ভ্রমন কাহিনী ২ঃ
আকবর হোসাইন
ইউরো ট্রিপঃ মিলান, ভেনিস, ইতালিঃ
৬ ই সেপ্টেম্বর আমস্টারডাম থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে মিলান এসে পৌছলাম। বন্ধুর মেস বাসায় সেদিন রাতে থেকে পরের দিন ৭ই সেপ্টেম্বর মিলানের বেশ কয়েকটা স্পট এ ঘুরলাম। তার মধ্যে অন্যতম ছিল দোমো। দোমোতে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। আমি ভিডিও করতেছিলাম আমাকেই, একটা হাত বাড়ানো ছিল।
হঠাৎ করে এক আফ্রিকান লোক আমার হাতে কিছু একটা রাখলো, আমি ভালভাবে বুঝে উঠার আগেই অনেকক গুলো কবুতর এসে আমার হাতে মাথায় বসে ঐ জিনিসগুলো খেয়ে ফেললো। আমি প্রচন্ড ভয় পেলাম বাট পরে সেটা অনেক ভাল লাগলো। ভিডিও চালু থাকায় পুরো দৃশ্যটা চমৎকার ভাবে ধারন হয়ে গেল।
পরে ঐ লোকটা আমার কাছে ৫ ইউরো চাইলো কবুতরের খাবারগুলোর জন্য। আমি তার সাথে বাংলায় কথা বলা শুরু করলাম। সে কিছুই বুঝলো না। আমার বন্ধু পরে কি বলাতে সে চলে গেছে। দোমোতে অনেক্ক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। দোমোর বিখ্যাত শপিং মলে ঢুকে একটু ঘুরাঘুরি করলাম। কি সুন্দর আর দামি দামি জিনিসপত্র বিশেষ করে রোলেক্স সহ অন্যান্য সব দামি ব্রান্ডের ঘড়ি দেখে তো আমি মাথা ঘুরা অবস্থা!! ভবিষ্যতে ৫০ হাজার ইউরো নিয়ে অধরা ভালবাসার হাত ধরে দোমোতে শপিং করার পরিকল্পনা করে মনে কিন্চিত দুঃখ নিয়ে সে জায়গা ত্যাগ করলাম৷ মিলানের মূল শহরে আরও কয়েকটা টুরিস্ট স্পট Vottorio Gallery, Sforzesco Castle, Teatro Alla Scala, Santa Maria, Sempione Park and Monumental cemetery ঘুরে Lecco lake এ আসলাম যেটা মিলান শহর থেকে ট্রেনে ২০ মিনিটের দূরত্বে। চারপাশে সবুজ পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছ পানির লেকটা অসাধারণ ছিল।
লেক্কোতেই আমার বন্ধুর মা বাবা থাকে। সারা দিন ঘুরে বিকেলে তাদের বাসায় গেলাম। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। বন্ধুর বাবা মা এত আন্তরিকতার সাথে গ্রহন করলো আমাকে!!! আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ইউরোপের গ্রামে ঘুরার খুব ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের, সেটা পূরণ হলো কারন বন্ধুর বাসা যেখানে সেটা গ্রামের মধ্যেই। কিন্তু এত সাজানো গোছানো যে এটাকে গ্রাম বলা অন্যায়।
৮ ই সেপ্টেম্বর ইতালির বিলাসবহুল শহর কোমো তে ঘুরতে গেলাম যে শহরে বিরাট কোহলির বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। ৫ ইউরো দিয়ে চলন্ত ক্যাপসুল ট্রেনে করে কোমোতে বিশাল উঁচু এক পাহাড়ে উঠলাম যেখান থেকে কোমো শহর এবং সুইজারল্যান্ডের ভিও টা অসাধারণের চেয়েও অসাধারণ লাগছিলো যা এখনও চোখে লেগে আছে। কোমো নিয়ে একটা লিখা আগে শেয়ার করছিলাম তাই বিস্তারিত বললাম না এখানে।
৯ই সেপ্টেম্বর, অপেক্ষার পালা শেষ, স্বপ্নের শহর ভেনিসে যাওয়ার দিন। অনেক আগেই আসা যাওয়ার টিকেট কাটা হয়ে গেছে। ৪৫ ইউরো আসা যাওয়া। হাইস্পিড ট্রেনের কথা অনেক শুনলাম, আজকে আমি সেই হাইস্পিড ট্রেনে উঠবো!! খুবই এক্সাইটেড ছিলাম।
দুপুর ১.৩০ এ মিলান সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে italo ট্রেনে করে রওয়ানা দিলাম। টিকেটে বগি নাম্বার এবং সীট নাম্বার দেয়া ছিল যেটা খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। ট্রেনের ভিতরের পরিবেশ টা মনে হলে কোন ভিআইপি রুম। এত সুন্দর, আর সীটগুলো এত আরাম দায়ক!!! খুব দ্রুত ট্রেন চলছে। প্রথম বার হাইস্পিড ট্রেনে করে যাচ্ছি!!! খুবই এক্সাইটেড!! এত দ্রুত চলছে ট্রেন কিন্তু কোন শব্দ নাই!! নিশ্চুপে সবুজের মাঠ ক্ষেত পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে তো ছুটছেই। প্রতিটি বগিতেই স্ক্রিনে ট্রেনের স্পিড দেখাচ্ছে, এবং একবার দেখলাম যে, ২১৮ কিমি গতিবেগে ট্রেন চলছে!!! প্রায় ২৮০ কিমি পথ ২ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম। ট্রেনে হালকা নাস্তার ব্যবস্থাটা অসাধারণ ছিল। আমার একটু বেশি ক্ষধা লাগায় আমি ২বার চেয়ে খেলাম। এই ট্রেনে ফ্রি ওয়াইফাই এর ব্যবস্থা ছিল বাট অনেক চেষ্টা করেও আমি কানেক্ট করতে পারি নি৷
আমি ভেনিসের এক স্টেশন আগে Mestree তে নেমে গেলাম এবং এখানে Via Antonio Vivaldi তে এক বন্ধুর বন্ধুর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো আগে থেকেই। তো এখানে বাংলাদেশী ৪ জনের এক মেসে উঠলাম এবং এক ভাই বিকেল বেলায় ওখানে ঘুরালেন এবং এ এলাকায় দেখলাম যে শতশত বাংলাদেশী। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে এ দিন আর মূল ভেনিস শহরে ঘুরতে গেলাম না।
পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা স্বপ্নের ভেনিস শহর ঘুরার জন্য বের হলাম। বাংলাদেশী এক ভাই বিনা টিকেটে আমাকে নিয়ে বাস এ উঠলো, বাট দুঃখজনক হলো ঐ স্টেশনেই আমাদের পিছন দিয়ে টিকেট চেকার উঠলো। চেকার কে দেখে আমার সাথের ভাই বাস ড্রাইভারের কাছে দ্রুত গেল টিকেট আনতে কিন্তু এ বাসে টিকেট নাই, পাঞ্চ মেশিন আছে যাদের কার্ড আছে তাদের জন্য।
পরে চেকারতো ধরলো আমাদের, আমার সাথের ভাই ইতালিয়ান ভাষায় কি কি জানি বলে ম্যানেজ করলো আমি বুঝি নাই। যাই হোক ভেনিসে ঢুকার আগেই বড় একটা ব্রীজ যখন পার হচ্ছিল তখন তা দেখে অনেক পুলকিত হয়ে গেলাম। কি সুন্দর আর বড় বড় জাহাজ। শেষ পর্যন্ত ভেনিস পৌঁছে গেলাম আমি, যে শহরের নদীর মত অলিগলি গুলো বিভিন্ন মানুষের ফেইজবুকে দেখতাম আগে।
Piazzale Roma বাস স্টেশনে নেমেই ঐ ভাই উনার কাজে চলে গেলেন। আমি একা হয়ে মনে মনে অধরা ভালবাসার হাত ধরে ভেনিসের সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলাম। কিভাবে যে ভেনিসের দৃশ্য গুলো বর্ননা করবো আমার জানা নাই। নদী বা সাগর শাসন কাকে বলে তা ভেনিসে না গেলে বুঝা যাবে না।
হাজার হাজার টুরিস্ট, শতশত বিভিন্ন সাইজের নৌকাসহ আরও জলযানে করে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে রোমাঞ্চকর ভাবে ঘুরতেছে যা শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। মনে মনে ভাবলাম ভবিষ্যতে অবশ্যই আমি আমার অধরা ভালবাসা কে নিয়ে ভেনিস আসবোই আসবো। আমি একাই হাটছি আর হাটছি, কোন স্পটই আমি চিনি না। অনেক বাংলাদেশীদের সাথে দেখা হলো, তাদের সাথে গল্প করলাম। আরাফাত ভাই ( যে ভাইয়ের বাসায় উঠলাম) দুপুরে আমার সাথে জয়েন করে আমাকে নিয়ে ঘুরার কথা।
এত সুন্দর লাগতেছে ভেনিস, একদিনে ঘুরে পোষাবে না ভেবে ভেনিস ট্রেন স্টেশনে গিয়ে টিকেটটা ১১ সেপ্টেম্বর ( ফিরতি টিকেট ছিল ১০ সেপ্টেম্বর রাত ৮ টায়) করতে চেষ্টা করলাম। বাট স্টেশনে গিয়ে কথা বলে জানতে পারলাম টিকেট চেন্জ করতে গেলে আরও ৩০ ইউরো দিতে হবে… ইউরো পকেটে ডেন্স দেয় না…. এটা চিন্তা করে টিকেট পরিবর্তনের আশা বাদ দিলাম।
দুপুর আনুমানিক ১.৩০ এর দিকে আরাফাত ভাই আসলেন। এবং দেখলাম যে উনার জ্বর, উনি বাসায় চলে যাবেন। কি আর করা মনটা কিন্চিত খারাপ হলেও কিছুই করার নাই। ভাই কে বল্লাম, ভেনিস এসে যদি একটু লঞ্চে না উঠি তাহলে কেমনে হয়। ৭.৫ ইউরো দিয়ে ৯০ মিনিটের ভেলিডিটির জন্য একটা টিকেট কাটলাম।
আরাফাত ভাই Ferrovia- Stazione Santa Lucia থেকে লঞ্চে তুলে দিতে গিয়ে দেখে অনেক ভিড়। পরে উনি উনার কার্ড দিয়ে আলাদা ভিআইপি গেইট দিয়ে আমাকে লঞ্চে তুলে দিলেন। এবং দেখলাম যে উনি আর নামতেছেন না। আমার সাথে যাচ্ছেন! কি যে খুশি লাগলো। আমরা San Marco তে নামলাম, দুমিনিট হেটে Rialto bridge এ আসলাম। এত সুন্দর ব্রীজটা যেটার উপর থেকে ভিও টা অসাধারণ। আমার কেমেরাট উনার হাতে দিলাম ছবি তোলার জন্য….
ওখান থেকে হেটে হেটে আমরা Piazza San Marco তে পৌছলাম। প্রতিটি ফটো স্পট এ ছবি তুললাম, ভাল লাগাটা হৃদয়ের মধ্যে এখনও ফিল করতেছি। যেহেতু ভেনিস শহরটা আরাফাত ভাইয়ের খুব পরিচিত জায়গা, তাই অল্প সময়ে Main tourist spot গুলো যেমন Piazza San Marco, Rialto Bridge, Accademia, Strada nuova, Grand Canal, Piazza Ducale, San Rocco, University ca’ Foscari Venezia, Church Salute ma Donna, Piazza Ducale এবং Ponte della libertà ঘুরা শেষ করলাম। প্রতিটি স্পট একেক রকমের সৌন্দর্য বহন করে। প্রতিটি স্পটে হাজার হাজার টুরিস্ট।
সন্ধ্যা ৮ টায় ফিরতি ট্রেন, তাই ৬ টার মধ্যে বাসায় চলে আসলাম কিন্তু একটু ও আসতে ইচ্ছে করছিল না। উনারা এত আন্তরিক ছিলেন আমার থেকেই যেতে ইচ্ছে করছিলো বাট ইউরোর চিন্তায় পরবর্তীতে অধরা কে নিয়ে আবার যাওয়ার পরিকল্পনা করে চলে আসলাম। Mestree station থেকে ৮ টায় রওয়ানা দিয়ে ১০টায় মিলান স্টেশন এসে পৌছলাম। এখান থেকে মিলানের বন্ধু মাহমুদ তার বোনের বাসায় নিয়ে গেল।
তো আমার পুরো ইউরোপ টুরের মধ্যে ভেনিস পার্টটা অন্যতম ছিল। যেটা এখনও খুব মিস করি….. আর সবচেয়ে খারাপ লাগে যে করোনা ভাইরাসের জন্য এ বিখ্যাত শহরগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা….
আজ আর নয়, পরবর্তী পর্বে সুইজারল্যান্ড ভিজিটের অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করবো। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আর স্পেশাল ধন্যবাদ আরাফাত ভাই কে, প্যারিসের রুহুল ভাইকে যার মাধ্যমে আরাফাত ভাইয়ের সাথে পরিচয়….আর অবশ্যই ধন্যবাদ মাহমুদ ভাইকে…