১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জামার্নির উলম শহরে জন্মগ্রহণ করেন আইনস্টাইন(einstein)। তার বাবা হারমান আইনস্টাইন ছিলেন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ী। মায়ের নাম পলিন। তাদের প্রথম সন্তান অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (albert einstein) ।আইনস্টাইনের যখন মাত্র এক বছর বয়স তখন হঠাৎ মন্দা নেমে আসে হারমানের ব্যবসায়। তিনি তাই সবাইকে নিয়ে চলে যান জার্মানির মিউনিখে । সেখানে নতুনভাবে শুরু করেন তার ব্যবসা।
একবার আইনস্টাইনের বাবা তার জন্য কিনে আনেন একটি কম্পাস।কম্পাসটি পেয়ে ভীষণ খুশি হন আইনস্টাইন। তাঁর রাত-দিনের খেলার সাথী হয়ে ওঠে সেই কম্পাস। তিনি দেখতে পান, যে কোন অবস্থায়।কম্পাসটিকে যেদিকেই ঘোরানো হোক না কেনো, তার কাঁটাটি স্থির হয়ে থাকে উত্তর-দক্ষিণ দিকে। আইনস্টাইন ভাবেন, কেনো এমন হয়?
কম্পাসের কাটা অন্যদিকে না ঘুরে শুধুই উত্তর-দক্ষিণমুখো হয়ে থাকে কেনো?
কি রহস্য লুকিয়ে আছে এর পেছনে?
তবে কি উত্তর-দক্ষিণ দিকটাতে এমন কোনো শক্তি রয়েছে যাকে চোখে দেখা যায় না অথচ কাজকরে যাচ্ছে প্রবল প্রতাপে?
এ প্রশ্নটি ছিলো আইনস্টাইনের জীবনে অজানাকে জানার প্রথম চেষ্টা।
১৮৮৫ সালে আইনস্টাইনকে ভর্তি করা হয় ক্যাথলিকদের এক প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে তিন বছর পড়েন তিনি। তারপর ১৮৮৯ সালে ভর্তি হন লুটপোল জিমনেসিয়ামে।
স্কুল জীবনে কিন্তু মোটেও ভালো ছাত্র ছিলেন না আইনস্টাইন Einstein ।
কোন বিষয়েই আনন্দ খুঁজে পেতেন না তিনি। তাঁর ভাল লাগতো শুধু অঙ্ক আর জ্যামিতি নিয়ে ডুবে থাকতে । আর করতেনও তাই। স্কুলের সব পড়া বাদ দিয়ে অঙ্ক নিয়ে কাটিয়ে দিতেন তিনি সারাটা সময়।
একবার একটি এ্যালজাবরা বই পেয়ে আইনস্টাইন ছুটে যান তাঁর চাচার কাছে। জ্যাকব নামের এ চাচাটি ছিলেন ইঞ্জিনিয়র। আইনস্টাইন তার কাছে জানতে চান ওটা কি ধরনের বই?
জ্যাকব বলেন, এর নাম এ্যালজাবরা। এগুলো এমন এক ধরনের অঙ্ক,যেগুলো গোয়েন্দাদের মতো অজানা বস্তুকে খুঁজে বের করে। মনে করো তুমি নিশ্চিত যে, কোন একটা জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে কোথাও না কোথাও। কিন্তু সেটা কোথায় রয়েছে বা তার সংখ্যা ও পরিমাণ কতো।তুমি তা জানো না। এখন সেই অদৃশ্য জিনিসটাকে ‘এক্স’ নাম দিয়ে এ্যালজাবরার সাহায্য নিয়ে খুঁজতে থাকো, দেখবে এক সময় তোমার হাতে এসে ধরা দেবে সেই অজানা বস্তুটি।
Einstein অবাক হন এ্যালজাবরার কথা শুনে।
সেদিন থেকে এ্যালজাবরা হয়ে ওঠে তার প্রিয় বিষয়। সে সাথে জ্যামিতিও রপ্ত করে চলেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই আইনস্টাইন (Einstein) ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। ক্লাসে পড়া পারতেন না বলে সবাই তাকে ডাকতো বোকা অ্যালবার্ট বলে । অথচ এমন সব বইয়ের লেখা গড়গড় করে বলে যেতেন তিনি, যে বই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছুঁতেও সাহস পেতো না।
মাত্র ছ’বছর বয়সে আইনস্টাইন (Einstein) শেষ করেন স্পিকারের জ্যামিতি। ইউক্লিডের জ্যামিতি শেষ করেন বারো বছরবয়সে। আর তেরো বছর বয়সে পড়ে ফেলেন ইমানুয়েল কান্টের যাবতীয় দর্শনের বই। ম্যাক্স টলেমি নামে মেডিক্যালের এক ছাত্রের সাথে সুসম্পর্ক ছিলো আইনস্টাইনদের পরিবারের। একবার সেই টলেমি ফোর্স এন্ড মেটার নামে একটি আইনস্টাইনকে। গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর লেখা অত্যন্ত কঠিন এ বইটিও মাত্র দু’দিনেই পড়ে ফেলেন আইনস্টাইন।
মিউনিখে আসার পর থেকে ভালোই চলছিলো হারমানের ব্যবসা।কিন্তু আইনস্টাইন যখন স্কুলের শেষবর্ষের ছাত্র, সে সময় আবার বিপর্যয় নেমে আসে তার ব্যবসায়। ফলে মিউনিক ছেড়ে ইতালির মিলানে চলে যান তিনি। তবে আইনস্টাইনকে রেখে যান মিউনিখে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার জন্য। স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ করে আইনস্টাইনও চলে যান মিলানে ।
কয়েক মাস অবসর জীবন কাটানোর পর ১৮৯৫ সালে আইনস্টাইনকে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত শহর জুরিখে । সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম ভর্তি হন আরাউ শহরের এক টেকনিক্যাল স্কুলে । এক বছর পর সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক্যাল ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হন তিনি। এখানে লেখাপড়ার খরচ ছিলো প্রচুর। অথচ আইনস্টাইনদের ব্যবসা সে সময় শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো। তাই আইনস্টাইন তাঁর আত্মীয়দের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান।
এ আবেদনে সাড়া দিয়ে মাসে বিশ ডলার করে সাহায্য দিতে রাজি হন তার এক মামা । বিশ ডলার তেমন কোনো আহামরি সাহায্য নয়। তবে আইনস্টাইন (Einstein) বলেছেন, তার অভাবের দিনে খুব উপকার হয়েছিলো ওই টাকা পেয়ে সুইজারল্যান্ডে এসে আইনস্টাইনের জ্ঞানপিপাসা বেড়ে যায়। জুরিখের পাঠাগার গুলোতে ঘুরে ঘুরে তিনি পড়ে চলেন গ্যালিলিও, নিউটন, হার্টজ, কিরকভ আর ম্যাক্সওয়েলের লেখা বিজ্ঞানের বই । হিউম, শোপেন হউয়ের এবং মাখের লেখা দর্শনশাস্ত্রের বইগুলো ও এ সময় শেষ করেন তিনি।
১৯০০ সালে সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক্যাল ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন আইনস্টাইন Einstein.
১৯০১ সালে ভালো বেসে বিয়ে করেন তার সহপাঠী সাইবেরিয়ার মেয়ে মিলেভা মরিসকে। এ বিয়ের কথা জানতে পেরে তাঁর মামা মাসিক ভাতা বন্ধ করে দেন। ফলে অপ্রত্যাশিতভাবেই আইনস্টাইন পড়ে যান অর্থকষ্টে। তাই মরিয়া হয়ে
তাকে কাজের খোঁজে বেরোতে হয়।
আইনস্টাইনের ধারণা ছিলো কোনো একটা কলেজে অধ্যাপকের কাজ পেতে অসুবিধা হবে না তার। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় তিনি চাকরি নেন।উইনটারথাল শহরের এক পলিটেকনিক্যাল স্কুলে। সেখানকার এক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়ায় সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় তাঁকে। শর্ত থাকে, সেই শিক্ষক ফিরে এলেই চাকরি ছেড়ে দিতে হবে আইনস্টাইনকে।
আইনস্টাইন (Einstein) এ শর্ত মেনে নিয়েই চাকরি নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কয়েক দিন পরই ফিরে আসেন সেই শিক্ষক। ফলে চাকরি পেতে না পেতেই চাকরি হারাতে হয় তাঁকে। আবার বেকার হয়ে পথে পথে ঘোরা শুরু হয় তার।
এভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর আইনস্টাইনের (Einstein) সঙ্গে দেখা হয় তাঁর কলেজ জীবনের বন্ধু মার্সেল গ্রাসমানের। আইনস্টাইনের বেকারত্বের কথা শুনে গ্রাসমান আইনস্টাইনকে নিয়ে যান তার বাবার কাছে। গ্রাসমান তার বাবাকে অনুরোধ করেন বন্ধুর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে।গ্রাসমানের বাবা ছিলেন প্রভাবশালী। আইনস্টাইনের সমস্যার কথা শুনে তিনি তাকে পাঠিয়ে দেন তার পরিচিত এক ভদ্রলোকের কাছে।হলার নামের এ ভদ্রলোক বার্নের প্যাটেন্ট অফিসের পরিচালক ছিলেন।
নিম্নপদস্থ কেরানীর চাকরি হয় Einstein এর
সেটা ১৯০৩ সালের কথা।জীবনের শুরু থেকেই গ্রহ-নক্ষত্র, আলো আর সময় নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উদয় হতো আইনস্টাইনের মনে। প্যাটেন্ট অফিসে কাজ নেয়ার পর থেকে সে সব প্রশ্ন আরো জটিল হয়ে ব্যাকুল করে তোলে তাকে। অফিসের কাজের ফাকে ফাকে সে সব চিন্তা-ভাবনাকে সুশৃঙ্খলভাবে লিখে চলেন
আইনস্টাইন। বাড়ি ফিরেও মেতে থাকেন জ্যামিতিক আঁকিবুকি নিয়ে ।
এভাবে কেটে যায় দুটি বছর।
তারপর ১৯০৫ সালে লিপজিগের এনালেন দ্য ফিজিক পত্রিকায় প্রকাশ করেন তার উদ্ভাবিত আপেক্ষিকদের ওপর লিখিত তিনটি প্রবন্ধ।প্রথম প্রবন্ধের নাম আপেক্ষিকবাদের বিশেষ তত্ত্ব (Special theory of relativity) প্রথম প্রবন্ধে আলোকত্ত্ব এবং ফটো ইলেকট্রিক প্রক্রিয়ায় এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করে আইনস্টাইন।
তিনি প্রমাণ করেন, আলোর উৎসের সাথে গতির কোনো সম্পর্ক নেই। মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি অতিক্রম করার সময় আলোকের স্পন্দনসংখ্যা কমে যায়। সে সময় আলো সামান্য রক্তিম দেখায় ।আইনস্টাইনের এ তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী সময় গড়ে ওঠে কসমোলজি থিয়োরি।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ Electro dynamics of moving bodies। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান মুভমেন্টের ধারণাকে চূড়ান্তভাবে ব্যাখ্যা করেন।আইনস্টাইন (Einstein) দেখান, তরল পদার্থের অণুগুলো তাপের প্রভাবে গতিশীল হয়।গতিপ্রাপ্ত অণু তরল পদার্থের ভাসমান অণুকে ধাক্কা দিয়ে সচল করে তোলে। এভাবেই পদার্থের মাঝে অণুসমূহ অবিরাম গতির অধিকারী হয়।
আইনস্টাইন (Einstein) বলেন, পদার্থ ও শক্তি আসলে একই সত্তার দ্বৈত রূপ।উপযুক্ত মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে পদার্থকে শক্তিতে এবং শক্তিকে পদার্থে।রূপান্তরিত করা সম্ভব। পদার্থ আসলে অতি ঘনীভূত শক্তিপুঞ্জের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।
এ সম্পর্কে আইনস্টাইনের বিখ্যাত তত্ত্বটি হলো E= mc2 এখানে, E অর্থ শক্তি। m বলতে বোঝানো হয়েছে পদার্থের ভরকে। আর c অর্থ
আলোর গতি।
অর্থাৎ, শক্তি = ভর X আলোর গতি X আলোর গতি ।
আলোর গতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল অতিক্রম করে। কাজেই সামন্য পরিমাণ পদার্থের আংশিক রূপান্তর থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যেতে পারে। যেমন, মাত্র এক পাউন্ড কয়লাকে আইনস্টাইনীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হলে তা থেকে এক হাজার কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টার চেয়েও বেশি শক্তি পাওয়া যাবে।
তৃতীয় প্রবন্ধে Einstein উল্লেখ করেন
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিরপেক্ষ গতি বলে কিছুই নেই। সমস্ত গতিই আপেক্ষিক–অর্থাৎ কোনো না কোনো একটি গতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বস্তু গতি লাভ করে। আইনস্টাইনের প্রবন্ধটি ছাপা হবার সাথে সাথে বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে বিতর্কের ঝড় ওঠে। কারণ, এ তত্ত্বকে মেনে নিতে হলে অনেক প্রাচীন মতবাদকেই অস্বীকার করতে হয়। আবার ভালো মতো যাচাই না করে এ মতবাদের বিরোধিতাও করা যায় না।তাই বিজ্ঞানীরা মেতে ওঠেন।
আইনস্টাইনের মতবাদের বিশ্লেষণের কাজে এক সময় শেষ হয় তাদের
হিসেব-নিকেশ। অবশেষে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হন আইনস্টাইনের (Einstein) মতবাদ পুরোপুরি নির্ভুল। ফলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আইনস্টাইনের নাম।এ সময় অস্ট্রিয়ার স্যালয়বার্গের বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ পান আইনস্টাইন। এটি ছিলো বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর প্রতি প্রথম স্বীকৃতি।
১৯০৯ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করে আইনস্টাইন। এক বছর পর পূর্ণ অধ্যাপকের পদ নিয়ে প্রাগের জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মিলেভা।জুরিখ ছেড়ে কোথাও যেতে সম্মত ছিলেন না। তার সোজা কথা, কোনোছোট শহরে যেতে রাজি নন তিনি।
পারিবারিক সমস্যাকে সব সময়ই এড়িয়ে চলতে চাইতেন আইনস্টাইন। এ কারণে বাধ্য হয়েই জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে জুরিখে ফিরে আসেন তিনি। এখানে এসে ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে যোগ দেন। এ সময় খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আইনস্টাইনের (Einstein) নাম। তাই সুইস নাগরিকত্ব গ্রহণ করা সত্ত্বেও ১৯১৩ সালে জার্মানির কাইজার উইলহেম ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর এবং রয়েল প্রশিয়ান একাডেমী অব সায়েন্সের সদস্যপদ দেয়া হয় তাকে। এর কার্যালয় ছিলো বার্লিনে।
প্রুশিয়ান একাডেমী অব সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তার সাথে কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আইনস্টাইন সিদ্ধান্ত নেন বার্লিনে যাবার। কিন্তু বেঁকে বসেন আবার সেই মিলেভা। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এখানকার সুখশান্তি ত্যাগ করে বার্লিনে যাবেন না তিনি। ফলে স্ত্রীর ওপর দু ছেলের দায়িত্ব দিয়ে একাকীই বার্লিনে চলে আসেন আইনস্টাইন (Einstein) । সেই যে জুরিখ ছেড়ে আসা-এর পর আর কখনো সেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি তার। কারণ বার্লিনে আসার পরপরই স্ত্রীর সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটেছিলো আইনস্টাইনের।
১৯০৫ সালে আইনস্টাইন যে স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেছিলেন। যাকে বলা হয় আপেক্ষিকবাদের বিশেষ তত্ত্ব সেটি ছিলো আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর প্রাথমিক ধারণা মাত্র। তার ওপর ভিত্তি করে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন প্রকাশ করেন আপেক্ষিকবাদের সাধারণ তত্ত্ব (General theory of relativity)। প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিউটনীয় সূত্র সমূহে যেসব দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি দেখা যাচ্ছিলো, এ তত্ত্বের মাধ্যমে আইনস্টাইন তা শুধরে দেন।
Einstein দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন, মহাকর্ষ শক্তি বলে কিছু নেই।
আসলে চতুর্মাত্রিক দেশ-কালের পরিসরে জড় পদার্থের চারদিকে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তারই আকর্ষণে সব পদার্থ নিজ থেকে চলতে থাকে। এই চলার পথটি সোজা নয়-বাঁকা আইনস্টাইন (Einstein) আরো বলেন, মহাকর্ষ শক্তি বলতে নিউটন যা বোঝাতে
চেয়েছেন সেটি আসলে চৌম্বকাবেশের মতো ব্যাপ্ত এক ধরনের আবেশ ।এর প্রভাবে আলোর পথ ১.৭ সেকেন্ড কোণে বেঁকে যায় । আইনস্টাইনের এই মতবাদ প্রকাশের সাথে সাথে কেঁপে ওঠে পৃথিবী।কারণ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে খ্যাত নিউটনের মতবাদকে প্রায়বাতিল করে দেয়া হয়েছে আইনস্টাইনের এই মতবাদের মধ্য দিয়ে ।
আসলেই কি তাই? এ মতবাদকে তো বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নেয়া যায় না ।কিন্তু সমস্যা হলো, আইনস্টাইনের মতবাদ এতোই জটিল ছিলো যে,কেবলমাত্র অতি জ্ঞানী বিজ্ঞানীরাই তা বুঝতে পারবেন বলে আশা করা হতো। কারণ বস্তু, সময়, কাল, শক্তি আর শূন্যতা নিয়ে এমনই কঠিন কঠিন তত্ত্ব ও হিসেব ছিলো সেই মতবাদের ভেতর, যারা এ মতবাদ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, সেই পদার্থবিদেরও যোগ্যতা ছিলোনা এ মতবাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাচাই করে দেখার।
অবশেষে ১৯১৮ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটির পক্ষ থেকে দু’দল বিজ্ঞানীকে পাঠানো হয় আফ্রিকা ও ব্রাজিলে । দু’মিনিটের জন্য সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে সেখান থেকে। সেই সূর্য গ্রহণের ছবি তুলবেন বিজ্ঞানীরা।তাতেই বোঝা যাবে আইনস্টাইনের মতবাদের সত্যতা।
১৯১৯ সালের ২৯ মে ছবি তোলেন বিজ্ঞানীরা। সে সব ছবি পরিস্ফুটনের পর তারা দেখতে পান আইনস্টাইনের মতবাদ নির্ভুল । সত্যি সত্যিই সূর্যের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আলোর পথ ১.৭ সেকেন্ড বেঁকে গেছে।
এ পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা মেনে নেন, আইনস্টাইনের মতবাদ শুধু নির্ভুলই নয়-এটা মৌলিক ও নিউটনীয় মতবাদ থেকে স্বতন্ত্র।জার্মানির ল্যানেস্টেস শহরে বাস করতেন আইনস্টাইনের চাচা রুডি।তাঁর মেয়ে এলসা ছিলেন বিধবা। ১৯১৭ সালে আইনস্টাইন বিয়ে করেন এলসাকে। পরবর্তীতে খুব সুখের হয়েছিলো তাদের বিবাহিত জীবন ।
পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় আইনস্টাইনকে (Einstein) । এর পরপরই প্রশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করে তাঁকে।
১৯২৯ সালে ইউনিফাইড থিয়োরি নামে এক নতুন মতবাদ প্রকাশ করেন আইনস্টাইন।
এর পরের বছর নাৎসী পার্টি জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়। ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ইহুদীদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। আইনস্টাইন (Einstein) ছিলেন ইহুদী তাই তাঁর বাড়ি ক্রোক ও ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে সরকার। এভাবে চারদিক থেকে নির্যাতিত হয়ে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। একদিন সুযোগ বুঝে জাহাজে উঠে বসেন-জার্মানি ছেড়ে আমেরিকা চলে যান।
এরই মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিলো আইনস্টাইনের নাম। তাই আমেরিকায় গিয়ে চাকরি পেতে সমস্যা হয় না তার। নিউ জার্সির বিখ্যাত শহর প্রিন্সটন। সেখানকার প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট অব এ্যাডভান্স স্টাডিতে চাকরি পেয়ে যান তিনি। তাকে নিয়োগ করা হয় গণিত বিভাগের পরিচালক।আমেরিকা আসার তিন বছর পর ১৯৩৬ সালে আইনস্টাইনের স্ত্রী এলসা মারা যান।
১৯৩৮ সালে ইভিউলুশন অব ফিজিক্স নামে একটি বই প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের । এ বইটি পদার্থবিজ্ঞানীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়
এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিজ্ঞানীরা মেতে ওঠেন নতুন নতুন মরণাস্ত্র উদ্ভাবনের কাজে।কয়েকজন বিজ্ঞানীর মনে পড়ে আণবিক শক্তির কথা।তারা ভাবেন, আণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যদি বোমা বানানো যায় তবে পৃথিবীকে চমকে দেয়া যাবে।
যারা আণবিক বোমার সম্ভাব্যতা নিয়ে ভেবেছিলেন এদেরই দু’জন ইতালিয় পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি ও হাঙ্গেরির লিও জিলার্ড ১৯৩৯ সালে দেখা করেন আইনস্টাইনের সাথে।বিজ্ঞানীরা আণবিক বোমা বানাবার কথা গোপন রেখে আইনস্টাইকে বলেন,আপনার সূত্রের উপর আমরা গবেষণা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক।কিন্তু সমস্যা হলো এজন্য প্রচুর অর্থ এবং লোকবলের প্রয়োজন।যা একমাত্র আমেরিকা সরকার সহযোগিতা করলেই সম্ভব।
আপনি যদি যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন, আমাদের মনে হয় তিনি আপনার কথা রাখবেন।
১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট আইনস্টাইন (Einstein) আণবিক গবেষণার প্রয়জনীয়তার কথা উল্লেখ করে আমেরিকার সে সময়ের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে একটি চিঠি লেখেন।সে চিঠির উপর নির্ভর করেই প্রতিষ্ঠিত হয় একটি গোপন গবেষণাগার।নাম দেয়া হয় ম্যানহাটান প্রোজেক্ট।এখানেই জন্মলাভ করে বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’ ও ‘লিটেল বয়’।
লিটল বয় নামের প্রথম বোমাটি ১৯৪৫সালের ৬ আগস্ট ফেলা হয় জাপানের হিরোশিমা শহরে।এর দু’দিন পর ৯ আগস্ট ফ্যাটম্যানকে ফেলা হয় জাপানেরই অপর শহর নাগাসাকিতে।এ দুটি বোমার আঘাতে শহর দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।মারা যায় কয়েকলাখ শহরবাসী।
ছেলেবেলা থেকেই যুদ্ধবিরোধী ছিলেন আইনস্টাইন
অথচ তাঁরই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে আণবিক বোমা উদ্ভাবন করা হয়েছে।আর সেই বোমায় মৃত্যু হয়েছে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের।এ কথা জানতে পেরে আইনস্টাইন প্রচণ্ড আঘাত পান
এ সম্পর্কে একবার সাংবাদিকদের তিনি (Einstein) বলেন, “যদি আমাকে জানানো হতো আমারই উদ্ভাবিত সূত্র ব্যাবহার করে এমন মরণাস্ত্র বানানো হবে,মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়া হবে,তাহলে আমি কখনো আণবিক গবেষণায় উৎসাহ যোগাতাম না।এখন মনে হচ্ছে বিজ্ঞানী না হয়ে বরং কাঠমিস্ত্রি হলে এতোটা অপরাধ বোধ থাকতো না আমার।“
আমেরিকায় এসেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন আইনস্টাইন (Einstein) । ১৯৪০সালে তাঁকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়।সর্বশ্রেষ্ট বিজ্ঞানী হওয়া স্বত্বেও আশ্চর্য রকম নিরহাঙ্কারী ছিলেন আইনস্টাইন।
ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ ছিলেন তিনি।অবসর সময়ে গান শুনতে ভালবাসতেন।আর ভালবাসতেন বেহালা বাজাতে।অনেক মনে করেন বিজ্ঞানের জটিল সূত্র নিয়র কাজ করতে করতে একেবারেই নিরস হয়ে হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন।আসলে তা নয়।বরং বলা চলে আইনস্টাইন ছিলেন এক মজার লোক। মজার মজার ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি জীবন জুড়ে।সে সব এতোটাই মজার ছিলো যে, সারা জীবনের ঘটনা সংগ্রহ করে রীতিমতো একটা বই লিখে ফেলা যায়।
একবার এক বন্ধুর বাসায় গেছেন আইনস্টাইন (Einstein) ।
নানা রকম খাবার দেয়া হয়েছে তাকে।তার কিছু কিছু তিনি খেয়েছেন।চাও খেয়েছেন।কিন্তু চা খাওয়ার পর হঠ্যাৎ তার চোখে পড়ে একটা অবাঞ্চিত দৃশ্য।তিনি দেখতে পান কাপের তলায় চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে রয়েছে একটা তেলাপোকা।
আইনস্টাইন (Einstein) বুঝতে পারেন, এতোক্ষণ চায়ের সাথে তেলাপোকার রসও খেয়েছেন তিনি।গা ঘিন ঘিন করে ওঠে তার।কিন্তু এ ব্যাপারে জাউকে কিছু বললেন না তিনি। অথচ এই অসাবধানতার জন্য গৃহকর্ত্রীকে কিছুটা তিরস্কার না করলেও চলেনা, তাও বোঝেন আইনস্টাইন।তিনি তখন তিরস্কার করার জন্য একটি মজার পথ বেছে নেন।
তাঁর পকেটে ছিল একটি চক।বিদায় নেয়ার সময় সেই চক দিয়ে সে বাড়ির দরজায় লিখে আসেন- “নতুন স্বাদের চা খাওয়াবার জন্য ধন্যবাদ।তবে এই ধন্যবাদ প্রাপ্য সেই হতভাগ্য তেলাপোকাটির।মরে গিয়ে যে কাপের তলায় আটকে ছিল।“
প্রথম স্ত্রী মিলেভাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন আইনস্টাইন (Einstein) ।মিলেভার স্বার্থপরতা আর বদমেজাজের কারণে সে বিয়ে স্থায়ি হয়নি।তবে আইনস্টাইনের দিক থেকে ভালবাসার কোন কমতি ছিলনা।আর এ কারণে শত ব্যস্ততার মাঝেও মিলেভাকে লিখেছিলেন আটশোটি প্রেম পত্র!
সেগুলো লেখা হয়েছিল ১৮৭৭-১৯০৩ সালের মধ্য।গড়ে প্রতি বছর লিখেছেন প্রায় একত্রিশটি চিঠি।আইনস্টাইনের মতো বড়মাপের আত্মভোলা বিজ্ঞানীর জন্য এছিলো ভালোবাসা প্রকাশের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।১৯৮৬ সালে মিলভাকে লেখা সেই চিঠিগুলো নিলামে বিক্রি হয় ২০লাখ
Einstein ছিলেন আসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী
কি করে একজন মানুষ এতোটা জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে,তার সমসসাময়িক বিজ্ঞানীরা তা ভেবেও পেতেন না।এ কারণে এক অবিশ্বাস্য প্রস্তাব করেছিল তারা আইনস্টাইন (Einstein) এর কাছে।প্রস্তাবটি হলো এই যে, আইনস্টাইনের মগজে কি আছে তা পরিক্ষা করে দেখার জন্য তিনি যেন অনুমতি দেন।
আইনস্টাইন মৃদু হেসে বলেছিলেন, “অনুমতি দিচ্ছি।তবে অবশ্যই এ কাজটি করবেন আমার মৃত্যুর পর-আগে নয়।“
দ্বিতীয় স্ত্রী এলসার মৃত্যুর পর থেকেই মন ভেঙ্গে গিয়েছিল আইনস্টাইনের।বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা রোগে আক্রান্ত হন।অবশেষে ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।তাকে ভর্তি করা হয় প্রিন্সটন হাসপাতালে। এখানেই ১৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর পর আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হন। তারা দেখতে পান,সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক পনেরো শতাংশ চওড়া।মস্তিষ্কের যে অংশটি বুদ্ধি,হাটাচলা এবং গাণিতিক চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে,সে অংশটি কিছুটা ভিন্নতর।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পান।আইনস্টাই্নের গ্রে ম্যাটার নিউরনের গ্লিয়ারের অনুপাত সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি।তবে গ্লিয়ার যে কি কাজ করে,সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।
শল্য চিকিৎসক প্রফেসর সান্দ্রা উইটেলসনের মতে, আইনস্টাইন যা চিন্তা করতেন সঙ্গে সঙ্গে তাই করতে পারতেন।বিজ্ঞানের চিন্তা-ভাবনা তাঁর মাথায় কত দ্রুত কাজ করত তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।তিনি যেন চিন্তার বিষয়গুলোর সমাধান পরিষ্কার ছবির মতো দেখতে পেতেন!
জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত মানব কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন আইন্সটাইন।শেষ বয়সে তিনি গবেষণা করে গেছেন মহাকর্ষ,বৈদ্যুতিক চৌম্বক ক্ষেত্র ও পরমাণু ক্ষেত্রের উপর।
আজ আইনস্টাইন আমাদের মাঝে নেই।কিন্তু তাঁর অবদান আমাদের মাঝে রয়েছে।একজন বিজ্ঞানী হিসাবে সেখানেই তাঁর স্বার্থকতা।
ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না।