কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ২৩ : #বিয়ে
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
সবাই আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হলো ইভানকে। সে যে নীলের কথাতে রাজি হয়ে এখানে দেখা করতে আসবে সেটা বুঝতে পারেন নি ইশারা।
এজন্যই ক্যান্ডেলের পরিবারকেও এখানে পরিবারসহ আসার বিষয় কিছু জানান নি তিনি।
ক্যান্ডেলের মা ফোন করে ইভানের আসার কথাটা জানাতেই আবীর চ্যাটার্জী আর জয়িতাকে নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। ইমন অফিসের কাজে থাকায় আসতে পারেনি।
তবে কাজ শেষ হলে সরাসরি এখানে আসবে।
আলোচনার জন্য ড্রয়িং রুমে বসেছে সবাই। কিন্তু কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সবাই নিশ্চুপ। গমগমে নীরাবতা বিরাজ করছে ঘরটাতে।
একটু আগে রাশেদার রেখে যাওয়া ট্রে-এর চায়ের কাপগুলো থেকে গরম ধোঁয়া উঠছে।
ইভান বসেছে ক্যান্ডেলের বাবার মুখোমুখি উলটো দিকে। ভদ্রলোক বেশ চুপচাপ বসে আছেন। একটু আগ পর্যন্তও নিজের স্ত্রীর কাছে চোখ গরম খেয়েছেন।
অবশ্য এখনো অব্দি খেয়ে চলছেন। কেউ না দেখলেও ইভানের দৃষ্টি এড়ায় নি বিষয়টা।
লোকটাকে বেশ শান্তশিষ্ট আর রসিক মনে হয়। সাথে একটু ভীতুও।
ভয়টা শুধুমাত্র স্ত্রীর প্রতি। কারণ তার স্ত্রীর ধারণা, ক্যান্ডেলের এমন উগ্রপন্থীর জন্য দায়ী উনি। লোকটা এ নিয়ে তর্কে যায় নি। বউকে হয়তো সমীহ করে চলেন। কিংবা দোষটা সত্যিই হয়তো তারই।
দেশের বাহিরে মেয়েকে এতোটা স্বাধীনতা দেওয়াই তার ঠিক হয়নি।
কে কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।সবাই হালকা কেশে-টেশে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
সবাইকে এমন নির্বাক থাকতে দেখে শান্ত, সরব কণ্ঠে প্রথম কথাটা ইভানই বলল।
“আমি বিয়ের কথা বলতে আসিনি। আমি শুধুমাত্র এটাই ক্লিয়ার করতে এসেছি যে আমাদের মধ্যে কোনোরকমের কোনো সম্পর্ক নেই, এমনকি ছিলও না কখনো। আর না ক্যান্ডেল আপনাদের ধারণা অনুযায়ী প্রেগন্যান্ট।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল উপস্থিত সবাই। অবাক চোখে তাকালো ইভানের দিকে। কিন্তু সে যথেষ্ট স্বাভাবিক এবং একই সাথে ভাবলেশহীন।
ইভানের কথায় ইশারা চাপা স্বরে কিছু বলার আগেই সে ক্যান্ডেলের মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “আপনি ঠিকই বুঝেছেন। মেয়েকে আরো সাবধানে বড়ো করা উচিত ছিল আপনাদের। ছোটো থেকে বাহিরের দেশের কালচারে বড়ো হলে যে কারোরই এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। সেই সময়টায় যেহেতু কিছুই করে উঠতে পারেন নি তাই এখন আফসোস করে লাভ নেই। আপাতত যেটুকু করতে পারেন সেটা হচ্ছে ওকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। আর বাকি রইলো যে ঘটনাগুলো আমার মা বলেছে! সেগুলো ওর ড্রাংক অবস্থার ছিল। এর বেশি আর কিছুই না। আপনারা বরং ক্যান্ডেলকেই জিজ্ঞেস করুন ওর সাথে আমার সম্পর্ক কখনো ছিল কিনা! সে অন্তত মিথ্যা বলবে না!”
সবাই বোকার মতো ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইলো ইভানের মুখপানে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না।
“আমি মিথ্যা কোনো দায় নিতে রাজি নই। আমি চাই যেটা সত্যি সেটাই সবাই জানুক। মিথ্যে বা ভুল বোঝাবুঝি না থাকুক। তবে সবটা বিশ্বাস করা না করা আপনাদের নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়। সেক্ষেত্রে আমার কোনো…”
“আমি বিশ্বাস করছি তোমাকে।” সূক্ষ্ম এক হাসিসমেত বলে উঠলেন সেই ভদ্রলোক।
তার এমন আচমকিত কথায় অবাক হয়ে গেল ইভান। বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই ভদ্রলোক আরো বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, আমাদের প্রথম থেকেই ওর দিকে খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আর এখন এখানে না বুঝেই হট্টগোল সৃষ্টি না করে, ভুলভাল ধারণা না করে, আগে নিজেদের ছেলেমেয়ের কথা শোনা উচিত ছিল। বিশ্বাস করা উচিত ছিল।”
ইভানের বিস্ময় যেন বাড়লো। এই কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ভদ্রলোকের প্রতি অদ্ভুত এক সম্মানবোধ তৈরি হলো ওর।
একমাত্র উনিই ওকে বোঝার চেষ্টা করছেন। আর কেউ না। নিজের কেউও না!
হয়তো ওনার জন্যই এখন বিষয়টা মিটানো একটু সহজ হবে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইভান।
কে বলবে উনি ক্যান্ডেলের বাবা! বাবার বিন্দুমাত্র বৈশিষ্ট্য পায় নি ক্যান্ডেল।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে গভীরভাবে চিন্তা করলেন কিছু একটা। তারপর মৃদুহাস্যে বললেন, “আমি ভুলভাবে না, সঠিকভাবে বিশ্বাস করেই তোমাকে নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইছি। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।”
হুট করে দেওয়া এমন প্রস্তাবে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো ইভান। নেত্রযুগলে যেন ভিড়ে এলো একরাশ বিভ্রান্তি। সে মোটের প্রস্তুত ছিল না এমন প্রশ্নের জন্য।
ক্যান্ডেল উপরতলায় সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলো। একপ্রকার জোর করেই নিচে যায় নি সে। ওখান থেকেই সব শুনছিল।
কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে হঠাৎ করে তার বাবার এমন প্রস্তাবনা শুনে চোখ ছানাবড়া হলো ওর। মারাত্মকভাবে চমকে গেল ও।
কারো মুখোমুখি না পড়ার জন্য প্রায় চোরের মতোই বাসায় ঢুকলো ত্রয়ী। ত্রস্ত ভঙ্গিতে, অতি সন্তর্পণে সিঁড়ির কাছ অব্দি যেতে না যেতেই খাবার ঘরের টেবিলের কাছে দাঁড়ানো সাবিহার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ত্রয়ী। অনুপলেই পাংশুটে বর্ণ ধারন করলো মুখটা। যেন ভরসন্ধ্যে বেলা প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করে অনেক গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে সে।
মেয়ের মুখ দেখে খুব হাসি পেল সাবিহার। তাও হাসি দমিয়ে এমনভাবে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন যেন তিনি কিছুই দেখেন নি, কিছুই বোঝেন নি।
তবে তিনি ভান ধরলেও, তিনি যে ওকে লক্ষ্য করেছে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝলো ত্রয়ী। লজ্জা পেল ভীষণ। অনতিকাল বিলম্বে একপ্রকার দৌড়েই উপরে উঠে গেল সে।
ত্রয়ীর কান্ডে নিঃশব্দে হেসে ফেললেন সাবিহা। স্বগতোক্তি করে বললেন, “আস্ত পাগলি একটা!”
ত্রয়ী গোসল সেড়ে বের হলো। তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই তৃণা এসে ঢুকলো রুমে।
আয়েশ করে বিছানার উপর পা তুলে বসে ত্রয়ীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বিয়ের শপিং কবে করবি? কাল?”
ভ্রু বাঁকালো ত্রয়ী। আয়নায় তৃণার দিকে চেয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বলল, “এতো তাড়াতাড়ি কেন করবো? এখনো তো তিন মাসের বেশি সময় আছে!”
“কী? কীসের তিনমাস?” আকাশ থেকে পড়লো তৃণা।
তার এমন উলটোপালটা প্রশ্নে একটু বিরক্ত হলো ত্রয়ী। কপাল কুচকে বলল, “ফাইনালের পরেই তো।”
“তোকে কিছু বলে নি নীল?” কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে শুধালো তৃণা।
ত্রয়ী তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে চুল মুছছিলো। তৃণার প্রশ্নে হাত থেমে গেল ওর। বোকার মতো চোখ পিটপিটালো। না বুঝতে পারার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কী বিষয়ে?”
“সামনের মাসে বিয়ের ব্যাপারে? মাসের প্রথম সপ্তাহেই তো বিয়ে! আজ সন্ধ্যেতে আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করতে তো এজন্যই এসেছিল। তোকে ঘরে তুলে নেবে।”
চমকালো ত্রয়ী। হাত থেকে ধপ করে পড়ে গেল তোয়ালেটা। রসগোল্লার মতো চোখ করে ঘুরে তাকাতেই তৃণা ভ্রু উঁচালো।
“জানতি না? আমি তো ভেবেছি তোকে বলে তারপরই আমাদের বলেছে।”
হতভম্ব হয়ে গেল ত্রয়ী। লোকটার ফোন ধরে নি বলে সে কি না বিয়েই এগিয়ে এনেছে! ভাবা যায়!
আবার নিজ মুখে সে কথা বলেও গেছে এখানে এসে।
আচ্ছা, তার কি বিন্দুমাত্র লজ্জা করে নি এভাবে আচমকা সাতদিনের মাথায় বিয়েটা এগিয়ে আনার কথা বলতে? অথচ ওর তো ঠিকই লজ্জা করছে।
“তারমানে তোকে বলে নি?”
তৃণার কথায় ধ্যান ভাঙলো ত্রয়ীর। অপ্রাকৃত ভঙ্গিতে মিনমিন করলো, “না মানে…।”
তৃণা ফিচেলভাবে হাসলো।
“জাদু-টাদু করে ফেলেছিস নাকি? তোকে ছাড়া তো থাকতেই পারছে না আর।”
তৃণার ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেল ত্রয়ী। কপট চোখ রাঙানি দিয়ে বলল, “আপু!”
সশব্দে হেসে ফেলল তৃণা।
“আপনি… বিয়েটা এগিয়ে দিয়েছেন!” ওপাশ থেকে করা ত্রয়ীর কৌতুহলী প্রশ্নে মৃদু হাসলো নীল।
ফোন ডান কানের থেকে বা কানে ধরলো। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে সায় জানিয়ে বলল, “হু, দিয়েছি।”
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে কিছু বলল না ত্রয়ী। কয়েক মুহূর্তে সময় নিয়ে মিইয়ে যাওয়া স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি এখনো বিশ্বাস করেন নি যে আমি আপনার কল খেয়াল করিনি?”
“বিশ্বাস করেছি।”
অবাক হলো ত্রয়ী। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো, “তাহলে?”
“কী ‘তাহলে’?”
“না মানে…আপনি না এক্সামের পরে এসব হবে বলেছিলেন? তাহলে এতো আগে কেন…?”
“কারণ তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না আমি। দিনের শুরুতে তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে, দিনের শেষে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তোমার শরীরের স্নিগ্ধ ঘ্রাণে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। এমন আরো অনেক কিছুই ইচ্ছে করে যার জন্য আমার তোমাকে দরকার। খুব বেশি দরকার। প্রত্যেকটা দিন একদম নিজের করে চাই তোমাকে আমি।”
সরাসরি এমন স্বীকারোক্তিতে চমকে গেল ত্রয়ী। আপেলের মতো গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো।
“তুমি কি জানো, আমি তোমাকে ঠিক কতোটা চাই?” তার নেশাতুর, বিমোহিত কণ্ঠের প্রশ্নে ব্রীড়া যেন সম্মোহনীর মত আঁকড়ে ধরলো ত্রয়ীকে।
তবে এ প্রশ্নেই যেন সমাপ্তি নয়, সন্ধিক্ষণেই সুললিত স্বরে আবার প্রশ্ন করলো, “তুমি আমাকে চাও না?”
বুকটা ধ্বক করে উঠলো ত্রয়ীর। চোখের পাতা মৃদু কম্পন উঠলো। গূঢ় কাঁপনে শিরশির করে উঠলো সমস্ত শরীর।
নীলকে থেমে যেতে দেখে ঢোক গিলল ও। বুঝলো, উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এখন।
অর্থাৎ বলতে হবে, ‘আমিও আপনাকে চাই’।
লোকটার কাছে কথাটা সামান্য হলেও, ত্রয়ীর কাছে তিন শব্দের ভয়ানক একটা বাক্য এটা। যেটা চিন্তা করতেই লজ্জায় বলয়ে আবিষ্ট হলো ত্রয়ী। অথচ লোকটা কতো সহজেই বলে দিলো। আর এখন তাকেও বলতে হবে।
বড়ো বড়ো নিঃশ্বাসের সাথে বুক ওঠানামা করতে লাগলো ত্রয়ীর। বিছানার চাদরটা আঁকড়ে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করলো ও। একশ্বাসে বলে উঠলো, “আমিও চাই আপনাকে।”
অনুভূতিরা ডানা ঝাপটাতে দেরি কিন্তু ত্রয়ীর ফোন কাটতে দেরি হলো না।
‘টুট টুট টুট’ শব্দে লাইন কেটে যেতেই অবাক হয়ে ফোনটা চোখের সামনে ধরলো নীল। অতঃপর অকারণেই হেসে ফেললো মৃদুভাবে।
বউটা তার বড্ড বেশিই লাজুক কিনা!
আড়চোখে ইভানের দিকে একবার তাকালো ক্যান্ডেল। চোখাচোখি হতেই শিউরে উঠে অন্যত্র দৃষ্টি সরালো।
সে যে এখন ওর হবু বর সেটা ভাবতেই অস্বস্তি ঝেঁকে ধরলো ওকে।
গতকাল কীভাবে যে বিয়েটা পাকা হয়ে গেল বুঝলোই না ক্যান্ডেল। ওর বাবা আর জয়িতার কারণেই হয়তো জল এতদূর গড়িয়ে গেল।
পরে অবশ্য সবাই চলে যাবার পর, বিয়ে এখনি করতে চায় না বলে বিষয়টা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল ক্যান্ডেল। কিন্তু নিজের মায়ের কারণে সেটা হয়ে ওঠে নি। কারণ তিনি বেশ বুঝেছেন, মেয়েকে সোজা পথে আনতে এই ছেলেই একমাত্র পারবে। তাছাড়া ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে নারাজ তিনি। বিয়ে দিলে নাকি এখানেই দেবেন।
এবিষয়ে ক্যান্ডেলের বাবাও রাজি। কাল সে মেয়েকে বুঝিয়েছেও। বাবার মুখের উপর না করতে পারেনি ও।
কিন্তু মনে মনে বিয়েটাও তো করতে চাচ্ছে না। একপ্রকার টানাপোড়েন চলছে ভেতরে ভেতরে।
ক্যান্ডেলের এসব চিন্তার মাঝেই ইভান একদম পিছনে এসে দাঁড়ালো ওর। একপেশে স্বরে বলল, “তুমি নাকি বিয়েতে রাজি?”
চমকে উঠলো ক্যান্ডেল। ঘাড় ঘুরিয়ে ইভানকে এতোটা কাছে দেখে প্রচন্ডরকম হকচকিয়ে গেল।
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ভ্রু উঁচু করে নামালো ইভান। চোখেমুখে ঈষৎ গাম্ভীর্যের ছাপ।
ক্যান্ডেল অপ্রস্তুতভাবে পলক ঝাপটিয়ে সামনের দিকে ফিরলো। কিছু বলতে গিয়ে টের পেল স্বর আটকে আছে। কণ্ঠনালী কেউ চেপে ধরেছে যেন।
“নীরাবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নেবো?” ভারিক্কি গলার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল ক্যান্ডেল।
সকাল সকাল এসব জিজ্ঞেস করতে এসেছে নাকি লোকটা!
ক্যান্ডেলকে নিরুত্তর দেখে ইভান ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ধরে নিচ্ছি তাহলে।”
শরীর শিরশির করে উঠলো ক্যান্ডেলের। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে দাঁড়িয়ে রইলো আড়ষ্ট হয়ে।
“আমার কিছু বলার আছে তোমাকে। পাঁচ মিনিট লাগবে।”
রাশভারী ধাচের কথায় আড়চোখে আরেকবার তাকালো ক্যান্ডেল।
সে বলল, “আমাকে বিয়ে করতে হলে কিছু জিনিস পারমানেন্টলি ছাড়তে হবে তোমার।”
ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ পড়লো ক্যান্ডেলের। প্রশ্নসূচক চোখে ইভানের দিকে তাকাতেই সে সিরিয়াস কণ্ঠে বলল, “ক্লাবে যাওয়া, লেট নাইট পার্টি করা, ড্রিংক করা মোটেও চলবে না। আর most importantly,-” এটুকু বলে ক্যান্ডেলের গায়ের অফ শোল্ডার টপসটার দিকে আঙুল ইশারা করলো ইভান, “কারো সামনে এসব Fancy ড্রেস একদমই পরতে দেবো না আমি।”
ক্যান্ডেল অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকাতেই ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “একান্তই পরতে হলে বেডরুমে, শুধুমাত্র আমার সামনেই পরতে পারবা। I Won’t mind.”
ভারী চমকালো ক্যান্ডেল। লজ্জায় সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো যেন।
“এসব মানা, না মানা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার জন্য যে তোমার নিজেকে চেঞ্জ করতেই হবে এমন নয়। আমার আগে থেকেই এসব জানিয়ে রাখার কারণ হচ্ছে, যাতে পরে তোমার মনে না হয় আমি তোমাকে জোর করছি। সবটা যেন সজ্ঞানে, নিজ ইচ্ছাতেই হয়।
তাই যদি এসব মানতে পারো তাহলেই বিয়েটা হবে। নাহলে হবে না। আমি নিজ দায়িত্বে ভেঙে দেবো। “
অবাক হয়ে তাকালো ক্যান্ডেল। কিছুই করতে পারবে না! আর তাছাড়া এসব ড্রেস পরবে না তো কী পরবে ও!
শাড়ি?
শাড়ি তো ও জীবনে কখনোই পরে নি।
ইভান ফোন বের করে বিছানায় বসলো। সময় দেখে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “ভাবার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি তোমাকে। ভাবো।”
তারপর একটু থেমে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, “আর তুমি নাকি এই প্রজেক্টে আর কন্টিনিউ করবা না বলেছ? কেন?”
ক্যান্ডেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। পিছনে ফিরলো না। বুক ধুকধুক করছে।অস্বস্তিতে অবশ হয়ে আসছে হাত পা ওর। ইদানীং এমনই হয়। পরপর এতোগুলো অপ্রীতিকর ঘটনার পর সে কী করে এই লোকটার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করবে! ঠিক এই কারণেই কয়েকদিন আগেই প্রজেক্টে ওর জায়গায় অন্য কাউকে নিতে বলে দিয়েছিল। তখন অবশ্য সে ঘুণাক্ষরেও জানতো না যে এই মানুষটার সাথেই তার বিয়ে ঠিক হবে।
তাছাড়া অন্য কাউকে নেওয়া হবে কিনা, বা তাকে অব্যহতি দেয়া হবে কিনা, তা নিশ্চিত জানানো হয় নি।
ইভান ফোনে কিছু করছিল। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না বলে তাকালো চোখ তুলে।
ক্যান্ডেল স্বস্থানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো। এদিকে ফেরে নি। হাতদুটো উদরের কাছে মোড়ামুড়ি করছে সে।
ইভান স্মিত হাসলো। এই মেয়ে গত কয়েকদিন আগ পর্যন্তও কতো ঝাঁঝের সাথে কথা বলতো, আর এখন! টু শব্দও তো করে না।
ইভান উঠে দাঁড়ালো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, “প্রজেক্টে তোমাকেই থাকতে হবে। নতুন কাউকে নেওয়া হবে না।”
থমকালো ক্যান্ডেল। হতভম্ব হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ইভানের দিকে। তবে চোখাচোখি হতেই আড়ষ্টতা বাড়লো। ফের সামনে তাকালো ও।
এরপর আর কিছু বলল না ইভান। কাঁটায় কাঁটায় পাঁচ মিনিট শেষ হতেই সে বলল, “সময় শেষ তোমার।”
ক্যান্ডেল শুনেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। ভেতরটা ছটফটিয়ে যাচ্ছে ওর। আশ্চর্যজনকভাবে মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কোনটাই বের হচ্ছে না।
‘না’ বলে দিলেই তো বিয়েটা একদম শান্তিমত ভেঙে যায়। তাহলে? কেন বলতে পারছে না ও!
নিজের উপর নিজে অবাক হচ্ছে ক্যান্ডেল। অদ্ভুত টানাপোড়েনে আরো এক মিনিট কেটে গেল।
তবুও সে কিছু বলতে পারলো না দেখে ইভান সরু চোখে কটাক্ষ করে বলল, “নাকি এটাকেও নীরাবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নেবো?”
চকিত হলো ক্যান্ডেল। ভেতরে ভেতরে দুর্নিবার প্রলয় শুরু হলো যেন।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ইভানের। সোজা গলায় বলল, “নিচ্ছি তাহলে।”
ক্যান্ডেল এবারো কিছু বলতে পারলো না। হাত পা শিরশির করছে। ঠোঁটদুটো যেন লেগে আছে একত্রে।সব কথাও কেমন দলাপাকিয়ে আটকে আছে গলার কাছে। এমন কেন হচ্ছে!
ইভান আর কথা বাড়ালো না। এখন বের না হলে অফিসের জন্য দেরী হয়ে যাবে।
“আমাকে যেতে হবে এখন। আর কাল থেকে রাইট টাইমে অফিসে দেখতে চাই তোমাকে। একয়েক দিনের সব মিটিং পেন্ডিং পড়ে আছে।”
বাঁকানো চাহনিতে আড়চোখে তাকালো ক্যান্ডেল।
বলতে বলতে রুমের দরজা পর্যন্ত গেল ইভান। তবে বের হবার আগেই হঠাৎ কী মনে করেই যেন ঘুরে দাঁড়ালো আবার।
কোনরকম ভণিতা না করেই বলল, “ওহ! আমি তো আমারটা বললাম শুধু। তোমার যা যা অপছন্দ সেটাও এখনি জানিয়ে দেও। তারপর আমি ভেবে দেখবো।”
অবাক হয়ে চোখ পিটপিটালো ক্যান্ডেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ইভানের দিকে।
“আছে?” সরু দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়লো সে।
ক্যান্ডেল দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “Perverseness.”
কপাল কুচকালো ইভান। ক্যান্ডেল নিজেও চমকে উঠলো। এতক্ষণে তো মুখ দিয়ে কিছুই বেরুচ্ছিল না।
অবশেষে বের হলো তো হলো, তাও এমন একটা কথা!
ভ্যাবাচেকা খাওয়া দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাতেই তার শীতল চাহনিতে ঘাবড়ে গেল ও।
ইভান মেজাজটা যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে মুচকি হেসে বলল, “সেটা বিয়ের পরে দেখা যাবে।”
এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ভেতরটা কেমন হিমেল শিহরণে শিউরে উঠলো ক্যান্ডেলের। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাতেই তাচ্ছিল্যের হাসিটা অধরকোণে ছড়িয়ে বেরিয়ে গেল ইভান।
আবছায়া মোড়ানো সন্ধ্যেবেলা৷ নীলদের ছাদের রেলিঙের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়ী। আর তার থেকে মাত্র কিছুটা দূরত্বে নীল।
একটু আগেই বিয়ের শপিং নামক ঝামেলার পাট চুকিয়ে ফিরে এসেছে দুই পরিবার। একত্রেই গিয়েছিল সবাই। ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়েছে।
নীলের মায়ের জোড়াজুড়িতে ফিরতি পথে এবাড়িতেই এসেছে ত্রয়ীরা। তার কথা, চা নাস্তা হলেও করে যেতে হবে।
আর সেই সুবাদেই ত্রয়ীর সাথে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে নীল। সবার গল্পগুজবের মধ্যেই তাদের থেকে আলাদা হয়ে ছাদে চলে এসেছে ত্রয়ীকে নিয়ে।
তবে আসা থেকে একটাও কথা হয়নি এখনো দুজনের। শুধু বারকয়েক নীলের স্নিগ্ধ হাসিসমেত নিমেষহীন চাহনির সাথে দৃষ্টি অদলবদল হয়েছে।
ত্রয়ী ছাইরাঙা চকচকে রেলিঙটা হাতে চেপে ধরে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। উদ্দেশ্য একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা। তবে শুরুটা করবে কীভাবে বুঝতে পারলো না। আদৌ জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝলো না।
তাই আরো কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে কাটিয়ে অবশেষে একরাশ শঙ্কা নিয়েই কথাটা জিজ্ঞেস করল, “আপনি নুহাসের সাথে কি কিছু করেছেন?”
ত্রয়ী আড় চোখের চাহনিতে পরখ করতেই দেখলো, এতসময়ে ঠোঁটের আগার থাকা চওড়া হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে নীলের। কপালে কেমন অমসৃণ ভাঁজ পড়েছে। বাঁকালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।
ত্রয়ী ঘাবড়ে গেল। তাকে নিরুত্তর হয়ে গম্ভীরভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঢোক গিলে আস্তে আস্তে অন্যদিকে তাকালো ও। চোরা চোখেও আর তাকানোর সাহস হলো না কেন জানি!
ও ভালো মনেই প্রশ্নটা করেছে। আজই এক বান্ধবীর কাছ থেকে শুনেছে, নুহাস নাকি হস্পিটালে ভর্তি। কারা নাকি তাকে কয়েকদিন আগে বাসায় ফেরার পথে উদোম কেলিয়েছে। সেই থেকেই নাকি আতঙ্কে পাগোলের মতো অবস্থা তার।
ব্যাপারটা এ অব্দি স্বাভাবিক হলেও পরের অংশ অস্বাভাবিক। ইতিমধ্যে কয়েকদফা ত্রয়ীকে ফোন করে ক্ষমা চাওয়াচাওয়ি শুরু করেছে সে। প্রথম প্রথম তো কলই ধরে নি ত্রয়ী। ব্লক করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে কার না কার ফোন নম্বর দিয়ে ফোন করে প্রথমেই কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।
বাধ্য হয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য ওর কথাগুলো শুনতে হয়েছে ত্রয়ীকে। কথাবার্তায় যা মনে হয়েছে সেই থেকেই নীলকে প্রশ্নটা করা যে সে কিছু করেছে কিনা। এর বেশি কিছুই না।
কিন্তু লোকটা কী অন্যকিছু বুঝবে নাকি আবার!
কে জানে! তার তো আবার উলটো বোঝার বাতিক আছে। তাকালেই হয়তো দেখবে এতক্ষণে রেগে মেগে আগুন হয়ে গেছে সে।
মুখটা শুকিয়ে গেল ত্রয়ীর। ইশ, কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেল! শুধু শুধু বিপদ বাড়ানো।
নীল দূরত্ব আরেকটু কমিয়ে ওর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে বুঝে গলাটাও শুকিয়ে এলো ত্রয়ীর। গুরুতর ভুল কিছু জিজ্ঞেস করেছে এমন ভঙ্গিতে তাকাতেই নীলের গমগমে স্বরের কথায় শুকনো মুখটা একদম চুপসে গেল ওর।
“খবর নেওয়াও হয়ে গেছে? মনে হয়, তোমার খুব চিন্তা হচ্ছে ‘ওর’ জন্য! খারাপ লাগছে? ভালোবাসো এখনো? বলো? বাসো? এজন্যই বিয়ে এগিয়ে এনেছি বলে ভালো লাগছে না? সরাসরি কেন বলছ না যে তুমি আমাকে পছন্দ করো না? আমাকে ভালোবাসতে পারবা না? কেন বলছ না, বলো? এখনো সময় আছে বলো, বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছি। এখনি দিচ্ছি।”
“না।” আঁতকে উঠে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো ত্রয়ী। চোখমুখ রক্তশূণ্য হয়ে এলো নিমিষেই। বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।
লোকটা যে এতটা ভুল বুঝবে, ভুল বুঝে বিয়েটাই ভেঙে দেবে সেটা ধারণাতীত ছিল যেন।
ওর মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাকাসে হয়ে আসা চেহারা, কাঁপা কাঁপা হাত, কাঁদো কাঁদো চোখের এলোমেলো দৃষ্টি জানান দিচ্ছে ও খুব বেশি ঘাবড়ে গেছে।
আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হয়তো বেসামাল হয়ে কেঁদেই ফেলবে।
“কী ‘না’?” শক্ত কণ্ঠের হালকা ধমকে চমকে উঠলো ত্রয়ী।
“তুমি না পারলে বলো, আমিই বলে দিচ্ছি। নিচেই তো আছে সবাই। যেহেতু তোমার বলতে ভয় করছে, সেহেতু আমি নিজে গিয়েই বলছি বরং যে বিয়েটা আসলে আমি করতে চাচ্ছি না। সেক্ষেত্রে তো কোনো দায়-ই থাকবে না তোমার।” বলেই যেতে উদ্যত হতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো যেন ত্রয়ীর। হুড়মুড়িয়ে হাত টেনে ধরলো ও।
ব্যস্তভাবে তীব্র আশঙ্কায় পূর্ণ, ভেজা কণ্ঠে বলল, “এসব কী বলছেন আপনি! দয়া করে বিয়ে ভেঙে দিয়েন না। আমি তো বলেছি বিয়েটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই আমার। আমি তো মেনেই নিয়েছি। বিয়েটাকেও আর আপনাকেও। তবুও কেন এমন করছেন!”
“যাতে তুমি সবটা নিজ মুখে স্বীকার করো।” বলতে বলতে ফিচেল হাসি দিয়ে দুষ্টুমি মাখা চাহনিতে তাকালো নীল।
থমথমে মুখটার রাতারাতি পরিবর্তনে পুরোদস্তুর বোকা হয়ে গেল ত্রয়ী। সদ্য অশ্রুতে টলমলে হয়ে ওঠা চোখটা অবিশ্বাস্য, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ থমকে রইলো নীলের মুখপানে।
পুরো বিষয়টা বুঝে আসতেই ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে গেল আপন শক্তিতে।
হাসিটা প্রশস্ত হতেই অনুরণিত হলো ত্রয়ীর চোখের পাতা। ঝট করে হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো ও।
লোকটা নাটক করছিল! ভারি সাংঘাতিক তো!
(চলবে…)