একটু আগে ইন্টারনেটে দেখলাম আমার ছাত্রী এসএসসিতে ফেল করেছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
আমি আর ওদের বাসায় ফোন দিলাম না।
এককাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিলাম।ব্ল্যাক কফি আমার স্ট্রেস কমায়।
এতই মনখারাপ হয়ে গেছে এই শেষ নভেম্বরের কোমল আবহাওয়ায়-ও ঘামছি।
কফি শেষ হওয়ার আগেই ছাত্রীর মায়ের নাম্বার মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠলো।
আসন্ন ঝড়ের শঙ্কা মনে নিয়ে আস্তে করে ফোনটা রিসিভ করলাম।
“স্যার বলছেন”
থমথমে একটা নারীকণ্ঠ শুনলাম।
জানি এটা ছাত্রী নিশাতের মায়ের কণ্ঠ।
এর আগেও অনেকবার কথা হয়েছে।
আজ কণ্ঠটা একেবারে অপরিচিত লাগলো,একদম সাপের মত শীতল।
“একটু আসতে পারবেন?এক্ষুণি! “
উনি অনুরোধ নাকি আদেশ করলেন বোঝা গেলো না।
আমি মরিয়া হয়ে উত্তর দিলাম
“আমি জানি ওর রেজাল্ট। আসছি।”
একটা ঝড়ের প্রস্তুতি নিয়ে নিশাতদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
দুই বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা, ওদের থেকে পড়িয়ে নিয়েছি।মোবাইলে ব্যাংকের ব্যালেন্স চেক করে দেখলাম, সাতাত্তর হাজার টাকা আছে।
মনেমনে ঠিক করে নিলাম, নিশাতের বাবাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ফিরিয়ে দেব।
স্টুডেন্ট পাশ করেনি,এই দায় কিছুটা আমারও।
যদিও কোনদিন আমি চেষ্টায় ত্রুটি রাখিনি।
তবু টাকাগুলো ফেরত দেব।কারো রক্তচক্ষুর পরোয়া আমি করিনা।
ভাবতে ভাবতে নিশাতদের গেটে রিকশা চলে এলো।অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে দুরুদুরু বুকে বেল বাজালাম।
ভেতরের অবস্থা মেঘ থমথম। ড্রয়িং রুমে নিশাতের আব্বা বসে আছেন।
সব শুনশান।
এত নীরবতা গায়ে কাটা দিচ্ছে।
সময় কাটছে না।
ঘড়ির কাঁটা যেন ড্রয়িং রুমে স্থির হয়ে আছে।
চাইছি, এখন একটা ঝড় উঠুক।
মেঘ কেটে যাক।
কিন্তু না।কেউ কোন কথা বলছে না।
এক কোনায় নিশাত বসে আছে।
ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে এক্ষুনি ওর হৃদপিণ্ড ফেটে কষ্টগুলো বেরিয়ে গিয়ে ওকে শান্ত করবে।
এই মূহুর্তে আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না।
এই পরিস্থিতি থেকে নিশাতকে কিভাবে বের করব সেটাও মাথায় আসছে না।
আমার কি এখন কিছু না বলে, দ্রুত ওদের বাসা থেকে বের হয়ে আসা উচিত?
মাথা কাজ করছে না।আমি এই মূহুর্তে সত্যি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি।
“কাল থেকে পড়াতে আসিয়েন।ওর পাশ করা লাগবে।”
হিমশীতল গলায় নিশাতের আব্বা নিরবতা ভাঙলেন।
আমি আটকে থাকা দম ছাড়লাম।
আর কোন কথা বাড়ালাম না কিংবা আমারও এ পরিস্থিতিতে কোন কথা বলার শক্তি নেই।
উনি ভেতরের রুমে চলে গেলেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে, বসে থাকা নিশাতের মাথায় একটা হাত রাখলাম।
সব স্বান্তনা বাক্যে হয়না কিছু স্বান্তনা নির্বাকও হয়।
মেয়েটার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।
যেন গুমোট মেঘ কান্না হয়ে ঝরছে।
আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না।
একপ্রকার দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
আমারও বয়স কম।
পিতার গাম্ভীর্য বা বিশালতা কিছুই ধারণ করা শিখিনি।
এত মন খারাপ আর কখনো হয়নি।
ওদের গলিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট কিনলাম।
প্রায় তিনবছর পরে আবার সিগারেট হাতে নিলাম।
তিনবছর আগে , যেদিন সীমা আমাকে রেখে আমারই বন্ধুর সাথে পালিয়ে বিয়ে করে নিলো, সেদিন আমি সিগারেট ছেড়েছিলাম।
মানুষ প্রেম হারালে নেশা ধরে আর আমি বিশ্বাসঘাতক চিনতে পেরে, মুক্তির আনন্দে সিগারেট ছেড়েছিলাম।
অদ্ভুত না?
কিন্তু আমার খুব শান্তি লাগছিলো এটা ভেবে যে, আমি আর ধোকার মধ্যে নেই।
ঐ চারবছর প্রেম ছিলো না, ধরে নিয়েছি ঐটা একটা দুঃস্বপ্ন!
বাসায় এসে নিশাতের আইডিটা আনব্লক করলাম।
তারুণ্যের প্রেম, বড় বাধভাঙ্গা আবেগে মোড়া থাকে।
পড়াতে গেলে আমি ওর চোখে মুখে শুধু প্রেম খেলা করতে দেখতাম।
মুখে কিছুই বলত না কিন্তু ওর সারামুখে প্রেম মাখামাখি হয়ে থাকত।
এত নিষ্পাপ, এত পবিত্র, এত নির্মল!
আমি দেখলেই ভয়ে কেঁপে উঠতাম।
এত নির্মল নিবেদনের যোগ্য আমি কোনদিনই নই।
আমি নিঃশব্দে এড়িয়ে যেতাম।
নির্মল প্রেম মাড়িয়ে যাওয়ার দুঃসাহস আমার যেন কখনো না হয়।
খুব সাবধানে পথ চলতাম।
প্রেম থাকুক তবে ঐ প্রেম যেন আমার মননে না লাগে।
নিঃশব্দে নৈবদ্য কুড়িয়ে নিতাম এমনভাবে যেন কিছুতেই নিশাত টের না পায়।
প্রেম যে আমার মর্মে লাগে, এটা ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না ,খুব সতর্ক থাকতাম।
ফেসবুকে এড ছিলো।
টুকটাক নক হত।
ওর পাঠানো প্রতিটা শব্দের আমি অন্যরকম অর্থ খুঁজে পেতাম।
আক্ষরিক শব্দে সুরের মূর্ছনা নষ্ট হবে।আমি ওকে ব্লক করে দিলাম।
আমি চাইও নি প্রেম আকার লাভ করুক।
ওর নিরাকার নিবেদন আমাকে ভালো রাখতে যথেষ্ট।
ব্লক নিয়ে নিশাত কথা তুললে, উত্তরে বলেছিলাম, “তোমার নিরবতাই সুন্দর “
মেয়েটা আর ব্লক নিয়ে কিছু বলেনি।
আজ ওর এমন অঝোরে কান্না আমি নিতে পারিনি।
আনব্লক করে রাখলাম।
যদি কিছু বলে হালকা হয়, হোক!
একবার কল দিতে নিয়েও দিলাম না।
রাতে ব্রাজিলের খেলা আছে।
এত পছন্দের দল!কিন্তু এখন আমার খেলা দেখারও মুড নেই। মাথাটা ধরে আছে।
একটা ঘুম দরকার।
কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।ঘুম ভেঙে গেলে,
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম ভোর পাঁচটা বিশ।
ওমা!সত্যি নিশাত কিছু একটা টেক্সট করেছে।
ক্লিক করতেই দেখলাম লম্বা মেসেজ।
“স্যার আপনি চলে যাওয়ার পরও সব ঠিকই ছিলো।আব্বু ভাত খেতে ডাকলেন।
আমার খাওয়ার রুচি ছিলো না। পেটভরা লাগছিলো।
এরপর বাড়িওয়ালী আন্টিরা আমার রেজাল্টের খবর নিতে আসলেন।আমার বান্ধবীর মা’ও এসেছিলেন।
সারাদিন অনেকেই ফোন করেছে। রাতেও আব্বু আম্মু কার-কার সাথে যেন ফোনে কথা বলেছেন।শুনেছি।
জানেন সবাই আসার পরে লজ্জায় আমি রুম থেকে বের হইনি।
সবাই অনেক ডাকাডাকি করে গেছেন।
সবাই চলে যাওয়ার পরে কেন এমন হলো বুঝতে পারলাম না।
শুনতে পেলাম আব্বু আম্মুকে মারছেন।
আম্মু চিৎকার করছেন।
আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি আম্মুর মাথাভরা রক্ত।
আমি আম্মুকে বাঁচানোর জন্য জাপটে ধরলাম।আম্মু আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।
খুব কান্না করছিলো আর বলছিলো সারাটা জীবন তোর জন্য শেষ করেছি।কি করি নাই আমি?কেন তুই আমাকে এই শাস্তি দিলি?
জানেন নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে।
সত্যিই তো এমন কোন কিছু নেই যা আব্বু আম্মু আমার জন্য করেননি।
আমি আরেকটু ভালোমত পড়লে আজকে আব্বু আম্মুকে এমন অপদস্ত হতে হত না”
নিশাত অনলাইনে নেই। তবু রিপ্লাই দিয়ে রাখলাম।অনলাইনে আসলে মেয়েটা দেখবে।
“নিশাত একদম মন খারাপ করো না।কতজনেরই তো দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়া লাগে।
আচ্ছা তোমার কোন পরীক্ষাটা বেশী খারাপ হয়েছিলো?
কাল এত মনখারাপ ছিলো বিস্তারিত শুনতে ইচ্ছে হয়নি।
আজ এসে সব শুনব।প্রয়োজনে আমরা বোর্ড চ্যালেঞ্জ করব।
আব্বু আম্মুর প্রতি অভিমান রেখো না।আসলে উনারাই তোমার সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী।
আশেপাশের লোকজনের কথা কানে নিওনা।
এরা হচ্ছে বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি!
তুমি বুঝলে তো আমার কথা?
এই প্রবাদের অর্থ তোমাকে এসে পইপই করে বুঝিয়ে দেব!
ভালো থেকো।এখন রেস্ট করো।এরপর থেকে আমরা নতুন উদ্যমে পড়ব।”
বিকেলের দিকে নিশাতের মায়ের মোবাইলে কল দিলাম।কখন যাব সেটা জেনে নেয়া দরকার।
ঐপাশ থেকে এত শোরগোল হচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
আবারও কল দিলাম।একই অবস্থা।
থাক আর কল দিব না।গিয়ে দেখি কি অবস্থা।
নিশাতদের গলিতে রিকশা গেলো না।
আতর লোবানের গন্ধে বোঝা গেলো কেউ মারা গেছে। ঐ তো খাটিয়া।
মৃত দাফনের পরিবেশ আমি একদমই নিতে পারিনা।
মাথা বুক ভার হয়ে যায়।
অকারণে এই মনখারাপ আজ মনে লাগানোর দরকার নেই।
নিশাতদের বাড়ির সামনেই খাটিয়া পাতা।লাশের খাটিয়া ডিঙিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
বরং বলে দিই কাল আসব।
নিশাতের জন্যও মনটা পোড়াচ্ছে। মেয়েটার সাথে আজই একবার দেখা হওয়া দরকার।
আমাকে দেখলে হয়ত একটু স্বান্তনা পাবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে এক পা দু পা করে কখন যেন নিশাতদের বাড়ির সামনের ছোট্ট জটলার কাছে এসে পড়েছি।
কে মারা গেছে জানতে ইচ্ছে হলো না।
জটলা কাটিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে নিশাতের আব্বার সাথে দেখা।
চোখাচোখি হতে উনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
পড়ে যাচ্ছিলেন।
আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম।
এখনো বুঝতে পারছি না কি হয়েছে।
কে মারা গেছে!
এটুকু বুঝতে পারছি, উনার কাছের মানুষ কেউ হবে!
মনে মনে নিশাতকে খুঁজছি। কোথাও চোখে পড়লো না।হয়ত মৃতের জন্য কোরআন শরীফ পড়ছে হবে!
উনি সেন্স হারিয়েছেন।
সবাই এসে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো।পানি ছিটানো হচ্ছে উনার চোখেমুখে।
চোখ খুললেন।
“স্যার নিশাত মা রাগ কইরা চইলা গেছে! “
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।এখনো বিষয়টা ক্লিয়ার না আমার কাছে।
“বুঝলাম না।কই গেছে?
আজ তো আমার আসার কথা ছিলো!
কই গেছে?
আপনি কাঁদছেন কেন?”
উনি আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন।
ঘরে কান্নার রোল উঠলো।
ওর মাকে আশেপাশে কোথাও দেখলাম না।
আস্তে-ধীরে জানলাম নিশাত রাতে সুইসাইড করেছে।
ঝগড়াঝাটির – অশান্তিতে কোন ফাঁকে নিশাত পালিয়ে গেছে, উনারা কেউ জানেন না।
সকালে দরজা ভেঙে পাওয়া গেছে মৃতদেহ।
পোস্টমর্টাম সেরে মেয়ে এখন চিরস্থায়ী নীড়ে যাওয়ার জন্য খাটিয়ায় প্রস্তুত।
পা এমন ভার হতে পারে জানা ছিলো না।
নিজের পা নিজেই টেনে আনতে পারছি না।
আমি দুলছি।
কি হারালাম,
কার কতটা গেলো, অনুভবের শক্তি আমার নেই। মন মগজ সব ভোতা হয়ে গেছে।
টলতে টলতে বাড়ি ছেড়ে এলাম,
এরপর খাটিয়াও পেরিয়ে এলাম।
আস্তে আস্তে গলি পেছনে রেখে বেরিয়ে এলাম চৌরাস্তায় অথবা জীবনের মোহনায়।
নিশাতের লাশ দেখার সাহস,শক্তি কোনটাই আমার নেই। এর চেয়ে বরং জীবিত নিশাতের স্মৃতি, পরম মমতায় হেঁটে বেড়াক আমার হৃদয়ের অলিন্দে অলিন্দে।
একটা খাম কিনলাম।
পঞ্চাশ হাজার টাকা, বেনামী খামে, কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলাম নিশাতের বাবার ঠিকানায়।
#একটি_জীবন_ও_প্রেমের_মৃত্যু
একটি জীবন ও প্রেমের মৃত্যু
Farida Ali Khan
Narayanganj