কনে বদল পর্ব ১৪
উদাস মনে চারু জিজ্ঞেস করল, “কেন মাধবীলতার সাথে কথা হয় না বুঝি?”
“না রে মা। মেয়েটা আমার সাথে রাগ করে যোগাযোগ করে না!”
“কেন !”
“ও চায় আমি ওদের ওখানে থাকি। আমার যে নিজের দেশে থাকতেই ভালো লাগে। এটা ওরা বুঝতে চায় না! এ বয়সে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না রে মা।”
“ওদের দেশে আসতে বলেন।”
“সেকি আর আসে। ওদের তো আর দেশের প্রতি টান নাই! ওরা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। ছোটো একটা নাতি হয়েছে সে তো সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলে। শুনলেই কেমন বিদেশি বিদেশি মনে হয়! মাটির গন্ধ নেই ওদের মাঝে! “
চারু কিছু বলছে না। সে ভাবছে সব মানুষের নিজস্ব কিছু দুঃখ থাকে! এই মানুষটার সব আছে তবুও তার দুঃখ আছে, কষ্ট আছে!
“তোমার বন্ধু কে দেখছি না?”
“ও অফিসে গেছে।”
“কীসে যেন জব করে?”
“ডেইলি স্টার পত্রিকায়।”
“গুড, তা তুমিও কিছু একটা শুরু করো। এখনি সময় জীবনটা গুছিয়ে নেয়ার।”
“জি, আমি এমনটাই ভাবছি।”
শোন, আমার বাবা বলতেন, “
গরীবের বড়ো হওয়ার সহজ পথ হলো পড়াশোনা করা। বাই দ্যা ওয়ে তোমার কফিটা খুব ভালো হয়েছে! আমার মেয়ের চেয়েও ভালো।”
একটু লজ্জিত হাসি দিয়ে চারু বলল,” ধন্যবাদ।”
“তা তোমার মনটা এখন ভালো হয়েছে? “
আপনার সাথে গল্প করে ভালো লাগছে!”
“তুমি মনে হয় একটু বেশি চাপ নিচ্ছ মা। জীবনটা এত কঠিন কিছু না। জীবন খুব সহজ! আমরা একে জটিল করে তুলি। এত ভেবোনা। জীবনে একটা লক্ষ্য ঠিক করো তা পাওয়ার পথ জানো আর টুকটুক করে এগিয়ে চলো বাস।
দ্যাখ পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নাই যা করা হয়নি? খুঁজে দেখ তুমি যা করতে চাও তা তোমার আগে অনেকেই করেছে। তাদের দেখে শিখ আর করে ফেল, এত চাপ কেন নিবে! জীবন হলো আনন্দের জায়গা , জীবনে বোকারা থাকে কষ্টে! মুখলেছ সাহেব হাসছেন।
চারু ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষটা নিজেই তো তার কথা মতো সুখি না। না-কি উনি সুখেই আছেন চারু ধরতে পারছে না!
“কি রে তুই এমন ঘরবন্দী হয়ে আছিস কেন? নাম্বার বন্ধ করে রেখেছিস!” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কাজল বলল।
“মোবাইল চালাতে ভালো লাগে না! “
“দ্যাখ তোরে বি সি এস দিতে আমরাই বলেছিলাম। তুই তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিস ভালো কথা। তারমানে তো এই না, সব কিছু বাদ দিয়ে দিতে হবে! তুই এতটা ডুবে যাচ্ছিস, যদি কোনো কারনে না হয় তখন তো হতাশ হয়ে পড়বি!”
“এমন কিছু আমি ভাবছি না। আমার ভাল লাগছে না তাই বের হচ্ছি না।”
“জীবন এমন করে চলে না চারু। জীবনে সব কিছু নিয়ে চলতে হয়। না হলে ভালো কিছু পেয়েও এমন কিছু হারিয়ে ফেলবি যার কাছে তোর অর্জন কিছুই না। আজ বেশি লেকচার দিচ্ছি মনে হয়, কারন বস মাথা ভারি করে দিয়েছে, কিছুটা তোকে দিয়ে হালকা করলাম।”
“কেন তোর বস বুঝি খুব ঝারে?”
“দুনিয়ার সব বসই ঝারে! বসদের জন্মই হয় অন্যকে বাশ দেয়ার জন্য বুঝলি। “
“যা এখন বাশের আলাপ বাদ দিয়ে গা ধুয়ে আয়। “
“তুই কি রাতের রান্না করেছিস নাকি?”
“হ্যাঁ করেছি।”
লক্ষীসোনা আমার! তোর জন্য একটা অফার আছে। রহস্যময় হাসি হাসছে কাজল।
“কি অফার রে?”
“বলব আগে খেয়েনি তারপর —“
কৌতূহল জাগে চারুর জানার জন্য। সে জানে কাজল ময়েটা বড্ড কাঠকাঠ ধরনের কোনো আবেগ টাবেগ নাই! যা বলেছে তাই করবে। তাই অনুরোধ করেও লাভ নাই।
————-
বিয়ে বাড়ি আর মরা বাড়ির মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই বিয়ে বাড়িতে মানুষের মুখে হাসি থাকে আর মরা বাড়িতে মুখখানা মলিন। এ ছাড়া ঝামেলা দুই বাড়িতেই প্রায় সমান।
নীরুদের বাড়িতে এসেছি তিনদিন হয়েছে। এখন নীরু অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়। ওর চোখমুখ ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সবচেয়ে বেশি ভয় ছিলো ওর মা আনোয়ারা বেগম কে নিয়ে। উনি শোকটা মোটেই মানিয়ে নিতে পারছেন না! শোকটা মেনে নিতে পারলে কেঁদে-কেটে হালকা হওয়া যায়।
মা আর মামা চলে গেছেন পরেরদিন। নীলা আপু ও লীটন ভাইকে মা সাথে করে নিয়ে গেছেন। যাওয়ার আগে মা আমাকে ডেকে বললেন, “তুই কিছুদিন এখানেই থাক। তোর শাশুড়ি স্বাভাবিক হলে পরে আসিস। “
মা হয়ত আজ একবার আসবেন। আজ আমার শশুরের মিলাদ হবে।
আমি এখন এসেছি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চারুর খোঁজে। নীরুই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, “চারু কে কেউ খবর দেয়নি কেন! আমার বোনটাকে কেউ খবর দাও।”
বাড়িতে আর কে আছে? আমিই আসলাম খবর দিতে। হলে এসে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়েছে। আমি সাধারণত মানুষের ওপর খুব একটা রাগ করতে পারি না। এ মেয়েটার ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে!
হল ছেড়ে চলে গেছে! কেউ বলতে পারে না কোথায় আছে! কারো কাছে নাম্বার নাই! আগে যে নাম্বারটা ব্যবহার করত সেটা বন্ধ। একটা মানুষ এতটা খারাপ হয় কি করে!
অনেক সময় ধরে একটা ছেলে পিছু নিয়েছে! মনে হয় ইউনিভার্সিটির ছাত্র হবে। কিছু বলতে চায় নাকি ঠিক বুঝতে পারছি না। টি এস সিতে দাঁড়িয়ে আছি এখন। ছেলেটা এবার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি না দেখার ভান করলাম। ছেলেটা বলল, “আপনাকে অনেকক্ষন থেকে ক্যাম্পসে ঘুরতে দেখছি, কাউকে খোঁজ করছেন? “
“জি, একজন কে খুঁজছি।”
“নাম বলেন দেখি খবর দিতে পারি কি-না।”
“আপনি বুঝি ইউনিভার্সিটির সবাইকে চিনেন!”
“সবাইকে চিনি না। আপনি যাকে খুঁজচ্ছেন তাকে মনে হয় চিনি।”
বিরক্ত লাগছে ছেলেটাকে গায়ে পড়ে কথা বলা আমার পছন্দ না। এদের সাথে ঝামেলায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। একটু হাসার চেষ্টা করলাম। তাই নাকি! তা কি করে বুঝলেন আমি কাকে খুঁজি?”
“আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন? আমি লিটন। চারুর সাথেই পড়ি। আপনাকে দেখলাম ওর হলে গিয়ে খোঁজ করতে চাই একটু কৌতূহল হলো।”
“না না ঠিক আছে। আমি রায়হান। “
“আপনি রায়হান! আপনার নাম শুনেছি।”
“তা চারুর কোনো খবর জানেন? “
“জানি না ভাই। কাজল আর ও হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে! কারো সাথে যোগাযোগ নাই!”
“আচ্ছা লিটন ভাই ভালো থাকবেন কেমন।”
ফেরাস্তার মতো একজন মানুষ না হয় তোর বিয়ে ঠিক করেই ফেলেছিল। তা তুই বলতে পারতি এ বিয়েতে তোর মত নেই। না উনি বিয়ের আগেরদিন চম্পট মারলেন। মামাকে নাকানিচুবানি খাওয়ালেন! এখন আবার লাপাত্তা হয়েছেন!
বাপ হলেও এমন মেয়েকে জীবনে ক্ষমা করত না। অথচ এ মানুষটা নাকি হলে এসে এ মেয়ের সাথে দেখা করেছেন! এবং বাড়িতে নিতে চেয়েছেন। মেয়ে যাইনি!
কোথায় ওনারা রাগ করবে তা না। মেয়েই উল্টো রাগ করে হল ছেড়ে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে!
একদিন শুনবে মামা আর নেই সেদিন হয়ত ভেউ ভেউ করে কাদঁবে! তাতেই মনে হয় সব মাফ হয়ে যাবে!
এমন একটা মেয়েকে আমার ভালো লেগেছিল ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে! সত্যি মা ঠিকই বলেছিল। নীরু অনেক বেশি দায়িত্বশীল। যার জন্য ওর এতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে! এ বিপদের সময় ওকে খবর দেয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠেছে!
মা-মেয়ে একজনও এসবের জন্য চারুকে দায়ী করেনি!
অন্য কেউ হলে চারুকেই দায়ী করত সব কিছুর জন্য।
চারুকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কিছু না। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। অপরাধির মতো ওকে খুঁজে বের করে ওর প্রিয় মানুষের মৃত্যুর খবর দিতে। ও যখন সবার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়। ওকে কেন বিরক্ত করব! থাকুক নিজের মতো।
আমার এখন চিন্তা হচ্ছে নীরুর মাকে নিয়ে। উনি কি করে থাকবেন। আমাদের বাড়িতে নিয়ে নেয়া যায়। উনি যে ধরনের মানুষ মনে হয় না যেতে রাজি হবে। প্রস্তাবটা নীরুকে দিয়ে দিতে হবে। আমি দিলে একটু অপ্রস্তুত হতে পারেন।
নীরুদের বাড়িতে আর কয়দিন থাকতে হবে জানি না। ওদিকে অফিসে মায়ের ওপর অনেক চাপ যাচ্ছে! দ্রুত অফিসে যাওয়া দরকার।
বিশাল মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। এ সব আমার মা করেছেন। আমার শাশুড়ী এত বড়ো আয়োজন করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মায়ের জোরাজোরিতে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন।
নীরুও আমাকে বলল,”ছোটো করে মিলাত পড়ালেই হতো।”
আমি বুঝতে পারছি মা চাচ্ছেন একটা অনুষ্ঠান করতে। আমাদের বউভাত তো আর করা সম্ভব না।
একটা কমিউনিটি সেন্টার খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। খাবার আইটেমও বেশ কয়েক প্রকার করা! ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে আমার কাছে।
মামাকে বললাম,” এতটা করা কী ঠিক হলো মামা?”
“আঃ! বুঝোস না কেন? বুবু চাচ্ছেন পার্টনারদের কে তোর বিয়ের খবরটা জানাতে। একটা অনুষ্ঠান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। “
আজ প্রথম শাশুড়ির সাথে স্বাভাবিক আলাপ হলো। এ কয়দিনে ওনার বয়স মনে হয় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে! অনেকটা শুকিয়ে গেছে! খুব ক্লান্ত লাগছে দেখতে। আমাকে বললেন, “বাবা শোন।
“জি,”
তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা?”
“না তো কোনো কষ্ট হচ্ছে না।”
“তোমার জন্য কিছুই করতে পারছি না বাবা।”
আমি খুব অবাক হলাম, এমন পরিস্থিতি উনি আমাকে নিয়ে ভাবছেন! ওনার দিকে গভীরভাবে তাকালাম। চোখগুলো কেমন ছোট ছোট হয়ে গেছে! চোখে কী মায়া! আমি বললাম, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই আছি। আপনি নিজের দিকে একটু নজর দিন তো।”
কেমন একটু হাসি দিলেন। সে হাসিতে প্রাণ নেই! দুইজন পায়ে পায়ে ওনাদের বাগানে আসলাম। হাত ধরে বসালাম। উনি আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে! এ চোখ দেখলে ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
দরাজ গলায় বললেন, “চারুর কোনো খবর পেয়েছ বাবা?”
“না ওকে পাওয়া যায়নি! “
“মেয়েটা কেন যে এমন করল! কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে!”
“আপনি এত ভাববেন না ঠিক পেয়ে যাব।”
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন! “বাবা তুমি কিছু মনে করো না কেমন? নীরু আমায় বলেছে, তুমি চাও আমি তোমাদের সাথে থাকি। আমি বাবা এ বাড়ি ছেড়ে থাকতে পারব না। মানুষটার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে বাড়ি জুড়ে। এখানেই আমি ভালো থাকব।”
“আপনি একা একা থাকবেন! “
“তোমরা আমায় নিয়ে ভেবো না বাবা। নায়লা কে নিয়ে আমি থাকতে পারব।”
“ঠিক আছে আম্মা আপনি যেমন ভালো মনে করেন।”
মনে পড়ে আমজাদ সাহেবের কথা। কী আন্তরিক হাসি দিয়ে মানুষটা কথা বলতেন! সবসময় একটা হাসি ওনার ঠোঁটে লেগেই থাকত। মানুষ কেমন করে চলে যায়!
এ সময় নীরু হাজির হলো হাতে একটা ট্রেতে চা বিস্কিট নিয়ে। ছোটো টেবিলে ট্রেটা রেখে মায়ের গা ঘেঁষে বসল। একটু জড়িয়ে ধরে বলল,” তুমিও চলো না মা আমাদের সাথে। কিছুদিন থেকে না হয় চলে এসো।”
উনি মেয়েকে একটু কাছে টেনে বললেন, “সে না হয় যাবো নে। তোরা গিয়ে একটু গুছিয়ে নে।”
“তুমি চা নেও বাবা” নীরু চায়ের কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“আপনিও নেন আম্মা।”
আমার তো চা খাওয়ার অভ্যাস নেই বাবা। চা খাওয়ার মানুষটা তো — একটা গভীর শ্বাস ছাড়লেন। ওনার মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল!
আমার ছোটো বোন রুবিনা হেঁটে হেঁটে বাগানে এসে আমার পাশে বসল। ও মিলাদের সময় এসেছিল আর যায়নি। আমাদের সাথেই ফিরবে বলে।
“ভাবি তোমাদের বাগানটা বেশ সুন্দর! “
“হ্যাঁ বাগানের গাছগুলো সব বাবার হাতে লাগান। বাবা খুব সৌখিন ছিলেন।”
আমাদের বাড়িতে এসেছি আজ। না আমার শাশুড়ি আমাদের সাথে আসেননি।
চলবে —
® নাবিল মাহমুদ