কনে বদল পর্ব ১২
একজন মানুষ হাত দেখে কিছু একটা বলেছে তা শুনে নীরুর মতো স্মার্ট মেয়ে এত ঘাবড়ে গেল! নীরুর অবস্থা দেখে সবাই খুব মজা পাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না নীরুর এত ভয়ের কি আছে?
সাধু নীরুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “সাবধান হয়ে যা।”
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল নীরু, “কীসের বিপদ বাবা?”
“তোর সামনে ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে।” বলেই সে চক্ষু বন্ধ করে ফেলল। নীরুর হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে! ও দ্রুত আসর ছেড়ে রুমে চলে গেল! সবাই মনে হয় খুব মজা পেয়েছে!
সবাই এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এই সাধুর বিশেষ ক্ষমতা আছে।
আমার এখন উচিৎ রুমে গিয়ে নীরুকে সান্ত্বনা দেয়া, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। সাধুর কর্মকান্ড দেখতে বেশ ভালো লাগছে!
এখন আরেকটা মেয়ে সাধুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাধু তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেয়েটা অনুরোধ করল,” বাবা আমার হাতটা একটু দেখেন না।”
হাতের ইশারায় মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে বললেন। সবাই এখন সাধুর দিকের চেয়ে আছে। তারপর তিনি হরহর করে মেয়েটির নাম-ঠিকানা, কিছু ঘটনা বলে দিলো। মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে সাধুর দিকে চেয়ে আছে! মানে সাধুর কথা সব মিলে গেছে!
মানুষকে আল্লাহ কোনো ক্ষমতা দেননি যা দিয়ে সে ভবিষ্যতে বলে দিতে পারবে। এ সব সাধুরা যা করে এরা খুব শান্ত হয়ে মানুষ কে পর্যাবেক্ষন করে। একজন মানুষ সুখে আছে তা তার দেহে প্রকাশ পায়। আবার কষ্টে থাকলেও তা প্রকাশ পায়। শারীরিক ভাষা দেখে সাধুরা গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে অনুমান করে একটা কিছু বলে দেয়। সেই কথাটাও থাকে একটু রহস্যময়!
রুমে ফিরে দেখি রুমের বাতি বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে আছে নীরু! পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ” তুমি এসব বিশ্বাস করো নাকি?”
“না, বিশ্বাস করি না। ওনার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠায় একটু খারাপ লেগেছিল তাই চলে এসেছি। “
এ জিনিসটা আমার মাথায় আসেনি! আমি ভেবেছিলাম নীরু ওনার কথায় ভয় পেয়েছে! এখন আমার খারাপ লাগছে নীরুকে বুঝতে পারিনি বলে!
“নীরু চলো সাগর পাড়ে যাই। “
“একটু অপেক্ষা করো আসছি,” নীরু উঠে দাঁড়াল। বাথরুম থেকে নীরু হয়ে আয়নার সামনে দাড়াঁল। নীরুর এ ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। রাতের বেলা কে ওকে দেখবে? তবুও বাহিরে যাওয়ার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়া।
আকাশ বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে, চাঁদের আলোতে বালি কেমম চিকচিক করছে! আমি নীরু কিছুক্ষণ সাগরের পাড়ে হাটঁলাম। সাগরের শো শো শব্দ শুনা যাচ্ছে। কেমন একটা হালকা বাতাস গায়ে এসে লাগছে। পুরো শরীর শীতল হয়ে যায়। দেহের সাথে মনটাও কেমন চাঙ্গা হয়ে গেছে! নীরু কে এখন আর চিন্তিত মনে হচ্ছে না।
নীরু একটু মিষ্টি হেসে বলল, “ধন্যবাদ। এত সুন্দর একটা মুহূর্তে উপহার দেয়ার জন্য। “
“তোমাকেও ধন্যবাদ নীরু। তুমি পাশে না থাকলে সময়টা এত সুন্দর হয়ে উঠত না।”
আমরা সাগরের অনেকটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। কী বিশাল একেকটা ঢেউ দেখলে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়! ঢেউয়ের পানি পায়ে এসে পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঢেউ যখন চলে অনেকটা জায়গা শুকিয়ে যায়। ঢেউয়ের পানি ধীরেধীরে বাড়ছে।
নীরু বলল, আসো বসি।”
পাড়ে কাঠের কতগুলো চেয়ার আছে। চেয়ারগুলো অনেকটা ইজিচেয়ারের মতো ইচ্ছে করলে শুয়ে থাকা যায়। চেয়ারগুলো ভাড়া নিল ঘন্টায় পঞ্চাশ টাকা।
দুটো চেয়ার পাশাপাশি করে লাগিয়ে নিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। আকাশে ইয়া বড়ো চাদ, সমুদ্রের গর্জন, মৃদু হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। হালকা শীত শীত লাগছে, কী যে ভালো লাগছে! ঠিক বলা যায় না।
“নীরু তুমি আগে কখনো সাগর দেখেছ?”
“হুঁ, বাবার সাথে একবার কক্সবাজার এসেছিলাম। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। হুট করে একদিন বাবা বললেন, ” আমরা কক্সবাজার যাব।” এরপর থেকে আমাদের দুইবোনের চোখে ঘুম নাই। টিভিতে সমুদ্র দেখিছি, কী বিশাল বিশাল ঢেউ।
ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে আসলাম চট্টগ্রাম। সেখান থেকে বাস ধরে সোজা কক্সবাজারে পৌঁছলাম। আমাদের কোনো হোটেল বুকিং দেয়া ছিল না। বাবা কয়েকটা হোটেল ঘুরে একটা পছন্দ করল।
হোটেলে উঠেই দেখা হলো বাবার এক কলিগের সাথে ওনারও ঘুরতে এসেছেন। উঠেছেন আমাদের পাশের রুমে।
পরেরদিন সকালে উঠে চারুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! বাবা তো চিন্তয় অস্থির! আশপাশের সব জায়গায় খুঁজা হলো কোথাও নাই!
বাবার কলিগরা রুমে নাই ওনারা খুব ভোরে বের হয়ে গেছেন। মা বলল, “মনে হয় ওনাদের সাথে গেছে।”
“বাবা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সারাটাদিন গেল দুশ্চিন্তার মধ্যে। ঘুরাঘুরি খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ। সন্ধায় ওনাদের সাথে ফিরে এলো চারু! তুমি এসেছিলে কখনো?”
” একবার বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম। আমরা ছিলাম গ্রামের ভিতরে একটা ছোটো রিসোর্টে। এস এস সি পাশ করার পর বন্ধুদের চলে এসেছিলাম। মাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম মার তো সময়ই হয় না। মা কত ব্যস্ত থাকে।”
রাত কয়টা বাজে জানি না, মনে হয় অনেক রাত হয়েছে। আমরা ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছোট কিছু ছেলেরা আছে ওরা চেয়ারগুলো ভাড়া দেয়।
নীরু বলল,” চলো রুমে যাই অনেক রাত হয়েছে। “
হেঁটে হেঁটে রিসোর্টে আসলাম। রাতের নিস্তব্ধতায় অনেকটা দূর থেকে সাগরের শো শো শব্দ শুনা যায়। শব্দটা মনের মাঝে কেমন একটা ভালো লাগা সৃষ্টি করে।
রিসোর্টে ঢুকেই নীলা আপুর সাথে দেখা হলো। আমাদের দেখে সামনে এগিয়ে এসে বলল, “তোরা কোথায় গেছিলি?”
“বিচে গেছিলাম।”
“রাতের বেলা বিচটা খুব সুন্দর লাগে তা-ই না? “
“হ্যাঁ আপু অসম্ভব সুন্দর! ভাইয়া কোথায়? “
“তোর ভাই এখন স্বর্গে আছে। নেশা করে সে কি আর দুনিয়ায় আছে! কেন যে এ সব ছাইপাঁশ গিলে বুঝি না!”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে নীলা আপা চলে গেলেন রুমে।
পরেরেদিন সকালে নীরুর নতুন এক জোড়া জুতা খুঁজে পাওয়া গেল না! নীরু কেমন অস্থির হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোনো একটা ভয় ওকে আঁকড়ে ধরেছে। আমি বুঝলাম ও যতই অস্বীকার করুক। সাধুর কথায় ওর মাঝে একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে!
এটা খুবই অদ্ভুত একটা ঘটনা। এমন রিসোর্ট থেকে এক জোড়া জুতা উধাও! রুমের অন্য কিছুতে হাত দেয়নি শুধু জুতা জোড়া নেই! জুতা জোড়া যে খুব দামি তাও না। এটা নীরু কক্সবাজার থেকে শখ করে কিনেছিল।
——–
ইলিয়াস সাহেব অফিসে নাহার বেগমের সামনে খুব একটা যান না। তার বোনটা অফিসে আসলে কেমন কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু নাহার বেগম অফিসে ঢুকেই ইলিায়ছ কে খোঁজ করেছেন।
ইলিয়াছ সাহেব বড়ো আপার রুমে উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, ” আসব আপা?”
“কে ইলিয়াছ ভিতরে আয়।”
একটা চেয়ার টেনে আপার সামনে বসে বললেন, “খবরটা শুনলাম আপা। অনেকদিন থেকে তো আমরা চেষ্টা করছিলাম কাজটা পাওয়ার জন্য।”
“হ্যাঁ, আমাদের কোম্পানির জন্য একটা খুব ভালো একটা সফলতা।”
“জি, আপা।”
“তুই এক কাজ কর। রায়হানের বউভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ব্যবস্থা কর। আমি চাচ্ছি বড়ো করে করতে যেন সবাইকে দাওয়াত দেয়া যায়।”
“ঠিক আছে আপা। তুমি কোনো চিন্তা করো না। ওদের কি খবর? “
“ওরা আছে ভালোই। সেইন্ট মার্টিন আছে এখন। আমি তো একটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ছেলেটা আবার তোর এমন কাজে আবার না বেঁকে বসে।”
“তুমি কি বলো আপি! আমাদের রায়হান ওমন ছেলেই না। এ যুগে এমন সোনার টুকরো ছেলেই হয় না।”
“আমার নরম ছেলটার জন্য এমন একটা মেয়েই দরকার ছিল।”
———–
আমজাদ সাহেবের মনখারাপ! একটু নয় ভীষণ রকমের মনখারাপ। তিনি আজ চারুর হলে গেছেলেন দেখা করতে। হলে গিয়ে উনি জানতে পারলেন চারু হল ছেড়ে দিয়েছে! মেয়েটা হল ছেড়ে দিলো অথচ তিনি কিছুই জানলেন না!
আনোয়ারা কে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। মানুষটা সাধারণ ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মন খারাপ বা রাগ করে না। অনেকক্ষণ ধরে সে ঝিম মেরে বসে আছে। অন্য সময় বাহির থেকে এসে এক কাপ চা চায়। আজ নায়লা কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরও চা চায়নি!
ব্যাপারটা বড়ো কিছু না। কিন্তু আনোয়ারা চিন্তিত তার ধারনা মানুষের পরিবর্তন খুব ছোট কিছু থেকে শুরু হয়। দুটি মেয়ে ছিল তার কলিজার টুকরো। আজ দুইজনের একজন কাছে নেই! চারু সপ্তাহে একবার হলেও বাড়িতে আসে। এ সপ্তাহে একবার আসেনি। চারুর নাম্বারটাও বন্ধ! চারুকে নিয়ে কি ওনার মন খারাপ?
হাতে এক কাপ চা নিয়ে এসে আনোয়ারা বললেন, “এমন করে বসে আছেন কেন! শরীরটা খারাপ লাগছে?”
একট গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, ” না শরীর ঠিকই আছে।”
“কই দেখি”কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে আনোয়ারা।
আনোয়ারা এ কাজটা প্রায়ই সময় করে। ব্যাপারটা ছেলে মানুষী হলেও আমাজাদের ভালো লাগে। তার সামান্য কিছু হলেই কি করে যেন আনোয়ারা টের পেয়ে যায়।
আনোয়ারার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দেয়,” কী দেখলে?”
“জ্বর তো নাই। শরীর তো বরফের মতো ঠান্ডা। এত ঠান্ডা কেন! আপনার কি খারাপ লাগছে?”
“আমার কিছু হয়নি তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। শান্ত হয়ে বসো এখানে।”
আমজাদ সাহেবের পাশে গা ঘেঁষে বসেন আনোয়ারা।
“আমরা কি কোনো ভুল করেছি আনু?”
হতবাক হয়ে মানুষটার চোখের দিকে তাকায় আনোয়ারা। চোখের কোনে কেমন জল জমেছে!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ