ভ্রমন কাহিনীঃ
#প্রথম_বিমান_যাত্রা
ফ্রান্স ২০১৬
২০১৬ সাল টা আমার চাকুরী জীবনে খুবই আনন্দময় একটা বছর ছিল। তখন আমি কক্সবাজারে ACF International নামে একটা অরগানাইজেশানে জব করতাম। জানুয়ারি তে আমি প্রমোশন পেলাম। সে আনন্দের রেশ না কাটতেই ফেব্রুয়ারী তে অফিস জানালো ৫ দিনের একটা মেন্টাল হেলথ্ ট্রেনিং এ প্যারিস পাঠাবে আমাদের ৩ জন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার কে। খবর টা শুনে যে কি পরিমান আনন্দিত আর এক্সাইটেড হয়েছিলাম যেটা এই লিখা লিখতে গিয়ে এখনও অনুভূত হচ্ছে। এর আগে দেশের বাহিরে কখনও যাই নি। কত ইচ্ছে ছিল বড় বিমানে উঠবো। অবশেষে আল্লাহ সে স্বপ্ন পূরন করাবে।
এর আগে আমাদের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ থেকে নেপাল ঘুরতে যাব বলে ৮ দিনের মধ্যে ৮০০০ টাকা দিয়ে পাসপোর্ট বানালাম ২০১২ তে বাট নেপাল যাওয়া হলো না। অবশেষে পাসপোর্টে একটা বিদেশি ভিসা সীল পড়বে… ভাবতেই যেন কেমন সুখ লাগতো।
ট্রেনিং শুরু হবে ১০ এপ্রিল আর শেষ হবে ১৪ ই এপ্রিল। তাই মার্চের মধ্যে ভিসা করতে হবে ঢাকায় গিয়ে। অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস নির্দিষ্ট সময়েই দেয়া হলো। তখন ইমেইল করে এপোয়নমেন্ট নেয়া লাগতো। সব কাগজপত্র রেডি করে আমি ফ্রান্স এম্বাসির ইমেইলে ইমেইল করে এপয়েনমেন্ট চাইলে তারা পরের সপ্তাহে এপোয়েনমেন্ট ডেট দিল। সময় মত সেখানে গেলাম। এবং আমার সিরিয়াল আসলো। খুবই ভয় লাগতেছিল।
এই প্রথম কোন ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি হব। কেন যাব কই যাব ইত্যাদি বেসিক কিছু প্রশ্ন করলো, উত্তর দিলাম। বাট কি একটা কাগজ আমার শট ছিল। তাই ফেরত দিল আমাকে এবং বললো আবার ইমেইল করে এপোয়েনমেন্ট নিয়ে যেতে। কি আর করা মন খারাপ করে চলে এলাম। পরে আবার ইমেইল করে ডেট নিয়ে সব সফলতার সাথে শেষ করলাম। ৭ দিন পর আমার অফিসের একজন পাসপোর্ট কালেক্ট করলো যেখানে আমাকে ২১ দিনের সেংগেন ভিসা দিল। পাশাপাশি আমার সাথের বাকি দুজনও ভিসা পেয়ে গেল। মজার বিষয় হলো আমার সাথের দুজনকে দেশে ফেরত এসে এমবাসি তে দেখা করতে বললো বাট আমাকে কিছু বলে নাই।
১০ এপ্রিল থেকে ট্রেনিং ছিল বাট আমরা ৩ জন সিদ্ধান্ত নিয়ে ২ দিন আগেই প্যারিস যাব বলে ঠিক করলাম। ৮ ই এপ্রিল ভোর ৪ টায় তার্কিশ এয়ারলাইনস এ ৩জন টিকেট পেলাম। রাত ১২ টায় গুলশান থেকে আমরা ৩ জন অফিসের গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌছালাম। আমার যে কি উত্তেজনা লাগতেছিল তা বুঝাতে পারবো না। এতই উত্তেজিত ছিলাম যে আমি আমার পাসপোর্ট সিকিউরিটি গেইট এ ট্রে তে রেখে চলে গেছিলাম৷ কিছুক্ষণ পর একজন আকবর হোসেন বলে ডাক দিলে বুঝতে পারলাম যে আমার পাসপোর্ট আমি রেখে আসছি। ইমিগ্রেশনে সব কাগজপত্র দেখলো, কি করি জানতে চাইলো। তো আমি মনোবিজ্ঞানী এটা শোনার পরই সে জানতে চাইলো আচ্ছা আমার সম্পর্কে একটু বলেন তো। এই প্রশ্ন টা আমি প্রতিবারই ইমিগ্রেশনে শুনি। যখনি তারা জানতে পারে আমি একজন মনোবিজ্ঞানী তখনও গল্প শুরু করে।
তো ইমিগ্রেশন শেষ, এর আগে বিমানে বোর্ডিং পাস নিলাম। আমরা ৩ জন একসাথে সীট চাইলাম। ৩.২০ এম এর দিকে বিমানে ঢুকার জন্য ডাক পড়লো আর আমরা গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। এই প্রথম বৈদেশি বড় বিমানে উঠতে যাচ্ছি। উত্তেজনা চরমে। বিমানে বিসমিল্লাহ বলে ডান পা দিয়ে ঢুকলাম, আমি ঢুকতেই সুন্দরী ললনারা হাস্যজ্বল মুখে ওয়েলকাম জানালো আর টিকেট দেখে পথ দেখালো। নাম্বার ধরে সীট খুঁজে দেখলাম যে আমাদের ৩ জনের সীট একদম পিছনের ৩ সীট। মাঝখানে ৪ সীট হলেও আমাদের টা শেষে হওয়াতে ৩ সীট। মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ জানালার পাশে বসতে না পেরে মন খারাপ। আমার কলিগ বললো যে আকবর ভাই জানালার পাশে বসে কি হবে, আকাশে আপনি কি দেখবেন। যাই হোক বসলাম। এতবড় বিমান কেমনে উড়বে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম।
খুব গুরুত্ব সহকারে কেবিন ক্রুদের দেখতে লাগলাম। সেফটি এনাউন্সমেন্টটা গুরুত্ব দিয়ে শুনলাম। এবার উড়ার সময়। যতই বিমান রানওয়ের দিকে যাচ্ছে ততই আমার উত্তেজনা বাড়তেছে। মূল রানওয়ে এসে যখন সাঁসাঁ করে টান দিল বুকটা ধড়পড় করে উঠলো। দেখতে দেখতেই বিমানটা উপরে উঠে গেল। স্বপ্ন পূরন হয়ে গেল। বিমান একদম উপরে উঠার পর কেবিন ক্রু রা খাবার মেনু দিয়ে গেল।
বড় খাবার যখন নিয়ে আসলো তখন আমি চিকেন আইটেমটা চুজ করছিলাম যতটুকু মনে পড়ে। খাবারটা দেয়ার পর মুখে দিয়ে দেখলাম যে ঝাল কম। আরেকটা কথা বলে নেই, তখন কানাডিয়ান এক মহিলা বস ছিল আমার, সে আবার আমি প্রচুর ঝাল খাই এটা জানতো। তো সে আমাকে দুষ্টামি করে বললো আকবর তুমি কাঁচা মরিচ নিয়ে যেও ফ্রান্সে। তো সে দুষ্টামি করে বললেও আমি সত্যি সত্যি কাঁচা মরিচ আধা কেজি নিয়ে নিলাম। তার মধ্যে কয়েকটা মরিচ আমি হ্যান্ড ব্যগে নিয়ে নিলাম। তো যখন দেখলাম যে বিমানের খাবারে ঝাল কম, তখন আমি ব্যাগ থেকে আমার কাঁচা মরিচ নিয়ে মজা করে খাওয়া শুরু করলাম। আহা কি শান্তি……..
তার্কিশ বিমানে সব ধরনের ড্রিংকস ফ্রী যত ইচ্ছে তত খাওয়া যায় এ কথাটা আমাদের আরেক কলিগ বললো। তো আমি আর আমার আরেক কলিগ সিদ্ধান্ত নিলাম যে ভাই আজকে বিমানের যত আইটেম ড্রিংকস আছে সবই খাব। যেই ভাবা সেই কাজ, আস্তে আস্তে অনেকগুলো আইটেমের এর পানি পান করলাম। কিছুক্ষণ পর পর একবার আমি আর একবার আমার ঐ কলিগ পিছনে গিয়েই এটা দেন সেটা ওটা দেন বলে নিয়ে আসতাম আর খেতাম। সীট একদম পিছনে হওয়ায় কেবিন ক্রুদের কাছে যাওয়া আসা সহজ ছিল। শেষবার যখন নাস্তার সময় আবার ড্রিংকস নিয়ে আসলো হঠাৎ আমার মাথায় ভোদকার কথা মনে পড়লো। ভোদকার নাম অনেক শুনছি বাট কখনও খাই নি। আজকে খাবই।
যেই ভাবা সেই কাজ, খুবই ভাব নিয়ে কেবিন ক্রুকে জিজ্ঞেস করলাম ” Do you have vodka?? Yes We have! Then plz give us vodka??? কেবিন ক্রু একটা গ্লাসে মাঝারি একটা বোতল থেকে ঢাললো, এবং আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলো… What do you want with Vodka!!?? i replied nothing, I will drink raw vodka… (খুব ভাব নিয়ে)। তখন সে আবার জিজ্ঞেস করলো are you sure nothing with vodka???
আমিও সেরকম বিরক্ত নিয়ে উত্তর দিলাম Yesss… Do u have any problem??? সে এবার ছোট গ্লাসটা ভরে আমার হাতে দিল এবং আরেকটা গ্লাস আমার কলিগের হাতে দিল। জীবনে প্রথম ভোদকা খেতে যাচ্ছি, ভাব কি আমার, ভাব খানা এমন আমি একজন ভোদকা খোর। এবার গ্লাসটা মুখে নিয়ে ডক করে মুখে অনেকটা ভোদকা ঢেলে গলাধঃকরণ করলাম। OMG…. Omaaaaa goooo….এটা কি খাইলাম। মুখে দেয়ার সাথে সাথে মনে হলো যে আগুন খাইলাম। চিতকার দিয়ে উঠলাম বিমানে। আমার চিতকারে আশেপাশের মানুষের ঘুমও ভেঙে গেলো। আমার পুরো বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে পানি চাইলাম। কেবিম ক্রু পাশেই ছিল।
পানি খেলান অনেকগুলো, বাট বুকজ্বালা তো কমে না। আমার কলিগ তখনো মুখে দেয় নাই। তাড়াতাড়ি তাকে নিষেধ করলাম খেতে। প্রায় ৫/১০ মিনিট আমাকে নিয়ে কেবিন ক্রুরা ব্যাস্ত ছিল। যে সস্তা ভাবটা একটু আগেও ছিল সে ভাবটা আমার আর নাই। লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে আমি এখন এক হতভাগা ভদ্র বিমান যাত্রী হয়ে বসে আছি।
তার প্রায় ১ ঘন্টা পর বিমান ল্যান্ড করলো। বিমান থেকো বের হয়েই প্রচন্ড বরফ শীত অনুভব করলাম। সুয়েটার গায়ে দিলাম। ইমিগ্রেশন সুন্দর করে পার হয়ে তিন কলিগ গার্ড এ নর্ড এ গিয়ে একটা হোটেলে উঠলাম এবং স্বপ্ন পূরনের ধাপটা শেষ করলাম।
তো আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার সবচেয়ে স্বরণীয় মুহুর্ত হলো ভাব সাব নিয়ে raw vodka খেতে গিয়ে বুক জালিয়ে ফেলা যেটা সারা জীবন আমার মনে থাকবে।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ….