কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ১৯
#অনুভবে
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
চমকালো ত্রয়ী। চোখের পাতা কেঁপে উঠলো ওর। দুরুদুরু বুক, অগোছালো দৃষ্টি নামিয়ে হাতে ধরে রাখা গ্লাসটার দিকে তাকালো। লোকটা এভাবে হুট করে কোলের উপর বসিয়ে দেবে কল্পনাও করেনি ও।
কোল থেকে উঠে পড়ার জন্য উদ্যত হতেই পিঠের উপর হাত রেখে কাছে টানলো নীল।
ভড়কে গেল ত্রয়ী। তাকালো অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে।
নীল থমথমে গলায় জানালো, “উত্তর না দিয়ে একচুলও নড়তে পারবা না।”
চোখ চড়কগাছ করে ফেললো ত্রয়ী। মানে কী! কী উত্তর দেবে ও!
দোটানায় পড়লো যেন। সামান্য ফোন না ধরা নিয়েও যে এমন কিছু হতে পারে সেটা আন্দাজই করতে পারেনি ও। বিস্তারিত না ভেবেই কাজটা করেছে।
যদিও এটা একপ্রকার ইগনোরের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে করেনি। এটা এখন কীভাবে বুঝাবে!
পূর্বের ন্যায় ত্রয়ীকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে অধৈর্য হয়ে উঠলো নীল। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজের হাতের মুঠোর গ্লাসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। পারলে বুঁদ হয়ে সে ওই গ্লাসেই ডুবে যায়।
“বলো?” ভীষণ রাশভারী গোছে প্রশ্ন ছুড়লো নীল।
ত্রয়ী জবুথবু হয়ে ক্ষীণ স্বরে কোনোমতে বলল, “আর হবে না।”
হাতের গ্লাসসহ পানি মৃদুভাবে কাঁপছে ওর।
“কী আর হবে না?”
“ফোন…ফোন ধরবো।”
“আর যদি না ধরো তাহলে?”
“ধরবো।”
“সত্যি?”
“হু।”
“এর আগ পর্যন্ত ধরোনি কেন?”
এপ্রশ্নের উত্তর করলো না ত্রয়ী। চেয়ে রইলো নিম্ন পানে।
“তোমার কী আমাকে ভালো লাগে না?”
বুকটা ধ্বক করে উঠলো ত্রয়ীর। থতমত খেলো খানিক। এর আগেও লোকটা এই প্রশ্ন করেছিলো। তখন উত্তর না দিয়েই কেটে পড়তে পেরেছিলো। কিন্তু এখন কী বলবে!
এমন নয় যে সে তাকে অপছন্দ করে, কিন্তু পছন্দ করে কিনা সেটা সে বলতে পারবে না। সে জানেনা।
তাই এই প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে গেল। হালকা নড়েচড়ে উঠে নিচু গলায় বলল, “আমি দাঁড়াই। এভাবে বসে থাকতে…! আমি বরং দাঁড়াই।”
“আমি চাই তুমি এভাবেই থাকো।” নীলের দরাজ কণ্ঠস্বরে ভ্যাবাচেকা খেলো ত্রয়ী। পাগোল নাকি লোকটা! এভাবে কোলে বসে থাকবে! ও কি বাচ্চা নাকি? তৃণা আপু এসে দেখলে!
নীলের হাত আলগা হয়ে এসেছিলো বলে হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে পারলো ত্রয়ী। নীল কিছু বুঝে উঠার আগেই কিছুটা দূরত্ব রাখতে পিছিয়ে গেল ও।
আস্তে করে গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, “আপনি থাকেন আমি চা নিয়ে আসি।”
“চা খাবো না আমি।”
নীলের কথা যেন কানেই শুনলো না ও৷ বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি নিয়ে আসছি।”
নীল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। চা যে সে আনবে না, এমনকি ফের এঘরমুখোও হবে না এটা নীল জানে।
প্রয়াস ল্যাপটপ খুলে বসেছে বেশ কিছুক্ষণ। তেমন কোনো কাজ নেই, তবুও।
মাথার মধ্যে শুধু একটা জিনিসই ঘুরছে। যদিও সেটা খুবই সামান্য বিষয়। তাও সে ভাবছে।
ওই নিকৃষ্ট লোকগুলোকে থানায় নেওয়া হয়েছে। শুধু ওই মধ্যবয়স্ক লোকটা, যার সাথে তিয়াসার বিয়ের কথা ছিল, ও পালিয়ে আছে।
ওকেও ধরা হবে আশা করা যাচ্ছে।
যেহেতু এখন আর কোনো সমস্যাই নেই সেহেতু এখন তো তিয়াসাকে অঞ্জলি দেবী নিজের কাছেই নিয়ে যেতে চাইবেন। কিংবা নিয়ে যাবেনও।
সেদিন তার সাথে কথা বলার পরই তাকে তিয়াসার কাছে, মানে এখানে নিয়ে আসতো প্রয়াস, কিন্তু সে বেশ অসুস্থ থাকায় হস্পিটালে নিতে হয়েছিল।
এখন মোটামুটি সুস্থ।
তাই কাল আসতে চেয়েছেন। নিশ্চয়ই তিয়াসাকে নিয়ে যাবার জন্যই!
কিন্তু তিয়াসা কি যাবে? যদি যায়?
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো প্রয়াসের। হঠাৎই বিরক্ত হয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে ল্যাপটপের স্ক্রিন নামালো।
সোফাতে মাথা হেলিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বারান্দার দিকে। বারান্দার লাইট বন্ধ। তাও তিয়াসা বেশ অনেকক্ষণ ধরেই সেখানে আছে। কী করছে কে জানে!
রুম থেকে শুধু শাড়ির আঁচলের এককোণা দেখা যাচ্ছে।
প্রয়াস উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়।
“কী করছ তুমি এখানে?”
প্রয়াস প্রশ্ন ছুড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তিয়াসা। চোখাচোখি হতেই সেই দীপ্তিময় হাসি ফুটলো তার অধরকোণে।
অজানা কারণেই বুকের ভেতর কেমন ধ্বক করে উঠলো প্রয়াসের। অবিন্যস্ত ভাবে দৃষ্টি ফিরাতেই তিয়াসা নিজের ডান হাতটা আস্তে আস্তে রেলিঙের পাশে থেকে এনে মেলে ধরলো প্রয়াসের সামনে।
প্রয়াস তাকালো।
হাতে জোনাকিপোকা তার। সবুজ আলো টিপটিপ করে জ্বলছে নিভছে।
যা হাতে পেয়ে দৃশ্যতই হীরা পাওয়ার সমান খুশি এই মেয়ে। এজন্যই এই জিনিসটা নিয়ে প্রায় একঘণ্টার বেশি এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
প্রয়াসকে দেখাতে গিয়েই জোনাকিপোকাটা উড়ে যেতে লাগলো৷ হাসি উবে গেল তিয়াসার। তড়িঘড়ি করে সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করলো। রেলিঙ পর্যন্ত যেতে যেতেই সেটা পুনরায় হাতে পেয়েও গেল তিয়াসা।
সেজন্যই আবার অধর ছড়িয়ে হাসলো ও।
জোনাকির সবুজ আলোর ছটায় বড্ড মোহনীয় লাগলো সেই হাসিমাখা মুখ।
প্রয়াস স্থির, স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো কতোসময়। তোলপাড় শুরু হলো হৃদ মাঝারে।
সে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তিয়াসার পিছনে। একহাত রেলিঙে রেখে বুক ঠেস দিলো ওর পিঠের সাথে।
তিয়াসা সহাস্যমুখে ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাতেই অন্যহাত দিয়ে আলতো করে গালের পাশের চুলগুলো গুজে দিলো কানের পিছনে।
তিয়াসা চোখ পিটপিটালো। মিষ্টি হাসিটা এখনো শোভা পাচ্ছে অধরকোণে।
সেখানেই দৃষ্টি থেমে আছে প্রয়াসের। নিজের অজান্তেই বিমোহিত হলো সে। রেলিঙ থেকে হাত নামিয়ে শাড়ি ভেদ করে কোমড় জড়ালো তিয়াসার। কাছে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে কোমল ঠোঁটজোড়া আবদ্ধ করলো নিজের ঠোঁটের মাঝে।
আচমকা রেখার ডাকে সম্বিত ফিরলো প্রয়াসের। এতক্ষণের ভ্রম কাটতেই বেজার চমকে দু’পা পিছিয়ে গেল সে। পিঠ ঠেকলো দেয়ালে।
হতবুদ্ধি হয়ে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে তিয়াসার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিজের ভিতরে এমন একটা ফালতু চিন্তা আসার বিষয় ভাবতেই অস্বস্তি শুরু হলো ওর। কালবিলম্ব না করে দ্রুতপদে ঘরে ঢুকে গেল ও।
তিয়াসা সমস্ত মনোযোগ একত্র করে জোনাকি দেখতে ব্যস্ত ছিল। সে ব্যস্ত রইলোও। রেখার ডাকে তার হেলদোল হয়নি। এমনকি এতক্ষণ তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যে তার রূপে মুদ্ধ হয়ে কীসব চিন্তা করে ফেলেছে তাও সে জানতে পারেনি।
ঘরে ঢুকে রেখার মুখোমুখি হতেই খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল প্রয়াস। অপ্রস্তুত ভাবটা প্রকাশ পেয়ে গেল না চাইতেও।
রেখা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ও আপনেরা ওইখানে ছিলেন!”
প্রয়াস হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। কপালে অজানা কারণেই অমসৃণ ভাঁজ এসে গেছে তার। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কারো সামনে দাঁড়াতেই অসহ্য লাগছে তার।
“রাত্তিরের খাওন রেডি। আপনেরা আসেন।”
প্রত্যুত্তরে শুধু মৃদুভাবে মাথা নেড়ে সায় জানালো প্রয়াস।
রেখা বেড়িয়ে যেতেই একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালো। তিয়াসার কাছাকাছি গেল না। তাকালোও না।
শুধু স্লাইডিং দরজাটায় টোকা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “নিচে আসো খেতে।”
ক্যাথি চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন হস্পিটালের ওয়েটিং রুমে। ক্যান্ডেল ভর্তি এখানে।
ফোনটা করেছিল জয়িতা। তাকে ইভান জানয়েছিল ক্যান্ডেলের ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে রাস্তা পার হতে গিয়ে।
এ অব্দি নাহয় ঠিক ছিল। কিন্তু চিন্তার বিষয়টা অন্য। মেয়ে তার এই নিয়ে তিনবার বমি করে ভাসিয়েছে। এত বমি করার কী কারণ? তিনি যা ভাবছেন তা নয় তো!
আশঙ্কিত হলেন তিনি।
এর উপর সকালে রাশেদার বলা কথাগুলোও তার কানে বাজছে।
ইনিয়েবিনিয়ে গতদিন নাকি ক্যান্ডেল তাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল। যদিও ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে করেছিল তাও রাশেদা, এমনকি তিনিও আন্দাজ করতে পেরেছেন যে প্রশ্নগুলো ক্যান্ডেলের নিজের জন্য ছিল।
সে রাশেদাকে বলেছিল যে তার এক ফ্রেন্ড ভুল করে, নিজের অজান্তে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিল। এছাড়াও আরো কিছুও করেছিল।
যেহেতু মেয়ের দিক থেকে ছেলেটা পুরো সায় পেয়েছে তাহলে কী ছেলেটা কিছুই করবে না?
রাশেদা বলেছে, অবশ্যই করবে।
যাইহোক রাশেদা কী বলেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো একটা টেস্ট করানো। তাছাড়া ইভানের মা তো আগেই বলেছিল যে ওদের মধ্যে গভীরভাবেই সম্পর্ক আছে।
সেই গভীরের অর্থ যে এত গভীর তা তিনি মাত্র বুঝলেন। থাপড়ে মেয়ের গালদুটো লাল করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
শুধু মেয়েকে না, সাথে মেয়ের বাপকেও। ওই বজ্জাত লোকের কথাতেই মেয়েকে বাহিরের দেশে রেখে এই দশা হয়েছে। প্রথম থেকেই দেশে থাকলে আজকে এই সমস্যা হতো?
হতো না।
এখন পরিস্থিতি আরো বেসামাল হয়ে পড়ার আগে কিছু করতেই হবে।
নীলের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। বেশ অপেক্ষা করিয়ে হলেও ত্রয়ী এলো। চা-সমেত এসে হাজির হলো।
নীল স্মিত হাসলো।
তবে ত্রয়ী চা-টা হাতে দিতে যাওয়ার সাহস করলো না। ঘরে ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে বিছানা থেকে একটু দূরে, একপাশের টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে নিচুস্বরে বলল, “আপনার চা।”
নীল বিছানা ছেড়ে উঠে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
ত্রয়ী না তাকিয়েও আচ করতে পারলো সেটা। তাই আড়চোখে অন্যত্র চাইলো ও। ছটফটিয়ে উঠলো ভেতরে ভেতরে। তার এমন ভাব যেন এই বুঝি চায়ের সাথে বিস্কুটের জায়গায় ওকেই ডুবিয়ে খেয়ে ফেলে নীল।
নেহাতই ভুল ভাবনা নয় যদিও।
টেবিলটার সাথে ঠেস দিয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলে নীল নজর গাঁথলো ত্রয়ীর দিকে।
আয়েশী ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই কপাল কুচকে ফেললো। পরমুহূর্তেই হাসি ফুটলো অধরকোণে। প্রশ্ন করলো, “এটা তুমি বানিয়েছ?”
“হু।” ছোট করে উত্তর দিলো ত্রয়ী।
নীল হাসিটা ধরে রেখেই আবার চুমুক বসালো।
চা-টা ঠান্ডা হয়ে গেছে পুরোপুরি। তবুও খেতে খারাপ লাগছে না।
যদিও গরম হলে আরো অসাধারণ হতো।
কিন্তু গরম থাকবে কী করে! সে জানে যে তার ত্রপাময়ী চা বানিয়ে আধাঘণ্টা ধরে ইতস্ততই করে গেছে।
এদিকে চা যে ততসময় সবুর করে নি।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভুলবশত নীলের দিকে আড়চোখে একপলক তাকালো ত্রয়ী। তখনি চোখ পড়লো সরাসরি লোকটার বুকের দিকে।
ভিজে শার্টের বেশ কয়েকটা বোতাম খুলে রেখেছে সে। প্রশস্ত বুকের বেশ খানিকটা অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে এতে।
অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে দেখে, অপ্রস্তুতভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো ত্রয়ী। হাঁসফাঁস লাগলো আচানক।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরালো। ফের পালানোর ধান্ধায় কিছু বলার উদ্দেশ্যে নীলের মুখের তাকাতেই চোখাচোখি হলো। ধড়ফড়িয়ে দৃষ্টি নত করলো ত্রয়ী।
তাড়াহুড়ো ভাবটা লুকিয়ে নমনীয় স্বরে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি রাতে খেয়ে যাবেন? আমি খাবার দিচ্ছি তাহলে।”
“কোথায় যাব?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ত্রয়ী। তবুও বলল, “আপনার বাসায়।”
“বাসায় তো যাব না। আজ রাতে থাকছি আমি। তোমার সাথে।”
বুকটা ধ্বক করে উঠলো ত্রয়ীর। চকিত ভঙ্গিতে নীলের দিকে তাকাতেই তার ফিচেল হাসি ঝংকার তুললো বুকের ভেতরটায়।
(চলবে…)