ফ্রিজ পর্ব ৯
সকাল বেলা নাস্তার পর মামা বলল,” রুনু চল তো মা তোদের এলাকাটা ঘুরে আসি।”
মামার সাথে বের হলাম। মামা কে নিয়ে ঘুরতে আমার বেশ ভালো লাগে! আমাদের এলাকা বলতে গোটা ত্রিশ বাড়ি, দেয়ালঘেরা ছোটোখাটো একটা মাঠ আছে সেখানে ছেলেবেলেরা ক্রিকেট খেলে। মাঠ কতদিন টিকবে ঠিক বলা যাচ্ছে না। এখানেও হয়ত যেকোনো দিন বাড়ি উঠে যাবে। এতটুকুন এলাকায় দুইটা মসজিদ আছে। এ মাঠটা যখন না থাকবে।
চায়ের দোকানে আড্ডা মারা আর সন্ধ্যার পর ছাদে তাসের আসর ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না ছেলেদের।
রাস্তায় দেখা হলো লিটন ছেলেটার সাথে। মামা কে বেশ কায়দা করে সালাম দিলো, ভদ্র ছেলেদের মতো। কোমল স্বরে আমার কাছে পরিচয় জানতে চাইল। আমার মামা পরিচয় শুনে একটু সমাদর করার চেষ্টা!
মামা অবশ্য তেমন একটা পাত্তা দিলো না।
আমার মনে হয় মামা এ সব ব্যাপার আগেই মোকাবিলা করেছে! আমার মা তো কম সুন্দরী ছিলো না। না-কি সে সময়ে ছেলেরা এমন ছিলো না।
মামা বলল, “ছেলেটা কে রে? “
“লিটন। আমাদের এলাকার বিরাট বড়োলোকের ছেলে।”
“ছেলেটা মনে হয় ভালোই! “
“আমি বললাম তোমার আর বাবার কাছে দুনিয়ার সব মানুষই ভালো তা-ই না মামা?”
মামা কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা একটু হাসি দিলো।
মামা কে নিয়ে এসেছি আমাদের স্কুলের সামনে। ঢাকা শহরের স্কুল আর বাড়ির মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই। সামনের সাইনবোর্ডটা দেখে বুঝা যায় এটা একটা স্কুল।
স্কুল,খেলার ছোটো মাঠ, মসজিদ ছাড়া আর কী বা আছে আমাদের এলাকায়? গুটিকয়েক দোকান, রাস্তার মাথায় একটা মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে হয়েছে নতুন। যাওয়া হয়নি কখনো। খাবারের নাকি যা দাম! ও সব বড়োলোকদের জন্য। মামা বলল, “আইসক্রিম খাবি রুনু?”
মাথা নাড়িয়ে মানা করলাম। তবু্ও মামা একটা আইসক্রিমের দোকানে ঢুকে পড়ল। “কোনটা নিবি বলতো মা?”
অনেকটা বাধ্য হয়ে একটা কোণ আইসক্রিম নিলাম। কতদিন এ দোকানটার সামনে দিয়ে গেছি কখনো ভিতরে ঢুকিনি। আমার ক্লাসে পড়ে টুম্পা। ওর বাবা কিসের যেন ব্যবসা করে। আমাদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। প্রায় দিনই কোণ আইসক্রিম খায়। আমাকে ডাকে খাবার জন্য আমি যাই না। ও খাওয়ালে পরে ওকেও তো খাওয়াতে হবে তা-ই না? একটা কোণ আইসক্রিম কত টাকা কে জানে? মনে হয় অনেক দাম। কখনো কিনিনি তো! তাই ঠিক দামটা জানা নাই! বাবা অবশ্য দুয়েকবার এনেছিল। মা খুব রাগ করেছে! এমনতেই সংসারে চলে না!
এখনতো সব ধরনের খরচ বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রিজ কিনবে বলে। আগে সপ্তাহে একদিন একটু ভালো খাবার রান্না হতো। পোলাও, মাংস, পায়েসও হতো মাঝেসাঝে। এখন সব বন্ধ।
মামা আমার হাতে একটা কোণ আইসক্রিম দিলো। আপাকে ছাড়া আমার খেতে ইচ্ছে করছে না! আপার জন্য একটা নিয়ে যেতে পারল হতো। দুইজন একসাথে খেতাম। মামা কে বললে অবশ্য কিনবে। এমনিতেই মামার অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। মামা বলল,” রুনু সবার জন্য একটা নিয়ে নিই কী বলিস? সবাই মিলে খেলে ভালোই লাগবে!”
আমি কিছু বললাম না। মামার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। মামা ছয়টা আইসক্রিম কিনল। আমি বললাম,” মামা ছয়টা কিনেছ কেন?”
“তোর আনোয়ার চাচা আছে না?”
আমার একটু হাসি পেল। আনোয়ার চাচা কি আইসক্রিম খাবে? আমরা দিলে মনে হয় খাবে।
আমার হাতে আইসক্রিম দেখে মা একটু কেমন করে তাকাল। মায়ের ধারণা আমিই মামা কে আইসক্রিম কিনে দিতে বলেছি। মামা না থাকলে বকাও দিতো!
মামা মা কে একটা আইসক্রিম দিয়ে বলল, “নে আপা আইসক্রিম খা।”
মা মনে হয় কেমন লজ্জা পেল! আমার কি আইসক্রিম খাওয়ার বয়স আছে? তোরা খা।
“খাওতো আপা। আইসক্রিম খাওয়ার আবার বয়স আছে নাকি!”
মা আইসক্রিমটা খুলে একটু কামড় দিলো। মা কে কেমন বাচ্চাদের মতো লাগছে! আইসক্রিম খাচ্ছে আবার কেমন করে হাসছে। মা কে কী যে ভালো লাগছে!
আপা আর আমি এসেছি আনোয়ার চাচার ঘরে। আমাদেরও দেখে আনোয়ার চাচা একটা হাসি দিলো।” আজ দুইজন একসাথে? “
আমি আনোয়ার চাচা কে একটা আইসক্রিম দিলাম। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আইসক্রিম এনেছিস কেন!”
আপা বলল,” আইসক্রিম খাওয়া কি আপনার বারণ নাকি? নেন।
হাত বাড়িয়ে আইসক্রিমটা নিল। আনোয়ার চাচা আইসক্রিম খাচ্ছে। দেখতে ভালোই লাগছে! আপা আর আমি ছাদে চলে আসলাম। সন্ধ্যাবেলা ছাদে উঠাটা পছন্দ করে না। অবশ্য দিনের বেলা আমরা ছাদে উঠি না। ছাদে উঠি রাতের বেলা। রাতের বেলা আমাদের কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু ছাদ থেকে আমরা দেখতে পারি। এখন দেখা যাচ্ছে লিটন ছেলেটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটা দিনের বেশি সময় চায়ের দোকানেই থাকে।
ছাদে এসেছি অনেকটা সময় কেটে গেছে। মা এখনো আমাদের খোঁজ করেনি! মা কী করছে কে জানে? মনে হয় মামার সাথে কথা বলছে। ভাই-বোন ভালোই গল্প করে।
আপা বলল,” এক কাপ কফি খেতে পারলে ভালো হতো।”
“কফি নিয়ে আসব নাকি আপা?”
আনোয়ার চাচার বাসায় কফি আছে। ইচ্ছে করলে বানিয়ে আনা যায়। যাব কি না বুঝতে পারছি না। যেতে ইচ্ছে করছে না। ছাদে বসে থাকতেই ভালো লাগছে! আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদটা এখন একটু বড়ো হয়েছে। ইদের সময় ছোটে হয়ে গেছিল। ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। একটা শীতল পাটি হলে ভালো হতো। শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখা যেত।
মামা আজ চলে যাবে। এ কয়দিন ভালোই কাটছিলো মামার সাথে। মা খুব ভোরে উঠে নাস্তা বানিয়েছে। মামার জন্য খাবার রেঁধেছে। একটা বাটিতে করে খাবার দিয়ে দিছে। বাবা যাবে মামা কে রেলস্টেশনে ছেড়ে দিতে। আপা মামার ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে দিছে।
নাস্তা শেষ করে মামা বের হয়ে গেল। যাবার সময় আমি আপা আর মা অনেকটা পথ সাথে সাথে গেলাম। মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “যাই রে মা ভালো থাকিস।”
আমার চোখদুটো কেমন ভিজে গেছে। মায়ের চোখদুটো ছলছল করছে। মা বলল, “সাবধানে যাবি। পৌঁছে কল দিবি।”
মামা চলে যাওয়ার পরও আমরা অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আপা বলল, “মা চল বাড়িতে যাই।”
মা একটা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে বলল, “চল যাই।”
স্কুল থেকে বের হয়ে দেখি আপা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আপা কে দেখে এগিয়ে গেলাম।” আপা তুমি এখানে?”
‘তোকে নিতে এলাম। আজ আমাদের কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। আমাদের একজন স্যার আজ মারা গেছে! একটা ক্লাস হওয়ার পর খবর পাওয়া গেল। স্যার মারা গেছে! কলেজ ছুটি হয়ে গেল।”
আমরা স্কুল থেকে বাড়ির দিকে হাঁটছি। রাস্তার পাশে একটা বড়ো ফ্রিজের দোকান দেখলাম। আমি বললাম, “আপা চল ফ্রিজ দেখি।”
আমরা ফ্রিজের দোকানটায় ঢুকলাম। কত ফ্রিজ দোকানটায়! বড়ো একটা ফ্রিজ দেখলাম। কী বড়ে ফ্রিজটা! গরম লাগলে ফ্রিজের ভিতরে ঢুকে পড়া যাবে। আমরা ঘুরে ঘুরে ফ্রিজ দেখছি। মা কত দামের ফ্রিজ কিনবে জানি না। মনে হয় ছোটোখাটো কোন একটা কিনবে। আমি আর আপা তিনটা ফ্রিজ পছন্দ করে রেখেছি।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ