দশবছর আগে ফারহানার সাথে দেখা এবং পরিচয় হয় আমার। এর বছরখানেক পর ফারহানা হটাৎ করে হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে। অর্থাৎ আমাদের স্টেট থেকে চলে যায়। এখন ইউনাইটেড কিংডমের কোন এক শহরে আশাকরি সে খুব ভাল আছে। আমি অন্তর থেকে দোয়া করি যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক ফারহানা।
তখন সোশ্যাল মিডিয়াতে এত সোশ্যাল ছিলামনা আমি। প্রথম প্রথম কয়েকমাস মোবাইলে কথা হত আমাদের। তারপর একদিন ওর নাম্বারটা বন্ধ পাই। তারপর ফোন করে ফারহানাকে আর পাইনি। সে হয়ত ইচ্ছে করেই সব অতীত ছুঁড়ে ফেলেছে! সাথে আমাকেও। কারণ সেই যন্ত্রণাদায়ক অতীতের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ কোন এক সন্ধ্যার আড্ডায় সে আমার কাছে স্বীকার করেছিল।
ফারহানার গল্পটি না শুনলে আমার জানা হতনা মানুষ সহজে ক্ষমা করতে পারেনা। যারা ক্ষমা করতে পারে তাদের কষ্ট যারা পারেনা তাদের কষ্টের কাছে নস্যি বলেই পারে। সভ্য সমাজে উদারতা বা মহানুভবতা বলে যেটাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করি।
গত দশবছর ধরে অসংখ্যবার ভেবেছি ফারহানার গল্পটা আমি লিখে ফেলব। পারিনি। কেন পারিনি জানিনা। হয়ত কঠিন বলে পারিনি। ফারহানার বুকে জমে থাকা কষ্ট কাগজে কলম ঘষে লিখে ফেলার মতন সহজ নয় বলেই পারিনি।
আজ চেষ্টা করলাম। কতটা গুছিয়ে পাঠকের কাছে প্রকাশ করতে পারব জানিনা।
ফারহানা বাংলাদেশের কোন এক গ্রামের অতি নিন্মবিত্ত ঘরের বড়সন্তান। সুন্দরী মেধাবী হলেও অষ্টাদশী ফারহানা ছিল বিত্তহীন পরিবারের বিয়ের বয়সী কন্যা সন্তান। ফারহানা যখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে তখন পাশের গ্রামের লন্ডন প্রবাসী ফরহাদ মোল্লা দেশে যায় বিয়ে করতে।
লন্ডন প্রবাসীর ঘরে বিলাসীতা বা জৌলুসের কোন কমতিতো ছিলনা তাই তাদের চাহিদা ছিল শুধু সুন্দরী একটা অষ্টাদশী কইন্যা। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই পরিবারের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে ছিল গরীব ঘরের সুন্দরী কন্যা। যাইহোক সবদিক দিয়ে ব্যাটেবলে মিলে যাওয়াতে মাত্র সাতদিনের মাথায় এক শুক্রবার জুমার নামাজের মোনাজাত শেষে মসজিদে বসেই ফারহানার সাথে ফরহাদের বিয়েটা হয়েই গেল।
ফারহানাতে ফরহাদ মোল্লা এতোটাই মুগ্ধ ছিল যে তরিঘরি করে করা বিয়ের আয়োজনে ফারহানার বিত্তহীন পরিবারে যাতে কোনরকম চাপ না পড়ে সেদিকে খুব যত্ন করে খেয়াল রাখে সে। লন্ডন থেকে নিজের পছন্দে নিয়ে যাওয়া পনের ভরি স্বর্ণের সাথে বিয়ের পরও ফারহানা নিয়মিত কলেজে যাবে, পড়াশোনা ঠিকঠাক মতন চালিয়ে যাবে এইসব প্রতিশ্রুতি সহ ফারহানাকে বঁধুবেশে খুশিমনে আপন ঘরে তুলে আনে ফরহাদ মোল্লা। ফারহানার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে ভালমতন প্রস্তুতির জন্য দুজন প্রাইভেট টিউটর ঠিক করে দেয়। ফরহাদমোল্লার তখন লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্র বাঙ্গালী পাড়াতে ঘনিষ্ট এক বন্ধুর সাথে পার্টনারশীপে করা বেশ জমজমাট একটা গ্রোসারী শপ। লন্ডনে পরিবারের কেউ থাকেনা বলে দুহাতে পাউন্ড কামিয়ে আর দশজন সাধারণ প্রবাসীর মতন দেশে সব ইনকাম পাঠাতে অভ্যস্ত ছিল ফরহাদ মোল্লা। দেশের মা বাপ ভাইবোনরা মহা বিলাসীতায় জীবন যাপন করে।
বিলাসীতার সমুদ্রে থাকলে শ্যাওলার মতন মানুষের স্বভাবে উগ্রতা জমতে থাকে। খুব স্বাভাবিকভাবে ফরহাদমোল্লার পরিবারেও ছিল বিত্তের অহংকার, কলেজে পড়ুয়া ছোট ভাইটা ছিল উশৃংখল। দেশের পরিবার যতটা বিলাসী জীবনযাপন করত প্রবাসে ঠিক ততটাই বিপরীতভাবে জীবন যাপন করত কঠোর পরিশ্রমী ফরহাদমোল্লা। তাঁর একমাত্র নিজস্ব সম্পদ বলতে ছিল সেই গ্রোসারীর ফিফটি পার্সেন্ট মালিকানা।
ফারহানার কাহীনিতে আসি এবার। বিয়ের দেড়মাস পর ফরহাদমোল্লা লন্ডন ফিরে আসে। ফারহানা শ্বশুড়বাড়ি থেকে নিয়মিত কলেজে যায়, প্রাইভেট পড়তে যায়।
প্রতিরাতে প্রবাসী স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলার সময় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে ফারহানা, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর লন্ডন এসে সংসার আর পড়াশোনা করবে সে। আর ফরহাদ মোল্লা এমন একটা স্বপ্ন নববঁধু ফারহানার চোখে গুঁজে সুখের সমুদ্রে ভাসতে থাকে।
সৃষ্টিকর্তার বিধান বড্ড অদ্ভুত! মানুষ ভাবে এক আর তাঁর জীবনে ঘটে আরেক! কোনপ্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই এক প্রলয়ংকরী ঝড় উঠে তাদের জীবনে! কোন অপরাধ নাকরেও দুটা জীবন, দুটো জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, সাধ, কল্পনা পরিকল্পনা সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রাতজেগে পরীক্ষার পড়া পড়তে পড়তে ফারহানা একরাতে রুমের দরজাতে খিল না দিয়েই টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিল, ফরহাদমোল্লার বখে যাওয়া ছোটভাই অশ্লীল নীল ছবি দেখা শেষে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করে ফারহানার রুমের দরজা খোলা। শয়তান তখন ওর মাথায় ভর করে। নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা সে। সাথেতো আছেই বিত্তের অহংকার আর বখাটেপনা!
সেরাতে ধর্ষিত হয় ফারহানা। সে চিৎকার করে সবাইকে বলে তাঁর দেবর তাকে ধর্ষন করেছে। পরিবারের সবাই ঘুম থেকে উঠে আসে মধ্যরাতে। সেরাতেই ফারহানা ফরহাদমোল্লাকে ফোন করে জানায় সব। ফরহাদমোল্লা হতভম্ব এবং আতংকিত হয়ে বুদ্ধিশূন্য হয়ে পড়ে কিছুসময়ের জন্য। একদিকে পরিবারের মানসম্মান, ছোটভাইয়ের ভবিষ্যত, অন্যদিকে নতুন বিয়েকরা প্রিয়তমা বউয়ের অসন্মান দুটোই অসম্ভব ভারি হয়ে উঠে তাঁর জন্য। ফরহাদমোল্লার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় কেয়ামত ঘটে গেলেও এই ঘটনা চার দেয়ালের বাইরে যাওয়া যাবেনা। থানা পুলিশতো অনেক দূরের কথা! অন্যদিকে অপমানিত অনুশোচনায় দগ্ধ হতবিহ্ববল ফরহাদমোল্লা দেশের ফ্লাইটের টিকেট কাটে সমস্যার মুখোমুখি হবার জন্য।
ফরহাদ মোল্লা দেশে ফেরা অবদি ফারহানাকে শশুড়বাড়িতে তাঁর রুমে বন্দিকরে রাখা হয়। কারো সাথে কথা বা দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়না ফারহানাকে।
ফরহাদ মোল্লা দেশে ফেরার পর থেকেই পাগলের মতন আচরণ করতে থাকে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
একদিকে ফারহানা শকে এবং শোকে পাথর হয়ে স্বামীর কাছে বিচার প্রার্থী, অন্যদিকে তাঁর পরিবার বলছে যেভাবেই হোক ঘরের সমস্যা ঘরেই দাফন হতে হবে। কোনভাবেই চারদেয়ালের বাইরের মানুষের কাছে পারিবারিক অহংবোধকে ধংস করা যাবেনা! ফরহাদমোল্লা বুঝতে পারে সে পুলসিরাতের দড়িতে দাঁড়িয়ে। ফারহানা মরেগেলেও ধর্ষককে ক্ষমা করবেনা। ক্ষমা সে ধর্ষকের পরিবারকেও করবেনা। ফারহানার বাবামায়ের পরিবার লড়াই করার মতন শক্তি এবং সাহস রাখেনা।
তখন ফারহানা ফরহাদ মোল্লার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ওদের এই অহংকার, অসভ্যতা সব তোমার অর্থের শক্তির কারণে। আমি তোমার স্ত্রী হিসেবে নই একজন মেয়ে হিসেবে এর ন্যায় বিচার চাই। আমি ক্ষমা করবনা।”
প্রিয় পাঠক, তামিল মুভির নায়কদের মতন ফরহাদমোল্লা এক নিমেষে প্রেমকে বা ন্যায় কে জয়ী করতে পারেনি। প্রচন্ড অসুস্থবোধ করার পর ফরহাদ মোল্লা সেরাতেই জ্ঞান হারান এবং হাসপাতালে নেবার আগেই হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ফারহানা মৃত ফরহাদের সাথে সাথেই সে ঘর থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে আসে। সে মামলা করতে পারেনি। সেসময় সেই পরিস্হিতি ছিলনা। এটাই বাস্তব।
তারপর অনেকগুলো দিন কেটে যায় মাঝখানে। ফরহাদ মোল্লার লন্ডনের ব্যবসার পার্টনার বন্ধু দেশে যায় ফারহানার সাথে দেখা করতে। ফারহানাকে উনি ফরহাদ মোল্লার হাফ ব্যবসার মূল্য ফেরত দিতে চান। ফারহানা তখন বলে, ওর স্বপ্ন ছিল লন্ডন গিয়ে সে গ্র্যাজুয়েশন করবে। সেই মানুষটা ছিল তখনো অবিবাহিত। উনি ফারহানাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাঁদের বিয়ে হয়। তারও একবছর পর ফারহানা লন্ডন আসে। কলেজে ভর্তি হয়। সংসার করে। স্বামীর ব্যবসায়ীক দায়িত্বও মালিকানা ভাগ করে নেয়। নিজের পরিবারের স্বচ্ছলতার দায়িত্ব নেয়।
গল্পের হ্যাপি এন্ডিংয়ের ঠিক এই দিকটাই এসে আমি সমস্ত ম্যানারস ভেঙে প্রশ্ন করে বসি, “সেই বেয়াদব, অসভ্য কুলাংগার রেপিষ্টটাকে ছেড়ে দিলে?”
সে সমুচাতে চিলি সস লাগাতে লাগাতে সহজ গলায় বলল, “শুনেছি গ্রামের পোলাপাইনের সাথে মারামারি করতে গিয়ে দুই পায়ে যখম হয়েছে। স্ট্রেচার ছাড়া হাঁটতে পারবেনা জীবনে আর।”
আমি তখন ফারহানার দিকে তাকিয়ে ভারিক্কি গলায় বললাম, “আল্লাহ ছেড়ে দেয়না বুঝছ? আল্লাহর বিচার হবেই!”
সেই ঠান্ডা সন্ধ্যার শীতল হয়ে আসা চায়ের শেষ চুমুকটা নিয়ে চলে যাবার আগমূহূর্তে দরজাতে দাঁড়িয়ে স্হির একটা দৃষ্টি দিয়ে ফারহানা বলেছিল, “আল্লাহ সবচে বড় বিচারক তবে তার বিচারের অপেক্ষা করবার ধৈর্য্য সবার থাকেনা ভাবী। তাই কিছু টাকা খরচ করে সুযোগটা দেখে নিতে হয়!”
ফারহানাকে বিদায় দিয়ে দরজার চাবির খট করা শব্দের সাথে সাথে আমার মগজে খট করে বেজে উঠে তখন, হোয়াট?! ফারহানাই তাহলে ঐ অসভ্য রেপিষ্টটার পাজোড়া ………!
সত্যি ! সব ক্ষমা সত্যি সহজ নয়!