আজকে লিখছি সততা নিয়ে একটি সত্যি ঘটনা।এই ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম প্রধান দেশের ঘটনা না। এই ঘটনা সুদূর ডেনমার্কের একজন হকারের কাহিনী।
চলুন ঘুরে আসি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে। সময়টা ২০০৩ সাল আমরা তখন সুইডেনের মালমো শহরে থাকি, আমার বরের উচ্চ শিক্ষার জন্য।
মালমো আর কোপেনহেগেন খুব কাছাকাছি।আমরা সাধারনধত কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টই ব্যবহার করতাম কারন মালমো আর কোপেনহেগেনের দূরত্ব গাড়িতে গেলে আধাঘন্টা।
এক উইকেন্ডে আমার বর বললো, চল এইবার কোপেনহেগেন শহরটা ঘুরে আসি তবে ফেরীতে যাব।ভাবতেই শিহরিত হলাম বাহ এতদিন Baltic sea পাড়ি দিয়েছি সেতুর উপর দিয়ে। এইবার সমুদ্রের বেশী কাছাকাছি অর্থাৎ তার বুকের ভিতর নীল পানির মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিব ফেরিতে।
তো বাচ্চাদের নিয়ে এক সকালে আমরা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে, ম্যাকডোনালসে খেয়ে ফেরার পথে বাচ্চারা একটু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। ওমা ফেরীতে উঠে ফেরী দেখে তাদের ক্লান্তি নিমিষেই উড়ে গেল। ফেরীতে নয় মনে হচ্ছিল ছোটখাট একটি শহর।
এদিকে আমার বর হলো চরম সিগারেট খোর।
পাঠকদের সুবিধার জন্য একটা ব্যাপার বলে নেই। ডেনমার্কের মুদ্রার দাম সুইডিশ মুদ্রার দামের চাইতে একটু বেশী। অনেকটা বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার মুদ্রার মতনই।
তো আমার বর একজন মধ্য বয়স্ক নারী বিক্রেতা কাছে গেলেন।যিনি একটা ছোট জায়গায় সিগারেট, পারফিউম, কিছু শুকনো খাবার নিয়ে একটি ভ্রাম্যমান দোকান সাজিয়ে বসেছিলেন।
আমার বর সিগারেটের প্যাকেট চাইতেই সেই নারী বিক্রেতা বললেন, আমি তো এখন তোমার কাছে কোন কিছু বিক্রি করবো না। অথচ তার দোকানটি খোলা ছিল।
আমার বর একটু রক্তিম মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো, দেখছো কেমন রেসিস্ট।
আমার আবার ঘাড়টা একটু ত্যাড়া টাইপের।
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, সে তোমার কাছে সিগারেট বিক্রি করলো না আর তুমি চুপচাপ মুখে চলে এলে?
আমার বর বললো কি আর করবো বলো তো? আমি তখন সাথে সাথে সে বিক্রেতার কাছে যেয়ে বললাম, কেন তুমি সিগারেট বিক্রি করলে না, আমার বরের কাছে, কোন সমস্যা আছে?
সে বিক্রেতা খুব নরম গলায় বললো, তোমরা কিছু মনে করো না প্লিজ। এই সময়টা আমি কারো কাছে কিছু বিক্রি করি না। আমি তখন তাকে বললাম, কোন সমস্যা না থাকলে আমি জানতে চাই, কেন?
সে তখন বললো, দেখ সমুদ্রের একপাশে ডেনমার্ক অন্য পাশটা সুইডেনে পরেছে। আমরা এখন দুই সীমানার মধ্যে খানে আছি। এখন এই অংশটা সুইডেন বা ডেনমার্ক কোন দেশের মধ্যেই পরে না।
তুমি তো জান সুইডিশ ক্রোনারের চাইতে ডেনিশ ক্রোনারের দাম বেশী।এখন আমরা মাঝ বরাবর আছি, তাই আমি এই সময়টা কনফিউজ থাকি। কারন আমি ডেনিশ মুদ্রা নিলে তা হবে অন্যায় কারন তোমাদের ঠকানো হবে।আবার সুইডিশ মুদ্রাও নিতে পারছি না।
সুতরাং একটু অপেক্ষা কর একটু পরেই আমরা সুইডেনের সীমানায় প্রবেশ করবো।তখন আমি সুইডিশ মুদ্রায় তোমাদের কাছে জিনিষপত্র বিক্রি করতে পারবো।
আমরা তো শুনে অবাক।এই ভাবে ভেবে এত চুলচেরা বিশ্লেষন করে সৎ থাকতে পারা তা কি ভাবা যায়? বাংলাদেশের বিক্রেতা হলে কি করতো তা সহজেই অনুমেয়।
অথচ মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের অসততা তো এখন সর্বজন বিদিত। তার প্রমান তো আমরা প্রতিবারই দেখছি, দূর্নীতিতে ১ম, ২য় হয়েই যাচ্ছি।
আমরা সৎ মানুষ হবো কবে? কে জানে আমরা আদৌ মানুষই আছি কিনা এখনও?
আমার পাকি-অভিজ্ঞতা
———————–
পাকিস্তান মুসলিম দেশ বলে এখনও যারা পাকিদের “ভাই” ভাবেন তাদের জন্য করুণা হয়, ঘেন্না হয় ।
কোরিয়াতে থাকা অবস্থায় প্রায় ১০/১৫ জন পাকিস্তানী ইন্টার্নেশনাল-ডর্মে ছিল । তাদের মাঝে একজনকে কেবল পেয়েছিলাম যাকে ভালো মানুষ মনে হয়েছিল ( ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা যা করেছিলো তার ডিটেইলস ইতিহাস সে পুরোপুরি জানে এবং শতভাগ দোষ স্বীকার করে অপরাধগুলো যে ক্ষমার অযোগ্য তা মেনে নিয়ে নিজের লজ্জা প্রকাশ করেছে সে নির্দ্বিধায়, আর সেই জন্য অন্য পাকিস্তানিরা তাকে “রাজাকারের” মত ট্রিট করতো ।)।
কয়েকটা ঘটনা বলছিঃ
#১/ কোরিয়া যাওয়ার পর পর এক পাকিস্তানি এক কাপ চা বানিয়ে আমার রুমে আসলো পরিচিত হতে । ভদ্রতার খাতিরে কথা বলার এক পর্যায়ে সে বলল,
“আমরা তো মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। কি সুন্দর এক সাথে এক দেশে ছিলাম ! পলিটিক্যাল কন্সপিরেসির কারণে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেল । আমরা তো জানি, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ তো এখনও আফসোস করে।”
আমি তখন টানা দশ মিনিট পাকিস্তানের কুকীর্তি বর্ণনা করলাম । তারপর বললাম, “বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আফসোস করার কোন কারণই নাই । পাকিস্তান যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধের সময় যে পরিমাণ অত্যাচার নির্যাতন করছে বরং সারাজীবন তারা পাকিস্তানকে ঘৃণাই করে যাবে এবং আরও কয়েকবার যদি জন্ম হয় তাহলেও সেই ঘৃণা বলবৎ থাকবে । আর পাকিস্তানের থেকে আলাদা হওয়াটা বাংলাদেশের শুধু অতীত -বর্তমান না ভবিষ্যতের সব ঘটনার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঘটনা ।”
জবাবে সে বলল, “ব্রাদার তুমি দেশে থাকতে পলিটিক্স করতে তাই না ?!”
“পাকিস্তানিরা যা করেছে তার জন্য পলিটিক্স করতে হয়না ! চায়ের জন্য ধন্যবাদ! আমি চিনি কম খাই, চায়ে চিনি বেশি ছিল !” বলে মগটা ধুইতে চলে গেলাম ! আমার পিছু পিছু সেও রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
#২/ একদিন কিচেনে আমি রান্না করছি । আরেক চুলায় রুটি ভাজছে আরেক পাকিস্তানি । কিচেনে আমরা দুইজন ছাড়া কেউ নেই । কাজ করতে করতে সে উর্দুতে কথা বলতে লাগলো । প্রায় দুই তিন মিনিট উর্দুতে বলে যখন আমার সাড়া পাচ্ছে না তখন ইংরেজীতে বলল, “সাইফুল, আই ওয়াজ আস্কিং ইউ সামথিং ফিউ টাইমস, বাট ইউ আর নট রিপ্লাইয়িং ?!”
আমি ইংরেজীতে জবাব দিলাম,” তুমি তোমার ভাষায় নিজের মত করে কথা বলতেছো, আমি কি করে বুঝবো তুমি আমার সাথে কথা বলতেছো ?!”
সে অবাক হয়ে হা হয়ে তাকালো আমার দিকে । তারপর বলল,
“তুমি উর্দু জানো না ?!!”
আমি বললাম, “না, তুমি বাংলা জানো ?!”
সে একটু ধাক্কা খেয়ে বললো, “তোমাদের স্কুলে উর্দু শেখায় না ?!”
আমি তার থেকেও আমার মুখ আরও বেশি হা করে ফেললাম, “উর্দু শেখাবে কেন ? ইন্টার্নেশনাল ইম্প্যাক্ট হিসেবে মান্দারিন ভাষাটা শেখানো স্টার্ট করলেও কথা ছিল ? কিন্তু উর্দু কেন শেখাবে ?! আচ্ছা তোমাদের স্কুলে বাংলা শেখায় ?!”
সে হা করা মুখ বন্ধ করে বলল, “তোমাদের অনেক বাংলাদেশী তো উর্দুতেই কথা বলে আমাদের সাথে ! তাছাড়া বাংলাদেশতো পাকিস্তানের সাথেই ছিল আগে, তাই ভাবলাম এখনও স্কুলে উর্দু শেখায় মনে হয় !”
আমি বললাম, “তুমি ১৯৫২ জানো ?”
সে বলল, ” আমি জানি না । আমি ইতিহাসে কাঁচা সাইফুল!”
আমি বললাম, “কিন্তু তুমি ইংরেজীতে অন্যান্য পাকিস্তানীদের চেয়ে ভাল ! তুমি গুগলে ‘১৯৫২ বাংলাদেশ’ লিখে সার্চ করে চটপট পড়ে ফেলতে
পারো । হ্যাভ এ গ্রেট ডিনার উইথ সাম ইন্টারেস্টিং রিডিং !”
#৩/ আরেকজন পাকিস্তানী একবার লাউঞ্জে বসে বলতেছে,
“সাইফুল, তোমার যে ইরানিয়ান ল্যাবমেট আছে, সে সবসময় কেমন খোলামেলা কাপড় পড়ে দেখছো , চেষ্টা করলে যে কেউ অনেক কিছুই দেখতে পারবে !তার চরিত্রও সুবিধার মনে হইলো না। নিজেরে আবার মুসলমান বলে বেড়ায় । এরা মুসলমানদের ইমেজের বারোটা বাজায় দিচ্ছে । এরা আমাদের মত ‘বেটার মুসলিম’ হইতে পারে নাই ।”
আমি বললাম, ” ‘বেটার মুসলিম’ কখনও অন্যের অগোচরে তার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলে না । সেই ইরানিয়ান মেয়েটা আজ পর্যন্ত তোমার চরিত্র নিয়ে আমারে কিছু বলে নাই । তুমি তার কাপড়চোপড় এর দিকে এইভাবে নজর দাও সেইটাও আমারে কখনও বলে নাই । কিন্তু তুমি তার চরিত্র নিয়া ঠিকই বাজে কথা বললা ! বেটার মুসলিমটা তাইলে কে ?!”
#৪/ আবারো কিচেনে ! বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে আলাপ করতেছিলো । উল্লেখ্য তখন যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেয়া শুরু হয়ে গেছে, শাহবাগের আন্দোলন সেইভাবে ইন্টার্নেশনাল মিডিয়াতে আসছিলো। যাই হোক , পাকিদের উত্তপ্ত আলোচনা চলছে, এক পর্যায়ে তাদের একজন আমাকে খুব আফসোসের স্বরে বললো,
“সাইফুল, বাংলাদেশে তো বিশাল জুলুম শুরু হয়ে গেছে । বয়স্ক বয়স্ক ঈমানদার মুসলমানদের ফাঁসি দিতেছে ৭১ এর জন্য ! এইটা ঠিক বল ?”
আমি বললাম, “বয়স্ক ঈমানদার নাতো , ৭১ এর যুদ্ধের সময় এরা হত্যা , ধর্ষণ সবই করছে । ইসলামিক আইনে তাদের জনসম্মুখ্যে গর্দান দেয়া উচিত ! তাদের ভাগ্য ভালো যে ইসলামি আইনে তাদের শাস্তি কার্যকর হচ্ছে না !”
সে খুব বিরক্ত হয়ে বলল, ” ৪০/৪৫ বছর আগে সে অপরাধ করছিলো কিনা তার প্রমাণ কী ?! আর এখন তো তারা এমনিতেই বার্ধক্যে মারা যাবে ! আগে যদি অপরাধও করে থাকে এখনতো অনেক বড় আলেম এরা !”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“এদের শাস্তি দেয়াতে তোমরা, মানে পাকিস্তান এত উদ্বিগ্ন, এটাই তো বড় প্রমাণ যে ৭১ এ তাদের ভূমিকা কী ছিল ! আর তারা যদি বার্ধক্যে মারাও যায়, কবর থেকে তার কঙ্কাল তুলে সেইটা অন্তঃত ফাঁসিতে ঝুলানো উচিৎ । নইলে যাদের খুন ধর্ষণ করছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে না !”
এই সময় আরেকজন পাকিস্তানি মেয়ে , যে কিনা পাশের আরেকটা চুলায় রান্না করছিলো সে বলে উঠলো,
“যুদ্ধের সময় ধর্ষণ হয়ই ! এইটা বড় কোন বিষয় না ! তখন মেন্টালি চাঙ্গা থাকার জন্য ফিজিক্যাল নিড ফুলফিল করাটা জরুরী থাকে । সেইখান থেকে কেউ রেপ টেপ করে ফেলতে পারে । যুদ্ধের সময় অত ইথিক্স নিয়ে ভাবলে হয় না !”
আমি সেই মেয়ের মুখে ধর্ষণের সাফাই শুনে আকাশ থেকে পড়লাম ! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম!
“আলহামদুলিল্লাহ ! জানো তো , আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন ! ৭১ এ আমরা স্বাধীন না হইলে এমন একটা জাতির সাথে আমাদের একসাথে থাকতে হইতো , যেই জাতির মেয়েরা পর্যন্ত ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে ! সে মায়ের জাত থেকে যেই সন্তান হতো তাদেরকে এটলিস্ট আমাদের ভাই বোন বলতে হচ্ছে না ! আলহামদুলিল্লাহ !”
আরও অনেক ঘটনা, কথা আছে । জাস্ট কয়েকটা তুলে ধরলাম এইখানে । আমি সিউর যারা অন্যান্য দেশে আছেন, তারাও এদের ব্যাপারে ভালোই আইডিয়া পেয়েছেন । পাকিস্তান নিয়ে মিথ্যা ফ্যান্টাসিতে ভোগা বাঙ্গালীদের বোধদয় হওয়ার চান্স নাই , তারা নিজেরাও জানে না কত বড় আজাব থেকে নিজের অজান্তেই তারা বেঁচে গেছে ।