মানবজীবন তছনছ করার জন্য প্রীতি ভাবির একটি মুচকি হাসিই যথেষ্ট। তার হাসি যেন মহাকাব্যের দ্বাদশ স্বর্গ। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অনন্ত কাব্যরস, আস্বাদন করতে বাসনা হয়।
প্রীতি ভাবিকে দেখলে মনটা বাক-বাকুম করে উঠে। গিরিবাজ কবুতরের মতো শূন্যে ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে করে। এমন ধ্বংসাত্মক চাহনি আমি আগে কখনো দেখিনি।
কিন্তু প্রকৃতির নিঠুর বিধানে আজ আমার হাত পা বাঁধা। আমি চাইলেও বলতে পারবো না, চলেন ভাবি হাতিরঝিলে হাঁটতে যাই, মহানগর ব্রিজের নিচে বসে শাহী ঝালমুড়ি খাই।
প্রীতি ভাবি আগে শাহজাদপুর থাকতেন। ভাইয়ার অফিস নিকেতনে সিফট হওয়ায় বাসা বদলিয়ে রামপুরায় চলে এসেছেন। আমাদের পাশের ফ্লাটের সি ইউনিটে উঠেছেন। বাসায় একা একা বোর হচ্ছিলেন তাই রিহানের আম্মুর সাথে গল্প করতে এসেছেন। আমি শোবার ঘর থেকে প্রীতি ভাবিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর ভাবছি।
“তিফার আম্মু আর প্রীতি ভাবি
গেঁথে গেলো হৃদয়ে দুইটা ছবি!”
হে ঈশ্বর, আমাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেললা ?
প্রীতি ভাবির সাথে সৌজন্য আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রিহানের আম্মু আমাকে ডেকে বললো,
– অনি একটু এদিকে এসো তো?
আমি এই ডাকের প্রতিক্ষাতেই ছিলাম। চোখের পলকে ছুটে এসে প্রীতি ভাবির অপজিট সোফাটিতে বসলাম। ভাবি হাসিমুখে বললেন,
– ভাইয়া ভালো আছেন?
আহ্ কী মধুর কণ্ঠ, আমি যেন গহীন চোরাবালিতে ডুবে গেলাম। রিহানের আম্মু আমার হুঁস ফিরিয়ে বললো,
– অনি ঘরে চিনি নাই, দোকান থেকে অল্প চিনি নিয়ে আসো তো ?
প্রীতি ভাবি চা খাবেন আর চিনি নাই মানে, চিনির ফ্যাক্টরি তুলে নিয়ে আসবো।
দুদিন ধরে লিফট নষ্ট তাতে কী ? ছয়তালার সিঁড়ি মাড়িয়ে পাঁচ কেজি চিনি নিয়ে আসলাম।
রিহানের আম্মু কিচেনে চা বানাচ্ছে। আমি এই ফাঁকে প্রীতি ভাবির সাথে রসায়ন শাস্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। কিন্তু রিহানের আম্মু এসে বলে
– অনি, ভাবির জন্য নুডুলস করবো কিন্তু বাসায় ডিম নাই ?
– প্রীতি ভাবি নুডুলস খাবে আর ডিম নাই মানে, এক্ষনি ডিম নিয়ে আসছি!
আমি আবারও ছয়তালার সিঁড়ি ভেঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে পাঁচ হালি ডিম নিয়ে আসলাম। এবার প্রীতি ভাবির সাথে মানব দেহের তেইশ জোড়া ক্রোমোজম নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো। কিন্তু হায় রিহানের আম্মু এসে বলছে,
– অনি, কেচাপ ছাড়া নুডুলস কীভাবে খাবে?
– কেচাপ নেই ?
– না, ফুরিয়ে গেছে!
– ওকে ব্যাপার না, আমি নিয়ে আসছি।
ছয়তালা থেকে কোনভাবে নেমেছি ঠিকই কিন্তু উঠতে পারছি না। দু’চোখ অন্ধকার হয়ে এসেছে, সর্ষে ফুল দেখছি শুধু। বাসায় এসে রিহানের আম্মুর হাতে কেচাপ দিয়েই বিছানায় পড়ে গেলাম। দেহে একটুও বল পাচ্ছি না। নাক মুখ দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।
অত্যধিক ক্লান্তিতে কখন চোখ লেগে গেছে বুঝিনি। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি প্রীতি ভাবি চা নুডুলস খেয়ে চলে গেছেন। আর আমার সামনে একাত্তর পরবর্তী স্বাধীন দেশের নব্য মহিলা রাজাকার দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে জঘন্য ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় বলে,
– কী অনি বাবু, প্রীতি ভাবিকে কেমন দেখলেন ?
আমার শরীরে কথা বলার শক্তি নাই। আমি শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখছি।
এ যুগের বেঈমান ঘষেটি বেগম হাসছে!
অসহ্য কালনাগিনীর মতো হাসছে !!!
প্রীতি ভাবি
উদ্বাস্তু অনিকেত