প্রিয় রূপকথা,
নিশ্চয় তুমি খুব অস্থির হয়ে আছো, হঠাৎ করেই আমি কোথায় হারিয়ে গেলাম এটা ভেবে। হবারই কথা। এমন তো কখনও হয়নি যে আমি তোমার মেইল পেয়ে উত্তর দেইনি। তাই এতো দেরি করে উত্তর দেবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এই অধম বান্দাকে নিজ গুণে ক্ষমা করে দিও ..
আসলে এই দুই সপ্তাহ ঢাকাতে ছিলাম না। বাড়িতে গিয়েছিলাম। মা অসুস্থ, ভীষণ রকমের অসুস্থ। হয়তো খুব বেশি দিন বাঁচবেন না। মাকে নিয়েই বেশ দৌড়াদৌড়ি চলল এ কদিন। ভদ্রমহিলা একটু দম নিতেই আমার হাত ধরে আবদার করে বসলেন, আমার বিয়ে দিয়ে আমার বৌ দেখতে চান। শেষ সময়ে ছেলের বৌয়ের সেবা পেতে চান। মেয়ে বোধকরি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, আমার উপস্থিতিটাই বাকি ছিল শুধু। আমার দুঃসম্পর্কের এক খালার মেয়ে, রেনু।
আমি চাইনি তবু কিসের থেকে কি হয়ে গেল কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না রুপু। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। যদিও জানি ক্ষমার যোগ্য আমি নই, তবুও যদি পার চেষ্টা করে দেখ একবার। আর ক্ষমা যদি নাও করতে পার তবে একরাশ ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থেকো। তবু নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়োনা।
কাবিন, জামদানী আর বিয়ের মানুষ তিনটা জিনিস রেখে গিয়েছিলে, কিন্তু তিনটা জিনিস ফিরিয়ে দিতে পারলাম না রুপু, শুধু কাবিন আর জামদানী টা তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। আর তোমাকে আমার মত বিশ্বাসঘাতকের জীবন থেকে চিরতরে মুক্তির কাগজটাও সাথে দিয়ে দিলাম।
ভালো থেকো, অনেক ভালো।
ইতি
সোহেল
মেইল পড়ে প্রথমে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব বা কি করা উচিত। হতভম্ব ভাবটা কাটতেই প্রচন্ড রাগ উঠল আমার, হারামজাদা ফাজিল ছেলে, ভেবেছে টা কি, যা মন চায় তাই করবে! বিয়ে কি কোন ছেলেখেলা যে ইচ্ছে হল করল আর ইচ্ছে হল ভেঙ্গে দিল! আর অনুমতি ছাড়া এক বৌ থাকতে কেউ আরেকজনকে বিয়ে করতে পারে! দাঁড়া দেশে পৌঁছে তোকে মজা দেখাচ্ছি। তোকে যদি ঠিক মতো শায়েস্তা করতে না পারি তবে আমার নামও রূপকথা নয়।
কিন্তু রাগের প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাবার সাথে সাথে অসম্ভব কান্না পেলো। সোহেল, আমার সোহেল! সে সত্যি সত্যি এরকম করেছে! এরকম করতে পারে! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। নিশ্চিত আমার সঙ্গে মজা করছে যাতে দুই সপ্তাহ উধাও হয়ে যাবার জন্য কিছু না বলি। নয়তো কি ভাবে এটা সম্ভব!
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে থেকে হাউমাউ করে কাঁদলাম। অসহ্য রকমের কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে একছুটে দেশে চলে যাই। কিন্তু সেটা একেবারেই সম্ভব না। প্রথমত জাপান থেকে চাইলেই যখন তখন দেশে ফেরা যাবে না আর তারওপর আমার কোর্স। ঠিক এই সময়ে কোর্স ছেড়ে যাওয়া মানে নিজ হাতেই পুরো ক্যারিয়ার নষ্ট করা। আর তার চেয়েও বড় কথা, কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, সোহেল মিথ্যা বলছে। এর পরের মেইলেই সে নিশ্চিত সবকিছু ক্লিয়ার করবে।
তাই আমি শুধু এক লাইনের একটা মেইল করলাম সোহেলকে।
তুমি মিথ্যে বলছো তাইনা?
উত্তরে একটা ছবি এলো। সোহেল আর তার পাশে একটা মেয়ে। খুব কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি রেনু।
এক নিমেষে আমার পুরো দুনিয়া ভেঙে খানখান হয়ে গেল যেন। কি করব কোন কিছু মাথায় এলোনা। অসম্ভব অস্হিরতা নিয়ে বাসায় টেলিফোন করলাম। আমি দেশে আসতে চাই, থাকব না এখানে, চাইনা আমার কোন ডিগ্রী। আমি শুধু ফিরে আসতে চাই।
: কি হয়েছে মা, বাসার জন্য খারাপ লাগছে?
: জানিনা বাবা, আমি ফিরে আসতে চাই।
: তুই চাইলে অবশ্যই ফিরে আসতে পারিস। তবে একটু ভালো করে ভেবে দেখ, সবকিছু ফেলে দেশে আসলে কি কোন উপকার হবে?
: জানিনা বাবা।
: জানতে হবে মা, এটুকু অন্তত ভেবে বের করতে হবে। তুই চাইলে এখনই আমি টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারি, সেক্ষেত্রে আগামী দশ পনেরো দিনের মধ্যে হয়তো তুই দেশে আসতে পারবি। কিন্তু তাতে তোর নিজের স্বপ্নটাই শুধু তুই নষ্ট করে ফেলবি। ভেবে দেখ, কি করতে চাস। ভেবে আমাকে জানাস, সেভাবেই সব হবে।
আমি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরের দিন মাথা ঠান্ডা হতেই শফিকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। চারদিন পর আরেক ক্লাসমেটের মাধ্যমে শফিকের খোঁজ পেলাম এবং সেও সোহেলের মতো একই কথা বলল। সোহেল আসলেই বিয়ে করেছে।
মনটা একদম ভেঙ্গে গেল আমার। পরের কয়েক দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই কাঁদলাম। ঠিকমত ক্লাসেও গেলাম না। কয়েকদিন অ্যাবসেন্ট থাকায় আমার ডিপার্টমেন্টের অন্য এক বাঙালি ছাত্র সাব্বির ভাই আমার খোঁজ নিতে এলেন।
সাব্বির ভাই জাপানে এসেছেন তিন বছর। উনার স্ত্রীও এখানেই থাকেন। দুজনের ছোট্ট ছিমছাম সংসার। আমার অবস্থা দেখে সাব্বির ভাই আমাকে উনার বাসায় নিয়ে গেলেন। ভাবীর সাথে দেখা হতেই নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। মনে হল যেন খুব কাছের কাউকে পেয়েছি। ভাবীর সাথে কথা বলে সেদিন প্রাণ ভরে আবারও কাঁদলাম। ভাবী সব মনোযোগ দিয়ে শুনে শুধু একটা কথাই বললেন,
: সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল রূপকথা, তোমার কোর্সে মন দাও। যা হয়েছে তা হয়তো তোমার জন্য ভালোই হয়েছে। এরকম একটা ছেলেকে তোমার ফ্যামিলি সহজ ভাবে নিতে পারতো না আর তুমিও ওদের ফ্যামিলিতে সহজ ভাবে মিশতে পারতে না। কাজেই এসব একদম ভুলে যাও, কখনও মনেও এনো না যে তুমি কখনও বিয়ে করেছিলে, বুঝেছো। একদম ঝেড়ে ফেল..
পরের বেশ কিছুদিন আমাকে আর ডর্মিটরিতে ফিরতে দিলেন না ভাবী। উনাদের ওখানেই থাকলাম। অসম্ভব দুঃখ, কষ্ট একসময় জেদে পরিনত হয়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে আর কখনও সোহেলের মুখ দেখব না আর কোর্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশেও ফিরব না, একবারও না।
এবং সত্যি সত্যি পরের প্রায় চার বছর আমি আর দেশে ফিরলাম না। বাবা প্রতিবছর জাপানে এসে আমাকে দেখে গেলেন, দেশে যাবার জন্য জোরাজুরিও করলেন, কাজ হলনা। বাবা হাল ছেড়ে দিলেন।
চার বছর পর বাবার হার্ট এট্যাক হল। অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিল না বলে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হল বাবাকে। কেবল মাত্র তখনই বাবার দেশে ফেরার ডাক উপেক্ষা করতে পারলাম না আর। নিজের দেশে ফিরে এলাম চার বছরেরও বেশি সময় পর!
একদম গুনে গুনে চারবছর তিন মাস একুশ দিন! ভাবা যায়!
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক