মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প
কোনদিনও বলতে আমার বাঁধেনা, আমি একজন রাজাকার পরিবারের সন্তান।
আমার দাদা ছিলেন পাকিস্তান সরকারের একজন খুবই বিশ্বস্ত দালাল। এবং আমার আব্বা কিন্তু বর্তমান যুগেরই একজন রাজাকার।
এই ভয়াবহ সত্য ঘটনা আমি জানতে পারি অনেক অনেক বছর পর এক অমাবস্যার রাতে। তখন আমার বয়স ছিল ষোল। দ্বিতীয়বারের মত আমার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার রাতে দাদিজান এই ভয়ংকর কলঙ্কিত অতীত বলেছিলেন আমাকে।
আমার বাবা শহরের একজন ধনী ব্যবসায়ী। তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে অসম্ভব রকমের মান্য করেন বাবা। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি দাদাজান খুবই কড়া একজন মানুষ। উনি যা বলেন, যেভাবে বলেন সেই ভাবেই সবাইকে চলতে হতো। এখনো উনার গলার তেজ বৃদ্ধ সিংহের মতই হিংস্র মায়াহীন শোনায়।
দাদাজান যদিও খুব বৃদ্ধ ছিলেন এবং উনার সেবাযত্নের জন্য সবসময়ই দুইজন মানুষের দরকার হতো তবুও দাদিজান উনাকে কোন ধরনের সাহায্য করতেন না। কোন এক অদ্ভুত কারণে দাদিজান দাদাজানকে সহ্য করতে পারতেন না। আমি সেই ছোট্টবেলা থেকেই দাদিজানের চোখে দাদাজানের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে ঘৃণা দেখতে পেতাম।
আমি দাদিজানের কাছেই বড় হই। বুদ্ধি হবার পর থেকেই আমি দাদিজানের সাথে ঘুমাতাম। দাদিই আমাকে গোসল করাতেন, খাওয়াতেন। এমনকি প্রতিদিন বিকেলে মকবুল স্যারের কাছে যখন আমি পড়তে বসতাম, তখন দাদিজান পর্দার ওপাশে একটা টুল নিয়ে দেড়ঘণ্টা ঠায় বসে থাকতেন।
আমার শান্ত লক্ষ্মী গৃহবঁধু আম্মা আমার ছোট দুইভাই আর আমাদের যৌথ পরিবারের সাংসারিক কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতেন। তাছাড়া দাদিজান কোন এক রহস্যজনক কারণে শুধু আমাকেই ভালবাসতেন, উনার সব গল্প মন খুলে শুধু আমার সাথেই করতেন।
দাদিজান প্রতিরাতে ঘুমানোর সময়ে আমাকে একটা করে ভয়ংকর গল্প শোনাতেন। আমি রাগ, ঘৃণা, আতঙ্ক আর একবুক ক্রোধ নিয়ে দাদিজানের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেসব গল্প শুনতাম। একজন নিপাট ভদ্রলোকের নিজদেশের সাথে বেইমানি করার, হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলানোর, নিজ গ্রামের অসংখ্য যুবতীদের হানাদারের হাতে তুলে দেবার ঘৃণ্য সব গল্প শুনতাম আর বাঙ্গালি হয়ে বাঙ্গালির সাথে কিভাবে বেইমানি করতে পারে ভেবে ভেবে অবাক হতাম!
আমি মাঝে মাঝে প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে খসখস করে রুলটানা পৃষ্ঠায় কলম চালিয়ে সেসব নির্মম নিষ্ঠুরতা লিখে ফেলতাম। আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নয়মাস ধরে চলতে থাকা অজানা সব নির্মমতার গল্প, শহীদদের গল্প, মুক্তিবাহিনীর গল্প, বীরাঙ্গনাদের গল্প লিখে রাখতাম আমার রুল টানা খাতার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।
আমাদের পরিবারটা ছিল খুব কনজারভেটিভ টাইপ। একদম কঠিন রক্ষণশীল যাকে বলা হয়।
দশবছর বয়স থেকেই আমি বোরখা পরতে শুরু করি। আমি দাদিজানের সাথে থাকতাম তাই উনার সাথে সাথে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, রোজাও রাখতাম খুব আগ্রহ নিয়ে। সেই দশবছর বয়স থেকেই খুব শ্রদ্ধা এবং আগ্রহ নিয়ে দাদিজানের সাথে সাথে সব সুরা, দোয়া কালাম, নামাজ শেখা হয়ে যায় আমার। দাদিজান আরবি বইগুলো গরগর করে পড়ে ফেলতেন কিন্তু বাংলা এক বর্ণও পড়তে বা লিখতে জানতেন না। আমি যখন অক্ষর শিখতে শুরু করি, দাদিজানের পাশে বসে দুলে দুলে বর্ণমালা পড়তাম দাদিজানও আমার সাথে সাথে পড়তেন। আমি যখন বাড়িতে পড়াতে আসা মকবুল স্যারের কাছে পড়তে বসতাম, দাদিজান ও দরজার ওপাশে একটা টুলে বসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার পড়া শুনতেন আর আত্বস্থ করতেন। আমি স্কুলের বইগুলো থেকে গল্পকবিতা বা ইতিহাস পড়ে শুনাতাম তখন লক্ষ্য করতাম দাদিজান কি অদ্ভুত চকচকে চোখের আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন!
যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম, দাদাজান ঠিক করলেন আমাকে মাদ্রাসাতে পড়াবেন। দাদাজানের কথার উপরে কারো কথা বলার সাহস ছিলনা ঘরে। আমি এলাকায় দাদাজানের নিজ অর্থে গড়া মহিলা মাদ্রাসাতে পড়তে শুরু করি। পাশাপাশি ছোট ভাইদেরকে দিয়ে লুকিয়ে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তাম। লুকিয়েই পড়তে হতো কারণ দাদাজান আর বাবা পছন্দ করতেন না গল্প উপন্যাস বা কবিতার বই পড়া। উনাদের ধারনা, এসবে ধর্মের কথা থাকেনা। মানুষের মনকে বিভ্রান্ত করে দেয় এসব বই! তবুও বইয়ের নেশা আমাকে ভাল মতোই পেয়ে বসেছে ততদিনে। আমি বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস, উপন্যাস , কবিতার বই এনে পড়তাম আর দাদিকে শোনাতাম। প্রতিরাতে নামাজ শেষ করে ঘুমানোর আগে দাদিজানকে কোন একটা বই থেকে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে শোনানো ছিল আমার নিত্য রুটিন। কোন কোন সময় আম্মাকে দেখতাম নিঃশব্দে আমাদের রুমে এসে বসে বসে শুনতেন।
তখন আমি মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রী, কয়দিন পরেই আমার দাখিল পরীক্ষা। পড়াশুনা বাদ দিয়ে দিনরাত গল্প উপন্যাস আর কবিতার বই পড়ছি। ছটফট করতে করতে লুকিয়ে লুকিয়ে বুকের ভিতরে জন্ম নেয়া গল্পগুলো লিখছি। খুব খুব ইচ্ছে করতো, যদি কাউকে দেখাতে পারতাম! একটু একটু করে লোভ জমতে থাকে বুকের ভিতর! কাগজে ছাপানো আমার কবিতা, গল্প দেখতে ইচ্ছে করে আমার!
তখন আমার ছোটবেলার গৃহশিক্ষক মকবুল স্যার আমার ছোট দুইভাইকে পড়াতে আসেন বিকেলে। সাহস করে একদিন স্যারকে দেখাই গল্প আর কবিতাগুলো। পড়ার পর স্যার হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মিনিট। আমি ভীষণ লজ্জা পাই। আমি আমতা আমতা করে স্যারকে বলি আমার বুকের ভিতরে জন্ম নেয়া এক টুকরো লোভের কথা! কিন্তু স্যারকে অনুরোধ করি এই ব্যাপারটা যেন কেউ নাজানে।
স্যার আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, “এই সৃষ্টি লুকিয়ে রাখলে যে পাপ হবে মা!”
সেদিন মকবুল স্যারের এক লাইনের সেই কথাটি ছিল আমার জীবনের একটা বন্ধ জানালা খুলে দেবার আশ্বাসের মতোই! ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডস অফ মাই লাইফ!
আমার দাখিল পরীক্ষা তখন শেষ। দাদাজান আব্বাকে আদেশ দিলেন আমার বিয়ের জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করতে।
আব্বার কাছে প্রতিদিন ঘটকরা বিভিন্ন রকমের পাত্রের সন্ধান আনেন আমার জন্য। আমার বিয়ের আলোচনা চলতে থাকে অন্দরমহলের ভাতের টেবিলে, চা নাস্তার সাথে এবং দাদাজানের শোবার ঘরে। দাদাজানের ঘরে বসে আব্বা আর আম্মা যখন পাত্রের ছবি আর পরিবার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসত, দাদিজানকে দেখতাম আমাকে টেনে নিজের ঘরে এনে খিল লাগিয়ে দিতেন।
এক অলস বিকেলে, আমি একটা রুলটানা খাতার পৃষ্ঠায় একটা গল্প লেখায় চেস্টা করছি। আমার ছোটভাই দৌঁড়ে এসে আমাকে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা হাতে দেয়। আমি অবাক হাতে পত্রিকার পাতা উল্টে দেখি আমার লেখা একটা কবিতা! আমার পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা অজানা স্রোত বয়ে যায়, আমার হাত পা কাঁপতে থাকে, টপটপ করে আমার চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটা পড়তে থাকে কালো কালো ছাপানো অক্ষর গুলোর উপর, আমার চোখের সামনে কালো ছাপানো অক্ষরগুলো ঝাপ্সা হতে থাকে আর আমার ছোট্ট বুকের একদম গভীরের একটা অস্পষ্ট স্বপ্ন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে!
প্রতিসপ্তাহে সেই সাপ্তাহিক সংখ্যাটাতে ছদ্মনামে আমার গল্প বা কবিতা ছাপা হতো। আমি সারাসপ্তাহ অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম সেই দিনটির জন্য। পুরোনো পত্রিকার পাতা জড়িয়ে লুকিয়ে সেই প্রত্যাশিত সংখ্যা ছোটভাইয়ের হাতে আমার কাছে পৌঁছে দিতো মকবুল স্যার। রাতে একই জিনিস একশবার করে পড়ে পড়ে আমার মুগ্ধশ্রোতা দাদিজান আর আম্মাকে শোনাতে হতো।
একদিন পত্রিকার একটা সংখ্যা দাদাজানের হাতে পড়ে। দাদাজান আমার ছদ্মনামের সেই গল্প পড়ে অবাক হন। এসব গোপন কথা কিভাবে পত্রিকায় গেছে সেসব পড়ে তাজ্জব বনে যান। আব্বাজানকে বলেন পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিতে।
আব্বাজান এলাকার প্রভাবশালী একজন মানুষ। দ্রুত পত্রিকার মালিককে ধরে আনা হয়। মকবুল স্যারের কথা জানাজানি হয়ে যায়। আমার কথা জেনে যান দাদাজান এবং আব্বাজান। আমাকে জিজ্ঞেস করেন উনারা আমি এসব কিভাবে লিখেছি! আমি ভয় পেয়ে বলে ফেলি দাদিজান গল্প করতেন ঘুমানোর সময়। দাদাজান সেদিন দাদিজানের সাথে কোন কথা বলেন না কিন্তু আমাকে স্পষ্ট করে নির্দেশ দেন এসব হাবিজাবি লেখা না লিখতে! আমি ঠিক বুঝতে পারিনা এসব গল্প লিখতে আমাকে কেন বারণ করা হয়!
আব্বাজান আমার বিয়ের তোরজোড় শুরু করেন।
একদিন বিকেলে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। আমাকে তাদের খুব পছন্দ হয়, আমাকে আংটি পরিয়ে দিয়ে যান পাত্রের মা। তারপর দুইদিন পর বাবা গম্ভীর মুখে জানান কোন এক অজানা গুজবে আমাকে তারা বউ করতে রাজি না!
ততদিনে আমার দাখিল পরীক্ষার রেজাল্ট আসে। আমি মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে দাখিল পাশ করি। আমার চেয়েও বেশি খুশি হন আমার দুই নীরব মুগ্ধ শ্রোতা ভক্ত! আমার দাদিজান এবং আম্মা। দাদাজান সেদিন খুশি না হয়ে গম্ভীর কন্ঠে আব্বাজানকে ধমক দেন। আমার বিয়ের ব্যাপারে কেন অবহেলা করছে আব্বা!
সপ্তাহ কয়েক পর আমাকে আবারো পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। এবার আংটি পরিয়েই ওরা বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলে। দাদাজান অবশ্য সেভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন আম্মা আব্বাকে।
আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। বেশ আয়োজন শুরু করে আব্বা। আত্মিয়স্বজন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। বিয়ের আনুসাংগিক বিষয় নিয়ে দাদাজানের শোবারঘরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করে আব্বা আর আম্মা।
ঠিক সেই সময়টাতে দাদিজান নিজের শোবারঘরের বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্ত মনে পান চিবুতে চিবুতে আমার মাথায় বিলি কাটে আর কবিতা শোনাতে বলে। আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছিলো।
আমি বন্দিজীবন থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করছিলাম। আমার মনেহতে থাকে, বিয়ে করে আমি আরেক গুহাতে বন্দি হতে যাচ্ছি!
দাদিজান আমার মনের কথা বুঝতে পারেন। আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাদিজান রহস্যময় হাসি হাসেন আর বলেন “তুই কোন চিন্তা করিসনা ময়না। এই হানাদারদের বেইল শেষ!”
আমি দাদির কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতামনা।
আমার বিয়ের ঠিক দুইদিন আগে এক সন্ধ্যায় দাদিজান বোরখা পরে কাউকে কিছু না বলে কোথাও যান। পরে জানতে পারি দাদিজান সেই পাত্রের বাড়িতে গিয়ে আমার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসেন।
আরো ভয়ংকর কথা হচ্ছে, সেই বাড়ি থেকেই আব্বাকে খবর দেয়া হয় দাদিজান গিয়ে বলেছেন, আমার দাদাজান একজন খুনি রাজাকার! আমার আব্বা একজন অসাধু ব্যবসায়ী! গোপনে মাদকের ব্যবসা করে! প্রশাসনকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে আব্বা মাদকের ব্যবসা করে দেশের তরুণ সমাজকে ধংস করে দিচ্ছে!
সেদিন আব্বা আর দাদাজান দাদিজানকে পাগল ঘোষণা করেন। দাদিজানকে উনার রুমে বেঁধে রাখা হয়। আমি মানিনা, আম্মা মানেনা দাদিজান পাগল! আম্মার প্রতিবাদ করার সাহস নাই। তবে আমি প্রতিবাদ করি। আমি কান্না করি। দাদাজানের পায়ে ধরে দাদিজানের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাই। আব্বাকে বলি, দাদিজান পাগল না। কেউ আমার কথায় বিশ্বাস করেনা।
সেই দুঃসহ দিনগুলোর একরাতে দাদিজান আমার হাতের মুঠোয় একটা ঠিকানা ধরিয়ে দেন। অনেক পুরোনো, প্রায় ছিন্নভিন্ন একটা কাগজে লেখা একটা নাম আর ঠিকানা । দাদিজান আমাকে পালাতে বলেন। আমার হাতে কিছু টাকা আর উনার গলার সোনার চেইনটা খুলে দিয়ে আমাকে পালাতে বলেন। মুক্ত বাতাসে বাঁচার জন্য পালাতে বলেন। একদল রাজাকারের গুহা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে অনুরোধ করেন।
কিন্তু আমি স্বার্থপর হতে পারিনা। আমি নিজেকে নিয়েই শুধু ভাবতে পারিনা। আমার আম্মা, দাদিজান, ঘরের সবার মায়া ছাড়তে পারিনা। আম্মা আমাকে বলেন, নিজে মানুষ হলেই শুধু এই শৃঙ্খল থেকে সবাইকে মুক্ত করা সম্ভব। নইলে এই পঁচা দুর্গন্ধময় গুহায় পঁচে মরতে হবে!
আমি বুকে পাথর বেঁধে, আম্মা আর দাদিজানের স্বপ্ন বুকে নিয়ে, মুক্তির আশায় একদিন সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসি।
দাদিজানের দেয়া সেই ঠিকানায় এসে পাই একজন অসাধারণ সুন্দর মানুষের সন্ধান! সাদা শাড়ি পরা এক দেবীর মতো দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর একজন মানুষ!
প্রতিমা দিদি! প্রতিমা দিদিকে দেখে আমি অবাক হতে হতে মুগ্ধ হই! উনার সিঁথিতে সিঁদুর কিন্তু গায়ের সাদা শাড়ি আমাকে অবাক করে! আমি প্রশ্ন করতে সাহস পাইনা সেই প্রতিমার মতন দেখতে মানুষটাকে। আমার অবাক চোখের প্রশ্ন দিদি ঠিকই পড়ে ফেলেন।
প্রতিমা দিদি আমাকে সেদিন জানান উনার প্রেমিক পুরুষটি বিদায় বেলায় উনাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি যদি না’ই ফিরি আর তাহলে স্বাধীনদেশে তুমি একজন শহীদের স্ত্রীর সন্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে!”
তারপর উনি আর বাঁধা দেবার সাহস পাননি।
প্রতিমা দিদি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, “কত লক্ষ মানুষ দেশের স্বার্থে প্রাণ দিল, জান দিল, ইজ্জত দিল! আমিও তাই দেশকে ভালবেসে জীবনের সব রঙ উৎসর্গ করে সাদা থান বেছে নিলাম। আমারো কি সাধ হয়না আত্মত্যাগ করতে! দেশের জন্য আত্মত্যাগে যে কি সুখ, কি তৃপ্তি সেটা সবাই বুঝেনা!”
আমি মনে মনে তৃপ্তির সাথে উচ্চারণ করি, আমিও তো নিজের স্বাধীনতার জন্য, রাজাকারের কবল থেকে মুক্তির জন্য নিজের মায়া মমতা ত্যাগ করলাম! নিজে মুক্ত হয়ে, একজন স্বাধীন মানুষের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তারপর আমার দাদিজান আর আম্মাকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করলাম! আমিও যে যুদ্ধে নামলাম! স্বাধীনতার যুদ্ধে!
আমি এখন প্রতিমা দিদির কলেজে পড়ছি। উনার কলেজের হোস্টেলেই থাকি। প্রতিমাদিদি আমার দাদিজানের ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়ে। পাশাপাশি পাড়াতেই থাকতেন। ইদ পুঁজোর আনন্দ, সেমাই প্রসাদ ভাগাভাগি করতেন। ধর্ম স্বার্থ নিয়ে সংঘাত শুরু হবার সাথে ছিটকে দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আমার আলোর তৃষিত দাদিজান কিভাবে কিভাবে যেন দিদিমনির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন! এই অদ্ভুত ব্যাপারটি আমার মনকে ভীষণ নাড়া দেয়! সত্যি, মুক্তিকামী মানুষকে বন্দি রাখা এত সহজ নয়!
যুদ্ধের সময় প্রতিমা দিদিমনির পুরো পরিবার পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবার সময় উনি থেকে যান এদেশে। দিদিমনি উনার প্রেমিকের ফিরে আসার আশায় বাংলাদেশে থেকে যান। কিন্তু দিদির প্রেমিক আর ফিরে আসেননি। দিদি পরিবার থেকে পাওয়া বিশাল সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে মেয়েদের স্কুল, কলেজ আর হোস্টেল বানান। হাজার হাজার বন্দী মেয়েদের অন্তরে শিক্ষার আলো জ্বেলে মুক্তির পথ দেখান। আমার মত বন্দি কিছু মানুষকে মুক্ত করার জন্য আজো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন দিদি।
এও কিন্তু স্বাধীনতারই যুদ্ধ!
** স্বাধীনতার যুদ্ধ **
2.মুক্তিযুদ্ধের সেরা ছোট গল্প
– আমাদের একাত্তরের জননীর প্রয়ান দিবসে-
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।
-রমা চৌধুরী
রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। শিক্ষা জীবন শুরু করেন নিজ বিভাগেই। তারপর
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ১৯৬১ সালে। সম্ভবত তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর !
কর্ম জীবন শুরু করেন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে।
১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈত্রিক ভিটায়। সাথে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে।
১৯৭১ এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে উনার বাড়িতে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় রমা চৌধুরীর উপর। তিন শিশুপুত্র তখন ঘরে । নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন পুকুরের জলে।
প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গানপাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুঁড়িয়ে দেয় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা।
তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন।
রমা চৌধুরীর লেখা ‘একাত্তরের জননী ‘ গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে,
” আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি।সে বাড়ির দু’তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার।”
তারপরের আট মাস কাটে জঙ্গলে লুকিয়ে ।রাতের বেলা পুঁড়া ভিটেতে খড়-পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে। বর্ষা কিংবা শীত , কোন ঋতুতেই নিজেদের রক্ষা করার সম্বলটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই।
অনাহার -অর্ধাহারে সন্তানেরা নানান অসুখে ভুগতে থাকে। ১৫ ই ডিসেম্বর রাত। বিজয়ের পূর্ব দিন। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। ডাক্তার-ঔষুধ-পথ্য কিছুই নেই। চারদিন এভাবে থেকে ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। শোকে তিনি তখন অর্ধ পাগলিনী। ১৯৭২ এর ১৫ ই ফেব্রুয়ারীতে আরেক ছেলে টগরও একই অসুখে ভোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে উঠেন পুত্রদের শোকে। এই সন্তানদের জন্যই তিনি আত্মহনন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।সন্তানদের মৃত্যুর পর প্রথম সংসার ভেঙে গেলে দ্বিতীয় সংসার করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন।
এই দুঃখিনী জননী সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী দুই পুত্রকে না পুঁড়িয়ে কবর দেন।
পুত্রদের হারিয়ে তিনি একটানা চার বছর পায়ে জুতা পরেন নি। যে পুত্রদের তিনি মাটিতে শুইয়েছেন সেই মাটির উপর জুতা পায়ে হাঁটতে নারাজ ছিলেন তিনি। দীর্ঘ চার বছর এভাবে হাঁটার পর প্রতিবেশীদের অনুরোধে জুতা পায়ে তুলেন।তাও শারীরিক অসুস্থতায়। কিছুদিন জুতা পায়ে রাখলেও গত ষোল বছর ধরে তিনি খালি পায়েই হেঁটে চলেন সবখানে ।
রমা চৌধুরীকে চিনতে চান ?
প্রখর রোদ কিংবা বৃষ্টি- বাদল। চট্টগ্রামের অলি-গলিতে যে বৃদ্ধা কাঁধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে বই বিক্রি করছেন , তিনিই আমাদের মা রমা চৌধুরী।
এভাবেই তিনি এখন পরিচিত। নিজের লেখা বই বিক্রি করেই নিজের যাবতীয় খরচ বহন করেন । এ যাবতকালে ১৮ টি মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
ব্যক্তিত্ববোধের অনন্য এক উদাহরণ রমা চৌধুরী ! তিনি একজন বিস্ময় মহিলাও। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণেই। দুজন ভাগ করে নেন নিজেদের কষ্টকে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হলে তিনি বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ না করার কথা জানান। মূলত তিনি দুঃখের উপাখ্যান শোনাতেই দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে।
রমা চৌধুরীর সেই পুঁড়িয়ে দেয়া বাড়িতে ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেছেন নিজের প্রচেষ্টায়। বেঞ্জামিন পার্কারের বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়ছে-
” With great power comes great responsibility.”
স্বাধীন দেশে আমাদের একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী সেই মহৎ দায়িত্বের ভার একাই বহন করছেন!
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লাল-সবুজ পতাকা দিয়েছে, বিশ্বমানচিত্রে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছে ।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেড়েও নিয়েছে অনেক । সম্ভ্রম হারানো মায়েরা দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন হায়েনাদের নির্যাতনের দিনগুলোকে।এমন দুঃখগাঁথা উপাখ্যানেরই এক নাম রমা চৌধুরী।
এইসব বেদনার স্মৃতি , বিষাদময় , যন্ত্রণার ক্ষত বয়ে চলা বীরাঙ্গনা মায়েদের জন্য ভালোবাসা মিশ্রিত বিনম্র শ্রদ্ধা ….
5.৭১ এর গল্প
#গল্প
‘৭১ এর গল্প
( সাত পর্বের গল্প। এই পর্বে এক থেকে তিন )
এক.
মামাবাড়ি যেন মায়ের আঁচলের মতো সুরক্ষিত এক আশ্রয়। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। পিরোজপুর থেকে বড় জোর সাত-আট কিলোমিটার হবে। আব্বার পোস্টিং তখন বাগেরহাট শহরে। তাই আব্বা আমাদের সাথে আসতে পারলেন না। যদিও বাগেরহাটও পিরোজপুর থেকে খুব একটা দূরে নয়। মাত্র উনিশ কিলোমিটার। তাছাড়া সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ ছিল তখন।
পঁচিশে মার্চের দু-এক দিন পর, বলতে গেলে একদম খালি হাতেই তড়িঘড়ি করে আমরা আমাদের ভিটেমাটি ছাড়লাম। সাথে ছিলো শুধুমাত্র ক্যারামবোর্ড, রেডিও, আর কিছু কাপড়চোপড়। গ্রামে পৌঁছে দিয়ে ভাইয়ারা আবার পিরোজপুরে ফিরে গেলেন। তারা তখন দেশের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের জন্য লড়তে হবে। যেভাবেই হোক দেশকে স্বাধীন করতে হবে।
যখন মামা বাড়ি পৌছালাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এবারের অভ্যর্থনাটা ছিল খুবই শীতল। অন্যবারের মত নয়। কোনো গার্ড-অফ-অনার নাই, বাচ্চারা ছুটে গিয়ে ভেতর- বাড়িতে আমাদের আসার খবর পৌঁছে দিলো না। আমরা বিভ্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্থ কিছু মানুষ, খালপাড়ের সুপারিগাছ ঘেরা কর্দমাক্ত মেঠোপথ ধরে ভিতর বাড়িতে পৌঁছালাম। সেদিনের খালপাড় থেকে বাড়ি পর্যন্ত খুবই অল্প পথটুকু অনেক দীর্ঘ মনে হয়েছিল।
আমাদের আসাটা আত্মীয়স্বজনদের কাছে ছিলো একেবারেই অযাচিত। সবার চেহারায় ছিল চাপা আতঙ্ক। প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে বুঝলাম ভাইয়াদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তাদের আশঙ্কার কারণ। ভাইয়াদের উছিলায় যেকোনো সময়ই কঠিন বিপদ নেমে আসতে পারে সারা বাড়ির উপর।
বরাবরের মতো এবারও আম্মা ছোটমামার ঘরে উঠলেন। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে কোনো ঘর ছিল না । এবেলা বড়মামার ঘরে, আবার ওবেলা ছোট মামার ঘরে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতাম। যখন যে বাড়িতে ইচ্ছে সে বাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়তাম।
একদিকে যুদ্ধের প্রচণ্ড আতঙ্ক, অন্যদিকে আত্মীয়দের আচরণে আমাদের সবার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। নিজেদের অবাঞ্চিত মনে হতে লাগলো। অথচ আমাদের করার কিছু ছিল না।
কোনো খবর কানে শোনা আর নিজের চোখে দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপলব্ধি। যুদ্ধের কথা আমরা অনেক শুনেছি। শুনেছি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হয়েছে পঁয়ষট্টিতে। উল্লসিত হয়েছি যুদ্ধে জিতে যাওয়া মিথ্যা শোনা-কথায়। কিন্তু যুদ্ধকে কোনোদিন প্ৰত্যক্ষ করতে হবে তা কখনো মাথায় আসেনি। কখনো ভাবিনি একদল নরপশু আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে হত্যা করার জন্য। কখনো ভাবিনি কোন নিরীহ মানুষের অমানবিক নিষ্ঠুর পরিণতি নিজের চোখে দেখতে হবে।
আম্মার আপন দুই ভাই, চারজন চাচাত ভাই, সব মিলিয়ে ছয়টি ঘর, কাচারী ঘর, মসজিদ আর বিশাল উঠোন নিয়ে আমাদের মামাবাড়ি। “খা” বাড়ি নামে পরিচিত। দুর্গাপুরে আরো একটা “খা” বাড়ি ছিলো যে বাড়িকে আমাদের মামারা “ছোট খা-বাড়ি” বলতো। এখনো জানি না এই ছোট- বড়র মানে কী। আর কী কারণেই বা ছোট-বড় যোগ করা হয়।
কোনো পড়াশুনার বালাই নাই। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। অনেকগুলো মামাত ভাইবোন। তার সাথে আরো দুই মামাতো বোনের ছেলেমেয়েরা অন্য শহর থেকে গ্রামে চলে এসেছে। সারাদিন, খালপাড়, বন জঙ্গল, ধানক্ষেত চষে বেড়াতাম। কখনো ধান ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটা। আইলের সরু পথ ধরে কে কতদূর যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা । ভাটির টানে খালের পানি যখন অনেক নিচে নেমে যেত, তখন খালের ঢালুবেয়ে কাদায় স্লাইডে বানিয়ে সরসরি খেলতাম। আমি ভালোই সাঁতার জানতাম। জোয়ারের সময়ে খালের এপার থেকে ওপার যাওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না আমার জন্য।
সারাদিন হৈচৈ করে কেটে গেলেও, অব্যাক্ত কষ্টগুলো খচখচ করে বুকে বাঁধতো প্রতিনিয়ত। কষ্টগুলো আরো বেড়ে যেতো যখন দেখতাম আম্মা নামাজের পাটিতে বসে কাঁদছেন অথবা বিষণ্ণ হয়ে বসে আছেন কোথাও।
আমরা তখন অনেক ছোট। সব কথা আমাদের জানতে নেই। কৌতূহলী কান যতটুকু শুনতো, সেগুলো নিয়েই ছিল আমাদের যত জল্পনাকল্পনা আর ভাবনা। আমাদের কষ্টের প্রধান কারন ছিল আমাদের দুই ভাই।
শুনলাম আমরা পিরোজপুর ছাড়ার সাথে সাথে ভইয়ারা আমাদের বাড়িটাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প বানিয়েছিল। পিরোজপুরের যুবক, বৃদ্ধ অনেকেই তখন একে একে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হচ্ছিলো। যুদ্ধের সব কর্মকাণ্ড ছিল আমাদের বাড়ীটাকে ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের এই ধরনের কর্মকাণ্ড, শহরে পাকসেনা আসার প্রথম ধাক্কাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
সঠিক নেতৃত্বের অভাব, ষড়যন্ত্র,অস্ত্রাগার, ট্রেজারি লুট আর নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। তার মধ্যে খুন, লোভ, নানান কারণে সংগঠিত দলের মনোভাব হয়ে পরল অনেক দুর্বল। আর্মি আসার খবরে সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য সবাই যে যার মতো দল খুঁজে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সে যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য আমার এই লেখা নয়, লিখবোও না।
ভাইদের কর্মকান্ডের খবর প্রতিদিনই আম্মার কাছে আসতো। আর ঐসব খবরগুলোই ছিলো আম্মার কান্নার কারণ। সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তা, একজন মায়ের জন্য অনেক কষ্টকর। আর তা যদি হয় তাদের জীবনের প্রশ্ন তাহলে?
তখন যেকোনো শহরে ঢুকলেই পাক-আর্মিদের প্রথম টার্গেট থাকত হিন্দুদের বাড়ি। পিরোজপুরে এর ব্যতিক্রম ঘটলো। প্রথমেই আমাদের বাড়িটাতে আগুন লাগানো হলো, তারপর আশেপাশের হিন্দুদের বাড়ি। বাড়িটা পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত ওরা এলাকা ছাড়লোনা।
আম্মা তার আশা, আকাঙ্খা, তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্ন এভাবে ছাই হয়ে যেতে দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। সেদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আম্মা তার এসব গভীর দুঃখকে আর জয় করতে পারেননি কোনোদিন।
দুই.
সেদিন সকাল আটটার মত হবে, সারা বাড়িজুড়ে কীসের যেন এক শোরগোল শোনা গেলে। আম্মার চাপা কান্না স্পষ্ট শুনতে পেলাম। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ততক্ষনে অনেকেই বাড়ির উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে।
খালপাড় থেকে শোরগোলের শব্দ অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিলো। শুনলাম স্কুলের মাঠে কাদের কে যেন বেঁধে রাখা হয়েছে। আমরা কয়েকজন দৌড়ে খালপাড়ের দিকে ছুটলাম। স্কুলের মাঠ থেকে শোরগোলের শব্দ আরো জোরালো হতে লাগলো। অসম্ভব ভয় আর আতংক নিয়ে কীসের টানে যেন স্কুলের দিকে দৌড়তে লাগলাম। ভাইয়াদের কথা মনে পড়ছিলো বারবার ।
পথে সাকা ভাইকে দেখলাম স্কুলের দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির দিকে ছুটে আসছেন। আমাকে দেখে ধমক দিয়ে উঠলেন।
-যা বাড়ি যা……………. কি করিস এইহানে? তোগো জন্য আমাগো হক্কলডিরে এহন মরতে অইবে।
সাকাভাই, আম্মার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তিনি সব ভাইদের বড়।
মনে হলো কে যেন আমার গালে কষে এক থাপ্পড় মারলো। আমার অপরাধটা কি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আতঙ্ক, ভয় আর অপমানে আমার পা দু’টো যেন অবশ হয়ে গেলো। আমি আর এগুতে পারলাম না। কান্নাগুলো দলা বেধে গলায় আটকে থাকলো। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। বাড়ি ফিরে এলাম।
আম্মার মুখটা অসম্ভম থমথমে। ঐটুকু বয়সে কিছু না জেনে না শুনে ঘটনার গুরুত্ব পরিমাপ করার একটা গুণ আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম ততদিনে।
অনেকে বলে সকাল দেখে সারাটা দিন কেমন যাবে তা বোঝা যায়। সেই সময়টায় আমরা আম্মার মুখ দেখে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করতাম। সেদিন দুপুরে খাওয়া হয়েছিল কিনা মনে নাই। বাড়ীসুদ্ধ সবার মধ্যে আতঙ্ক। কেউ কারো সাথে কথা বলছিলো না।
বিকেল নাগাদ জানা গেলো ক্যাম্পে যাওয়ার পথে শান্তিবাহিনীর লোকেরা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ইস্কুলের মাঠে বেঁধে রেখেছিলো। পরে,তাদের পাক-সেনাদের হাতে তুলে দেয় । ঐ তিনজন ছিলেন মন্টুভাই, বাচ্চু’দা আর ফজলু ভাই। বাচ্চু’দা ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী । অনেকটা আপন ভাইয়ের মতো। ফজলু ভাই প্রতিবেশী না হলেও ওরা সবাই ছিলেন ভাইয়াদের অতি কাছের বন্ধু। ঘটনা শুনে মনে হলো কারা যেন আমাদের আপন ভাইদের পাক-সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। চোঁখে বরবার ভেসে উঠছিলো ওদের মুখ। টগবগে তাজা তিন তরুণ কত অসহায় ভাবে কিছু কাপুরুষদের হাতে বন্দি! আমরা তখনও জানিনা আমাদের দুই ভাই কোথায় আছে, কেমন আছে!
অন্য জাততিদের সম্বন্ধে আমার ততটা ভালো করে জানা নাই। তবে ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতায় পাক-ভারত উপমহাদেশের মানুষরা যে অনেক এগিয়ে, তা আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ পরও প্রতিদিন উপলব্ধি করা যায় ।
দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-একমাসের মদ্ধেই স্বাধীনতা বিরোধীরা শক্তি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো । শান্তির বাহিনী নামে অশান্তি, ধর্মের নাম অধর্ম, খুন-খারাপি, ধর্ষণ রাহাজানি, লুটতরাজ কোনো কিছুই বাদ রাখলো না তথাকথিত শান্তিরক্ষা বাহিনী।
পরের ঘটনাগুলো আরো করুণ, আরো কষ্টের আর মর্মান্তিক! ওদের মৃত্যুপূর্ব ঘটনা ছিল অসম্ভব ভয়াবহ। পাক-সেনারা সরকারি ইস্কুলে তাদের ক্যাম্প বানিয়েছিলো। স্কুল চলাকালীন সময়ে সবার চোখের সামনেই তাদের অত্যাচার চালাতো। বন্ধুদের কাছে শোনা সেইসব অমানবিক ঘটনার লেখার ভাষা আমার জানা নাই। দীঘদিন অত্যাচারের পর একসময়ে গুলি করে তারা তাদের বলেশ্বর নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
শুনেছিলাম ফজুভাই গুলি করার সময় ঘুরে বুক পেতে দিয়েছিলেন। বুক অথবা পিঠ তাতে কি আসে যায়। তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তার চেয়ে বড়ো কি হতে পারে ?
আমাদের আরএক প্রতিবেশী মন্টুদা-র লাশ বলেশ্বর নদী হয়ে দামোদর খালে ভেসেভেসে স্মশানঘাটে গিয়ে আটকে যায় । মাসি-মা ( মন্টুদা-র মা ) খবর পেয়ে ছুঁটে যান খালপাড়ে। দুদিনের লাশ ফুলেফেঁপে ভারী হয়ে গ্যাছে ততদিনে। অনেক কষ্ট করেও তার লাশ খাল থেকে তুলতে পারলেন না তিনি। আর্মিদের ভয়ে কেউ সাহায্য করতেও এগিয়ে এলো না। মাসিমা ছেলের লাশের উপর আছড়ে পরে কতক্ষন কেঁদেছিলেন সেই হিসাব আজ কারোকাছে নাই ।
সাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তীনি সেনারা নদীর ঘাটে এরকম খুনের তান্ডবলীলা চালিয়েছে প্রতিদিন। কংক্রিটের সেই ঘাট এখনো ওদের হাজার হাজার খুনের সাক্ষী।
এখন ঘাটের পারে মনোরম স্মৃতিসৌধ তৈরী হয়েছে। বছর ঘুরলে নিবেদিত হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর বছরের বাকিটা সময়ে সেখানে ছাগলের অবাধ বিচরণ!
তিন.
একটু ফিরে যাই ঊনসত্তরের সেই দিনগুলোতে । প্রতিবেশী এবং আশেপাশের বাড়ীঘরের সবাই আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। প্ৰায় প্রতিদিন বিকেলে আমাদের বাসার আঙিনায় ক্যারম খেলার আড্ডা বসত । যদিও সেটা ছিল শুধু মাত্র বড়ভাই দের জন্য। আমরা শুধু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতাম।
ঊনসত্তরের শেষেরদিকে আড্ডা গুলো কেমন যেন নিস্তেজ হতে লাগলো। দেশ তখন উত্তাল। দিনই দিন ভাইয়ারা রাজনীতির এর সাথে আরো বেশি জড়িয়ে পড়লেন । বড়ভাই ভাসানী ন্যাপ আর মেজ ভাই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন, পরে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, তারা শহরের নেতা গোছের কেউ তখন।
বাসার বারান্দায় একটা লম্বা টেবিলে আমরা পড়তে বসতাম। আমি, মেজপা আর সেজ্পা। বড়’পা দোতালায় । রাত আটটা অথবা আর একটু বেশি হবে হয়তো, হঠাৎ বাইরে প্রচন্ড একটা শব্দে আমরা কেঁপে উঠলাম। ভয়ে দৌড়ে ভিতর ঘরে চলে গেলাম।
আম্মা খারাপ কিছু আন্দাজ করতে পারছিলেন । তিনি স্বভাবগত ভাবেই দুশ্চিন্তায় ভুগতেন সারাক্ষণ। কাকতালীয় ভাবে তার আশঙ্কা কিভাবে জেন মিলেও যেত। আমাদেরকে বললেন
-আইজ আর পড়তে অইবেনা, সবাই ঘুমাইতে যাও
আমরা দোতালায় চলে গেলাম। ভাইয়ারা তখনও বাসায় ফেরেননি। আমার কৌতহলী মন কিন্তু শান্ত হতে পারল না কিছুতেই । কিছুক্ষন পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো । নিচতলা থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো । চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। জানতাম আম্মার চোখে পড়লে রক্ষা নাই। তবুও কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। দেখলাম মেজ ভাইয়া বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছেন । আম্মা তার মাথায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কানে এলো বোমার আঘাতে মন্টু’দার কব্জি উড়ে গেছে।
ভোরে ঘটনার কিছুটা বিস্তারিত খবর পাওয়া গেল। রাজনৈতিক কারণে মন্টু’দার নামে তখন ওয়ারেন্ট ছিল। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য তিনি নাকি হাতে সবসময়ে বোমা নিয়ে ঘুরতেন।
চারদিকে অনেক গাছপালা ঘেরা, সামনে বিশাল উঠোন নিয়ে মন্টুদাদের বাড়ি। সামনে রাস্তা। আরেক পাশে নালা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে, মাঝেমাঝে বাড়ির পিছন দিক থেকে যাতায়াত করতেন মন্টু’দা। সেদিন নালা পার হতে গিয়ে পা পিছলে পরে যান। আর বোমা ফেটে গিয়ে তার কব্জি উড়ে যায়।
সকালে আমরা কয়েকজন ঘটনার জায়গাটা আবিষ্কার করে ফেলাম। মাটিতে তাজা রক্ত আর হলুদ বারুদের দাগ তখনো খুব স্পষ্ট । বকাঝকা খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম।
শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি মন্টু’দা। গ্রেফতার হয়ে তার জেল হয়। পচিশ এ মার্চ এর কিছু আগে মুক্তি, আর তারপর পাক-সেনাদের হাতে নির্মম মৃত্যু। পরিণতি সেই শশ্মানঘাট !
এরকম লাখো নির্মম আর নিষ্ঠূর ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটেছে। মায়ের চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু, কন্যার ধর্ষণ, সারা জীবনের তিলতিল করে গড়ে উঠা স্বপ্ন, সব পুড়ে ছাই হয়েছে। অথচ এতো রক্ত, আত্মত্যাগ, মায়েদের কান্না, সব ভুলে আজ অ-মুক্তিযোদ্ধাদের লোভ লালসা অত্যাচারে পদদলিত হচ্ছে সবকিছু। অর্থ, ক্ষমতা, লোভ-লালসা অদ্ভুত সব জিনিশ, যার কাছে মানুষের মনুষ্যত্ব আজ মূল্যহীন!
’৭১ এর গল্প
( এই পর্বে চার থেকে সাত -)
মে মাসের শেষের দিকে বড় মামার বড়ো ছেলে, পান্না বাড়িতে ফিরে এলেন। উনি বিডিআরে চাকরি করতেন। সাথে নিয়ে এলেন একটা থ্রি-নট-থ্রী রাইফেল।
তখন দেশের দুর্যোগকে ভর করে ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিলো খুব । ভয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল সবার। পান্না ভাই আসায় একটু স্বস্তি মিলল। পান্না ভাই এবং আরো কয়েকজন মামাবাড়ি সহ আশপাশে বাড়িগুলো রাতভর পাহারা দিতে শুরু করলেন । ভরসা একটা মাত্র রাইফেল। পান্না ভাইয়ের গানের গলা ছিলো অসম্ভভ ভালো। বেনজু বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাইতেন আর পাহারা দিতে দিতেন। তার গানের আবেশটা ছিল মেঘলা রাতে ক্ষনিকের চাঁদের আলোর মতো। মনটা একটু ভরসা
পেতে পেতে আবার গুমোট অন্ধকারে তলিয়ে যেত।
একদিন পালপাড়ায় আর্মিরা হানাদিলো। মামাবাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে পাল পাড়া। আমার কয়েকজন কোনো এক ধান ক্ষেতের আইল ধরে হাটছিলাম তখন। দূরথেকে শুনতে পেলাম মেশিনগানের গুলির আওয়াজ আর মানুষের শোরগোল। দেখলাম কুন্ডলী পাকানো কালো ধোয়া সারা গ্রামের আকাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। খুব ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ালাম সবাই ।
হঠাৎ কোথাথেকে একদল আর্মি আমাদের ঘিরে ধরলো। কোথা থেকে এলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। অসম্ভব ভয়ে আমরা সবাই তখন আধামরা প্রায়। লাইন ধরে দাঁড়াতে বললো। উর্দু ভাষা আমাদের জানা ছিলোনা। তবে ইশারায় যা বললো আমরা কিছুটা বুঝতে পারলাম।
কিছুক্ষন কী যেন বলাবলি করল নিজেরা। একসময়ে আমাদের কলেমা পড়তে বললো। আর মুসলমান কি না একে একে প্যান্ট খুলে পরীক্ষা নিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলো।
ধর্মের গোঁড়ামি মানুষকে কতটা অন্ধ আর অমানুষ করে দেয় সেদিন ভালো করে না বুঝলে ও পরবর্তী জীবন প্রত্যক্ষ করেছি অনেকবার। আজ যেন আরো প্রকট এবং ভয়ংকর।
এই ঘটনার পর পান্নাভাই গ্রামে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। তিনি এবং আরো কিছু যুবক মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়লেন। আমার আবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকলাম।
পাঁচ
আম্মার সাথে মামিদের ছোটখাটো ঝগড়া লেগেই থাকত। বিষেশ করে আদরযত্ন কম নিয়ে। বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ী নাকি পরের বাড়ি হয়ে যায়। আম্মা তা মানতে চাইতেন না। বাবা-মা বেঁচে না থাকলেও সে তার অধিকার পুরোপুরি আদায় করে নিতে চাইতেন। তাছাড়া আম্মা ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট। সীমাহীন আদরে বড় হয়েছিলেন। তাই হয়তো তার আবদার বেশি ছিল।
একসময়ে আমি মেজখালার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। “আকঞ্জি বাড়ি”, মামাবাড়ি থেকে দুরত্ব সিকি মাইলও না। মেজখালাদের গোটা পরিবারটাই ছিল অসম্ভব ভালো। আমার দেখা কিছু ভালোমানুষদের মধ্যে তারা ছিল কয়েকজন। সবাই বলত মেজখালু নাকি একটু পাগলাটে স্বভাবের। যদিও আমার তা কখনও মনে হয়নি। খুবই সদালাপী আর ভালো মানুষ।একজন ভালো স্কুলশিক্ষক ও বটে ।
কোন এক অজানা কারণে এই সদালাপী মানুষটি বিয়ের কয়েক বছর পরেই আর একজন মেয়েকে বিয়ে করেন। মেজোখালা সেই সতীনের সাথে আজীবন সংসার করেছেন। দুই মায়ের সন্তানেরা বড়ো হয়েছে আপন ভাই বোনদের মতো। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী আর মানুষের মন !
ঐ বাড়িতেও খালার বড় মেয়ে পরিবার সহ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দুই ছেলেমেয়ে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। বাড়িতে সবমিলিয়ে ৮-১০ জন বাচ্চাদের দল। তাছাড়া আশেপাশের ঘরগুলোর বাচ্চারা তো আছেই।
আমার আশ্রয় জীবন আরেকটা মাত্রা পেলো । এবারে মাত্রাটা একটু ভিন্ন। খালার মেয়েজামাই, মানে সম্পর্কে আমার দুলাভাই, কিভাবে যেন আমাদের রেডিওটা বাগিয়ে আনলেন ওবাড়ি থেকে। তারপর থেকে রেডিওটা সারাক্ষণ নিজের দখলে রাখতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুলাভাইয়ের সাথে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারে খবর শোনতাম।
সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা আর দিনশেষে রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনা। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর শুনতাম আর গর্বে বুক ভরে উঠত। আবার কখনোবা হঠাৎ বুক মোচড় দিয়ে উঠতো কষ্টে, ভাইয়াদের কথা ভেবে । মেজ খালার বাড়িতে থাকলেও প্রতিদিনই মামাদের বাড়িতে যাওয়া হতো শুধু আম্মাকে দেখার জন্য, তার সাথে কিছু খবরের আশায়।
ভাইয়ারা এখন কোথায়! ওরা কি শেষ পর্যন্ত দেশ স্বাধীন করতে পারবে? নানারকম এলমেল ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতো মন। যদিও স্বাধীনতার কি মানে তখন ভালোকরে বুঝতাম না। আজ কী বুঝি? আসলে আমাদের দেশের মানুষ, রাজনীতিবিদ, আমলা, কেউ কি এখনও স্বাধীনতার মানে বুঝি? থাক এসব কথা….
কিছুদিন পরে মামাবাড়ির আনন্দ-বিষাদের পাঠ চুকলো। হয়তো জুলাই মাস হবে। আব্বা এসে হাজির। পরদিনই চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করতে লাগলেন। আমরা সবাই গোঁ ধরলাম আব্বার সাথে চলে যাবার জন্য। আমাদের বাগেরহাটে নিয়ে কোথায় রাখবেন তার কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। সেজন্য আমাদের সাথে নিতে চাইছিলেন না। মেজপা আর আমার জেদের কাছে আব্বা হার মানলেন। তাছাড়া আম্মা সবাইকে একসাথে ছাড়তেও চাইলেন না।
দুদিন পর নৌকায়ে করে বাগেরহাট রওনা হলাম। দীর্ঘ পথ। বাগেরহাট পৌছুতে রাত হয়ে যাবে, তাই খুব ভোরেই রওয়ানা হলাম। কতটা পথ, কতগুলো গ্রাম, কতটা মাঠ পারি দিয়েছিলাম মনে নাই। তবে মনে আছে অর্ধেকটা পথ সরু খালবেয়ে। কিছুটা বিলে ধরে। কোথাও কোথাও মাঠ আর খাল ভর্তি পানি মিলে যেন সমুদ্র! মাঠঘাট পেরিয়ে আকাবাঁকা খালের বুক চিরে কখনো বৈঠা, কখনো লগি ঠেলে মাঝি যেভাবে নৌকা চালিয়ে যায় ভাবতে অবাক লাগে। বিকেল নাগাদ ছোট্ট থানা শহর কচুয়া পৌছুলাম। বাগেরহাট পৌছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তখনও জানতাম না এই কচুয়া ঘিরে আমার, আমাদের পরিবারের অনেক সুখের স্মৃতি জড়িয়ে যাবে একদিন! সেকথা কোনোদিন লেখা যাবে হয়তো ।
অনেক কিছু বলতে গিয়ে কথার সাথে কথার মালা গেঁথে আসল গল্প বলতেই ভুলে যাই। এরকম গল্পের মালা গাঁথা আমি খুবই অপছন্দ করি। এসব করলে একসময়ে অমনোযোগী হয়ে যাই। আজ এতদিন পরে ভিতরে জমে থাকা স্মৃতির মেঘগুলো কেমন যেন আবেগের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না। পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমার সবসময়ে মনেহয় আমার জীবনটা অনেকের তুলনায় অনেকটাই ঘটনাবহুল আর রঙ্গিন। যদি এমনটা ভাবি যে আমার লেখা ‘কোনো দাওয়াতের গল্পের টেবিল না’ তাহলে গল্পের মালা গাঁথার অধিকারটুকু আশা করি আমার কোনো অন্যায় আবদার নয়।
যখন বাগেরহাট পৌঁছিলাম , সন্ধ্যার কালিমা সূর্যের আলো মুছে দিয়েছে তখন। দড়াটানা আর ভৈরব নদীর পার ঘেঁষে বাগেরহাট শহর। বলেশ্বর নদী অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে মিশেছে দড়াটানায়। ব্রিটিশ আমলের অনেকগুলো প্রধান মহকুমা শহরের মধ্যে বাগেরহাট অন্যতম একটি।
ডাকবাংলোর ঘাটে অনেকগুলো গানবোট, ভেসে থাকা অগুনতি লাশের ভীড়, সবমিলিয়ে একধরনের ভয় আর মিশ্র অনুভুতি নিয়ে বাগেরহাটের জীবন শুরু হলো আমাদের।
ছয়
কোনো থাকার ব্যবস্থা ছিলোনা, তাই দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিতে হলো কিছুদিনের জন্য। আব্বা আগে থেকেই ওদের গেস্ট রুমে থাকতেন। বিত্তবান ফ্যামিলি, বিশাল বাড়ি। নামকরা আর্কিটেক্ট দিয়ে নকশা করা। বাড়ির সামনে বাহারি ফুলের বাগান। সারা বাড়ি মোজাইক করা অদ্ভুত সুন্দর আর দামী ফার্ণিচারে ঠাসা।
তার কিছুদিনের মধ্যে আমরা ভাড়া বাড়িতে উঠে গেলাম। তিন রুমের একতলা দালান সামনে-পিছনে বারান্দা। সেকেলে টাইপের নকশা। বাড়িটা ছিল বাগেরহাট রেল স্টেশনের কাছেই। বাড়িওয়ালা শহরের ডাকসাইটে উকিল। বিশাল জমির উপর বাড়ি, বাড়ির পিছনে বিশাল এলাকা নিয়ে গাছপালা আর পুকুর। পুকুরে শান-বাঁধানো ঘাট। ওই শান-বাঁধানো ঘাট। পুকুরের কালো টলটলে জলের সাথে অনেক কথা হতো তখন আমার।
আমাদের অতি কষ্টের জীবনে একটু একটু করে সুখের ছোঁয়া লাগতে শুরু করলো তারপর থেকে। আসলে এই সুখ বলতে জীবযাপনের সুখের কথা বলছি, কিছুটা ভালো খাবার, জামাকাপড় ইতাদি। কিন্তু মানসিক ভাবে আমরা তখনও বিষন্ন আর বিশাদ্গ্রস্থ, ভাইবোনগুলো ছড়ানো ছিটানো। আম্মা বাকি সব ভাইবোন সবাই তখনও মামাবাড়িতে। সব অনিশ্চয়তা আর ভয় ছাড়িয়ে আমাদের প্রধান কষ্টের কারণ ছিল বড় আর মেজ ভাই দের অনুপস্থিতি।
কিছুদিন পর স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম। নুরুল আমিন গভারমেন্ট হাই স্কুল। বাসার পাশ দিয়ে রেল লাইন ধরে হেঁটে যেতাম। আমার ক্লাসমেট সিরাজুল ছিল আমার সঙ্গী।
স্টেশনের পাশের চায়ের দোকান ছিল রাজাকারদের আড্ডা। ভয় হতো যদি জানতে পারে আমার ভাইয়েরা মুক্তিযোদ্ধা তাহলে আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। বাসা থেকে বের হয়ে কুঁকড়ে থাকতাম যতক্ষণ না রেল লাইনে উঠতাম। তখন জানতাম না ওরা আগেথেই জানত আমাদের গোপন কথাগুলো। শুধুমাত্র আব্বার কারণে কিছু বলতো না। আব্বা ছিল সরকারী অফিসার, রেশনের চাল-তেল ছিল আব্বার ছিল। সেই কারণে পাক- আর্মিরাও আব্বাকে সমীহ করত, যদিও তা ছিল উপরে উপরে। সেকারণেই ঐ অশিক্ষিত লোভী মানুষ নামের অমানুষ গুলো আমাদের কিছু বলতনা। তবে স্বাধীনতা যদি আরো কয়েকমাস মাস পরে আসতো, তাহলে আমাদের পরিবারের কেউই ঐ নরখাদকদের হাত থেকে রেহাই পেতাম না। যে নীল নকশার খবর আমরা জেনেছি স্বাধীনতার পরে।
কিছুদিন পরে সেজ আপা এসে যোগ হলেন। সেজ’পা আমি পিঠা-পিঠি তাই বন্ধুত্ব ও ছিল অনেক। মেজ’পা ঐ আত্মীয়র বাড়িতে বেশির ভাগ সময় থাকতেন, তাই একাকী মন খারাপের দিন কিছুটা হলেও কাটল। কাঁদুনি আর বিলুকে খুব মিস করতাম। বছরের মাঝমাঝি সময়ে আম্মাসহ বাকিরা সবাই হাজির।
সাত
বাগেরহাট শহরের পাশ ঘেঁষে দুই নদী। দড়াটানা আর ভৈরব। দড়াটানা নদী একসময়ে ভৈরব হয়ে কেন্দুয়া বিলে মিশে গাছে । নদীর ওপারের পূর্বদিকের গ্রামগুলো বিস্টুপুর ,মাটিভাঙ্গা, নাজিরপুর, কচুয়া গোটা এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কঠিন ঘাটি। প্রায় প্রতিদিনই নদীর ওপার থেকে গোলা-গুলির শব্দ ভেসে আসত। শুনতাম মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আর্মিদের যুদ্ধ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি এতই শক্ত ছিল যে বহুবার যুদ্ধ করেও পাক-আর্মিরা কিছুতে তাদের পরাজিত করতে পারেনি।
একদিন সারা বাগেরহাট শহর জুড়ে প্রচন্ড উত্তেজনা। আর্মিদের টহল বেড়ে গেল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সার্চ করা হচ্ছে। শোনা গেল পাক-আর্মিদের ক্যাম্পের সামনেই মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার কমান্ডারের বুক ঝাঁজরা করে দিয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। সারা শহরজুড়ে তখনা আতঙ্ক।
সেদিন বিকেলে পাশের রুম থেকে কার যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আব্বা যেন কার সাথে কথা বলছেন। মেজো ভাইয়ার গলা মনেহলে।
তা কি করে সম্ভব ? একসময়ে রুমের দরজা খুলে গেল। আমরা ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। সত্যি তাই। আজ এতদিন পর ভাইয়াকে দেখে কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হৈচৈ করে চিৎকার করা যাবে না তা জানতাম। দেখলাম টেবিলের উপর একটা এস-এম – জি আর কয়েকটা গ্রেনেডে , অনেকটা আতা ফলের মতো দেখতে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের মেজ ভাইয়। বিস্টুপুর ক্যাম্পের একজন মুক্তিযোদ্ধ-কমান্ডার। বড়োভাইয়ার খবর তখনও জানি না।
সেপ্টেম্বরে পর থেকে আমাদের মনে একটুআধটু চাপা আতংক থাকলেও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তেমন একটা ভয় পেতাম না বরং বন্ধু মহলে একটু গর্ব করেই চলতাম।
বলতে গেলে সবাই জানতো আমাদের ভাইরা মুক্তিযোদ্ধা। এমন কি রাজাকাররাও জানতো।
ভাইয়া সেই রাতেই চলে গেলেন। তারপর মাঝেমাঝে মেজো ভাইয়াকে চিঠি লিখতাম আমরা। চোখের জলে কাগজগুলো এমন ভাবে ভিজে যেত যে না শুকানো পর্যন্ত ভাঁজ করা যেত না। লেপ্টে যাওয়া অক্ষরগুলো পড়া যেত কি না ভাইয়াকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।
একজন লোক আসতো আমাদের বাসায়। আব্বার সাথে কথা বলতো। তার মারফত চিঠি পাঠানো হতো। পরে জেনেছি সে শুধু চিঠি নেয়ার জন্য আসতো না। আব্বার কাছথেকে শহরের খবর খবর , পাক-আর্মিদের গতিবিধির খবর নেওয়া ছিল তার প্রধান কাজ।
নভেম্বরের মাঝামাঝি আব্বা অফিস থেকে ফিরতে দেরি করছিলেন দেখে আমার সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সন্ধ্যায় অফিসের পিওন এসে খবর দিলো আব্বাকে পাক-আর্মিরা ধরে নিয়ে গাছে। বাসায় কান্নার রোল পরে গেল। আমরা কেউই জানি না কি করতে হয় অথবা হবে এই পরিস্থিতিতে। বাসায় পুরুষ মানুষ বলতে আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। আমি
ছুটে গেলাম সেই আত্মীয়ের বাসায় যদিও জানি তার ও কিছু করার নাই।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তোমার আব্বা ভালো মানুষ তার কিছু হবে না। তিনি বললেন।
আমি বাসায় ফিরে এলাম।
আব্বা সত্যি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আব্বার কাছে ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে চেয়েছিলো। আমাদের ভাইদের কথা জানতে চেয়েছিলো। তেমন কোনো সদুত্তর পায়নি। শেষেমেষ এক উর্ধতন অফিসারের দয়ায় কোনো টর্চার না করেই ওরা আব্বাকে ছেড়ে দেয়। আসলে সেই সময়টাই পাকিস্তানী আর্মিদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল।
যতদূর মনে পরে ষোলোই ডিসেম্বরের আগেই বাগেরহাট স্বাধীন হয়েছিল। হয়তো পনোর ডিসেম্বর। সবাই রাস্তায় নেমে পড়েছে। চারিদিকে আনন্দের বন্যা। আমাকে কেউ ঠেকাতে পারলো না। আমি পিরোজপুরের দিকে রওনা হলাম। আমার মনেই হয়েছিল ভাইয়ারা প্রথমেই আসবে আম্মার সাথে দেখা করতে।
দড়াটানা নদী পার হলাম। তখনও বাস চলা শুরু করেনি। একটা ভ্যানে চড়ে বসলাম।
বৈটপুর ভাঙা ব্রিজের কাছে আসতেই দেখলাম দূরে তিন চারটা রিক্সা বাগেরহাটের দিকে আসছে। সবার হাতে অস্ত্র। বুঝতে কষ্ট হলোনা ওরা মুক্তিযোদ্ধা। কাছে আসতে দেখলাম মেজো ভাইয়া , চান ভাই , টুকু ভাই এবং আরো অনেকে। আমাকে দেখে রিক্সা থেকে নেমে দৌড়ে এলো।
বড়োভাইয়া কে দেখলাম না। বড়োভাইয়া ফিরে এলো স্বাধীনতার একমাস অথবা আরো পরে, কখন এখন ঠিক মনে নাই।
দেশ স্বাধীন হলো আমরা আমাদের আমাদের ভাইদের পেলাম। কিন্তু তারা ঘরে ফিরতে পারলোনা বহুদিন। আজও পারেনি। কেন পারেনি কি কারণে পারেনি সেই কলুষিত অধ্যায় এই গল্পের আন্তে চাই না। বামপন্থী রাজনীতি করা ছিল যেন অপরাধ। আজও তাই !