১. একজন ভালো বন্ধুর গল্প
২.বন্ধুত্বের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত
৩.সত্যিকারের বন্ধুত্বের গল্প
৪.কলিজার বন্ধু স্ট্যাটাস
১. একজন ভালো বন্ধুর গল্প
ছোটবেলায় আমার একটি নেশা ছিল । আমাকে পরীক্ষায় প্রথম হতেই হবে । আমার আব্বা জজ ছিলেন, তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, তোমাকে সবার চেয়ে বেশি জানতে হবে ।
আমার স্কুলের সব বন্ধুরা যখন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত, তখন আমি জ্যামিতি আর বীজগণিতের মাঝখানে ডুবে থাকতাম। তাই বৃত্তি পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হওয়াটি আমার কাছে ছিল ডালভাতের মত ।
ক্লাসে আমি হতাম প্রথম আর তাপস হতো দ্বিতীয়। তাপস ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আর খুব নরম মনের মানুষ। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলতো না ও ।
ক্লাস শেষ হলেই সাথে সাথে দিতো ছুট । আমার কাছে ওর এই ব্যবহারটি ঐ বয়সে কেমন যেন লাগতো । একদিন ক্লাসের শেষে আমি তাপসের পিছু নিলাম , ও আসলে কোথায় যায়, কি করে সেটা দেখতে ।
দুই মাইল হেঁটে অন্য একটি গ্রামে গিয়ে সে ঢুকে পড়লো একটি ছোট ছনের ঘরে । এখানেই থাকে সে ? আমার মনটি কেমন যেন হয়ে গেলো ।
আমি যে এতক্ষণ তাপসকে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছি সেটা সে বুঝতে পারেনি । হঠাৎ ওর মা বেরিয়ে এলেন, সাথে সেও । দুজনেই আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ।
তাপস জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের গ্রামে কোথায় এসেছিলে ? আমি বললাম, এই এখানেই, একটি কাজে এসেছিলাম ।
ওর মা আমাকে দেখে খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন, তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কিভাবে তার ছেলের সহপাঠীকে আপ্যায়ন করবেন । আমাকে একটি পিঁড়িতে বসতে দিয়ে, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে একটি থালায় কিছু মুড়ি নিয়ে এলেন ।
আমাকে খেতে দিতে দিতে বললেন , তাপসের বাবা নেই , স্কুল ছুটির পর পাশের জমিতে কামলা খাটে, ওই সংসার চালায়।
আমি যে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । আমার মাথায় শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কীভাবে সারাদিন কাজ করেও এই ছেলেটি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয় !!!
ওর মা বলতে থাকলেন , জানিনা বাবা, আর কতদিন ও পড়তে পারবে । যা খরচ । কোনো বৃত্তি না পেলে ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। ও তো কখনো প্রথমও হতে পারে না যে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারবে । ( তখন আমাদের স্কুলে এই নিয়ম ছিল যে, শুধু ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্র/ছাত্রী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবে )।
আমার মন এত খারাপ হয়ে গেলো যে আমি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম । মনে আমার শুধু বেজে চলেছে ওর মায়ের কথাগুলি ।
কয়েকদিন পর পূজা । সবাই কেনাকাটা করছে বাজারে । হঠাৎ তাপসের মাকে আমি বাজার দেখতে পেয়ে কিছু কিনে দিতে চাইলাম কিন্তু তিনি কিছুতেই নিতে রাজি হলেন না।
এরপরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । আজকে ঈদ । বাসায় রান্নার ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে । হঠাৎ আমাদের দারোয়ান এসে বললো, একটি ছেলে আমার সাথে দেখা করতে চাইছে ।
আমি বললাম, তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিন । দারোয়ান বললো , অনেকবার বলেছি কিন্তু কিছুতেই ভিতরে আসতে চাইছে না। তাপস দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে । আমি বললাম , আরে, আরে , বাসায় চলো । ও কোনো মতেই বাসায় এলো না ।
যাওয়ার আগে আমার হাতে একটি পুটলি ধরিয়ে দিয়ে বললো , আজকে তোমাদের ঈদ , আমি এটি তোমার জন্য এনেছি । আমি খুলে দেখবার আগেই ও পালিয়ে গেলো । বাসায় এসে দেখলাম একটি রঙ্গিন পাঞ্জাবি ।
ভাবলাম যার নিজের জীবন ধূসর রঙ্গে রাঙা সে কিনা আরেক জনের জীবন রাঙাতে রঙিন পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে!
ঈদের দিনেও আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো ।
এর পরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । পরীক্ষাও এসে গেছে । পরীক্ষার দিন ওর সাথে দেখা হলো ।
ও আমার কাছে এসে বললো, এটাই আমার শেষ পরীক্ষা , আর কোনোদিন পড়াশুনা করতে পারবো না । তোমার সাথে আর আমার দেখা হবে না ।
ওকে কেন যেন ভালোবেসে ফেলেছিলাম । ওর চোখের দিকে তাকালাম । দুচোখে শুধুই বৃষ্টির আভা ।
পরীক্ষা শেষ হলো, কয়েকদিন পরে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে । আব্বা জিজ্ঞেস করলেন , কেমন পরীক্ষা দিলে ? প্রথম হতে পারবে তো ? আমি হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর দিলাম না ।
আমি তো জানি আমার কি রেজাল্ট হবে ।
রেজাল্ট বেরুনোর দিন আমি তাপসের পাঞ্জাবিটি পরে রেজাল্ট আনতে গেলাম। দেখলাম, সারা ক্লাসে উত্তেজনা । তাপস প্রথম হয়েছে আর বৃত্তির জন্য মনোনীতও হয়েছে সে। তাপসের দুই চোখে আনন্দ অশ্রু।
সে আমার কাছে এসে চুপিসারে বললো ,”এভাবে তুমি আমার পাঞ্জাবির ঋণ শোধ দিলে?
শিক্ষক বলেছে তুমি প্রশ্নের সব উত্তর দাও নি, কিন্তু আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছো, যাতে আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারি,তাই না?
২.বন্ধুত্বের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত
জন্ম মৃত্যু
.
যে ভয়টা গত চার মাস ধরে করে আসছিলাম, আজকে তাই হলো। গ্রীষ্ম গেলো, শরৎ গেলো কোনো খোঁজ নাই; এখন এই বিদঘুটে ঠান্ডায় তার মনে পড়লো? আমার বন্ধুর ফোন- রিপন কী খবর?
– ভালো
– শোন, জরুলী কথা আছে। তোর বাসায় আমি চারটা বাশকো রাখছিলাম না?
– হু
– আছে না ফেলে দিছিস?
– আছে
– ছুটির দিন, একটা বাশকো একজনকে দিয়ে আসতে পারবি? তোর বাসার পাশেই
– ওকে
– গুড। কিন্তু সাবধান, ভদ্রমহিলা প্রেগন্যান্ট। দুই সপ্তাহ পরে বাচ্চা হবে। এননাইন্টিফাইভ মাস্ক পরবি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার মাইখে ডেলিভারি দিবি
– দোস্ত রে, বাচ্চা হওয়ার পরে দি?
– ক্যা?
– এই সময়ে তার বাসায় যাওয়া কি ঠিক? কখন ব্যাথা উঠে না উঠে..
– কখন দিতে হবে না হবে, সেটা তুই ভালো জানিস না আমি? ব্যাটা মূর্খ! তুই শুধু বাশকো ডেলিভারি দিয়ে চলে আসবি। বাচ্চা ডেলিভারি দিতে তো কই নাই! আর না পারলে বলে দে, অন্য লোক পাঠাবো।
.
আমি তার বাশকো [বাক্স] নিয়ে রওনা দেই।
সে বলছিল বাসার পাশে, কিন্তু জিপিএস-এ দেখি বাসা থেকে পাক্কা সাতাশ কিলোমিটার। একেতো মারাত্মক ঠান্ডা, তার উপর স্নো। ঢাকায় থাকতেও অনেক জ্বালাতো। বলতো অমুক জায়গায় যা, দশ টাকা রিক্সা ভাড়া। রিক্সায় উঠে দেখতাম পঞ্চাশ টাকা। তার “এই তো কাছে” কথার মানে ধরে নিতে হবে পঞ্চাশ কিলো।
.
মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রিতে আধা ঘন্টা ধরে গাড়ির বরফ সাফ করা যে কত কষ্টের, সেটা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। হাত-পা জমে অসহ্য ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে, নাক চোখ দিয়ে নেমে আসবে বন্যার পানি। এক ঘন্টা ড্রাইভ করে পৌঁছুলাম বিশাল এক বাড়ির গেইটে। ইন্টারকম সুইচ টিপতেই স্পিকারে এক ভদ্রমহিলা বলে উঠল- জাভেদ?
– জি
– ভেতরে আসুন। দরজা ওপেন।
.
এই বাড়ির দাম কমপক্ষে তিন মিলিয়ন তো হবেই। ঝকঝকে তকতকে, আধুনিক বাক্স আকারের বাড়ি। আমি ড্রাইভওয়ে পার হয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতে সেটাও খুলে গেলো। ভেতরে জুতার কভার রাখা, সেটা পরে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলাম। ভদ্রমহিলা দেয়াল ধরে ধরে সাবধানে এসে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। বলল জাভেদ, বাসায় কেউ নেই। আমার হাজবেন্ড টরন্টো গেছে। আপনাকে যে কি দিয়ে আপ্যায়ন করি..
– না না, ওসব কিচ্ছু লাগবে না। আপনি অসুস্থ। আমি পার্সেলটা দিয়ে চলে যাবো
– আপনার ভাইয়ের আসতে এখনো দুই ঘন্টা দেরি। আমার মেয়ের আসতে এখনো এক ঘন্টা লাগতে পারে; অনার্স পরীক্ষা চলছে। আমি খুব সিক ফিল করছি
– কোনো হেল্প লাগলে বলবেন
– যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি আমাকে হাসপাতালে নিতে পারবেন?
– তারচেয়ে বরং আমি এম্বুলেন্স ডেকে দেই?
– এম্বুলেন্স তো আমিও ডাকতে পারি। আমি এম্বুলেন্স এ উঠতে ভয় পাই
– ওকে, ঠিক আছে চলেন
– আমি এখন যেতে চাচ্ছি। কেন জানি ভয় লাগছে। হঠাৎ পেইন উঠেছে
– আমি গাড়িটা তাহলে গেইট দিয়ে ঢুকিয়ে দরজার পাশে আনি।
.
আমি মেইন গেইট দিয়ে গাড়িটা ব্যাক ইন করে ভেতরের উঠোনে নিয়ে আসি। উনি নিজেই আস্তে আস্তে হেঁটে উঠে বসলেন। সাবধানে গাড়ি টান দিতে থাকি। হাসপাতাল খুব একটা কাছেও না। কেন যে কাছেরটা রেখে দুরেরটায় যেতে চাচ্ছে খোদা মালুম। মনে হচ্ছে খুব জেদি মহিলা, কারো কথা শুনবে না। এই হেভি স্নো এর মধ্যে বিশ কিলোমিটার যাওয়া কম কথা না। গাড়ি ছাড়ার দুই মিনিটের মাথায় কোঁকানি দিয়ে উঠে ‘আ’ বলে উঠলেন। আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছেন?
– হা..উঃ..
.
আমি মারাত্মক টেনশনে পড়ে যাই। বোঝাই যাচ্ছে প্রসব বেদনা। আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকি; বাক্স ডেলিভারি দিতে এসে শেষ পর্যন্ত বাচ্চা ডেলিভারি দেওয়া যেন না লাগে। দেশে পড়ছিলাম জুওলজি। আর কানাডা এসে নিয়েছিলাম ল্যাব টেকনিশিয়ান সার্টিফিকেট। ওটা পরে কোনো কাজে লাগে নাই, ঐ ফিল্ডে চাকরি পাই নাই। ফিলিপিনোদের সাথে কম্পিটিশনে পেরে উঠি নাই। অবশ্য কোর্স করার সময় ঐ কলেজে একবার বাচ্চা ডেলিভারির ভিডিও দেখিয়ে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিল। সেই বীভৎস দৃশ্য মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি। ভাই রে ভাই..
.
পাঁচ কিলোমিটারও এগিয়েছি কিনা সন্দেহ, ভদ্র মহিলা এবার তীব্র যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠল। মিনিটখানেক পরপর চেঁচিয়ে উঠতে লাগলো। উনার কাছে অনুমুতি না নিয়েই আমি নাইন-ওয়ান-ওয়ান এ কল দিলাম। সাথে সাথে অন্য পাশ থেকে অপারেটর ফোন ধরে বলল, বলেন কী সাহায্য করতে পারি!
– আমি একটা পেশেন্ট নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি, বাচ্চা ডেলিভারি হবে। কিন্তু রাস্তার মধ্যেই তার বেশ ব্যাথা উঠে গেছে
– আপনি এখন কোথায়?
– কার্লিং এভিনিউ তে। এখন ক্যানাডিয়ান টায়ারের সামনে দিয়ে ইস্ট এ যাচ্ছি
– কোন হসপিটালে যাচ্ছেন?
– অটোয়া জেনেরাল
– ওকে, সাবধানে ড্রাইভ করেন। লাইন কাটবেন না। এম্বুলেন্স আপনাদের গাড়ি ধরে ফেলবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। দ্রুত যে কোনো পার্কিং লট-এ পুল ওভার করবেন। রাস্তার পাশে না থামাই ভালো। গাড়ির নাম্বার, কালার, নাম্বার প্লেট বলেন।
.
এবার ভদ্র মহিলা প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে বললেন, জাভেদ, আমার হয়ে যাচ্ছে! পানি ফেটে গেছে। আর সময় নাই!
.
ইয়া আল্লাহ!
আমি অপারেটরকে বললাম, উনার বাচ্চা মনে হচ্ছে এক্ষুনি হবে, কী করবো?
– আপনি এক্ষুনি গাড়ি পার্ক করেন। আপনাদের ঠিক পেছনেই এম্বুলেন্স এসে গেছে। দেখতে পাচ্ছেন ?
– হ্যা!
– আমরা লাইন এ আছি, এম্বুলেন্স থেকেও আমাদের সাথে ফোনে যোগ দিচ্ছে প্যারামেডিক পার্সন। আপনাকে ইন্সট্রাকশন দিবে। শান্ত থাকবেন, টেনশন নিবেন না। গুড লাক!
.
সৌভাগ্যক্রমে ঠিক পাশেই একটা চার্চ এর পার্কিং লট পেয়ে ঢুকে পড়লাম। এম্বুলেন্সটাও পাশে এসে দাঁড়ালো। আমার গাড়ির মধ্যে তখন চলছে ভয়ার্ত চিৎকার। জীবনে এরকম ভয়াবহ দৃশ্য আর দেখি নাই। এতো কষ্ট! ও আল্লাহ রক্ষা করো!
.
.
এম্বুলেন্স থেকে প্যারামেডিক এর লোক এসে আমাকে বলল, আপনি এম্বুলেন্স এর সামনে প্যাসেঞ্জার সিটে গিয়ে বসুন। বাচ্চা ডেলিভারি শুরু হয়ে গেছে। আমরা দুঃখিত এই অবস্থায় রোগীকে এম্বুলেন্সে ট্রান্সফার করা যাবে না। আপনার গাড়িতেই ডেলিভারি করানো হচ্ছে। আপনার আপত্তি নেই তো?
– কোনো সমস্যা নাই।
.
আমি তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স এর সামনে গিয়ে বসি। বাইরে এখনো মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রি। দুই মিনিটের মাথায় দেখি তারা কম্বলের মধ্যে নবজাতক বাচ্চা মুড়িয়ে এম্বুলেন্সের পেছনে নিয়ে ঢুকালো। একজন এসে বলল, আপনি বাচ্চার কে হন?
– মামা
– কংগ্রাচুলেশন্স! আপনি এখন লাভলী কিউট মেয়ে বাচ্চার গর্বিত মামা!
– থ্যাংক ইউ! আলহামদুলিল্লাহ!
– হোয়াট?
– না কিছু না।
.
একটু পরে তারা স্ট্রেচারে করে মা কেও দ্রুত গাড়ি থেকে বের করে এম্বুলেন্সে তুলে আমার কাছে এসে বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার বোন আর ভাগ্নি দুজনই বেশ ভালো আছে। আপনি যা করেছেন, একদম পারফেক্ট! পার্কিং লটটা বাচ্চা ডেলিভারির জন্য দারুন!
– হা হা
– আপনার গাড়ি আমরা ক্লিন করে দিচ্ছি। পাঁচটা মিনিট সময় দিতে পারবেন?
– শিওর!
– আমরা বাচ্চা আর মা কে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি কি যেতে ইচ্ছুক?
– অবশ্যই!
.
আমি অপেক্ষা করতে থাকি এম্বুলেন্সের মধ্যে। প্রযুক্তিতে ঠাসা। এমার্জেন্সি রেডার আছে মনে হয়। এদের এম্বুলেন্স যে আসলে কত বড়, ভেতরে না বসলে বোঝার উপায় নেই। মাঝারি সাইজের ট্রাকের সমান। এসব দেখাও কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়। এজন্য আমার বন্ধু একটা বড়সড় ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
ছেলেটা আবার এসে বলল, আপনি কি মুসলিম?
– হু
– আপনার বোন জিজ্ঞেস করল আপনি আধান [আজান] দিতে পারবেন কি না
– অবশ্যই!
– একটু কষ্ট করে যদি গাড়ির পেছনে আসতেন..
.
আমি বাচ্চার ডান কানের কাছে ফিসফিস করে “আল্লাহু আকবর” বলে আযান দিতে থাকি। যদিও বাচ্চাটা ইনকিউবেটরে, আমার আযান তার কানে পৌঁছাচ্ছে কিনা সন্দেহ। বাচ্চাটা ঘুরে থাকায় চেহারা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। বাচ্চার মায়ের দু চোখ বেয়ে খুশির অশ্রুধারা নেমে আসছে। পাশে বসা প্যারামেডিক বিস্ময়ে আমার দিয়ে চেয়ে থাকে..
.
এম্বুলেন্স চলা শুরু করার আগে ছেলেটা এসে বলল, আপনি ইচ্ছে করলে বাসায় চলে যেতে পারেন। বাচ্চার বাবা আর খালা হসপিটালে অপেক্ষা করছে। ভদ্রমহিলা আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই দেখেন আপনার ভাগ্নির ছবি- বলে সে তার মোবাইল স্ক্রিনে একটা রাজকন্যার ছবি দেখালো। বলল আপনাকে যেন টেক্সট করে পাঠিয়ে দেই।
আমি আনন্দে কেঁদে ফেলি। মাশাল্লাহ!
.
ছেলেটা আবার এসে বলল, আপনার বোন আপনাকে অনুরোধ করেছে তার মেয়ের জন্য একটা নাম ঠিক করে দিতে। ভালো নাম মনে হলে যেন তাকে জানাই। উনি আসলে খুব আবেগতাড়িত হয়ে আছেন
– এখনই বলি? একটা নাম মনে এসেছে
– কি?
– ‘নুহা’
– বিউটিফুল! আপনি এই কাগজে স্পেলিং লিখে দেন প্লিজ, হয়তো বার্থ সার্টিফিকেটেও দেবে।
.
আচ্ছা হঠাৎ এই নুহা নামটা কেন আমার মাথায় আসলো?
আমি ওদের বিদায় দিয়ে রিলাক্স হয়ে সিটে বসলাম। কেমন একটা স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করতে থাকি। ঠিক পাশেই টিম হর্টন্স থেকে কফি এনে গাড়িতে বসতেই দেখি বেআইনি পার্ক করার জন্য উইনশিল্ডে পার্কিং পুলিশ টিকিট দিয়ে গেছে দেড়শো ডলারের! ঠিক এ সময়ে চিশতির ফোন- রিপন ‘বাশকো’ দিতে পারছিলি?
– হু
– কিছু কইলো?
– কিছু বলার সময় পায়নি। বাচ্চা হয়ে গেছে
– মানে, কখন?
– একটু আগে আমার গাড়ির মধ্যে। হাসপাতালে নিতে নিতেই..
– এম্বুলেন্স ছিল না? সব ব্যাপারে তোর এতো মাতব্বরি ক্যা!
– অনুরোধ করছিল নিয়ে যেতে
– বলল আর তুই উল্লুকের মতো নাচতে নাচতে নিয়ে গেলি! কোন দায়িত্বটা এ পর্যন্ত ঠিকমতো করছিস বল তো? বাচ্চা কিডা ডেলিভারি দিলো? তুই?
.
আমি উত্তর দেবার আগেই মোবাইল বন্ধ হয়ে গেলো। চার্জ শেষ।
যাক গে, ভালোই হলো; গালি খাওয়ার অনেক টাইম আছে। সে কমপক্ষে একশোটা প্রশ্ন করে যুক্তি দেখিয়ে আমাকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে যে আমি টরন্টোর হাই পার্কের মিনি চিড়িয়াখানায় বাস করার একজন যোগ্য চিড়িয়া! টরন্টো জু তে ঠাঁই পাবার যোগ্যতা আমার এখনো হয় নাই..
.
উত্তেজনায় এখনো নরমাল হতে পারিনি।
কফিটা শেষ করে সিটে হেলান দিয়ে রিলাক্সড হয়ে বসি। গাড়ির সিট ভালো করেই ক্লিন করে গেছে। হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ পাচ্ছি। কিছুটা ধাতস্থ হতেই দেখি লাইন ধরে হ্যাজার্ড আলো জ্বালিয়ে কালো গাড়ির বহর পার্কিং লট এর জায়গা দখল নিচ্ছে। মানুষজন কালো পোশাকে সাজগোজ করে, ফুলের তোড়া হাতে চার্চের মধ্যে ঢুকছে। পুরুষ-মহিলা সবাই খুব সচেতন সাজগোজ নিয়ে। নামার আগে আয়নায় ফাইনালী লিপস্টিক, চোখের নকল পাঁপড়ি ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। পুরুষগুলো পারফেক্টলি স্যুটেড-বুটেড। কেউ মারা গেছে। ব্ল্যাক কমিউনিটির ফিউনারেল অনুষ্ঠান।
.
আমি বসে বসে এদের কীর্তিকলাপ দেখতে থাকি। সবাই দুঃখী দুঃখী ভাব আনার চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের চেহারায় কৌতুক কৌতুক ভাব নিয়ে এসেছে।
.
আমি বাসার দিকে রওনা দেই।
ভালোই হলো; অটোয়ায় আমার কিছু আত্মীয় বাড়লো। যদিও সোমালিয়ান। এ জন্যও আমার বন্ধু চিশতীকে স্পেশাল থ্যাংকস জানাই মনে মনে। সমস্যা হলো তার রেখে যাওয়া এখনো তিনটা ‘বাশকো’ আমার বাসার স্টোর রুমে পড়ে আছে।
কপালে আরও কী আছে কে জানে!
.
.
জাভেদ ইকবাল
.
৩.সত্যিকারের বন্ধুত্বের গল্প
ভোর চারটায় বন্ধুর বাসা নক করার পর সে হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে বলল, ভেতরে বস, আসতেছি। তার মেজাজ মনে হচ্ছে না খুব একটা ভালো। কারণ অনেকটা জোর করেই তাকে নিয়ে যাচ্ছি সাথে; জি ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার কেন্দ্রে।
.
কয়েকবার সে ঘুমে টলতে টলতে আমার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করল। প্রথমবারে লুঙ্গির গিট্টু বাঁধতে বাঁধতে বাথরুমে ছুটলো। তারপর দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেইজমেন্ট নেমে এক বস্তা পিঁয়াজ এনে রান্নাঘরে ছুঁড়ে মারলো। এরপর আবার বাথরুমে গিয়ে দাঁত মাজা শেষ করে ওখানেই চুপ মেরে গেলো; আর কোনো সাড়াশব্দ নাই। বাথরুমের দরজাও খোলা। আমি একটু ঝুঁকে গলা বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে উঁকি মেরে দেখি সে খুব যত্নে মাথার শেষ সম্বল; দুই পাশে ঝুলে থাকা চুল আঁচড়াচ্ছে।
.
আঁটসাঁট হয়ে তার লিভিংরুমে বসে থাকি। বেশি বড়লোকদের বাসায় গিয়ে স্বস্তি পাই না। তার রুপোর মোমদানি, শোপিস, মরোক্ক দেশের খান্দানি সোফা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমার মতো গরিব মানুষকে এখানে একদম মানায় না। একবার আমার জামায় বেঁধে কর্নার টেবিলের উপর রাখা ইরান দেশের হাজার ডলারের ফুলদানি পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। সেই দুঃস্বপ্ন এখনও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়!
.
সে পিঁয়াজ মরিচ কুঁচি করে, চারটা ডিম ভেঙে সামান্য দুধ মিশিয়ে ভাজি করে ফেলল। মাইক্রোতে মাসলকালাইয়ের ডাল গরম করে, টিকিয়া ভেজে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। আমরা একসাথে খেয়ে উঠলাম। কফি মেকারে শুধু আমার জন্য কড়া করে কফি বানিয়ে হাতে দিলো। হয়তো ভয় পাচ্ছে ড্রাইভ করতে গিয়ে যেন ঘুমিয়ে না পড়ি। আমাকে আরও দুই’শ বিশ কিলোমিটার পশ্চিমে যেতে হবে, ক্লিনটন শহরে। অলরেডি অটোয়া থেকে পাঁচ ঘন্টা টানা জার্নি করে এখানে এসেছি।
.
আমরা ফজরের নামাজ পড়ে গাড়িতে গিয়ে বসি। সে উঠেই বলল, রিপন তোর পরীক্ষা দুপুর একটার সময়। এতো ভোর ভেলা রওনা দেওয়ার হেতু কী?
– একটু কাজ আছে
– ঐখানেও তোর কাজ!
– এমনি একটু..
– তোর ‘এমনি’ মানে বুঝতে হবে বিরাট ঘাপলা আছে। যাই হোক, স্টার্ট দেওয়ার আগে দয়া করে গাড়ির অয়েল, ওয়াসার ফ্লুইড, কুলার লেবেল; সব চেক করে উঠবি। প্রতিবার রাস্তায় একটা না একটা অঘটন ঘটাস। আর শোন, আমার রাতে ঘুম হয়নি; রাস্তায় খবরদার আমাকে ডাকবি না, পুতিন এটম বোমা মারলেও না। তুই যে হারে সেহেরীতে পানি খাইলি, সারা রাস্তা মুততে মুততে যাবি। একবারে ক্লিনটন পৌঁছে তারপর ডাক দিস- বলে সে প্যাসেঞ্জার সিট পেছনে নামিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল।
.
গাড়ির টায়ার, সব ধরণের ফ্লুইড, অয়েল চেক করে, কাঁচগুলো ভালমতো মুছে রেডি করি। নিশান আটানব্বই মডেলের লোহার গাড়ি, খুব মজবুত! বডিতে অল্প কিছু জং ধরা ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নাই, পংখীরাজের মতো চলে। আমার গর্বের শেষ নাই..
.
ড্রাইভিং সিটে বসে দেখি ব্যাটা সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেছে; নাক ডাকছে। তার এই অভ্যাসটা দারুন,শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। খুব হিংসে হয়। ওদিকে আমি হাজার চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট দিতে পারলাম না। চেক করে দেখি গাড়ির হেডলাইট জ্বালানো ছিল; অফ করতে মনে নাই। এই দুই ঘন্টা ব্যাটারী খেয়ে একদম নিঃশেষ করে ফেলেছে। চিশতীকে আস্তে আস্তে ডাকা শুরু করি- এই দোস্ত.. দোস্ত..
.
সে তার গাড়ি থেকে তার টেনে আমার গাড়ির ব্যাটারিতে লাগিয়ে স্টার্ট দিয়ে ফেলল। ঠিক সকাল সাড়ে নয়টায় পৌঁছুলাম ড্রাইভ টেস্ট সেন্টারে। গাড়ি পার্ক করতেই এক ভদ্রমহিলা দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এসে বলল, জাভেদ ভাই আসছেন? আপনি পাঁচ মিনিট রেস্ট নেন, আসতেছি। আমার পরীক্ষা কিন্তু ঠিক সাড়ে এগারোটায়- বলে আবার দৌড়ে চলে গেলো।
সে পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, কে রে উনি?
– এক পরিচিত; পিঙ্কি ভাবি
– ঘটনা কী?
– তাকে একটু পরীক্ষার রাস্তাটা দেখিয়ে দেব। প্রথমবার পরীক্ষা দিতে আসছে তো.. ভয় পাচ্ছে
– এ নিয়ে মোট এগারোবার তুই পরীক্ষা দিতে আসলি। পিঙ্কি ভাবি জানে সেটা? এখন বুঝলাম কেন তোর এতো তাড়া। নিজের পাশ করার নাম নাই, জনসেবা করতে আইছিস!
.
আমি পিঙ্কি ভাবীকে নিয়ে বের হয়ে তাকে দুইবার রুট চিনিয়ে দেই। এই রুটেই এক্সামিনার পরীক্ষা নেবে। প্যারালাল পার্কিং, পয়েন্ট টার্নিং সব দেখিয়ে দিলাম।
.
এবার চিশতী আমাকে নিয়ে দেখাতে লাগলো কিভাবে ড্রাইভ করতে হবে। সে শুধু এক্সপার্টই না, সুপার এক্সপার্ট। ফর্মূলা ওয়ান রেসে অংশ নিলে সে নিশ্চিত পজিশনে থাকবে। আমি তিনবার ড্রাইভ করে আসতেই বলল, রিপন তোর পাশ না করার আমি কোনো কারণ দেখি না। ইনশা আল্লাহ আজকে পাশ করবি।
.
পরীক্ষার এখনো এক ঘন্টা বাকি।
আমরা পরীক্ষা সেন্টারের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকি। সে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, বল তো এই বাড়িটার দাম কত?
.
[ভাই রে ভাই, সেই দুই হাজার চৈদ্দ সাল থেকে যতবার ক্লিনটন শহরে আসছি, ততবারই সে এই বাড়ির দাম বলে। প্রথম বলেছিল পঞ্চাশ হাজার। তারপর বলেছিল ষাট হাজার; হাসতো এতো কম দাম বলে। আর এখন তার বিস্ময় এই অজোপাড়াগাঁয়ে এই বাড়ির দাম কেমনে এতো বেশি হয়!]
.
গত বছর পরীক্ষা দিতে এসে যেহেতু সে বলেছিল আড়াই লক্ষ। তাই আমি এক লক্ষ বাড়িয়ে বললাম, সাড়ে তিন?
– ওরকমই। কি অবস্থা দেখ!
মনে মনে ঠিক করে রাখি, নেক্সটবার জিজ্ঞেস করলে বলবো সাড়ে চার..
.
.
ঠিক একটার সময় এক্সামিনার চাইনিজ ভদ্রমহিলা এসে আমাকে রেডি হতে বলল। পূর্বের দশবারের মধ্যে একবারও কোনো পুরুষ এক্সামিনার আমার ভাগ্যে পড়ে নাই। পরীক্ষা শেষ করে গাড়ির মধ্যে বসি। চিশতী আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মন খারাপ করিস না; নেক্সট টাইম।
আমি পাশ করি নাই।
মিনিটপাঁচেক চুপ থেকে বললাম, দোস্ত
– বল
– ঘন্টাখানেক একটু বসতে পারবি?
– কেন?
– আরেকজন আবদার ধরছে তাকে যেন রাস্তা দেখিয়ে দেই
– তোর সেই পিঙ্কি ভাবি পাস করছে?
– হু
– সাব্বাশ! সারাদিন ঐ কর! এটাও কি ভাবি?
– আপা। ইফতারি নিয়ে আসছি, রাতের খাবারও। বেশি লেট হলে সেহরীও হয়ে যাবে
– আচ্ছা যা।
.
রুনা আপাকে দুইটার সময় ট্রেইনিং দিয়ে আমরা সাড়ে পাঁচটার দিকে রওনা দেই। কারণ আবারো ব্যাটারির সমস্যা। রোড অ্যাসিস্ট্যান্ট “সিএএ” আসতে পাক্কা দুই ঘন্টা সময় নিলো। চিশতী আর রিস্ক না নিয়ে কানাডিয়ান টায়ার দোকানে গিয়ে একটা লিথিয়াম রিচার্জেবল ব্যাটারী বুস্টার কিনে দিলো। প্রয়োজনে রাস্তায় ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়া যাবে।
.
আমরা সেই জঙ্গলের মধ্যে থামলাম!
গাড়ির পেছনের ডালা খুলে ছোট ফোল্ডিং টেবিল পেতে ইফতারি সাজাতে থাকি। এক বাক্স ঘুগনি বের করে, ছোট গ্যাস স্টোভ জ্বালিয়ে ননস্টিক পাত্রে গরমে দেই। তরমুজ বের করে কেটে ফেলি। শসা, লেবু, টমেটো বের করে চপিং বোর্ডে ফালি করি। খেঁজুর, মুড়ির কৌটো বের করি। ঘুগনি গরম হলে ঢাকনা দেওয়া ছোট এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি বের করে অল্প আঁচে গরমে দেই। ওটাতে তেহারী আছে; রাতের খাবার। যথেষ্ট আছে, সেহরিও হয়ে যাবে। দুইটা ডাব বের করে দা দিয়ে কেটে ফেলি। চিশতী পাশেই ফোল্ডিং চেয়ারে বসে সব দেখতে থাকে।
.
ইফতারি শেষ করে, নামাজ পড়ে তাঁবুর ভেতরে বসে দুই বন্ধু চা খেতে থাকি। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। সে বলল, বদনা আনছিস?
– হু। সাথে বেবি ওয়াইপার, লুঙ্গিও
– গুড, দে দেখি!
– টর্চ লাইট আর একটা চাকুও আছে সাথে
– আয়।
.
আমরা তাবু থেকে কিছুদূর গিয়ে একটা ঝোপ খুঁজে নেই, প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য পারফেক্ট। গাড়ির পেছন থেকে চারটা ইট বের করে এনে দুটা করে দুইপাশে দিয়ে পায়খানা বানিয়ে ফেলি। সে বসে পড়তেই আমি মুখ উল্টোদিক করে দাঁড়িয়ে থাকি। সে খুব জঙ্গল ভয় পায়। সহজ হতে বলল, দেখ রিপন এটা জঙ্গল হিসাবে মনেই হচ্ছে না
– ঠিক। আকাশটা দেখ, ফুল মুন! দোস্ত, আজকে না গেলে কেমন হয়?
– সেহেরি?
– সব ব্যব্যস্থা আছে
– কম্বল?
– আছে
– ইট এখানেই থাক; কি বলিস? নেক্সট টাইম লাগতে পারে। কোনো পাবলিকের বাপের সাধ্যি নাই খুঁজে বের করা।
সে সিগারেট ধরিয়ে ভক ভক করে ধোয়া ছাড়তে থাকে।
এবার আমি বসলাম, সে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে অভয় দিতে লাগলো যে ভয়ের কিছু নাই..
সে মনে হয় অনেকদিন পরে হাসলো।
.
.
সব গোছগাছ করে সকাল নয়টায় আমরা রওনা দেই।
সে আবার বিড়বিড় করে বলে উঠলো, মানব সিবা কত্যি আইছিস! মানব সিবা! নিজির পাশ করার নাম নি, আরেকজনরে ট্রেনিং দিতে আইসে! সাতশো কিলোমিটার আইশি ডাব্বা মারলি! তোর তেল খরচই তো আড়াইশো ডলার রে উল্লুক! এই ক্লিনটন শহরের পাইছিস কী? দুনিয়ায় আর টেস্ট সেন্টার নাই?
সে রেগে গেলে খাঁটি কুষ্টিয়ার ভাষায় কথা বলা শুরু করে।
.
আইয়ুব বাচ্চুর গান ছেড়ে দেই- “মেয়ে..তুমি কি আকাশ চেনো, চেনো না..” তার খুব প্রিয় গান। যদিও গানটা আমার খুব অপছন্দের। এখানে মহিলা জাতিকে খুব আন্ডারএস্টিমেট করা হয়েছে। গানটায় গায়ক সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স এ ভুগছে।
.
বললাম দোস্ত, গাড়ির স্প্রিড বাড়িয়ে দিবো?
– এই.. ইস্প্রিড কী রে? ঠিক করে বল! স্পিডের সাথে ‘র’ যোগ করিস কেন? বল স্পি!
– ইসপি
– ইড
– ইড
– এবার একসাথে বল- স্পিড!
– স্প্রীড!
– আবার স্প্রিড বলে রে গাধাটা! তোর সমস্যাটা কী বল তো?
আমি যে ‘র’ ছাড়া স্প্রীড বলতে পারি না; ব্যাপারটা তাকে কেমনে বুঝাই?এখন আমার যেকোনো কথাতেই সে রেগে যাবে।
চুপ মেরে গেলাম।
জাভেদ ইকবাল
৪.কলিজার বন্ধু স্ট্যাটাস
ও বন্ধু আমার..
#ছোটগল্প
একটা ছেলেতে আর মেয়েতে শুধু বন্ধুত্ব হয় না, কথাটা শুনেছেন না? নিশ্চয়ই শুনেছেন। আমিও শুনেছি। তারপরেও আমার আর দীপার মধ্যে একদম ঘানিভাঙা বন্ধুত্ব হয়েই গেল।
খেয়াল করে দেখবেন, একদঙ্গল চাইনিজকে একসাথে দেখলে যেমন লাগে, ভার্সিটির শুরুর দিনটায় অপরিচিত মুখগুলোকে তেমনই লাগে। কিন্তু কারোর দীপাকে মনে রাখতে সমস্যা হয়নি। কারণ তার ডান গালে এতটাই গভীর টোল পড়ে যে তাতে অনায়াসে একটা রসমালাই গুঁজে দেওয়া যাবে। এই এক গালে টোলওয়ালীর সাথে আমার এমন নিটোল বন্ধুত্ব হয়ে গেল, যে সাতদিনের মধ্যে বড় ভাইদের মাঝে আমার ডিমান্ড এত ভয়ানক বেড়ে গেল । এতটাই যে টং দোকানে আমার চা বা কোকের বিল দিতে হয় না। উদ্দেশ্য? দীপার নাম্বার পাওয়া। দীপা কী এমন রসগোল্লা সেটা বুঝিনি, কিন্তু এই আদর যত্ন দারুণ উপভোগ করতাম।
আমার মন ততদিনে উড়ে বেড়াচ্ছে বুয়েটের আর্কিতে চান্স পাওয়া কোচিংয়ের ওই কোঁকড়া চুলের মেয়ের চারপাশে। যেহেতু আমার পকেটমানি টাইট ছিল, দীপাও বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে তার পকেট মানি থেকে সম্প্রদান কারকে চতুর্থী বিভক্তিতে আমাকে টাকা সাপ্লাই করতে থাকলো। কিন্তু না! আমার সাথে ছিনিমিনি খেলতে খেলতেই ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই থেকে চোথা জোগাড়ের বিনিময়ে কোঁকড়া চুলওয়ালি তাকে হৃদয় দিয়ে বসলো।
বোতল বোতল মাউন্টেন ডিউ খাওয়া আধুনিক এই দেবদাসকে উদ্ধার করলো কলা অনুষদের এক কন্যা। আমি যখন কার্জন থেকে কলা ভবনে শাটল ককের মত যাওয়া আসায় ব্যস্ত, তখন দীপা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আমার প্রক্সি, নোট জোগাড়, নোট লিখে নিজ দায়িত্বে কপি করা থেকে শুরু করে সবকিছু তৈরি করে রাখতো। প্রয়োজনে পরীক্ষার আগের দিন সিলেবাস দেখে আকাশ থেকে কোলবালিশ সহ ভূপাতিত হওয়া আমাকে এসে পড়িয়ে দিয়ে যেত বাসায় এসে।
কলা অনুষদের সেই কন্যা আমায় কলা দেখিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছেড়ে বিলাতি অক্সফোর্ডের এক পিএইচডি পড়ুয়াকে বিয়ে করে চলে গেল। এদিকে প্রথম বর্ষের রেজাল্টে আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি গেল। সেই গুলির শব্দ আরো ভয়াবহ শোনালো, কারণ দীপা ফার্স্ট হয়েছিল। আমার বাবা মা সকাল বিকাল এতবার দীপার পা ধুয়ে পানি খেতে বললো যে প্রথমবারের মত আমার চোখ পড়লো দীপার পায়ের দিকে। শঙ্খের মত ধবধবে সে পা, দেখলেই মনে হয় আলতা পরার জন্যে তৈরি।
দীপার জন্যে জামাতে দাঁড়িয়ে ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েরা প্রেম নিবেদনের প্রস্তুত।কিন্তু ওইদিকে দীপার কোনোদিকে কোনো মাথাব্যথা নাই। সে সবার সাথে জোট বেঁধে হইহই করে। আমার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখলেও, ভালো ছাত্রীদের মধ্যে বিরলতম যে ব্যাপার, সে বন্ধু অবন্ধু সবাইকেই সাহায্য করে। কিন্তু এই ব্যাপারটা আবার আমার জ্বলে। আমি বলি,” তোকে এত রবিনহুডগিরি করতে কে বলে?” সে হাসে। মধুর সে হাসি, কিন্তু আমার গায়ে জ্বালা ধরে। ক্লাসের সবচেয়ে অসভ্য বিরক্তিকর ছেলেটাকেও সে সাহায্য করে, সবচেয়ে নেকুপুষু মেয়েটারও সে বান্ধবী।
আমার সাথে তার বন্ধুত্বে কোনো খাদ নাই। আমি ওকে সবরকম বিপদ আপদ থেকে দূরে রাখি। কে ওকে নিয়ে জেন্টস টয়লেটে বাজে কথা লিখে, তাকে গিয়ে কড়কে দিয়ে আসি। বড় ভাইদের এমনভাবে ভাঁজ দিয়েছি যে তারা ওকে বিরক্ত করতে সাহস করে না। আমি ওকে সযত্নে সব খারাপ থেকে আড়াল রাখি। নিজে প্রেমের সাগরে অনবরত সাঁতার কাটলেও, দীপা যেন কোনো ভুল না করে,সেদিকে আমার খুব খেয়াল।
দীপার আন্তরিক চেষ্টায় আমার রেজাল্ট আস্তে ধীরে মাঝারি মানের কাতারে পৌঁছালো পরের বছরগুলোয়, আর ও নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ভালো রেজাল্ট করে যেতে লাগলো। ততদিনে দীপা আমার ঘরের মানুষ, যখন তখন আসতে পারে। আবার অসময়ে বাসায় গেলে দীপার মাও আমাকে ডিম কিনে এনে দিতে বলতে দ্বিধা করে না।
এক হালি প্রেম বা প্রেম প্রেম খেলার পরে যখন একটু বিরতি নিচ্ছি, তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত দীপার জীবনে প্রেম এলো। সেই বজ্রপাত হলো সরাসরি আমার হৃদয়ে। আমার মনে যেন সেদ্ধ ডিমের গায়ের পাতলা পর্দার মত আবরণ জমে ছিল, দীপা প্রথম যেদিন আমায় ফেলে ওই ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গেল ওইদিন আমি প্রথম বুঝলাম… কী বুঝলাম সেটাও স্পষ্ট বুঝলাম না। কিন্তু খুব জ্বলুনি হচ্ছিল। দীপা অতি উৎসাহ নিয়ে আমাকে যখনই তার প্রেমের আখ্যান শোনাতে আসলো, আমি অতি রূঢ়ভাবে তাকে এড়িয়ে গেলাম।
চতুর্থ বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার ঠিক আগে আগে দীপার সেই প্রেম থাকলো না। কারণ জানা নেই। তবে সেই প্রেমের ধাক্কায় টলটলায়মান বন্ধুত্বটা আবার আগের মত হয়ে গেল। নতুন করে দীপার সঙ্গ পেয়ে আমি আবারও ওকে হারিয়ে ফেলার কেমন কেমন অনুভূতিটা নিছক হিংসা ভেবে এড়িয়ে গেলাম।
কিন্তু টাইফয়েড জ্বর যেমন প্যারাসিটামল দিয়ে সাময়িক চাপা দেওয়া যায় কিন্তু শেষমেষ তালু ফুঁড়ে বের হয়, তেমনভাবে মাস্টার্স চলাকালীন এক অসহ্য দুপুরে দীপা হাসতে হাসতে সামনে ওর অনামিকা তুলে ধরলো। আগেরদিন শুক্রবার নানা ব্যস্ততায় দীপাকে ফোন দেওয়া হয়নি, সেই ফাঁকে তিনি একদম আরেকজনের বাগদত্তা হয়ে হাজির হয়েছেন। হুট করে দেখতে এসে আংটি পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে, ঠিক তেরোদিন পরে তার বিয়ে। অতি সুযোগ্য পাত্র বিয়ের সাতদিন পড়ে আবার উড়াল দিয়ে চলে যাবেন। ডকুমেন্ট রেডি করে মাস্টার্স শেষে দীপাকে নিয়ে যাবেন।
এই প্রথম আমি এক ক্লাস মানুষের সামনে সত্যিকারের রাগারাগি করলাম দীপার সাথে। “তোর এত বিদেশ যাওয়ার লোভ? তুই চাইলে তো জিআরই দিয়েই যেতে পারিস। সে জন্যে বিয়ে করতে হবে কেন?” পানচিনির মিষ্টি খেতে থাকা ক্লাসের পোলাপান আমার রাগ দেখে বোকা হয়ে গেল। আরো অবাক হলো দীপা। রীতিমত তোতলাতে তোতলাতে বললো,” আশ্চর্য, লোভের কী আছে? আমি বিয়ে করতে পারি না?”। হক কথা, উত্তরে আমার বলার কিছু ছিল না।
সাময়িক রাগ থুপে থাপে ঠাণ্ডা করে আমি ঠিকই দীপার বাবা আর ভাইয়ের সাথে সমানতালে ওর বিয়ের আয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শুধু তাই না, দীপার হবু বর এর আংটি কেনার সময় সাথে গেলাম। ছেলেটা এক কথায় চমৎকার। কিন্তু হিংসার অঞ্জন লাগানো আমার চোখ বললো,” এত ভালোও ভালো না।”
সবকিছুই ভালো হচ্ছে। দীপাকে খুশি দেখাচ্ছে। ওর খুশিতেই আমার খুশি ভেবে নিজেকে বুঝ দিচ্ছি ঠিকই….কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু… ভাঙ্গা দাঁত যেমন বারবার জিভে খোঁচা দেয়, তেমনই কিছু একটা হারিয়ে ফেলার অদৃশ্য অনুভূতি আমাকে থেকে থেকে ভীষণ বিরক্ত করতে লাগলো।
যাই হোক, খুব সুন্দরভাবে দীপার হলুদ হয়ে গেল। আমার পুরো পরিবার গেল হলুদে। আমার আবার স্পেশাল ডান্স পারফরম্যান্সও ছিল দীপার সাথে, ” মেরি ইয়ার কি শাদি হ্যা”। মেয়েটা নাচতে পারে না একদম, আমি উৎরে দিলাম ওকে। নাচ শেষে মায়ের পাশে বসতে না বসতেই মা অস্ফুটে বললো,” গাধা একটা জন্ম দিয়েছি। এরকম একটা মেয়েকে বউ করে ঘরে আনলেও বুঝতাম একটা কিছু করেছিস জীবনে।” পাশ থেকে বাবা বিরক্ত হয়ে বলে,” আহহ আনানের মা, কোথায় কী বলো? এখন কী এগুলো বলার সময়? কেউ শুনে ফেললে কেমন হবে?”।
ভেতরটা কেন যেন একদম পুড়ে কুঁকড়ে গেলেও আমি ভাবলেশহীনতার চাদরমুড়ি দিয়ে আবার সবার সাথে হইহই শুরু করলাম।
হলুদ আর বিয়ে পরপর দুইদিন। বিয়ের দিন সকালে কাবিন হবে। দীপার মায়ের বলে দেওয়া স্পেশাল মাবরুম খেজুর জোগাড় করে আমি সকাল সকাল হাজির। কিন্তু জুমআর নামাযের সময় হয়ে যাচ্ছে, ছেলেপক্ষ আসছে না। এদিকে দীপাকে পার্লারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে। শেষে ছেলের ফুপা বা চাচা কেউ ফোন করে বললেন,কাবিন হবে না আর আলাদা করে। যা হবার একেবারে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়েই হবে।
দীপার পরিবারের সবাই ভীষণ বিরক্ত হলো। এটা কি ছেলেখেলা নাকি? যাইহোক, দীপা রওয়ানা দিল পার্লারে আর দীপার সাজ শেষ হয়েছে বা হবে হবে সময়ে জানা গেল যে এই বিয়ে হবে না। ছেলেপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ছেলে বিদেশি প্রেমিকার সাথে তুমুল অভিমান নিয়ে দেশে বিয়ে করতে এসেছিল। মানভঞ্জন হয়েছে। বাপ মায়ের ইজ্জত ডুবিয়ে আর দীপার কপালজোরে ছেলে দুপুরের ফ্লাইটে লুকিয়ে পগারপার হয়েছে।
কথা নাই বার্তা নাই দীপার মা ঠুশঠাশ অজ্ঞান হওয়া শুরু করলেন। আর দীপার বাবা অনেকটা বাংলা সিনেমার প্রবীর মিত্র স্টাইলে বুক চেপে সোফায় বসে রইলেন। দীপার মামা চাচারা মিলে ছেলের গুষ্টি উদ্ধার করা শুরু করলে । মামলা করবেন, হ্যান করবেন, ত্যান করবেন। তুমুল চাপাবাজ দীপার ফুপা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ছেলেকে কানে ধরে ফেরত আনার মহতী প্ল্যান ভাজতে লাগলেন। এই হট্টগোলের মাঝে দীপার সাথে থাকা আমাদেরই আরেক বান্ধবীকে ফোন দিয়ে দীপাকে সেন্টারে না নিয়ে বাসায় ফেরত আনতে বলে দিলাম আমি।
আমার মা ফোন করেছিল আমি গাড়ি কখন বাসায় পাঠাবো ওদের আনতে সেটা জানতে। আমার থেকে বিস্তারিত শুনেও কেন যেন তখন তখনই গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দিতে বললো। এর মাঝে কোন ফাঁকে দীপা ওর রুমে ঢুকে গেল। সুখের বিষয়, কেউ ওকে ঘাটালো না। একা থাকতে দিলো। আমার কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছিল। আমি ওর দরজা নক করে ঢুকে পরলাম।
দীপা খুব সেজেছে। ভারী লেহেঙ্গা, ভারী গহনা। কিন্তু ওকে সুন্দর লাগছে না, কেমন জড় পুতুল পুতুল লাগছে। আপাত দৃষ্টিতে ওকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও, সাড়ে চার বছরের দৃষ্টি ধোঁকা খায়না আমার। আকস্মিক ধাক্কায় মেয়েটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে।
দীপা আমাকে দেখে একটু হেসে বলে,” শুনেছিস? আমার নাচ দেখে নাকি পাত্র ভেগে গেছে! কী একটা অবস্থা বল তো!”। আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল ওর কথা শুনে। ওই মুহূর্তে আমার সাধ্য থাকলে আমি ওই ছেলের টুঁটি চেপে মটকে দিতাম। সেটা যেহেতু সম্ভব না, কী মনে করে আমি চট করে নাটকীয়ভাবে হাঁটু গেঁড়ে বসে ওর হাত ধরে বললাম,” দীপা, আমাকে বিয়ে করবি?”
কিছুটা হচ্কচিয়ে গেলেও, হাত সরিয়ে নিল দীপা। টোলওয়ালা বিখ্যাত হাসিটা দিয়ে বললো,” ধুর ব্যাটা! তুই আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করবি? আমি ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস? এতও খারাপ দিন আসে নাই আমার। আব্বুর ডাবল খরচ হবে আর কী, কিন্তু পরে, মানে কয়েক বছর পরে বিয়ে করবো আবার।আপাতত ভালোই হলো, এবারের অনুষ্ঠানের কাচ্চি ডিপ ফ্রিজে রেখে রেখে অনেকদিন খাবো। চিন্তা করিস না, টিফিনে তোর জন্যেও নিবো।”
আমাকে হাসানোর জন্যেই বললো। একটুও হাসি আসলো না আমার। একটু জোর দিয়েই বললাম, ” আমি সিরিয়াস দীপা।” দীপার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। কিছুটা কঠিন স্বরে বলল,” কেন? আমাকে কেন তুই বিয়ে করবি? তুই কি আমাকে ভালবাসিস? আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে কতজনকে প্রস্তাব দিলি? আমার থেকে টাকা নিয়ে কতজনকে ফুল দিলি, শাড়ি দিলি। তোর প্রতিটা প্রেম কাহিনীর প্রতিটা অধ্যায় আমার মুখস্ত। কখনো তো আমার কথা তখন ভাবিসনি। আজকে কেন তোর আমাকে বিয়ে করতে হবে? আমি তো পানিতে পড়ি নাই আনান। আমি ঠিক আছি”। কান্না হাসিতে দীপার মুখটা বেঁকেচুরে গেল।
আমার নিজেরই তখন কান্নার দশা। রচনামূলক প্রশ্নে বরাবর কাঁচা এই আমি ওকে কেমন করে বুঝাই আমার মনের কথা? ওকে কিভাবে বলি গত কয়েকটা দিন যখনই মনে হতো দীপা অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে, সেই অনুভূতিকে চাপা দিতে আমার ঠিক কতটা মনের জোর প্রয়োগ করতে হয়েছে? ঠিক কতবার এর মাঝে আমার দীপার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে থেকে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়েছে? এর মাঝে একটা দিন রাতেও যে আমি ঘুমাতে পারিনি, এর কিছুই আমি বলতে পারলাম না ওকে। চুপচাপ চোরের মত রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।
আমাদের জানা ছিল না, তখন দীপাদের লিভিং হলে একটা জমজমাট নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। প্রধান কুশীলব আমার জন্মদাতা পিতা এবং মাতা। আমার মা দীপার মায়ের হাত ধরে বলছেন,” আপা, আপনার মেয়েটাকে আমি খুব যত্ন করবো। আমি তো জানি দীপা কেমন। আমার চাইতে ভালো আর কোনো ছেলের মা দীপাকে চিনবে না। আমার মেয়ে নাই আপা, আপনার মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দেন।” ওদিকে আমার বাবাও দীপার বাবার হাত ধরে বসে আছেন। বাবা বললেন,” ভাই, আপনার মেয়ে যে ঘরেই যাবে, তারা ভাগ্যবান। আপনারা বরং দেখেন চিন্তা করে। আমার নালায়েককে তো আপনারা অনেকদিন চেনেন। সে দীপার যোগ্য পাত্র না হয়তো, কিন্তু আমি জানি, আমার ছেলের অন্তর ভালো। এতগুলো বছর আপনাদের মেয়ের পাশে বটগাছের মত ছায়া হয়ে ছিল, আপনারা জানেন। আপনারা যদি ঠিক মনে করে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন, আমাদের সৌভাগ্য হবে।”
স্বাভাবিক সময়ে এমন প্রস্তাবে তারা কী করতো ভাবতে পারছি না, কিন্তু এই মুহূর্তে দীপার বাবা মাকে দেখে মনে হচ্ছে তারা খড়কুটা পেলে সেটাও আঁকড়ে ধরবেন। ঘটনা দেখে নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে না পারা আমাকে হাত ধরে টান দিয়ে দীপার ছোট মামা রঙ্গমঞ্চের মাঝে নিয়ে এল। বলে,”কি ইয়াং ম্যান? তুমি চাও দীপাকে বিয়ে করতে? ভালো রাখবে আমাদের মেয়েটাকে?”
শুধু উত্তরে জি বললেই হতো। কিন্তু যে কথা একটু আগে দীপাকে একা পেয়ে বলিনি, হদ্দ বেকুবের মত ঘরসুদ্ধ মানুষের সামনে যাত্রার নায়কের মত কাঁপা কাঁপা স্বরে সেই আমিই বললাম,” আমি দীপাকে ভালোবাসি।” মনে হলো, ঘর ভর্তি মানুষ বড় করে শ্বাস ফেললো। আবছা আবছা কাকে যেন শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলতে শুনলাম, আরেকটা কে যেন বললো,” আগের থেকেই কিছু ছিল মনে হয় দুইজনের মধ্যে।” বাবা আমার কাছে এসে চাপা স্বরে বলল,”এই কথাটা এরকম স্টুপিডের মত এভাবে না বললে হতো না, না?”
দীপা রাজি হয়েছিল। অবশ্য ওকে একটু বোঝাতে হয়েছিল, কিন্তু বুঝতে ঠিকই পেরেছিল।অংকে দীপা খুবই ভালো। সে অবশ্যই হিসাব মিলাতে পেরেছে, স্বামী হিসেবে আমি ভালোই হবো। কারণ আমার আগাপাশতলা ওর জানা বোঝা। এরকম ছেলেরা জীবন সঙ্গী হিসেবে ভালো হয়।
দীপাকে ওই ভারী হাবিজাবি খুলিয়ে আমার মায়ের তাড়াহুড়া করে আনা একটা হালকা গোলাপি জামদানি পরানো হয়েছে। এখন ওকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। বোকার মতন ভুলে দীপার কবুলও শুরুতে আমিই বলে ফেলেছিলাম। আমি মোট ছয়বার কবুল বলেছি। খুব সম্ভব দীপার বাবা আমার কান্ডকারখানা দেখে কার কাছে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন এই আতঙ্কেই বিয়ে পড়ানোর পরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। আবার সেই কান্না দেখে উপস্থিত সবাই কেঁদেছে।
যাইহোক, রুসমত বা কিসমত কোনো একটা কাজে মাথায় ওড়না দিয়ে ঢেকে দীপার এক ভাবী জিজ্ঞাসা করেছিল আমাকে, ” আয়নায় কী দেখা যায়?” আশেপাশের মানুষ কী কী সব শিখিয়ে দিচ্ছিল। পরী দেখা যায়, চাঁদ দেখা যায়, আরো হাবিজাবি। আমি নাক মুখ বুঁজে উত্তর দিয়েছি,” আয়নায় আমি আমার সবচে প্রিয় বন্ধুকে দেখি।” উত্তর শুনে আয়না ছেড়ে দীপা পূর্নদৃষ্টি মেলে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়েছিল।
খুব রোমান্টিক উত্তর হয়নি জানি। কী আর করার। দীপাকে তো ভালোবাসার কথা বলা হয়নি এখনও। এরচেয়ে এইটুক প্রতিশ্রুতি নিয়ে জীবন শুরু হোক। এটা তো নিশ্চিত, যাই হয়ে যাক না কেন, দীপাকে আগলে রাখবো আমি। বেশিরভাগ মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করে, সময়ের সাথে বন্ধুত্ব আসে। আমাদের মাঝে না হয় বন্ধুত্বের মোড়কেই ভালোবাসা আসুক জীবনে।