংসার চলে না। লাগামহীন এই জীবনযাত্রায় মেয়ে বড় হলে কি হবে তার উচ্চশিক্ষার? আমি কিছু করলে সকিনা আর প্লেট হাতে থাকতো না। তাকে বিরিয়ানি রান্না করে দিয়ে আমার লজ্জা কমতো। সেও টিভিতে হিন্দি গান ছেড়ে পা মেলে মজা করে খেত। বৃদ্ধা খালাকে ইলিশ মাছের ডিম কিংবা কয়েক টুকরা মাংস দিয়ে খাবার দিতে পারতাম।
শুধু ভাবিই, কিছু কি করা হয়? না দেশের জন্য না নিজের জন্য। মাঝে মাঝে নিজেকে পঙ্গু লাগে। নিজের দেশকে ভালোবাসি অথচ এতোসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন কথা বলি না। দেয়ালের কান আছে এই ভয়ে মুখ বুজে মধ্যরাতের হাহাকার হয়ে বেঁচে থাকতে আজকাল শুধু লজ্জাই হয়!!!!
## লজ্জা
” রোকসানা খন্দকার রুকু “
Kobitor.com