#ছোটোগল্প
সংসারটা আর টিকল না৷ তিন বছর প্রেম করে বিয়ের পর মাত্র ছয়টা বছর যেতে না যেতেই ছাড়াছাড়ির শীতল বাতাস বয়ে গেল ছোট্ট ফ্ল্যাটের দুই বাসিন্দার মাঝে। বিচ্ছেদের কারণটা দীর্ঘদিনের তিক্ততা। প্রথমটা বেশ ভালোই যাচ্ছিল। ওদের বোঝাপড়া ভালো ছিল৷ একে অপরের প্রতি যত্নশীল, সহানুভূতিশীল৷ আবেগ, ভালোবাসারও কমতি দেখা যায়নি। তবু ধীরে ধীরে একটু একটু করে ফাটল ধরল, একসময় চিরে চৌচির করে দিয়ে সম্পর্কের মাঝে বেশ বড়সড় খাদ দেখা দিল, যার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে শুধু ভর্ৎসনা আর অভিযোগেরা যেতে পারে, হঠাৎ জেগে ওঠা ভালোবাসারা খাদ পার হতে ভয় পায়।
ফাটলটা অবশ্য জোরালো ছিল, ওদের সন্তান নেই। কোনোদিন হবে না এমন নয়, হচ্ছে না৷ বিয়ের বছর দুয়েক পর যখন দেখা গেল সংসারে আলোর দেখা নেই, ওরা চলে গেল ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো, দু’জনের কারো কোনো সমস্যা নেই। তবে? ডাক্তার বললেন চেষ্টা চালিয়ে যেতে৷ এরা তাই করল। কিন্তু কেন যেন খোদা মুখ তুলে চাইলেন না৷ এদের আগের সম্পর্কের মাধুর্য কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকল। একদিনে নয়, দিনে দিনে, খুব ধীরে।
একদিন সমীর বলেই ফেলল, “তোমার সাথে বোধহয় আমার জুটিটাই ঠিকঠাক হয়নি। বিয়ের সময় বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছি তো, ওদের দোয়া না পেয়েই এমন নিঃন্তান হয়ে রয়েছি।”
আয়না তখন রাতে শোওয়ার আগে চুল আঁচড়াচ্ছিল আয়নার সামনে বসে। সে দ্রুত ঠেলে আসা চোখের জল লুকিয়ে ফেলল। সে নিজেও তার বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু একথা তো কোনোদিন মনে হয়নি! সমীর কি তবে তাকে আর চায় না?”
অদৃশ্য একটা দেয়ালের প্রথম ইটটা সেদিনই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। কথাটা কিন্তু সমীর ইচ্ছাকৃতভাবে বলেনি, মনে হয়েছে, বলে ফেলেছে। সেটা যে আয়নাকে কষ্ট দিয়েছে তাও বুঝতে পারেনি। এরপর থেকে আয়নার তুলনামূলক শীতল আচরণ তাকে অবাক করলেও তেমন ভাবায়নি। যে নারী মা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে, তার মন খারাপ থাকাটা স্বাভাবিক।
সমীর কখনো স্ত্রীর মান ভাঙাতে গেছে, ঘুরতে নিয়ে গেছে দূরে কোথাও। আয়নার মন বসেনি। তার ঠান্ডা আচরণ কষ্ট দিয়েছে সমীরকে, আয়না বুঝেও বোঝেনি।
এরপর দিনে দিনে দেয়ালটা উঁচু হয়েছে। একসময় এমন হয়েছে যে সেটা ডিঙিয়ে ওপাশে যাওয়ার উপায় আর নেই। হয় ভেঙে ফেলো, নয়তো দু’জন দুদিকে বসবাস শুরু করো।
শ্বশুরবাড়ির অনেকের কথায়, খোঁটায় আয়নারও দিন দিন নিজেকে অসহ্য বোধ হয়। আবারও ডাক্তার দেখায়, কত বদ্যি কবিরাজের কাছে যাওয়া হয়, ফলাফল শূন্য। সমীরের আবেগের সমূদ্রে শুধু ভাটার টান, জোয়ারের দেখা নেই। আয়নাও নিস্পৃহ হয়ে ওঠে দিনদিন। কলহ বেড়ে চলে, ছোট ছোট কথায় ঝগড়া বেঁধে যায়। খিটখিটে মেজাজে কত দিন যায় স্বভাবিক কথাটুকুও হয় না।
একদিন দুজনেই বুঝে যায়, তাদের মিলনটা সত্যি ভুল ছিল। এবার আর একসাথে থাকা চলে না৷ উকিলের সাথে কথাবার্তা হয়ে গেছে। ডিভোর্সের দিন তারিখও ঠিক হয়ে গেছে।
এর মাঝে হঠাৎ আয়না অসুস্থ। মনের অসুখ থেকে বুঝি শরীরের অসুখ। আয়নার মাঝে মাঝে এত খারাপ লাগে, মনে হয় মরেটরে যাবে। একদিন সমীর অফিস থেকে ফিরে দেখে আয়নার মুখের দিকে তাকানো যায় না। কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে বেচারি। পরদিনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় আয়নাকে।
নিয়তির আজব পরিহাস! ডাক্তার প্রেগনেন্সি টেস্ট করাতে বলে। টেস্ট করার পর রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
ডাক্তার মহিলাটি মিষ্টি করে হেসে বললেন, “অভিনন্দন।”
আয়নার তখন কিছু বোঝার উপায় নেই। সে টেবিলের কাচ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে থরথর করে কাঁপছে। শব্দ শুনে পাশ ফিরে চেয়ে দেখে সমীর কাঁদছে। একদম শিশুদের মতো। তার নিজের চোখেও পানি চলে এসেছে। নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে গেছে। তবে কি তাদের মিলন ঠিকঠাক ছিল?
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরর পথে রাস্তার মাঝখানে গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। এখান থেকে গ্যারেজও একটু দূরে। এখুনি ঠিক করানো যাবে না। ওরা নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। সমীর আয়নাকে নিয়ে গিয়ে ফুটপাতের ওপর সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসালো।
এখনো দু’জন স্বাভাবিক হতে পারেনি। ডিভোর্স হওয়া এখন সম্ভব না। আর কখনো সম্ভব হবে কি না জানা নেই। দু’জনেই আগের মতো উষ্ণ সান্নিধ্য ফিরে পেতে চাইছে, চাইছে দিনটা উদযাপন করতে। খুব করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু সংকোচের পাহাড়টা ঠেলে সরাতে পারছে না কেউ। ভয় হচ্ছে, যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা ঘুচবে তো? নাকি শীতল সম্পর্কটা জীবনভর বয়ে নিতে হবে? আয়নার পার্সব্যাগে এখনো ডিভোর্সের উকিলের অ্যাপয়েনমেন্ট কার্ডটা রয়ে গেছে। সমীর সেটা অভ্যাসবশত তাকেই দিয়েছিল যত্ন করে রেখে দিতে। আহা সংসার!
অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাসে যাওয়া যাবে না, সমীর সিনএনজি খুঁজছে। টুকটাক কথা বলে আয়নার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আহ্লাদী কথা বলা তো সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছে দু’জন!
সমীরও একসময় এসে বসল আয়নার পাশে। দু’জন অন্যমনষ্ক। কারো কথার শব্দে সম্বিত ফিরল তাদের।
“স্যার ম্যাডামরে ফুল কিন্যা দ্যান, খুশি হইব।”
সমীরের মনটা নেচে ওঠে। বিয়ের আগে এরকম কত ফুলওয়ালা বাচ্চার থেকে ফুল কিনে দিয়েছে আয়নাকে! ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে সে, “কত দাম?”
মিলন বলে ওঠে, “পনেরো টাকা পিস।” সে জানে, সামনের লোকটা এখন বলবে দশ টাকা, সে একটু দামাদামি করে দশ টাকায় দিয়ে দেবে।
কিন্তু লোকটা তেমন কিছু বলল না। জিজ্ঞেস করল, “কয়টা ফুল এখানে?”
“স্যার এগারোটা।”
“এগারোটার দাম কত হবে?”
মিলন প্রায় সাথে সাথে জবাব দেয়, “একশো পয়ষট্টি টাকা।”
লোকটা হেসে বলে, “তুমি কি আগে হিসেব করে রেখেছিলে?”
মিলনের হলুদ দাঁতের সারি বের হয়ে আসে। সে বলে, “না। আমগো পাশের ঘরে কামরুল চাচা থাকে। পড়ালেহা জানে। আমারে অংক শিখায়৷ আমি সময় পাইলেই মনে মনে অংক করি৷ এহন বেশি সময় লাগে না।”
সমীর অবাক হয়ে তাকায় ছেলেটার দিকে। টিংটিঙে শুকনো, কিন্তু পোক্ত শরীর। গায়ের রঙ ময়লা হলেও চেহারা সুরত বেশ সুন্দর। সে সবগুলো গোলাপ কিনে নিয়ে সমীরকে একশো পয়ষট্টি টাকাই দিল। তারপর বলল, “তুমি গাছে চড়তে পারো?”
মিলন এই লোকের সুন্দর ব্যাবহারে ভারি খুশি। ময়লা দাঁতগুলো আরেক দফা বার করে সে জবাব দিল, “জে পারি।”
“ওইযে দেখছ রাস্তার উল্টোপাশে কদম ফুলের গাছটা, ওটা থেকে ফুল পেড়ে এনে দিতে পারবে? যে কয়টা ফুল আনবে প্রতিটার জন্য পনেরো টাকা করে পাবে।”
বলা শেষ হতে দেরি, মিলনের দৌড় দিতে দেরি নেই। তরতর করে গাছে উঠে পকেট আর হাত ভর্তি করে ফুল নিয়ে আসে সে। গুনে দেখা যায় বাইশটা হয়েছে। সমীর এবার প্রশ্ন করে, “একটা পনেরো টাকা হলে মোট কত হয়?”
মিলন দ্রুত জবাব দেয়, “তিনশো তিরিশ টাকা।”
সমীর খুশি হয়ে চারশো টাকা ধরিয়ে দেয় মিলনের হাতে। বলে, “বাকিটা বখশিশ।”
মিলন টাকা হাতে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে টলটলে পানি অবশ্য গড়াতে দেয় না, তার আগেই ছুটে পালায়। বাপের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া আছে তার, স্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে পারবে। কিন্তু ভর্তি আর খাতাপত্রের টাকা বাপ দিতে পারবে না৷ তার নিজেকে জোগাড় করতে হবে। এই টাকাটাই জমছিল না তার। এবার হয়ে গেল। মন থেকে দোয়া করে সে, স্যারের ভালো কইরো আল্লাহ, ম্যাডামেরও ভালো কইরো।
সমীর এগারোটা গোলাপ আর বাইশটা কদম মিলিয়ে অদ্ভূত এক তোড়া বানায়। তারপর সংকোচ ঝেড়ে ফেলে আয়নার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য।”
আয়না ভেবেছিল ভালোবাসি বলবে বুঝি! ভারি লজ্জা হচ্ছিল তার। রাস্তায় কত লোক! চেয়ে আছে হা করে। সমীরের বিকার নেই। তবু ভালোবাসি শোনার জন্য মন কেমন করছিল। সমীর না বললেও চোখ দেখে বোঝা গেল বলতে পারছে না সে, চোখের ভাষা কিন্তু সেটাই!
আয়না তোড়াটা নিল। কী বলবে সে? কিছু যে বলা যাচ্ছে না। গলাটা ভারি হয়ে আসছে। ফুলের ঘ্রাণ নিল আয়না। গোলাপ আর কদমের মিশ্রণে যে গন্ধটা তৈরি হয়েছে তাতে উল্টে বমি আসার জোগাড়! মুখ বিকৃত করে তোড়াটা সরিয়ে দিল সে। ঠিক অনেক আগের মতো আহ্লাদী গলায় বলল, “তুমি না যাচ্ছেতাই! কী দিলে বলোতো এটা!”
চাঁদনী রাতে জানালার ধারে বসে সমীরের কাঁধে মাথা রাখে আয়না। জিজ্ঞেস করে, “ভালোবাসাটা কি তবে সন্তান কেন্দ্রিক ছিল?”
সমীর খানিক ভেবে উত্তর দেয়, “না। ইগো বড় বেশি জমে গিয়েছিল। ভালোবাসা চাপা পড়ে গিয়েছিল নিচে। ইগোর দেয়াল ভেঙে গেছে, ভালোবাসা তাই বাঁধ মানছে না।”
আয়না গভীর মনোযোগের সাথে জানালা দিয়ে শহরের উঁচু বাড়িঘরগুলো দেখে। এতদিন এই দৃশ্যে হাহাকার জাগত, এখন কেমন তৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছে মন।
গোলাপ আর কদমের গল্প
সুমাইয়া আমান নিতু