- আমার জীবনের গল্প।
- কষ্ট জীবনের গল্প।
- বাস্তব জীবনের গল্প।
- মানুষের জীবনের গল্প।
- বাস্তব জীবনের শিক্ষণীয় গল্প।
- আমার জীবনের কষ্টের গল্প।
1. আমার জীবনের গল্প
ফুটবল:
মেসি- নেইমার- রোনাল্ডোরা
কি ফুটবল খেলে??
ফুটবল খেলতাম আমরা। বাপরে বাপ খেলা কাকে বলে! খেলার আগে গেম প্ল্যান অনুসারে সবার পজিশন ঠিক হল।
তোরা তিনজন ডিফেন্সে, আমরা দুইজন মিডফিল্ডে, তুই ডানে, তুই বামে। আর তুই মেইন স্ট্রাইকার।খেলায় অফসাইড নাই।
তুই (মেইন স্ট্রাইকার) ওদের গোলবারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গোলকিপারের সাথে গল্প কর। নিচে নামার দরকার নাই।
শুধু আমরা বল এগিয়ে দিলে গোল করবি। খবরদার, মিস হওয়া চলবে না।
তারপর খেলা শুরু হওয়ার দুই মিনিট পর পজিশন-টজিশন সব ভেঙ্গেচুরে একাকার অবস্থা। ডিফেন্ডার চলে গেছে গোল করতে, স্ট্রাইকার এসে ডিফেন্স সামলাচ্ছে।
আরো পরে দেখা গেল মাঠের এক কোণায় একটা জটলা। জটলার মাঝখানে বল। বল যেখানে দুই টিমের গোলকিপার বাদে বাকি সব খেলোয়াড় সেখানে।
যে যেদিক থেকে পারতেছে সেদিক থেকে লাত্থি মারতেছে। কিন্তু বল বেচারা বের হওয়ার জায়গা পাচ্ছে না।
মাঠে কাদা থাকলে আরেকটা দৃশ্য দেখা যায়। জটলার ভিতর লাথালাথি চলতেছে। এক এক জন বলে অলরেডি তিনবার করে লাথি দিয়েছে, অথচ বল দুই ইঞ্চিও নড়েনি। আরেকজন দৌড়ে এসে স্লিপ, এক স্লিপে দশ হাত গিয়ে বলে মারা।
হঠাৎ একজন একহাতে চোখ ধরে চেঁচিয়ে উঠল ‘ঐ, আমার চোখে কাদা পড়ছে’। তারপর আরেক চোখ খোলা রেখে পাশের পুকুরে ঝুপ করে দিল লাফ।
কাদা-জলের ভারে আরেকজনের প্যান্ট কোমর ছেড়ে অভিকর্ষের টানে ভূ- কেন্দ্রের দিকে ছুটছে।
খেলার শুরু পাঁচ মিনিট পর গোলকিপারের চিল্লানি শুরু করছে। সে অলরেডি ৫ মিনিট গোলকিপিং করে ফেলেছে। এখন আরেকজনকে গোলকিপার হতে হবে। সে এখন স্ট্রাইকিং-এ খেলবে। এরপর আগের স্ট্রাইকার সরাসরি গোলকিপিং-এ চলে এলো ৷
এভাবেই সব প্লেয়ার গোলকিপিং, ডিফেন্স, মিডফিল্ড, স্ট্রাইকিং সব
পজিশনে খেলে ফেলে পুরোই অলরাউন্ডার ।
অথচ এই মেসি,নেইমার ,রোনাল্ডো তারা একটা পজিশনে খেলে।
ভালো খেলোয়াড় হতে হলে ,আমাদের মতো সবখানেই খেলার যোগ্যতা থাকা চাই।
আসলে টোটাল ফুটবলের জনক কিন্তু আমরাই বোদ্ধারা যতই অন্য কিছু বোঝাক না কেন!!
– লেখকের নাম খুঁজে পেলাম না,অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য, পুরো বাস্তব কাহিনি, যারা ফুটবল খেলেছেন তারা অবশ্যই রিলেট করতে পারবেন
……………
স্বপ্ন সারথী
বুয়েটে ভর্তি হতে না পেরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে অনার্স শুরু করলাম, খানিকটা দুঃখবোধ নিয়েই। তারপরও চোখে স্বপ্ন, ভালো ফলাফল করে বিসিএস বা কোন বিদেশী উন্নয়ন সংস্হায় চাকুরী নিবো। কিন্তু কিসের কি? সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই বাবা বাসায় বিয়ের পাত্র নিয়ে হাজির, আমাকে না কি বিয়ে করতে হবে!
রাশেদ, আর্মির ক্যাপ্টেন। প্রকৃতি প্রদত্ত আমার সৌন্দর্যটাই কাল হলো। গেলো মাসে আমার খালাতো বোন সালমার বিয়ের অনুষ্ঠানে সে বর পক্ষের একজন। সাজগোজ করা এই আমাকে তার ভীষণ পছন্দ হলো। খোঁজ নিতে নিতে ঘটক নিয়ে একেবারে আমাদের বাসায় হাজির। আর গর্ভনমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক আমার বাবা আব্দুল আলী, এ পাত্র পেয়ে বেজায় খুশি। ফৌজির সাথে না কি তার একান্ত কথোপকথনও হয়েছে, এরপর থেকে বাবার গো এই ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে।
বান্ধবীদের অনেকেই আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে শুনে যারপরনাই খুশি। তার উপর ছেলে আর্মির তাগড়া জোয়ান সুদর্শন এক অফিসার, খিলক্ষেতে নিজেদের বাসা। বান্ধবীরা আমার আসন্ন বাসরের কল্পনায় ওরা নিজেরা যতোটা না উত্তেজনায়, আমি ঠিক ততোটাই বিরক্ত। আমার বরাবরই স্বপ্ন লেখাপড়া শেষ করে, ভালো কিছু করা। সেকেন্ড ইয়ারেই বিয়ে, আমার সেই আশাটাতে যে গুড়ে বালি বেশ বুঝে নিলাম।
বাবা শিক্ষক হলেও প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাইরের ছিলেন না। ভালো পাত্রের কাছে পাত্রস্হ বা কন্যা দায় মুক্তি, কারণ যেটাই হোক আমার আপত্তি থোরাই না কেয়ার করে এরপর বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন। তাইতো ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাশেদ কে আমার “কবুল” বলা। জীবনের আরেকটি অধ্যায়ের শুরুটা কিন্তু মোটেও সুখকর অনুভূতির ছিলো না।
রাশেদের শত চেষ্টা সত্বেও, বিয়ের বাসরের আগ পযর্ন্ত আমি ওর সাথে কথা বলিনি। সত্য বলতে কি, রাশেদ আমার কাছে তখনো পযর্ন্ত ভিলেনই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছ্বাসে ভরা যৌবন, সদ্য গড়ে উঠা বন্ধু মহল। আড্ডা, সিনেমা, কবিতা, বিতর্ক। আর মাহিন বা সোহেলের মতো সহপাঠী রোমিওদের আমার পিছনে ছোক ছোক করা। ভালোই লাগছিলো। বেশ স্বপ্নের একটা জীবন ফেলে আমাকে এখন থেকে আর্মির বউ হয়ে, সংসার আর পার্টি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। আসন্ন বোরিং জীবনটার কথা ভেবেই আতংকিত ছিলাম।
তবে বাসর রাতেই কিন্তু রাশেদ আমাকে আতংকমুক্ত করে দেয়। অত্যন্ত মেধাবী এই ফৌজি কিভাবে যেনো আমার ভাবনাগুলোকে বুঝে গিয়েছিলো। আমাকে আমার মতো পড়াশোনা আর জীবন চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়াটায় বুঝলাম, এই লোককে আসলেই বিশ্বাস করা যায়।
রাশেদের সাথে কথোপকথনের কিছু সময় পর থেকেই কিন্তু ছেলেটাকে আর অপরিচিত বলে মনে হয় নি। নিজে থেকেই আমাকে সহজ করে নিলো। আর বাসর রাতে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ওর পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে একটা নেকলেস পড়িয়ে দেয়। এমনিতেই বিয়েতে ওদের পরিবার থেকে ভারী গয়নার সেট পেয়েছিলাম, অতিরিক্ত এই গলার হারটা বউয়ের জন্য লুকিয়ে কেনা। শুনেই মনে মন বললাম “হাউ সুইট”। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত রাশেদ কিন্তু নিয়ম করে প্রতি এনিভার্সেরিতে আমাকে স্বর্ণের কিছু উপহার দিয়ে গেছে। আমার প্রতি ছেলেটার থাকা অকৃত্রিম ভালোবাসা নিঃসন্দেহে প্রশ্নাতীত।
কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে হয়তো অনেকেই খানিকটা হোচট খেয়েছেন। উৎসুক মনে প্রশ্ন। রাশেদ বিয়ের কতো বছর পর মারা গেলো? কিভাবে? আমার বতর্মান অবস্হাই বা কি? ধৈর্য ধরুন, কাহিনীতে একে একে সব কিছুই বলে যাবো। আমার জীবনটা যে সত্যই বর্ণিল, আকর্ষণীয় এক উপন্যাস। এই ছোট্ট জীবনেই এতো কিছু ঘটে যাওয়া আর তা সামলিয়ে বার বার ঘুরে দাড়ানোটার গল্পটাতে অনেকেরই প্রশংসা পাই। কিন্তু লোকে বুঝতে পারে না, জীবনে সংগ্রামী হয়ে বেঁচে থাকার মূল মন্ত্রটা যে বারো বছর আগে রাশেদই আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। তাইতো দক্ষ সৈনিকের মতোই আমি এক অকুতোভয় জীবন যোদ্ধা।
এই যে দেখুন, আপনাদের সাথে অন্য বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছি গল্পটা যেনো কোথায় গিয়ে থেমেছিলো। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বাসর রাতে রাশেদের দেওয়া আশ্বাস আর ভালোবাসার অংশটুকুতে। পৃথিবীর সবচাইতে দ্রুত প্রেম মনে হয় আমার আর রাশেদেরটাই। বাসর রাতের দ্বিপ্রহরের মধ্যেই আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে ফৌজির পেশি বহুল শরীরের কাছে আত্মসমর্পণ করালাম। ওর ভীষণ যত্ন ও ভালোবাসায় নেওয়া জীবনের প্রথমবারের আদরটাতে কিন্তু একটুও কষ্ট পাইনি। নিজেকে মনে হয়ছিলো পরিপূর্ণ একজন, এরপর থেকেই প্রেমময় জীবন সঙ্গী পাওয়ার আনন্দে বিভোর থাকলাম।
অনেকেই হয়তো বলবেন, সব স্বামীরাই বিয়ের প্রথম প্রথম এরকম প্রেম ভালোবাসায় গদ গদ থাকে। তারপর আস্তে আস্তে তাদের আসল রূপ বের হয়। অশান্তি, অবহেলা, দূর্ব্যবহার, পরকীয়া আর সর্বোপরি কষ্টের সংসার জীবনটাকেই বেশিরভাগ নারীকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এক বিন্দুও মিথ্যা বলছি না। আমাদের বারো বছরের সংসারে, আমার প্রতি রাশেদের ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি, বরঞ্চ বেড়েছে। হ্যাঁ, আমাদের মধ্যেও মান অভিমান ঝগড়া ঝাটি হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই এগুলো আমাদের ভালোবাসাকে বাড়িয়ে দিয়ে গেছে বহু গুন।
একটা উদাহরণ দেই, বিয়ের তৃতীয় বছরের কোন একদিনের কথা। রাগ করে আমি ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম বলে সে টানা আঠারো ঘন্টা পানি পযর্ন্ত ছুঁয়ে দেখেনি। আচ্ছা আপনারাই বলেন এরপর কি কোন মানুষের সাথে আর কথা না বলে থাকা যায়!
শুধু আমার সাথের রিলেশনেই না, পরিবার বা প্রফেশনেও সততা ও বিশ্বাসের জন্য রাশেদের সুনাম ছিলো। তাইতো ওর মৃত্যুর এতো বছর পরও, অনেক মানুষই ওর কথা মনে রেখেছে। লোকজনকে খুব সহজেই আপন করে নেওয়ার তীব্র সম্মোহনী ক্ষমতার এই লোকটা, এখনো আমার মতো আরো অনেকের প্রাত্যহিক প্রার্থনায় আছে।
মূল গল্পে ফিরি, বাসর রাতের পর থেকে চলমান বৈবাহিক জীবন। আমি অসম্ভব ভাগ্যবতী একজন, খুব ভালো একটা পরিবারের ছেলের বৌ হতে পেরেই। আমার শ্বশুর সদ্য রিটায়ারমেন্টে যাওয়া একজন ব্যাংকার, শাশুড়ি স্হানীয় একটা স্কুলের শিক্ষক। তাদের দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় জন মেয়ে। বিয়ে হয়েছে অনেক বছর আগে। তাইতো একমাত্র ছেলের বউকে নিজের মেয়ে করে নিতে তাদের খুব একটা কষ্ট হলো না। আমি শিক্ষকের মেয়ে, গুরুজনদের কিভাবে সন্মান করতে হয় পরিবার থেকে শিখে এসেছি। তাইতো সব মিলিয়ে শ্বশুর বাড়িতে মানিয়ে নিতে আমার খুব একটা সমস্যা হয় নি। আর সবচাইতে বড় কথা, স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির সবাই আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় আকুন্ঠ সমর্থনটায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়িয়ে দিলো বহুগুন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের সময় রাশেদ আটাশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সাভার ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড ইনফেন্ট্রির অফিসারের ঐ সময় খিলক্ষেত -সাভার -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস- নানান ডেটিং স্পটে আমাকে নিয়ে তার দৌড়ঝাপ। তীব্র প্রাণ শক্তিতে ভরপুর এই লোকটার সাথে টিনেজদের মতোই প্রেম চালিয়ে গেলাম বিয়ের পর টানা দুই বছর। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যাই এদিক ওদিক। আর সেই সাথে পড়াশোনাও চলছে পুরোদমে। ভার্সিটি শেষ করে মাঝে মধ্যে সাভার ক্যান্টনমেন্টে ওর মেসে রাত যাপনগুলো যেনো জীবনে আরেকটি বাসর রাত হয়েই আসে।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার দিন দশেক আগে থেকে শরীর প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। বমি, মাথা ব্যথা, দূর্বলতা। প্রেগন্যান্সির লক্ষণগুলো স্পষ্ট। আশংকা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে টেস্ট করতে পাঠালেন। এমনিতে পরিকল্পনায় ছিলাম, কিন্তু মনে পড়লো কিছুদিন আগে সাভারের মেসে উত্তেজিত সৈনিকের অরক্ষিত ভালোবাসাটার কথা। তখনই কিন্তু আমার মনে সন্দেহ জেগেছিলো।
পরবর্তী দিন ফলো আপ ভিজিটে ডাক্তারের কাছে গেলে, টেস্ট রেজাল্ট দেখে নাটক সিনেমার মতো বলে উঠলেন “সুখবর, আপনি মা হতে যাচ্ছেন।” কথাটা শুনেই শরীরে শিহরণ জাগলো, তীব্র আনন্দে। কিন্তু পরক্ষণেই সামনের সপ্তাহ থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা কথাটা মনে পড়ে যায়। এরই মধ্যে সর্বোচ্চ ফলাফল করার লক্ষ্য নিয়ে প্রিপারেশন নেওয়া। হঠাৎ এই অসুস্থতাটা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল ব্যাঘাত আনতে পেরে, এই ভাবনা থেকে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে পারলাম না।
মন খারাপের অনুভূতি নিয়ে চুপ করে ডাক্তারের পরামর্শ শুনে যাচ্ছি, পাশে বসা রাশেদের হাতটা হঠাৎই অগোচরে আমার হাতে। ওর দিয়ে যাওয়া আলতো মৃদু চাপে মুহূর্তেই ভীষণ সাহসী হয়ে গেলাম। আত্মবিশ্বাসী এই আমার মনে হলো, পরীক্ষা আর মাতৃত্ব দুটোই সামাল দিতে পারবো, দিতে হবে। রাশেদ যে সবসময় পাশে আছে, আমার স্বপ্ন সারথী হয়ে।
আমার জীবনের গল্প স্বপ্ন সারথী দ্বিতীয় পর্ব
মাতৃত্বের আস্বাদ পেতে যাচ্ছি, সংবাদটা মুহূর্তেই নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। নিজ শরীরে অনাগাত সন্তানকে ধারন করে আছি, ভাবতেই প্রতি মুহূর্ত শিহরিত হই। হঠাৎ করেই নিজেকে অনেক পরিনত বলে আবিষ্কার করলাম। আর সবচাইতে খুশি হলাম, রাশেদকে আনন্দে ভাসতে দেখে। পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ সম্ভবত এখন রাশেদই। সারাক্ষণ হাসি খুশি মুখে একটা চিন্তার ভাজ, পিতৃত্বের প্রস্তুতি ও দ্বায়িত্বে থাকা ব্যস্ত একজন। চাকুরীর শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু পর পর আমার খোঁজ নেওয়া, অনাগত সন্তানকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন গল্প। অনুভূতি গুলো আজীবনের সুখ স্মৃতি হয়ে আছে।
আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডটা কিন্তু মোটেও মসৃণ ছিলো না। শুরু থেকেই নানান শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো, যার সরাসরি প্রভাব পড়লো অনার্সের পরীক্ষাগুলোতে। এমনিতে প্রতি পরীক্ষার আগে আগে আমি হলে উঠে যেতাম, শামসুন্নাহার হলে সহপাঠীদের সাথে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অন্য রকম একটা আনন্দও ছিলো। কিন্তু শারীরিক অবস্হার বিবেচনায় সেবার খিলক্ষেতের বাসা থেকেই পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কোন এক পরীক্ষার আগের রাতের কথা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারিনি, চিন্তিত রাশেদ সারারাত আমার পাশে। সকালে পরীক্ষা দিবো কি দিবো না, দোলাচলে। রাশেদের দেওয়া অভয় আর সাহসেই শেষ পযর্ন্ত পরীক্ষা হলে চলে এলাম। দৌড় ঝাপ করে শিক্ষকদের সহায়তায় সিক বেডে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্হাও করলো রাশেদ। একটু পর পর বমি, একটু রেস্ট আবার পরীক্ষার খাতায় লেখা। ঐ দিনের কথা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি। এভাবেই সেবারের বাকি পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম নিজের সাথে একরকম যুদ্ধ করেই।
ও আপনাদের আরেকটা কথা জানিয়ে রাখছি, মানসিক শক্তি যোগাতে পরীক্ষা চলাকালীন পুরো সময়টাতেই কিন্তু রাশেদ ছুটিতে ছিলো। সত্য বলতে কি, ওর সার্বক্ষণিক উপস্হিতি ও সাপোর্টের কারণেই পরীক্ষাগুলো শেষ করতে পেরেছিলাম। আর অনার্সের রেজাল্টও কিন্তু শেষ পযর্ন্ত খুব খারাপ হয়নি। আমার জীবনের আরেকটা স্বপ্ন পূরণ হলো। আর এভাবেই রাশেদ সারথী হয়ে পাশে থেকে গেলো মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত।
অনার্স পরীক্ষা শেষে পড়াশোনার চাপ ছিলো না বলে অনাগত সন্তানের যত্নে নিজেকে সময় দিতে পারছিলাম। নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সিএমএইচে রুটিন চেকআপে নিয়মিত যেতাম, রাশেদের হাত ধরে। প্রেগন্যান্সির ঝুঁকিপূর্ণ প্রথম তিন মাস কাটিয়ে উঠার পরের চেকআপেই দুঃসংবাদ পেলাম, গর্ভকালীন ডায়াবেটিকস। খবরটা শুনে আমার চাইতে মনে হয় বেশি দুঃখ পেয়েছিলো রাশেদ। বেচারা হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার আর ডাইটেশিয়ানের সাথে দফায় দফায় কনসালটেশনে। আমার জন্য ডায়েট চার্ট তৈরী, ইনসুলিনের ডোজ আর এগুলোর সময়মতো প্রয়োগ সবকিছু মনিটরিং করে গেলো ডেলিভারির আগ পযর্ন্ত।
সৈনিকদের চাকুরীর এই একটা সমস্যা, যখন তখন বদলির আদেশ। ডেলিভারির মাস দুয়েক আগে হঠাৎই ওর যশোর সেনানিবাসে বদলি, আমার জন্য দুঃসংবাদ হয়ে এলো। যদিও সাথে আরেকটা সুসংবাদ ছিলো, রাশেদের মেজর পদে প্রমোশন। স্ত্রীকে এ ভাবে রেখে সে কিছুতেই নতুন কর্মস্হলে যাবে না, আড়ালে মা কে বলেছে আর্মির চাকুরী থেকে না কি ইস্তফা দিবে! বাসায় যখন এসব ইত্যাদি ইত্যাদি নাটক চলছে, আমি শান্ত মাথায় দুশ্চিন্তা না করে চাকুরীটা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। আর তার বাদেই ভীষণ মন খারাপ করে ওর যশোর যাওয়া। সে রাতের কথা আজো আমার মনে আছে, জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো অনেকক্ষণ।
এখনকার মতো সে সময়টাতে ফোনে ফ্রি অডিও ভিডিও কল করার কোন অপশন ছিলো না। রাশেদ তারপরও বলতে গেলে কাজের সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণই আমার সাথে ফোনে যুক্ত। আর প্রতি সপ্তাহে ঢাকা যশোর দৌড়াদৌড়িতেও ওর একটুও ক্লান্তি নেই।এবার সে সময়টাতে আমার অন্য আরেকটা স্বপ্ন পূরনের গল্পের কথা আপনাদেরকে জানাবো, যেটাও কিন্তু রাশেদের হাত ধরেই পাওয়া।
ছাত্র জীবনে আমি বরাবরই মেধাবীদের একজন। উদয়ন স্কুলের প্রথম দিককার ছাত্রী, বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে স্কুল বা পরবর্তীতে কলেজে শিক্ষকদের বাড়তি মনোযোগ পেয়েছি। গনিতে পারদর্শী ছিলাম বলে, বাবার মতো শিক্ষকদেরও আশা ছিলো বুয়েটে ভর্তি হতে পারবো। কিন্তু বুয়েট ভর্তি স্বপ্ন ভঙ্গের পর আর সাইন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথে হাটি নি। আইআরে ভর্তি হয়ে করা এই পড়াশোনাটাতে আমার চাঁপা কষ্ট আছে, ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় থাকা মেধাবী রাশেদ কিন্তু সেটা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলো।
রাশেদের অনুপ্রেরনাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ য়ের এমবিএতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখলাম। নিজের সম্পর্কে আমার ভাবনা যখন তলানিতে, ঠিক সেই সময় রাশেদ আমার প্রজ্ঞা, মেধা বা লিডারশিপ স্কিলসের প্রশংসায়। ওরই বন্ধু শামস ভাই তখন আইবিএয়ের ফাইনাল সেমিস্টারের ছাত্র। ভাইয়া আমার প্রেগন্যান্সি কালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিন বাসায় এসে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করতেন। শামস ভাই আগে থেকেই ভর্তি কোচিংয়ের সাথে জড়িত, পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখেন। আর সর্বোপরি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আগে থেকেই থাকা আমার দক্ষতায়, প্রথম বারেই আইবিএতে ভর্তির সুযোগ মিলে গেলো।
আমার প্রথম সন্তান জন্মের সপ্তাহ দুয়েক আগে পাওয়া এই অর্জনটা অন্যরকমভাবে আত্মবিশ্বাস দিয়ে গেলো। আমার পক্ষেও অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব, রাশেদের বহুদিন ধরে দিয়ে যাওয়া উৎসাহের এই বাস্তব ফলাফল অনুপ্রেরণার। পরিবার পরিজন বা স্বজনদের সবাই এক বাক্যে বলতে লাগলো ” সাদিয়াতো আইবিএতে চান্স পাবেই, ও তো ছোটবেলা থেকেই তুখোড়”। জীবনের কঠিন সময়ে, নিজের ভিতরের সেরাটা বের করে আনতে পারার পুরো কৃতিত্বটা অবশ্য আমি সবসময় রাশেদকেই দেই। সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর স্ত্রীদের যে কোন সাফল্যে স্বামীর অবদান সিংহ ভাগ। আর আমার ক্ষেত্রে রাশেদের কনট্রিবিউশন একটু বেশিই।
এবার মূল গল্পে ফিরি, আমার বড় কন্যা “রাইসা” জন্মের মুহূর্তের সময়টা থেকে। প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টাতে সতর্কভাবে বাসাতেই কাটিয়েছিলাম। নিয়মিত চেকআপ আর সঠিক চিকিৎসায় বড় কোন সমস্যা না হলেও শেষ মুহূর্তে এসে জটিলতার শুরু। বাচ্চার তেত্রিশ সপ্তাহ বয়সের কমপ্লিকেশনটায় অস্ত্রোপচারে যেতে হলো, জরুরী নোটিশে।
হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে যাওয়া এই আমাকে গভীর রাতে এম্বুলেন্সে করে খিলক্ষেত থেকে সিএমএইচে নিয়ে আনা হলো। রাশেদও তখুনি যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। উদ্বিগ্ন রাশেদ পুরোটা পথ কলিগ, হাসপাতাল স্টাফ আর স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে যায়। ভোরে পরিমরি করে হাসপাতালে এসে আমার পাশে সদ্যজাত কন্যাকে দেখে রাজ্যের বিস্ময়ে। আমার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। এরপর রাইসাকে অনভ্যস্ত হাতে ভয়ে ভয়ে ভীষণ যত্ন নিয়ে যখন কোলে তুলে নেয়। “বাবার হাতে সদ্যজাত সন্তান” পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যটা উপভোগ করলাম প্রাণভরে।
কাহিনীটাকে এখন একটু দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। রাইসা জন্মের পর আমার আর রাশেদ, দুজনের জীবনেই অনেক পরিবর্তন। রাইসাকে কেন্দ্র করেই যেনো আমাদের জীবনের চাকা। তবে আইবিএতে এমবিএ শুরু করা, সাথে নবজাতক। আমার জীবনটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠলো। স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় শেষ পযর্ন্ত দুটোই সামাল দিতে পারলাম, বেশ ভালোভাবেই। যদিও এমবিএ একটু সময় নিয়েই শেষ করলাম, সংসার আর পড়াশোনাকে ব্যালেন্সড রাখতে। এমবিএয়ের ফাইনাল সেমিস্টারে এসে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেগন্যান্ট হওয়ার সংবাদ, সবাইকে আবারো খুশির জোয়ারে ভাসালো।
সত্য বলতে কি, আমার দ্বিতীয় সন্তান জারার জন্মের সময়টাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। রাশেদ মিরপুরে স্টাফ কলেজের কোর্সে ছিলো বলে পুরো সময়টাতে ওকে পাশে পেয়েছিলাম। জারার জন্মে এবার সবচাইতে বেশি খুশি হলো সম্ভবত ওর বড় বোন রাইসা। তিন বছরের অতটুকুন বাচ্চা সারাক্ষণ বোনকে আদরে রাখে, সেই থেকে আগলে রেখেছে আজো পযর্ন্ত।
আমাদের পরিবারের এরপরের গল্পটা আর আট দশটা সাধারণ পরিবারের মতোই। দুই বাচ্চা দেখভালের পাশাপাশি আমাদের দুজনের ক্যারিয়ার চালিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। রাশেদ চৌকস মেধাবী অফিসার, বরাবরই বসদের সুনজরে। আর আমিও এমবিএ শেষ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ব্যস্ত পেশাগত জীবনে।
রাশেদের মৃত্যুর পর আমার একটা বড় আফসোস এখনো তাড়া করে, ঢাকার বাইরে কোন সেনানিবাসে ওর সাথে গিয়ে সংসার করতে না পারা। নিজের পড়াশোনা, বাচ্চা বা ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আমি আগাগোড়া ঢাকাতেই থেকে গেছি। যার ফলে আমাদের বিয়ের বয়স বারো বছর হলেও, বহুদিন আমাদের আলাদা থাকতে হয়েছে।
রাইসার বয়স তখন নয় আর জারার ছয়, দুজনেই ঢাকা সেনানিবাসের নামী একটা স্কুলে। আমি চাকুরীতে ব্যস্ত এক্সিকিউটিভ পদে। রাশেদ লেঃ কর্নেল হিসেবে বান্দরবানের আলীকদমে একটা ব্যাটেলিয়ানের দ্বায়িত্বে। আমাদের পরিবারে চারদিক থেকে তখন শুধুই সুখের সংবাদ, রাশেদের নামে আর্মি হাউজিং প্রজেক্টে একটা প্লটও বরাদ্দ হয়েছে। সুন্দর একটা বাড়ি তৈরী করার স্বপ্নে আমরা বিভোর। ঠিক ঐ সময়টাতেই একটি দূর্ঘটনা পুরো পরিবারকে তছনছ করে দিয়ে গেলো।
দু হাজার বারো সালের তেইশে অক্টোবর, এক দূর্যোগময় রাতে কিছু পাহাড়ি দূষ্কৃতিদের তাড়া করে ক্যাম্পে ফেরার পথে রাশেদকে বহন করা জীপটা পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। রাশেদ সহ অন্য একজন সৈনিক ঘটনাস্হলে নিহত, জিপের ড্রাইভার সহ বাকি তিনজন আরোহী গুরুতর আহত। সবাইকে দ্রুত হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলেও, ইতোমধ্যে রাশেদের মৃত্যুটায় নিশ্চিত ছিলো উদ্ধারকারীরা।
রাত দুটোর দিকে যখন মৃত্যু সংবাদটা পাই, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। খানিকক্ষণ বাদে ধাতস্হ হতেই জোর একটা চিৎকার দিলাম। রাইসা আর জারা দুজনেই হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে ভয়ার্ত চাহনীতে। আমি নিশ্চিত মেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরে আমার করা কান্নাটায় সেদিন আরশ কেঁপে উঠেছিলো।
আমার জীবনের গল্প স্বপ্ন সারথী তৃতীয় ও শেষ পর্ব
স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু সংবাদ, আমার ভিতরে যে কি পরিমাণ তোলপাড় করেছিলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বারবার নিজেকে প্রমাদ দিয়ে গেলাম, ভুল শুনেছি বা কথাটা আদৌ সত্য নয়। স্ট্রং ডিনাইয়ালে। জোর চিৎকার করে বুক ফাটা কান্নাটায় কিন্তু সেদিন আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। এক অজানা আতংকে ভয়ার্ত দুটো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। মেয়ে দুটো যে সত্যই দূর্ভাগা। এতো ভালো একটা বাবাকে ওরা অল্প বয়সেই হারিয়ে ফেললো। আর মনের মধ্যে আশংকাটা উকি দিয়ে যাচ্ছে, পারবো কি রাশেদকে ছাড়া বাকি জীবন পাড়ি দিতে?
রাশেদের মৃত্যুটা মুহূর্তেই টক অব দ্যা কান্ট্রি। যদিও আর্মি হেড কোয়ার্টার প্রথম থেকেই খুব সতর্ক, মিডিয়ায় সংবাদটা যেনো অতিরঞ্জিত না হয়। রাত অনেক গভীর হলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই নানান লোকজনে সমাগম হতে লাগলো খিলক্ষেতের এই বাসাটায়। আমার অবশ্য মিডিয়ার সাথে কেনো, আপনজনের সাথেও কথা বলার অবস্হা নেই।
“আমি রাশেদের কাছে যাবো, আমাকে তোমরা রাশেদের কাছে নিয়ে যাও।” কেঁদে কেঁদে করা আমার এই অনুরোধটায় সবার নির্বাক দৃষ্টি, আমার কান্নার মাত্রাটাকেই বাড়িয়ে দিয়ে গেলো। সে রাতে অনেক লোকজনের উপস্থিতি থাকলেও, সবাই পিনপতন নীরবতায়। রাশেদের অস্বাভাবিক মৃত্যুটাকে কেউই মেনে নিতে পারলো না।
ছেলের অকাল মৃত্যুর সংবাদটা আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই নিতে পারলেন না। একমাত্র ছেলের শোকে শাশুড়ি বিছানা নিলেন আর শ্বশুরকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। উচ্চ রক্তচাপের রোগী রাশেদের বাবা খানিকক্ষণ পর পরই মূর্ছায় যাচ্ছেন। আর এভাবেই একটা সুন্দর সুখী গোছানো পরিবারের উপর দিয়ে হঠাৎ বয়ে যাওয়া ঝড়, একেবারে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে ফরমালিটিজ শেষ করে ভোরের মধ্যেই লাশ ঢাকায় আনা হয়। সকালের মধ্যে আর্মির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্হার লোকজনের এই বাসায় জমায়েত। আমাদের অবস্হা দেখে কেউই অবশ্য স্বান্তনা দেখানোরও সাহস পেলো না। একটা অসহায় পরিবারের কান্নায়, ভীষণ শক্ত হৃদয়ের লোকটিও আড়ালে চোখ মুছে গেলো।
রাশেদের লাশটা বাসাতে আনতেই প্রথমবারের মতো বিশ্বাস হলো ও আর নেই। আশ্চর্য হলেও সত্য লাশের খাটিয়াটা দেখার পর থেকেই আমার কান্নাটা থেমে যায়। পরম ভালোবাসা নিয়ে ওর মুখটা দেখতেই অন্য রকমের একটা সাহস পেয়ে গেলাম। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও যে আমাদের কথা মনে করছিলো, মুখ খানা দেখে নিশ্চিত হলাম। অভয় দিয়ে যাওয়া স্মিত হাসি।
রাশেদ চলে গেলেও, এভাবেই জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাহসটা দিয়ে যায়। একটা মৃত মানুষও যে কতোটা শক্তিশালী হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই রাশেদ। ওর মৃত্যু শোকটা মুহূর্তেই আমার মধ্যে শক্তিতে রূপান্তরিত, অজান্তেই। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে বাবা নিজের জীবন দিয়েছে, মেয়ে দুটোর মতো আমরাও ওর অবদানের জন্য আজীবন গর্বিত।
রাশেদের হঠাৎ এই চলে যাওয়াটাতে আমরা যতোই কষ্ট দুঃখ বা বিপদে থাকি কি না, এরপর জীবন কিন্তু চলতে লাগলো জীবনের নিয়মেই। পুরো দেশের শিরোনাম হয়ে বীরের মর্যাদায় সামরিক কবরস্হানে সমাহিত হওয়া রাশেদের কথা অল্পদিনের মধ্যেই সবাই ভুলে গেলো, শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারটি ছাড়া। সরকার বা সেনা দপ্তর থেকে নিয়ম মাফিক সাহায্য সুবিধা বা ক্ষতিপূরণ ছাড়া আমরা আর কারো কোন সহায়তা পাইনি। সত্য বলতে কি, আমাদের আর্থিক সহায়তার কোন প্রয়োজন ছিলো না। মানসিক সাপোর্টটাই তখন খুব জরুরী। কাছের কিছু আত্মীয় স্বজন প্রথম দিকে খোঁজখবর নিলেও, অল্পদিনের মধ্যেই যে যার ব্যস্ততায়। আর তাইতো বাধ্য হয়ে আমাকেই পুরো পরিবারের দ্বায়িত্ব নিতে হলো। আর মৃত রাশেদই আমার সারথী, কঠিন জীবন যুদ্ধে।
আমার শ্বশুর আব্দুল লতিফ, রাশেদ মারা যাওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় নিজেও ছেলের কাছে চলে গেলেন। সবাই আবারো শোকের সাগরে ভাসলাম। বাবা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন কিন্তু পুত্র শোকটাকে আর নিতে পারলেন না। স্বামী মৃত্যুর পর শ্বশুরের ছায়ায় সংসারটাকে টেনে নেওয়ার ভাবনায় থাকা এই আমি জীবনে আরেকটা বড় হোচট খেলাম। আর এদিকে আমার শাশুড়ির অবস্থাও অবনতিতে, ছেলে স্বামী হারিয়ে মায়ের এক প্রকার পাগল প্রায় অবস্হা। সব মিলিয়ে নিজেকে আবারো ভীষণ অসহায় বলে মনে হলো।
পরিবারের এতো কঠিন সময়েও কিন্তু ভেঙ্গে পড়িনি, রোজ রাতে রাশেদ এসে আমাকে সাহস দিয়ে যায়। আমার শিক্ষক বাবা মেয়ের এই ভয়ানক বিপদে পাশে এসে দাড়ালেন। দুঃসময়ে আমার নিজের মা আর বাবা নিজেদের সবটুকু দিয়েই আমাদেরকে সাহায্য করলেন। মেয়ে দুটোকে দেখভাল বা স্কুলে আনা নেওয়ার দ্বায়িত্ব পালন করাতে, আমিও অফিসে মনোযোগী হতে পারলাম। মেয়ে দুটোও নানা নানীর ভালোবাসায় আপ্লুত।
জীবনে হঠাৎ ঝড় আসবে, লন্ড ভন্ড করে দেওয়া বাতাসে ঘর বাড়ি ভেঙ্গে যাবে। আবার নতুন করে বাড়িঘর তুলে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার বাবার দেওয়া প্রতিনিয়ত এই দীক্ষাটা আর সাথে রাশেদ নামক সারথীর সার্বক্ষণিক উপস্হিতির অনুভূতি, আমি যেনো জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক সৈনিক।
এরপর থেকে দুটো মেয়েকে ঘিরেই আমার জীবন। চাকুরীতেও উন্নতি করতে থাকলাম নিজের যোগ্যতায়। সেনা পরিবারের সাথে সবসময়ই যোগাযোগ ছিলো, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অনেকের সাথেই দেখা হয়। সবাই ভূয়সী প্রশংসা করে, পরিবারকে সুন্দর ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বলেই। আমি নিশ্চিত মানুষের করা প্রশংসায় আড়াল থেকে রাশেদও অনুভব করে, সে যে আমার স্বপ্ন সারথী।
স্বামী মৃত্যুর দশ বছরেরও বেশি সময়টাতে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিস্হিতিরই সম্মুখীন হতে হয়েছে, তবে সব কিছুই সামাল দিয়েছি দক্ষ হাতে। দুটো চাকুরী পরিবর্তন করেছি শুধুমাত্র নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে। পুরুষ যখন ভাবে অকাল বিধবা এই আমি দুটো সন্তানকে নিয়ে অসহায়, আমার কাছ থেকে অন্য কিছু পাওয়ার আশার প্রকাশ। আমি আর রাশেদ দুজনেই তখন হাসাহাসি করি, আর সেসব লোকজনের জন্য সবসময়ই আমাদের করুনা আর ঘৃণা। ওরা যে আমার যোদ্ধা পরিচয়টা জানে না বলেই।
করোনাতে আমার নিজ বাবার মৃত্যু, অনেক বছর পর পরিবারে বড় একটা ধাক্কা হয়ে এলো। কিন্তু ততোদিনে আমি জীবন যুদ্ধের পাকা এক সৈনিক। শোককে আবারো শক্তিতে রূপান্তরিত করলাম। মেয়ে দুটোকে আমার বাবা অনেক বছর আগলে রেখেছিলেন, ওদের কষ্টটাই আমাকে বেশি ব্যথিত করে। বাচ্চা দুটোর ভালোবাসার মানুষ গুলো যে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমি একটা বিদেশী উন্নয়ন সংস্হার এইচ আর ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমার ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্সের দিকটা দেখে বলেই এদের সাথে আছি বেশ কয়েক বছর হতে চললো। পেশাগত খুব বড় ধরনের ঝামেলা নেই বলে পরিবারকেও সময় দিতে পারছি। শাশুড়ি অসুস্থ থাকলেও মা কে পরিবারের ছায়া বলেই মনে করি। শাশুড়ি যখন প্রতি নামাজে শেষে ছেলে ও স্বামীর পাশাপাশি আমার জন্যও দোয়া করে, খুব ভালো লাগার একটা অনুভূতি হয়। বিশ্বাস করি সবার দোয়া ছিলো বলেই জীবন যুদ্ধে হারিনি।
আমার নিজের খুব ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। বেঁচে থাকার সময়টাতে রাশেদ আমার এই স্বপ্নটাকে খুব উৎসাহ দিয়ে যেতো। এমনকি মৃত রাশেদ প্রায়ই এসে স্বপ্নটার কথা জানান দিয়ে যায়। গত বছর রাইসা আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে এখন পুরোদস্তুর মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। জীবনের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হলো, আর বরাবরের মতোই রাশেদ আমার সারথী। আমাদের ছোট মেয়ে জারা এ বছর শহীদ আনোয়ার থেকে ইংরেজি ভার্সনে এইচএসসি দিবে। ওর খুব শখ, মায়ের মতো আইবিএ তে পড়বে। বড় বোন ও আমার উৎসাহে, মেয়েটা খুব আশাবাদী। এখন নিজের মতো করেই প্রস্তুতিতে আছে।
স্বামী মৃত্যুর পর দুটো অবুঝ মেয়েকে নিয়ে গত দশ বছরের জার্নিটাতে কিন্তু নিজেকে কখনোই একা মনে হয়নি। যখনই হোচট খেয়েছি বা বাধা এসেছে, প্রাণপণে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করেছি। রাশেদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি অনুভব করে। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েদেরকে মানুষ করাই ছিলো আমার জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবারের জন্য থাকা ওদের মৃত বাবার ভালোবাসা আর ওদেরকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন, মেয়ে দুটোকে কখনোই লাইনচ্যূত হতে দেয়নি। এখনো প্রতিদিনই মেয়েদের কথোপকথনে থাকে বাবার প্রতি ভালোবাসা ও সন্মান। আর এভাবেই রাশেদ এখনো আমার স্বপ্ন পূরনের সঙ্গী, দক্ষ সারথী হয়েই।
END
২.কষ্ট জীবনের গল্প
#এক ।
আম্মা দেড় কেজি খাসির মাংস দিয়ে কোরমা রান্না করতে করতে আপনমনে আব্বা আর ভাইয়ার গুষ্টি উদ্ধার করছেন । আম্মার কথাগুলো শোনার চেয়ে আমি বরং কোরমা হওয়ার অপেক্ষা করছি । আরেক চুলা থেকে পোলাওয়ের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে ।
আম্মার হাতের কোরমা পোলাও পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটা খাবার । সম্ভবত সব মায়েদের হাতেই এই খাবারটা অসাধারণ হয় ।
আমাদের বাসায় বছরে হাতে গোনা কয়েকদিন কোরমা পোলাও রান্না হয় । তারমধ্যে একটা হচ্ছে আত্মীয়স্বজন এলে ।
আজ আত্মীয়স্বজন কেউ না এলেও ভাইয়া বিরাট একটা কাজ করেছেন । যথারীতি এস এস সির পর এইচ সিতেও কেবল ‘এ’ মাইনাস পেয়েছেন ।
আব্বা তাতেই মহাখুশি । টানাটানির সংসার কী না বুঝলেও খাসির মাংসের কোরমা যে বিলাসিতা আম্মার রাগ থেকে টের পাচ্ছি ।
আব্বা খেতে খেতে বললেন ; সবাইকে যে জিপিএ ফাইভ পেতে হবে এমন কোনো কারণ নেই ।
আমরা দুই ভাই দুই বোন । আম্মা সুন্দরভাবে ভাগ করে দেওয়ার ফাঁকে ফোঁস করে বললেন ; তোমার আশকারা পেয়ে ছেলের এমন রেজাল্ট ।
আব্বা মৃদু হেসে বললেন ; যেসব ছেলেমেয়েরা এরচেয়েও খারাপ রেজাল্ট করেছে তাদের কথা চিন্তা করলে তুমি শান্তি পাবে ।
আম্মা কিছু বলেন না । ভাইয়া মাথা নিচু করে খাচ্ছে দেখে আমার মায়া লাগে । উনি যথেষ্ট চেষ্টা করেও পারেননি । অথচ আমার বড় দুই বোন তার অর্ধেক পড়ে ভালো রেজাল্ট করেছে ।
সামান্য একটু পোলাও বেঁচে আছে । আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি । জানি এরপর আব্বা মিষ্টি দই দিয়ে পোলাও খাবেন । বিচিত্র কারণে আমি আম্মা ঘেষা না হয়ে আব্বাকে ফলো করি ।
আব্বা সামান্য পোলাও নিয়ে আমার দিকে ঠেলে দেওয়ায় আমার বোনদের চোখেমুখে অদৃশ্য একটা বঞ্চনার কিঞ্চিৎ হতাশা টের পাই । এমনিতে অবশ্য কদাচিৎ বড় মাছ রান্না করলে আব্বা মাথাটা প্লেটে নিয়ে ভেঙে সবাইকে সামান্য ভাগ দিয়ে তুলতুলে মগজ আমার প্লেটে তুলে দেন । মাছের মাথা সুড়ুৎ করে টেনে খাওয়ার মধ্যে অন্যরকম মজা আছে ।
#দুই ।
স্বাভাবিকভাবেই ভাইয়া বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেও চান্স পায়নি । কলেজের অনার্সে চান্স পাওয়াও সহজ নয় ।
ভাইয়া হাল ছেড়ে দেওয়ায় আম্মার মন খারাপ হলেও আব্বার মধ্যে কোনো বিকার নেই ।
খেয়াল করে দেখেছি যত বড় সমস্যাই হোক না কেন আব্বা হাসিমুখে মেনে নিয়ে একটা না একটা সমাধান বের করে নেন ।
আব্বার ডিউটির কোনো টাইমটেবল না থাকায় রাতের খাবার এক সাথে খাওয়া হয় না । বাঙালির সব পারিবারিক আলাপ খাবার টেবিলে হলেও আমরা পারিবারিক মিটিং থেকে বঞ্চিত ।
এক রাতে খাবার সময় আব্বা ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন ; তোমার কী প্ল্যান ?
ভাইয়া চকিতে আমার দিকে তাকালে মৃদু হেসে তাঁকে আশ্বাস দিই ।
ভাইয়ার বদলে আম্মা ঠেস দেওয়া কন্ঠে জবাব দিলেন ; দেখো কোনো ভাবে দুবাই পাঠানো যায় কি না ।
আব্বা ভাত নাড়াচাড়া করে বললেন ; এই দেশের সবচেয়ে বড় সেক্টর হচ্ছে এগ্রিকালচার, তুমি এগ্রিকালচারে ডিপ্লোমা করতে পারো ।
; এরপর কি চাষবাস করবে ? আম্মা ফোড়ন কাটেন ।
; আহা রুমা, তুমি কোনোকিছু পজিটিভলি নিতে পারলে না ।
; পজিটিভলি না নিলে এই সংসারে টিকে আছি কীভাবে ?
আব্বা কিছু না বলে আপনমনে খেতে থাকেন । ঢাকা শহরের পুলিশের একজন ওসি হওয়া স্বত্ত্বেও আমাদের টাকাপয়সার বাহুল্য নেই । আপা চাকরি করতে চাইলেও আব্বার জন্য সম্ভব হয়নি ।
এক সময় নীরবতা ভেঙ্গে ভাইয়া বললেন ; তুমি যা বলো তাই হবে আব্বা ।
; আমি তোমার মতামত জানতে চেয়েছি রুমান, ধীর কন্ঠে বলেন আব্বা ।
ভাইয়া চুপ মেরে থাকায় বোঝা গেল তার কোনো মতামত নেই ।
আমরা দুই ভাই ড্রয়িং রুমে ঘুমাই ।
বাথরুমে যাওয়ার আগে দেখি ভাইয়া শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে । শীর্ষেন্দুর মানবজমিন বইটা বোধহয় সে মুখস্থ করে ফেলবে ।
বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বললাম ; মন খারাপ ভাইয়া ?
ভাইয়া বই থেকে চোখ না সরিয়ে আস্তে করে হু শব্দ করে ।
; মন খারাপ করিস না, আব্বার পরামর্শটা ভেবে দেখ ।
ভাইয়া বই থেকে চোখ না তুলে বলে; ভাবাভাবির কী আছে ? ইলেকট্রনিকসের সময় এগ্রিকালচার মন্দ না ।
কোনো কারণ ছাড়াই ভাইয়া মিটিমিটি হাসছে । ধীরেধীরে মনস্তত্ত্ব বুঝতে শিখছি । এই বয়সে একা একা হাসির পেছনে অন্যরকম কারণ থাকে ।
মাস তিন চারেক ধরে এলাকার এস এস সি পড়ুয়া একটা মেয়েকে পড়াতে গিয়ে ভাইয়া খেই হারিয়ে ফেলেছে । মেয়েটা সেই লেভেলের গাধা হলেও ভাইয়ার মাথাটা বোধহয় খেতে ভুল করেনি ।
; তোর ছাত্রীর খবর কী ?
; এই গাধাটাকে পড়াতে গিয়ে আমার নিজের অবস্থাই খারাপ ।
হাসি চেপে হালকা ভাবে জিজ্ঞেস করলাম ; সুন্দর মেয়েদের ব্যাপারে সাবধানে থাকিস ভাইয়া, এরা শান্তশিষ্ট হলেও ছেলেদের মাথা খাওয়ায় বিটলার ওস্তাদ ।
ভাইয়া আমার দেড় বছরের বড় হলেও ম্যাচুরিটির দিক দিয়ে আমি এগিয়ে ।
ভাইয়া বই ভাঁজ করে এক পাশে রেখে বলে ; তোকে একটা কথা বলি ?
; হুম ।
; আম্মাকে বলবি না তো ?
তীর জায়গা মতো লেগেছে দেখে নির্দ্বিধায় বলি ; নিশ্চিন্তে বলতে পারিস, আম্মা কেন দুনিয়ার দ্বিতীয় কেউ জানবে না ।
ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে ; নিপু মেয়েটা পড়ালেখায় খারাপ হলেও এমনিতে খুব ভালো ।
এসব আলোচনায় জিভ নাড়তে নেই । নইলে মাছ ফসকে যাবে ।
আমার নীরবতায় আস্বস্ত হয়ে ভাইয়া বলে ; সুন্দর হওয়ায় তাকে অনেকে টিজ করে ।
আমি অপেক্ষা করলেও আমার নায়কোচিত চেহারার বড় ভাইয়ের গল্পের স্টক শেষ ।
; তুই কি নিপুর প্রেমে পড়েছিস ভাইয়া ? যদি এমন হয় খুব সাবধানে থাকিস ।
ভাইয়ার মুখ লাল হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারলাম অনুমানটা জায়গা মতোই লেগেছে ।
#তিন ।
আমাদের নিস্তরঙ্গ দিন ঘটনা বিহীন কেটে যাচ্ছে । আব্বাকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ট্রান্সফার করা হলেও শেষতক সেই ট্রান্সফার বাতিল হয়ে যায় ।
বড় আপার বিয়ের কথা চলছে । ছেলে ইটালি ছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে একটা রেস্টুরেন্ট দিয়ে ভালোই ব্যবসা করছে । আব্বা প্রথমে রাজি না থাকলেও আম্মার জোরাজোরি আর পরিবার ভালো দেখে আব্বা শেষতক রাজি হয়েছেন ।
ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করার সামর্থ্য আব্বার নেই । বড় চাচা বিয়ের আলাপের সময় সিলেট থেকে এসে কয়েকদিন ধরে আছেন । এই ক’দিন আমার জন্য যেন চান রাত ।
বেশ কিছু টি শার্ট, জিন্স, কার্গো ট্রাউজার কেনা হয়ে গেছে । সেই সাথে দামী কেডস এবং অতি অবশ্যই একটা মোবাইল ।
মোবাইলের নাম স্মার্টফোন না হলেও মোটোরোলা রেজর ফোনের স্টাইল রয়েছে । কল এলে ফ্লিপ তোলার সময় নিজেকে কেমন আত্মবিশ্বাসী আত্মবিশ্বাসী লাগে ।
ভালো ফোন, ল্যাপটপ, বাইক মানুষকে স্মার্ট করে তুললেও ল্যাপটপ বাইক না থাকায় আমার কোনো দু:খ নেই । আব্বার সামর্থ্যের বাইরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবিনি আমরা ।
বড় চাচা আসায় ঈদ কারো কম লাগেনি । চাচা আম্মার জন্য মিরপুর বেনারসি পল্লী থেকে চারটে শাড়ি কিনে এনেছেন । শাড়িগুলোর কারুকাজ দেখলেই দাম আঁচ করা যায় ।
আম্মা লম্বা আঁচল টেনে মৃদু প্রতিবাদ করতে চাইলে চাচা না তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলেন ; রুমা, তোমাদের জন্য তো খরচ করার সুযোগ আমার নেই ।
আম্মার মুখটা কালচে হয়ে গেলে বুঝতে পারি কিছু একটা সমস্যা আছে।
আম্মা নি:শব্দে চাচার সামনে চালের গুড়োর সন্দেশ রেখে বলেন ; আজকেই বানিয়েছি ভাইজান, আমি চা নিয়ে আসি ।
আম্মা চলে যাওয়ার মাঝে চাচা আমাকে ইশারা দিয়ে বলেন ; থাকলে আরও কয়েকটা দিও নইলে হিমেলের নজর লাগবে ।
মুহূর্তে গুমোট পরিবেশটা কেটে যায় ।
কিছুকিছু মানুষের নিছক উপস্থিতি, কথাবার্তা মানুষের জন্য অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে । এঁরা টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করার চেয়ে জরুরি অবস্থায় কেবল সাথে থাকলেও বিপদকে তুচ্ছ মনে হয় ।
বড় চাচা তেমনই একজন মানুষ । রাজনীতি করার পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতের ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে । বিভিন্ন সময় ঢাকা এলেও বাসায় কদাচিৎ আসেন । আমরা কেউ বাসায় না থাকলেও টোকেন মানি পেলেও সাথে অযথা খরচ না করার জন্য আব্বার নিষেধাজ্ঞা পাই ।
আপার বিয়ে উপলক্ষ্যে চাচার খরচের বহর টের পেলেও আব্বা কিছু বলতে পারেন না । একে তো বড় ভাই, তার উপর চাচার গমগমে কন্ঠস্বর । এই দুটো উপেক্ষা করার সাধ্য আব্বা তো দূর অনেকেরই নেই ।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল সিলেটে চাচার সাথে থাকি । একবার সিলেট গিয়ে চাচাকে বলেছিলামও । এক ধমকে সেই শখ মিটে গেছে ।
সিলেট থেকে আসার সময় চাচা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন ; তোর দাদা থাকলে তোকে এখানে রেখে দিতাম কিন্তু তোর বাবার জন্য সম্ভব না । সাথে যোগ করলেন ; জীবনে যাই হও না কেন মা-বাবার কথার বাইরে যাবা না ।
দাদা দাদির কোনো ছবি নেই । কেবল তাঁদের রুমটা সযত্নে খালি পড়ে আছে । আমি সেবার কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ফিরে এলেও আব্বা আর বড় চাচার ভেতরকার শীতল যুদ্ধটার কারণ বুঝতে পারি না ।
ছোট চাচা এদিক দিয়ে নিরাপদ । বছর সাত আট ধরে ফ্রান্সে পলিটিকাল এলাইলাম নিয়ে যথারীতি দেশের মতো বিন্দাস আড্ডা আর টুকটাক কাজ করে জীবন পার করে দিচ্ছেন । এখনো বিয়ে থা করেননি । মাঝেমাঝে ফোন করলেও বেশি আলাপ করার আগে বলবেন ; লাইন কেটে গেলে আর আলাপ হবে না, আমার কার্ড শেষ ।
চাচা ফোন কার্ড দিয়ে কল করেন । বড় চাচার সামনে জড়োসড়ো থাকলেও আম্মা ছোট চাচার সাথে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলেন ।
শাসন আর স্নেহ মমতার ফল্গুধারা বয়স এবং সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয় । এটাই জগতের রীতি ।
আপার বিয়েটা সাদামাটাভাবেই হওয়ার কথা । চাচার জন্য সম্ভব হয়নি ।
বিয়ে উপলক্ষ্যে সিলেট থেকে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন । মেজ খালা মেজ মামা আর আমাদের ছোট বাসায় সবাই গাদাগাদি করে থাকলেও আনন্দের কমতি নেই ।
এই বয়সেও বড় চাচির রূপে স্নিগ্ধতা রয়েছে । সাধারণত সুন্দর মেয়েরা ভালো রান্নাবান্না করতে পারে না, তাদের ব্যক্তিত্বেও ঘাটতি থাকে ।
আমার বড় চাচি এই দু’য়ের ঊর্ধ্বে । আম্মার পাশে দাঁড়িয়ে কিচেন সামাল দিলেও উনিই যে সবকিছু করছেন বুঝতে পারি ।
সকাল থেকে রাত অব্দি খালাতো মামাতো ভাইবোনদের আনাগোনা লেগেই আছে । খাওয়া আর আড্ডার বহর দেখে আমি বিস্মিত ।
আমার ধারণা ছিল জনবহুল এই ঢাকা শহরে আমরা ভীষণ একা । কিন্তু একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আমার ভুল ভেঙে দিয়েছে । এসব কিছুর পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, আমার খালা মামারা তাঁর কথা উল্লেখ করেন না ।
স্নেহময়তা ভালোবাসা কি স্পর্শ করা যায় ? চাচা নিজের গাড়িটা নিয়ে আসার পাশাপাশি প্রতিদিন গাড়ি ভাড়া করছেন । আমার কাজ হচ্ছে চাচার সাথে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া ।
কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের সময় খুব মজা হলেও বিদায়বেলা আপা আমাদের সবার মন খারাপ করে দিলো ।
আব্বাকে জড়িয়ে ধরলে আব্বা আপাকে অভয় দিয়ে শান্ত করলেও বড় চাচাকে জড়িয়ে ধরে আক্ষরিক অর্থেই কান্নায় ভেঙে পড়লে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী চাচা নিজেকে সংযত করতে পারেননি ।
চাচা আপাকে আগলে ধরে নি:শব্দে কাঁদছেন । আশপাশের অনেকে সেই দৃশ্য দেখে অবাক ।
আব্বা অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন । কেবল চাচার সাথে পাল্লা দিয়ে আম্মাও কাঁদছেন । এমন কান্না কেবল হুমায়ূন আহমেদের স্বল্প ডায়ালগের নাটকে দেখা যায় । বাস্তবে সম্পর্কের এমন বহু ধারায় বয়ে যাওয়া সমুদ্রটা হারিয়ে গেছে ।
আমার পাশে অল্পবয়সী একটা স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়ে তার চাঁপা কলার মতো আঙুলগুলো দিয়ে ভাইয়ার আঙুলগুলো দৃঢ়তার সাথে ধরে আছে । বলে না দিলেও বুঝতে পারি মেয়েটির নাম নিপু ।
নিপু নামের মেয়েরা কি কঠিন মুহূর্তেও নিপুণ হয় ? আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমার সহজসরল বোকাসোকা ভাইয়াকে জীবনের জটিল এবং কঠিন মুহূর্তেও ঠিকই আগলে রাখবে ।
নিপু চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় । মুহূর্তের সেই পলকে অস্বস্তির চেয়ে অন্যরকম একটা আশ্বস্ত করার ভাব ছিল ।
মেয়েরা যে অল্পবয়সে ম্যাচুরড হয় নিপুর চাহনিতে বুঝতে পারি।
আত্মীয়স্বজনদের অল্পসংখ্যক ছাড়া একে একে সবাই কমিউনিটি সেন্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন । নিপু একা যেতে চাইলে আমি ভাইয়াকে সাথে দিয়েছি । সেই সময়টা নিপু মাথা নিচু করে ছিল ।
আমি শীর্ষেন্দু সমরেশ পড়িনি । তিন গোয়েন্দা আর ওয়েস্টার্ন গল্পে বিভোর থাকলেও অজান্তে চিরন্তন বাঙালির মন ধারণ করে আছি ।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল নিপুকে বলি আসছে দিনগুলো খুব খারাপ হবে । মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে । ভাইয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও দোষ দেওয়া যাবে না ।
সময় আর যুগের দোহাই দিয়ে একটা সময় মানুষ তার সুন্দর আবেগ অনুভূতিকে হত্যা করে যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে ।
আমার বলা হয় না ।
আনন্দঘন কমিউনিটি সেন্টার হটাৎ জনশূন্য হয়ে পড়লে একটা ভীষণ ঝড়ের পর যেমন সুনসান নীরবতা নেমে আসে, সহসা তেমনই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে । আব্বা আম্মা চাচাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে ।
একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন বড় চাচি । উনার তদারকিতে বেঁচে যাওয়া খাবার আত্মীয়স্বজনের সাথে দেয়ার পর যা রয়েছে তা গাড়িতে তোলা হচ্ছে । বড় চাচার টেনশনে অন্তত দেড়শ’ মানুষের খাবার রয়ে গেছে ।
কমিউনিটি সেন্টারের বাইরের মরিচবাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে । রঙিন আলোময় পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । আমরা ক্লান্ত দেহ আর বিষন্ন মন নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার ছেড়ে বাসায় ফিরছি ।
সেই বাসায় আমার আপা বেড়াতে এলেও তার বিছানার অংশটা তার নিজস্ব জগতের থাকবে না ।
মেয়েরা কি বিয়ের সময় তাদের সবটুকু নিয়ে যায় ? আমি জানি না কিন্তু আকুলভাবে চাচ্ছি আব্বা আম্মা আর ভাইবোনদের জীবন যেন এক সুতোয় বাঁধা থাকে ।
সে এক অলীক জগতের ভাবনা হলেও রাস্তার ফ্লোরেসেন্ট আলোয় আমি অলীক জগতটা দিব্য চোখে দেখতে পাই ।
বন্ধুবান্ধব আমার পছন্দে বাছাই করেছি কিন্তু পারিবারিক জীবনটা আল্লাহর দেওয়া ।
আমরা যদি পাপমুক্ত জীবনযাপন করি, মৃত্যুর পর কি বেহেশতে সবাই এক সাথে থাকতে পারবো ? সেখানে কি বড় চাচা থাকবেন ? আমার অসম্ভব সৎ আব্বা কি তাঁর আব্বা আম্মার সাথে থাকবেন নাকি আমাদের সাথে থাকবেন ?
#পরিশিষ্ট :
আম্মা আজ আমাকে দিয়ে দুই কেজি খাসির মাংস আর বাসমতী চাল আনিয়েছেন । সাথে দেশি মুরগির রোস্ট ।
বড় চাচা রসমালাই দই আর কোক নিয়ে এসেছেন ।
এই প্রথম আব্বা কোরমা পোলাও খেলেও আম্মার রান্নার প্রশংসা করলেন না ।
আব্বার ভারি মুখ দেখে চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন ; ছেলের কালকে ফ্লাইট আজ তোর মুখ ভার করে না রাখলেও চলতো ।
এ টি আই থেকে এগ্রিকালচারের উপর ডিপ্লোমা শেষ করে ভাইয়া ইন্টার্ন করার জন্য ডেনমার্ক যাচ্ছে । ইন্টার্ন করার সময়ই ভাইয়া দেড় লক্ষ টাকা বেতন পাবে । ছয় মাস পর ভিসা এক্সটেনশন করে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবে ।
ভাইয়ার মতো নিরীহ মানুষের এমন এডভেঞ্চারাস স্বপ্ন থাকার কথা নয় । আমার মন বলছে ভাইয়া নিপুর জন্য এসব করছে ।
আব্বা চাচার কথায় মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন ; ও আর কোনোদিন ফিরে আসবে না ভাইসাব ।
অনেক অনেকদিন পর আব্বার কন্ঠে ‘ভাইসাব’ শব্দ শুনে চমকে উঠলাম । বড় চাচা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা করায় এনিয়ে আব্বা দু’য়েকবার কথা বলায় বড় চাচা পারতপক্ষে এড়িয়ে চললেও দায়িত্ববোধ থেকে সরে থাকতে পারেননি ।
আপার বিয়ের পুরো খরচ দিয়েছেন । ভাইয়ার ডেনমার্ক যাওয়ার খরচও উনি দিয়েছেন ।
আল্লাহর রাসুল ( স:) বলেছিলেন ‘চাচা পিতৃব্য’ । পিতার অবর্তমানে চাচা দায়িত্ব পালন করবেন । আব্বা থাকা অবস্থায়ও চাচার ভূমিকা দেখে আমি বিস্মিত ।
ভাইয়া আমাদের না জানিয়ে ইন্টার্নশিপের জন্য একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করার পর সিলেটে গিয়ে বড় চাচাকে বুঝিয়েছে ।
সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর আম্মার উচ্ছাস দেখে আমি কিছুটা অবাক হলেও কিছু বলি না ।
সারাজীবন টানাটানির সংসারে থেকে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলার আবদার কিংবা সুযোগ অন্যায় কিছু নয় ।
আব্বার মতো আমারও মন বলছে ভাইয়া আর ফিরে আসবে না ।
আমরা ধীরেধীরে সামুদ্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি । সেই সমুদ্রে মানুষগুলো ভাসমান হিমবাহের মতো । একেকজন কাছাকাছি ভেসে থাকলেও কেউ কাউকে স্পর্শ করছে না ।
ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে বড় চাচা সিলেট চলে গেছেন ।
বাসাটা খালি খালি লাগছে । আমার সাথের অনেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় চলে যাচ্ছে । আমারও ইচ্ছে করছে । দেশে জীবনযাপন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে । বেকারত্বের চেয়ে বড় ইস্যু শ্বাস ফেলার জায়গার বড় অভাব ।
আইইএলটিএসের ক্লাস করছি । ভালো স্কোর করলে স্কলারশিপ পেতে পারি ।
ঝড়ের পর রাতটা বড় আরামের করেছে । আমি মিশেল রাচেলের রাইটিং বইয়ে ডুবে আছি । ভাইয়া না থাকায় পড়ার টেবিলে আমার একচ্ছত্র আধিপত্য ।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে টের পেলাম আব্বা এসেছেন । আব্বা কিছু না বলে খাটে বসলেন ।
অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ; কিছু বলবে আব্বা ?
উনি কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে জিজ্ঞেস করলেন ; তুমিও কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ?
; আগে ভিসা তো হোক আব্বা ।
; ভিসা হবে, আব্বা দৃঢ় কন্ঠে যেন ঘোষণা দিলেন ।
মাথা নিচু করে বললাম ; ওখানে পড়ালেখা করে সামান্য কিছু রোজগার করে চলে আসবো আব্বা ।
আব্বা যেমন নি:শব্দে এসেছিলেন তেমনই ফিরে যান । এই বছর রিটায়ার করলেও এই প্রথম মনে হলো আব্বা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন । সংসার এবং চাকরির অনিয়মের জন্য ষাটের মধ্যেই আব্বাকে বয়ষ্ক লাগে।
গ্রাস এবং আচ্ছাদনের প্রচেষ্টা কখন যে মানুষের যৌবন কেড়ে নেওয়ায় পাশাপাশি মনের সুন্দর ইচ্ছেগুলো মেরে ফেলে ।
এক সুন্দর বিকেলে আমেরিকার স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে একা একটা স্ন্যাকসবারে স্ন্যাকস খাওয়ার পর কোকে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি । আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি কোনো প্রাইভেট ইউনি থেকে বোধহয় ঘরে ফেরার সময় খুনসুটিতে মেতে উঠেছে । ট্রাফিক জ্যামে অভ্যস্ত সি এন জি চালক মোবাইলে হেসে হেসে কার সাথে যেন কথা বলছে ।
দামী একটা গাড়ির আরোহী বিরক্তি নিয়ে তাঁর গেজেটে মগ্ন হয়ে পড়েছেন ।
হালকাপাতলা গড়নের একটা মেয়ে বাইকের পেছন থেকে চালককে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আছে । ধরে রাখার এই স্টাইলে কোনো অশ্লীলতা নেই বরং নিরাপত্তাবোধ আছে । যাত্রী বোঝাই বাসের আরোহীদের চেহারা ভাবলেশহীন হলেও চোখে ঘরে ফিরে যাওয়ার আনন্দ দেখতে পাচ্ছি।
হঠাৎ শরীর মনে ক্লান্তি টের পাই । কফি নিয়ে কফির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছি ।
আনমনে বড় চাচাকে ফোন করলাম ।
চাচা ফোন ধরেই বললেন ; ভিসা হয়েছে ?
; জি চাচা ।
; কবে যাবি ?
একটা রিক্সায় নতুন এক জোড়া দম্পতিকে অকারণে হাসতে হাসতে দেখে বললাম ; চাচা, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না ।
চাচা ক্ষানিক নীরব থেকে বললেন ; আমি তোর চাচিকে বলেছিলাম শেষ পর্যন্ত তুই যেতে পারবি না । বলেই চাচা হাসছেন ।
কান্নার মতো হাসিও সংক্রামক । চাচার সাথে আমিও হাসছি । আমার চোখ দিয়ে নি:শব্দে টপটপ করে জল পড়ছে । এমন কান্নার সময় মানুষের নাকের পাটা ফুলে উঠলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমার তেমনটা হচ্ছে না ।
রাতে বড়’পা তার বরকে নিয়ে এসেছেন । নতুন জামাইয়ের সম্মানে আম্মা ভালো রান্নাবান্না করতে চাইলেও দুলাভাই সেই সুযোগ না দিয়ে ছয়জনের জন্য যথেষ্ট গরম গরম কাচ্চি আর বোরহানি নিয়ে এসেছেন । উনার এই সৌজন্য বোধটুকু ভালো লাগে । আপার চোখেমুখ দেখে বুঝতে পারি দুলাভাইকে পুরো কব্জা করে ফেলেছে । খাওয়ার টেবিলে সেই প্রসঙ্গ তুললে আপা ঝাড়ি দিলেও দুলাভাই কিছু না বলে মিটিমিটি হাসে ।
আপারা চলে গেলে আব্বা আম্মাকে আমার না যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানালে আম্মা রাগারাগি শুরু করেন ।
; তুই যদি যাবি না তাহলে তোর চাচার এতগুলো টাকা কেন নষ্ট করলি কেন ?
আব্বা হাসছেন । আব্বার চোখেমুখে ক্লান্তি ছাপিয়ে নিখাঁদ আনন্দ খেলা করতে দেখে মনে হলো আব্বাকে ছেড়ে আমার কখনো বিদেশ যাওয়া হবে না ।
মাঝরাতে বড় চাচা ফোন করে আম্মার সাথে কথা বলেন ।
ড্রয়িংরুমে একা একা শুয়ে আছি । আমার বিছানার পাশটা খালি । বুক শেলফে ভাইয়ার গল্পের বইগুলো জমে আছে । মধ্যবিত্তের প্যানপ্যানানি জীবন নিয়ে লিখা গল্প উপন্যাস আমাকে কখনো টানেনি । আজ কেন যেন সেই বইগুলো দেখতে ভালো লাগছে ।
অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না । আব্বার রুমে সামান্য টোকা দিতেই আব্বা জিজ্ঞেস করলেন ; কে ?
; আমি আব্বা । তোমার কি কাল সকালে ডিউটি আছে ?
অন্ধকারে আব্বা মৃদু হেসে বললেন ; তোর বোধহয় ঘুম আসছে না, বালিশটা নিয়ে চলে আয় ।
বোধহয় বছর বারো তেরো পর আব্বার পাশে শুয়ে আছি । আব্বা আমার চুলে বিলি কাটার পাশাপাশি অনুচ্চ শব্দে ইয়া আজিজু ইয়া রাহিমু ইয়া কারিমু পড়ছেন ।
খুব ইচ্ছে করছে ছোটবেলার মতো আব্বার গলাটা পেঁচিয়ে ধরি । ছোটবেলার অভ্যাস বড় বেলায় কেবল কল্পনা করা যায় ।
অচেনা এবং ভয়াবহ প্রতিযোগিতামূলক এক ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভয় পেলেও এই মুহূর্তে আমার ঘুম পাচ্ছে ।
আব্বা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন ; তুই কি আসলেই যাবি না ?
আধো ঘুম আধো জাগরণে বলি ; উঁহু ।
; দেশে ভালো লাগবে তো ?
আমাকে নীরব থাকতে দেখে আব্বা বলেন ; জীবনে কখনো ভয় পাইছ না বেটা, সবসময় মনে রাখবি আব্বার দোয়া তোর সাথে আছে ।
আমি চাইলেই আমেরিকার চাকচিক্যময় জীবন বেছে নিতে পারতাম । কিন্তু আব্বা একা হয়ে যাবেন বলে ভিসা পেয়েও যাচ্ছি না ।
ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে খুব । নিপুকে বিয়ের কথা ভাইয়া জানিয়েছে । বিয়ের পর নিপুর যাওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার ।
একই পরিবারে থাকলেও কিছু মানুষ শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে । ভাইয়া পেরেছে ।
ঘুমের ঘোরে অজান্তে বাম হাতে আব্বাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে গভীর অরণ্যের মাঝে একটা ঝর্না দেখতে পাই ।
#ছোটগল্প ।
#কাচপোকার_দিনরাত্রি ।
( অনেকটা টাইম ফিউশন ঘরানার গল্প । নব্বই দশকের শেষ এবং মিলেনিয়ামের দ্বিতীয় দশককে এক সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করেছি কেবল । সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ) ।
৩.বাস্তব জীবনের গল্প
সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরছি একটা মাঠের পাশ দিয়ে। হঠাৎ কেমন একটা কান্নার শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাঠের ভিতর এসে দেখি ছোটো একটা ছেলে বসে বসে কাঁদছে!
আমি কাছে গিয়ে বললাম, “কে তুমি?”
ছেলেটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো কেমন ফুলে গেছে। চেহারা দেখে ছেলেটা কে চিনতে পারলাম। এর নাম সুমন। বয়স দশ-এগার বছর হবে। ওর বাবা রিকশা চলায়।
আমি সুমনের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে রে সুমন?”
কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ভাই আল্লাহ আমার বাবা মা কে গরীব বানাল কেন?”
ওর প্রশ্নটা কেমন বুকের মধ্যে বিঁধল! আমি কিছুই বলতে পারলাম না!
“ইসমাইলের বাবা কত বড়লোক। ও যা ইচ্ছে কিনতে পারে।”
“সুমন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাসায় চলে যা। কাল তো শুক্রবার। তোর স্কুল ছুটি। কাল সকালে আমার বাসায় চলে আসবি। কাল আমি তোর প্রশ্নের জবাব দিবো।”
সুমন উঠে ধীরে ধীরে বাসায় চলে গেল।
সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। “বাবু উঠ। তোর কাছে একটা ছোটো ছেলে এসেছে। “
“মা তুমি আমার রুমে দুইজনের নাস্তা দাও।”
সুমন আমার রুমে আসল। ওর মনটা এখন খারাপ। খুব অসহায় লাগছে ছেলেটাকে।
“কী রে কেমন আছিস?”
আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো একটু হাসি দিলো।
“এ দিকে এসে বোস।”
আমার খাটে এসে বসে মাথা নিচু করে রইল। আমি হাতমুখ ধুয়ে এসে ওর পাশে বসলাম। মা নাস্তা দিয়ে গেল।
“নে নাস্তা খা।”
খেতে কেমন লজ্জা পাচ্ছে। অল্প অল্প করে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আমার রুমের টিভিটা চালু করলাম। গতকাল একটা চারশো মিটার দৌড়ের ভিডিও ডাউনলোড করে রেখেছিলাম।
“সুমন ভিডিওটা খেয়াল করে দ্যাখ। “
সুমন টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
“কী দেখছিস?”
খুব নীচু স্বরে বলল,” সবাই দৌড় দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। “
“গুড। এটা চারশো মিটার দৌড়ের প্রতিযোগিতা।”
সুমন টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। দৌড় এখনো শুরু হয়নি। সবাই যারযার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
“সুমন ভালো করে দ্যাখ, সবাই কিন্তু সমান লাইনে দাঁড়াইনি! আগে-পিছ করে দাড়িয়েছে।”
সুমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আবার টিভির দিকে তাকাল।
“সবার পিছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে লোকটা পিছনে পড়ে গেল না?”
সুমনের বিস্ময় ভাবটা এখন আর বাড়ছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এমন করল কেন ভাইয়া?”
“শোন, যে লোকটা পিছনে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সে পিছনে পড়ে গেছে। ভালো করে খেয়াল করে দ্যাখ। তার বৃত্তটা কিন্তু ছোটো। আর সামনে থাকা মানুষটার বৃত্তটা বড়ো। অর্থৎ গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে তাকে অনেকটা পথ দৌড়াতে হবে। পিছনে থাকা লোকটার বৃত্ত ছোটো। সে কম পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।”
সুমন খুব মনযোগ দিয়ে দৌড় দেখল। এ খেলায় পিছনে থাকা লোকটাই জিতে গেল।
শোন সুমন, পৃথিবীটাও একটা খেলার মতো। তোর মনে হতে পারে বড়লোকের ছেলেরা এগিয়ে আছে। ওরা টাকা দিয়ে অনেক সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু গরীবের ছেলেরা তো অনেক পিছনে পড়ে আছে তাই না?
সুমন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
“আসলে কিন্তু তা না। আল্লাহ কী করছে শোন, গরীব ছেলেদের ভিতরে এক আলাদা শক্তি দিয়ে দিছে। যে শক্তি ব্যবহার করে গরীব মানুষ সহজে জিততে পারে। প্রতিটা গীরব মানুষের মধ্যে আল্লাহ পৃথিবী পাল্টিয়ে দেয়ার মতো শক্তি দিয়েছেন!
দৌড়টা দেখলি, জিতল কে জানিস?”
সুমন মাথা নাড়াল।
“উসাইন বোল্ট। এ মানুষটা কিন্তু খুব গরীব ঘরে জন্ম গ্রহন করেছেন। শুধু দৌড়ে নয়। ফুটবলে দেখ, মেসি, রোনালদো, কালো মানিক সবাই গরীব ঘরের সন্তান। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে দেখবি গরীব মানুষের জয়জয়কার! এরাই ইতিহাস সৃষ্টি করে।
তোর মাঝেও ক্ষমতা আছে যা তোর বড়লোক বন্ধুর মধ্যে নাই।”
সুমন চলে গলে। যাওয়ার সময় ওকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হলো।
কয়েকমাস পরে সুমনের সাথে আবার দেখা হলো। ও আমাদের বাসায় এসেছে মিষ্টি নিয়ে।
“কী রে সুমন কেমন আছিস?”
সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “ভালো আছি ভাইয়া।”
“কীসের মিষ্টি এনেছিস?”
“আমি ক্লাস ফাইভে প্রথম হয়েছি ভাইয়া!”
“এ তো দারুণ খবর রে!”
সুমন বলল,” দোয়া করবেন ভাইয়া।”
“সুমন শোন, আমাদের নবীও কিন্তু গরীবই ছিলেন!”
Nabil Mahmud
৪.মানুষের জীবনের গল্প
পাদুকা:
আজ আমাদের ৯ম বিবাহ বার্ষিকী। কিন্তু দুইজন আজ দুই পৃথিবীর বাসিন্দা।
বউ উচ্চস্বরে হেসে আমাকে সেদিন, ২০১৭ সালের এই দিনে বলেছিল,
“আরে রহমতুল্লাহ, আপনি এত কিপটা কেন? কি করবেন টাকা পয়সা জমিয়ে রেখে? আইজ মরলে কাইল দুই দিন!”
২৯ শে এপ্রিল ছিল তার জন্মদিন আর ১ মে আমাদের মেরিজডে। আমি দুইদিনের গিফট একসাথে দিয়েছিলাম তাকে। সেই প্যাকেট টা হাতে নিয়ে র্যাপিং খুলতে খুলতে সে আমাকে এই কথাটা হাসতে হাসতে বলেছিল। কুমিল্লা আড়ং থেকে একটা দামি ড্রেস তাকে গিফট করেছিলাম বার্থডে আর মেরিজডে একসাথে মিলিয়ে। পার্পল কালারের একটা ড্রেস। ৯/৯.৫ হাজার টাকা দাম ছিল। সে বলেছিল, শুনেন রহমতুল্লাহ, আমি জেনেশুনে আপনাকে বিয়ে করেছি। পয়সা ওয়ালা জামাই আর দামি গিফট চাইলে বা দরকার হলে আপনার সাথে রিলেশান করতাম না আর বিয়েও না। প্রসংগত তার শখ ছিল ড্রেস কেনা তাও একসাথে অনেকগুলা। ফিক্সড প্রাইস দোকানে গিয়ে যে কয়টা তার পছন্দ হয় তার সবগুলা কিনতো আর দোকানে বলে আসত তার বাবা টাকা দিবে।দোকানি পরিচিত ছিল।আমি বলতাম,আমার সাথে রিলেশান করলে এত এত কেনাকাটা করা যাবেনা! আমি বছরে ৩/৪ টা ড্রেস বড়জোর দিতে পারবো! সে তাতেই রাজি ছিল।
আড়ং থেকে কেনাকাটা সে নিজেও করতোনা, বলতো ওরা অনেক বেশি দাম নেয়। আমাদের মত চাকুরিজীবিদের জন্য আড়ং না। ওটা বিদেশি আর ঘুষখুরদের জন্য। আমার কেনা ড্রেসটা পরেরদিন চেইঞ্জ করে সে ওই টাকার মাঝে তার জন্য ড্রেস,আমার জন্য সিল্কের একটা পাঞ্জাবী আর এই জুতা জোড়া এনেছিল। আমি জুতা দেখে বলেছিলাম,এত্ত দামি জুতা? আমি কি এগুলা পরবো নাকি আলমারিতে তুলে রাখবো? সে আমার কথা শুনে আবারো হেসেছিল আর বলেছিল, আহারে কিপটা লোক! কিছুত শখ আহ্লাদ জীবনে পুরন করেন!
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের বেড়ে উঠা ছেলে। ব্রান্ড নিয়ে কখনো ভাবিনি বা ভাবার সুযোগ ছিলনা। কম টাকার মাঝে যুতসই জিনিস কেনার অভ্যাস আমার। তবে আব্বা সবসময়ে বলতেন, পুরুষের জুতা আর বেল্ট এই দুইটা জিনিস কখনো কমদামি কিনতে নেই! আমাদের স্কুল লাইফ কেটেছে কমদামি বাটা জুতা পায়ে দিয়ে।লাল রঙ এর খুবই পরিচিত জুতা কিন্তু কলেজে ভর্তি হবার পর আব্বা বলেছিলেন দামি ফিতাওয়ালা জুতা কিনতে। সেই থেকে কিছুটা দামি ননব্রান্ড ফিতার জুতা আর দামি একটা বেল্ট কেনার চেস্টা করতাম।
এই জুতা জোড়া পাঞ্জাবির সাথে পড়তাম। সে ঠিক করে দিত কিসের সাথে কি পরবো! মনে পড়ে ইন্ডিয়া যাবার সময়ে সে এই জুতাজোড়া সাথে নেয়,আমি যদিও মানা করেছিলাম। সে বলেছিল, আমরা ত রাজস্থান যাচ্ছি। সেখানে আপনি পাঞ্জাবি পরবেন আর সাথে এই জুতাজোড়া! মাঝে মাঝে জুতাটা কালি করে সু বক্সে রেখে দিতে গেলে সে হেসে বলতো, খুব সাবধান। আস্তে ধইরেন, চামড়া ছিড়া যাইবো, বেশি পায়ে দিলে ক্ষয় হইয়া যাইবো। আপনার দামি জুতা বলে কথা! যত্নে তুইলা রাইখেন,আহিয়ানের বিয়ার সময়ে পইরেন। বেয়াই বাড়ি যাইবেন, কমদামি জুতা পড়বেন নাকি? ইজ্জ্বত থাকবো? আমি আমার বউ বাচ্চার জন্য কখনো হিসেব করতাম না বা করিনা এখনো।তাদের সুখের জন্যই আমার সব শ্রম। কিন্তু নিজের জন্য পারিনা, অভ্যাস নাই সে জন্য! বউ বলতো আপনার সব কিপটামি নিজের জন্যে! কি লাভ হইবো কিপটামি করে? বাচবেন কয়দিন রহমতুল্লা, একটু মন খুলে বেচে নেন!!
বউ মারা যাবার পর আবার আমি বিয়ে করি গত নভেম্বর মাসে। বিয়ের সদাইপাতি মেঝ ভাই ভাবি আর বোনেরা করেছে। সবকিছু কিনে যখন জুতার কথা আমাকে জানালো ওদের বলেছিলাম, জুতা আমার আছে একজোড়া! দামি, অনেক দামি অনেক সুন্দর! বউ কিনে দিয়ে গেছে! দামি জুতা। কথাছিল ছেলের বিয়ের সময়ে পড়বো কিন্তু ভাগ্যের খেল! নিজের বিয়েতেই পড়তে হলো!
প্রয়াত বউয়ের পছন্দ করে কিনে দেয়া ব্রান্ডের দামি জুতা পরে বউয়ের রিপ্লেসমেন্ট নতুন বউ আনতে গিয়েছি! বিয়ের জন্য রওনা দিয়ে ছেলেকে পাশে বসিয়ে এই জুতার ছবিটা তুলেছি। ভাগ্যের খেল কি খেল!
বউ আচমকা আমাকে জিজ্ঞেস করতো যদি সে না থাকে আমি কি আবার বিয়ে করবো? আমার বুকে কি অন্য কেউ ঠাই নিবে? আমি চুপচাপ জিজ্ঞেস করতাম, যদি আমি মরে যাই তুমি কি করবে? সে পাগলের মত কান্না করতো! মারা যাবার আগে প্রেগনেন্সি নিয়ে যে কয়টা দিন সে অসুস্থ ছিল, হাসপাতালে আর বাসায় দৌড়ানোর দিনে সে আমাকে বলতো, যদি তার কিছু হয়ে যায়,আমি যেন দেখেশুনে আহিয়ানের জন্য আরেকটা মা নিয়ে আসি।ছেলে যেনো কোনভাবেই মায়ের অভাব না পায়! কেউ যেন আমাদের ছেলেকে করুনা না করে, ছেলেকে যেন কারো করুনা নিয়ে বাচতে না হয়!
সব কথার শেষে আমাকে শুধু একটা প্রশ্ন করতো, আপনি আবার বিয়ে করেন আর না করেন, সেটা আপনার ব্যাপার।আমার শুধু একটা প্রশ্নের শুধু উত্তর দেন,
আমাকে কি ভুলে যাবেন রহমতুল্লাহ?
এখন আমি শুধু হিসেব করে যাই,
আমি কি ভুলে যাবো তাকে?
শুভ বার্ষিকী বউ(প্রয়াত)।
৫.বাস্তব জীবনের শিক্ষণীয় গল্প
মৃত জীবন
———
আবিরকে আমি ভিডিওতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। আমার চোখে মুখে প্রেম খেলা করে যাচ্ছিলো। সে প্রেমে কোন উত্তাপ ছিল না, উচ্ছ্বাস ছিল না। ঠিক যেন শেষ বিকালের আবির রাঙা প্রেম। খুব ইচ্ছা করছিল, ওকে ছুঁয়ে থাকি। কি হয় ছুঁয়ে থাকলে? কিন্তু মনকে বোঝাচ্ছিলাম, ওকে ছুঁয়ে থাকার অধিকার আমি হারিয়েছি।
আবিরকে আমি ছেড়ে এসেছি এক বছর আগে। শুধু আবিরকে নয়। আমার ছেলে আনানকেও ছেড়ে এসেছি। আনানের বয়স তখন ছয় বছর। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। একঘেয়েমি জীবন আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছিলো। বিয়ের পর থেকেই সংসারের সব দায় দায়িত্ব আমার ছিল। আবির সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল তার ক্যারিয়ার নিয়ে। আমাদের কে ছেড়ে ছুড়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর পড়া পড়তো। পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে ব্যস্ত ছিল প্রাকটিস নিয়ে। আমাদেরকে সময় দেওয়ার সময় কোথায় ? একবারও ভাবতো না, ডাক্তারী পাশ করে আমি সম্পূর্ণ বেকার হয়ে বাসায় বসে আছি। না বি সি এস করার জন্য একটু পড়ার সুযোগ পাই, না কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মত সুযোগ আছে। ছেলেকে কে দেখবে ? সংসার কে দেখবে ? আমার মা বাবা বেঁচে ছিলেন না। তাই আমাকে সাপোর্ট করারও কেউ ছিল না। তেমন ভালো কাজের লোকও পাইনি, যার উপর চোখ বন্ধ করে বাচ্চাকে ফেলে রাখা যায়। ক্যারিয়ার নিয়েও এত বেশি হতাশা ছিল না। বেশি হতাশা ছিল, আবির আমাকে সময় দেয় না, তাই। আমার বাবাকে দেখেছি, কতটা রোমান্টিক ছিল। সব বিবাহ বার্ষিকীতে আম্মুর জন্য ফুল নিয়ে আসতো, গিফট নিয়ে আসতো। অথচ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী কবে, আবিরের মনেও থাকে না। বাচ্চা হওয়ার পরে ওর ভিতরে কোনদিন বাচ্চা নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস দেখিনি। আমার বাবা আমার জন্য কত কিছু করতো। গল্প নাটকেও তো দেখেছি, বাবারা বাচ্চার ব্যাপারে কত কেয়ারিং হয়। অথচ আবিরকে দেখে মনে হয়, বাচ্চার ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথাই নেই। বাচ্চাকে কখনোই পাঁচ মিনিট সময় দেয় না।
আমার খুব মন খারাপ থাকতো সব সময়। ওকে বলতাম, ” আমাদেরকে একটু সময় দাও। ” ও বিরক্ত হয়ে বলতো, ” আমার সময় কোথায়? ” সংসার জীবনটা অর্থহীন লাগতো। নিরানন্দ জীবনটাকে বোঝা মনে হতো। সাইকিয়াট্রিস্টও দেখিয়েছি অনেকবার। কোন লাভ হয়নি। বরং আমার ভিতরে সুইসাইডাল টেন্ডেসি এসেছিল।
সে বার আমাদের বাসায় আমার শ্বশুর শাশুড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। প্রতিবারই ওনারা আসলে আবিরের সাথে আমার একটু ঝগড়া হতো। আমি যতই মন প্রাণ দিয়ে তাদের সেবা যত্ন করার চেষ্টা করি না কেন, আবিরের মনে হতো, ঠিক তার মন মতো সেবা যত্ন হচ্ছে না। আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও আবিরের মন পাওয়া যেত না। আবির আমাকে দিয়ে বাবা মায়ের সেবা করিয়ে বেহেস্ত হাসিল করতে চাইতো। এই নিয়েই মাঝে মাঝেই আমার সাথে বেঁধে যেত। সে বার মুখ ফুটে বলেছিলাম, ” আমি যতই করি, তোমার মন ওঠে না। এতই যদি বেহেস্ত পেতে চাও, তাহলে বাবা মায়ের সেবা যত্ন নিজে করো। ” আবির ভীষণ ক্ষেপে যেয়ে আমাকে একটা চড় মেরেছিল।
আমি ঐ মুহুর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই জীবন আর রাখবো না। রেল স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্লাটফর্ম টা একটু নিরিবিলি হলেই কোন ট্রেন দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বো। হঠাৎ আমার পাশে এসে এক মহিলা বসলেন। বললেন,
– আমি আগের ট্রেনটা পাঁচ মিনিটের জন্য মিস করেছি। অনেকক্ষণ থেকেই তোমাকে ফলো করছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি খুব বিপদের মধ্যে আছো। সমস্যাটা কি আমার সাথে বলা যায়?
– আমার কোন সমস্যা নেই।
– দেখো, আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম। মানুষের মন কিছুটা বুঝতে পারি। তুমি নিঃসংকোচে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। অনেক সময় দুঃখ কষ্ট গুলো শেয়ার করলে মনটা হালকা হয়। তখন ঠান্ডা মাথায় সব কাজ করা যায়।
মহিলাটার ভিতরে কেমন জানি একটা সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। খুব আপন আপন একটা ভাব ছিল। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে, এত আপন করে কেউ আমার সাথে কথা বলেনি। আমি একে একে আমার সব দুঃখ কষ্টগুলো তার সাথে শেয়ার করলাম। এমনকি আজ আত্মহত্যা করতে এসেছি, সেটাও বললাম। তিনি বললেন,
এক সময় আমিও তোমার মত ভুল করেছিলাম। আমার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে, আমি আমার স্বামীকে খুব মিস করতাম, এখন ও করি।
– আমি তো মারাই যাবো। মিস করার সুযোগ নেই।
– তুমি চলে গেলে তোমার বাচ্চার কি হবে?
আমি জেদের সাথে বললাম,
– সে আমি জানি না। আমি এ জীবন আর রাখবো না।
তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– আচ্ছা এক কাজ করা যাক। ধরে নাও, তোমার এ জীবনের মৃত্যু হয়েছে। ধরে নাও, এই মুহূর্ত থেকে তোমার নতুন এক জীবন শুরু হলো। তুমি বলেছিলে, তুমি ডাক্তার। আমার নিজস্ব একটা এনজিও আছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করি। কাউকে বাসস্থান দিয়ে, কাউকে খাওয়া দিয়ে, কাউকে চাকরি দিয়ে বিপদগ্রস্ত মেয়েদের সাহায্য করে আমার এনজিও। আমার প্রতিষ্ঠানে একজন ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। তুমি ইচ্ছা করলে সেখানে চাকরি নিতে পারো। আমি বাড়িতে একাই থাকি, ইচ্ছা করলেই আমার সাথে থাকতে পারবে।
আমার কি হলো জানি না। তার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। সে তার সাথে আমার টিকিট ও কাটলো। আমি চলে এলাম তার সাথে সিলেটে। প্রথম প্রথম আনানের জন্য ভীষণ কষ্ট হতো। আস্তে আস্তে এনজিও এর কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা শুরু করলাম। নীলা আপু জোর করলেও বেতন নিতাম না। সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের সেবা করে এক ধরনের তৃপ্তি পেতাম। ওরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। নীলা আপু ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।
আজ বিকালে আমি আর নীলা আপু চা খাচ্ছিলাম। নীলা আপু বললেন,
– দেখো মৌ, কি সুন্দর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মা হীন একটা বাচ্চাকে এই ভদ্রলোক কি সুন্দর করে মানুষ করছেন।
উনি ওনার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। হঠাৎ মোবাইলে আবির আর আনানকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। ভিডিও তে দেখি –
আবির সকাল বেলা চুমু খেয়ে আনানের ঘুম ভাঙাচ্ছে। ছেলেকে ব্রাশ করিয়ে নাস্তা খাওয়াচ্ছে। যত্ন করে স্কুল ব্যাগটা গোছাচ্ছে, টিফিন ভরে দিচ্ছে। এর পর ছেলেকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ছেলেকে গোসল করিয়ে খাওয়া দাওয়া করালো। ঘুম পাড়ালো। বিকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলে কে গুছিয়ে নিয়ে গেল চেম্বারে। চেম্বারের সাথেই খেলনা দিয়ে সাজানো একটা কাঁচের ঘর। আনান সেখানে বসে পড়ছে। আবির মাঝে মাঝেই এসে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবার যেয়ে রোগী দেখছে। চেম্বার শেষ করে বাসায় এসে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। বিছানায় যেয়ে আবির সাইড টেবিলে রাখা আমার ছবিটা নিয়ে নিজে একটা চুমু খেলো তারপর আনানের হাতে দিলো। আনান ছবিটা নিয়ে একটা চুমু খেলো তারপর ছবিটা বুকে জড়িয়ে রেখে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
আমি কাঁদছি। আমি হাওমাও করে কাঁদছি। নীলা আপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন। মানুষ এতটা বদলায় ? কিভাবে? আমার মৃত জীবনে হঠাৎ করে প্রানের সঞ্চার হলো। আমার খুব ইচ্ছা করছে, আমার স্বর্গে ফিরে যাই। ঐ স্বর্গে আমার কি একটু জায়গা হবে ?
৬.আমার জীবনের কষ্টের গল্প
আজ আমার মা কে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে। খবরটা শুনে আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না! পারব কী করে এ তো সুস্থ হওয়ায় ছাড়া নয় পরাজিত হয়ে ছাড়া!
ডাক্তার আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন, “রায়হান সাহেব কথাটা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে! আমরা অত্যন্ত দুঃখিত! চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত উন্নতি হওয়ার পরও আজ আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
“যদি মাকে বিদেশে কোথাও নিয়ে যাই?”
“সে আপনি নিতে পারেন কিন্তু কিছু হবে না। শুধু শুধু বিদেশের মাটিতে দৌড়াদৌড়ি করবেন। কোনো আশা থাকলে আমি বলতাম!”
কথাটা বলতে বুকের মাঝে কেমন বেধে যাচ্ছিল। “কতদিন টিকবে মা?”
“দেখুন নিশ্চিত করে তো বলা যায় না। আমাদের ধারনা ত্রিশদিনের বেশি টিকবে না। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন।”
আমি কিছুই বললাম না। শুধু অসহায় হয়ে ডাক্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে হু হু করে কান্না পাচ্ছিল।
“আপনার অবস্থা আমি বুঝি রায়হান সাহেব। এক কাজ করুন মাকে নিয়ে যান যা খেতে চায় খাওয়ান, আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করান। শেষ সময়টা আনন্দে কাটুক।”
আমার কাঁধে আলত করে চাপ দিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।
আমি মায়ের কাছে এসে বললাম,” মা চলো আমরা বাড়ি যাই।”
মা বললেন,” আমি সুস্থ হয়ে গেছি নারে?”
আমি মায়ের দিকে তাকতে পারছি না। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “হ্যা মা।”
“আমি তো বলেছিলাম আমার কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে একটু ব্যথা করে, দুইটা ব্যথার ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। তুই জোর করে এখানে ফেলে রাখলি। এরা কী সব যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘাটাঘাটি করল।”
আমি খুব কষ্টে মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছি। মনে হয় ঠিক মতো পারছি না। বারবার হাসি হারিয়ে যায়!
মায়ের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিল একজন নার্স। নার্স কে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল,” যাই রে মা ভালো থেকো। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসো কেমন। আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছি।”
নার্সটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিল।
মাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম। মা কে জিজ্ঞেস করলাম,” আজই বাড়ি যাবে না কি ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখবা? তুমি তো ঢাকায় আসতেই চাওনা! আবার কবে আসবা ঠিক নেই।”
“হ্যাঁ, চল আজ বরং ঢাকা শহরটাই ঘুরে দেখি।”
” কোথায় যাবা মা? “
“তোর মনে আছে খোকন একবার তুই টিভিতে শিশু পার্ক দেখে, শিশু পার্কে যাওয়ার জন্য কী কান্নাকাটি করেছিলি! তোকে তো তখন নিতে পারিনি! চল আজ যাই।”
মা কে নিয়ে শিশুপার্কে এসেছি, রাইডগুলোতে বড়োদের চলা যায় না। অনুরোধ করে ট্রেনে চড়লাম। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসেছি। আমার শুধু কান্না পাচ্ছে! মায়ের সামনে কাঁদতে পারছি না।
আমার মার এমনই ভাগ্য যখন স্বামী সন্তান নিয়ে কাটানোর কথা, আমাদের দুই ভাই-বোন কে মায়ের কাছে ফেলে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মা আমাদের নিয়ে সংগ্রাম করলেন। ছেলে বড়ো হয়েছে এখন একটু আরাম আয়েশ করবে এমন রোগ মাকে আঁকড়ে ধরল যা এ দুনিয়ায় দুই পারসেন্ট মানুষের হয়!
মা কে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। বাড়ির সবাই মায়ের খবর জানে শুধু মা জানে না! মা কে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসল বড়ো আপু। বড়ো আপুর হাসিতে কোনো প্রান নেই! দেখেই বুঝা যায় কত কষ্ট করে কান্না চাপিয়ে রাখছে!
মা বড়ো আপু কে দেখে বলল, “কী রে লুনা তুই চলে
এসেছিস?”
“মা তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছ এমন খুশির দিনে আমি আসব না তাকি হয় বলো।” বড়ো আপু অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল!
“ভালোই করেছিস।”
বড়ো আপু মা কে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। গ্রামের এ বাড়িটা করতে চাচ্ছিলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল মা কে নিয়ে শহরেই থাকব। কিন্তু মা কিছুতেই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হলো না। কি আর করার? মা এখানেই রয়ে গেল। শহরে গেলেও দুইয়েকদিন থেকেই হাঁপিয়ে উঠত।
বড়ো মামা এলেন সন্ধ্যায় এক গাদা বাজার নিয়ে। মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন! মা বলছে, “কি রে অমন করে কাঁদছিস কেন? আমি তো এখন সুস্থ। “
মামা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “খুশিতে কাঁদছি রে বুবু।”
“তুই এত সব বাজার এনেছিস ক্যান?”
“কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না বুবু। তোমার হাতে পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল তাই। “
মা রাতের বেলা বড়ো আপার সাথে পিঠা বানাতে শুরু করলেন। সেই পিঠা আর বানানো শেষ হলো না।কিছুক্ষণ পরে ব্যথায় কেমন করতে লাগলেন। মা ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
দিনগুলো মনে হয় ঘড়ার গতিতে দৌড়াচ্ছে! কেমন করে নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। একটা করে দিন যায় আর বুকের মধ্যে কেমন শুন্য শুন্য লাগে! কয়েকদিন পর মা আমায় ডেকে বললেন, “তুই অফিসে যাস না কেন?”
“মা আমার ছুটি।”
“কীসের ছুটি নিয়েছিস? “
“অনেকগুলো ছুটি জমে গেছে মা, এখন ছুটি না কাটালে আর কাটাতে পারব না! “
দিন যেতে লাগল রোগটা মা কে একটু একটু করে কাবু করতে লাগল! চোখের সমানে মাকে ক্ষয়ে যেতে দেখছি কিছুই করতে পারছি না! আমার মতো এত অসহায় সন্তান পৃথিবীতে নাই!
বড়ো আপা মাঝে মাঝে কেঁদে উঠে মায়ের সামনে গেলে জোর করে হাসার চেষ্টা করে! মা জিজ্ঞেস করলে বলে, “বাবার কথা মনে পড়ছে মা!”
বড়ো মামা একেকদিন একেকটা জিনিস নিয়ে এসে বলে,”আপা আজ তোমাকে নিয়ে এটা খেতে ইচ্ছে হলো।”
দিন যাচ্ছে আর মা কেমন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে! আমাদের আশা কেমন ফুরিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমার মন বলে হুট করে মা ভালো হয়ে যাবে। উঠে বলবে দ্যাখ আমি সুস্থই আছি তোর ও সব ডাক্তার -ফাক্তার সব ভুয়া।
মায়ের হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা উঠল। মায়ের সারা শরীর কেমন নীল হয়ে গেছে। মা সবাই কে কাছে ডাকলেন। বড়ো আপা আসছে মা সে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি পাশে বসে আছি। আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমার মা আর থাকবে না! এটাই বোধহয় মায়ের শেষ কথা! বড়ো মামা কেঁদে কেঁদে বলছে, “কী হয়েছে বুবু?”
মায়ের কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে! জোর করে শ্বাস নিচ্ছে! খুব কষ্ট করে মা আমার মাথায় হাত রেখে বলল, “আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার কী যে ভালো লাগছে! আমার আপন মানুষগুলো আমায় এত ভালোবাসে! আমাকে মরতে দিতে চায় না। বাবারে মানুষ তো চিরদিন বাঁচে না!”
মা আর কথা বলতে পারল না। কেমন ছটফট করতে লাগল! চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। একটা সময় আমার মা ঘুমিয়ে পড়ল! সেই ঘুম আর ভাঙ্গল না!
অফিস থেকে ত্রিশদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। পনেরো দিনের ছুটি রয়েই গেল! আমার মা এমনই সবার থেকে আলাদা !
মা।
Nabil Mahmud