কনে বদল পর্ব ১৫
নীরু কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলাম। আমাদের সংসার জীবন শুরু হলো। নীরু আমাদের সংসারটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে একটু একটু করে। আমার মা ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত থাকে তাই পুরো সংসারের দায়ভার ওর ওপরেই।
অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। আমাদের অনেকগুলো ব্যবসা আছে। মূল ব্যবসা কাপড়ের। দুইটা গার্মেন্টস আছে গাজীপুরে।
এছাড়া কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা আছে। এটা আমি দেখি মা কাপড়ের ব্যবসাটা দেখেন।
নীরু আসার পর থেকে রুবিনার পড়াশোনাটা বোধহয় ভালোই উন্নতি হয়েছে। মা বরাবরই নীরুর ওপর খুশি। মনে হয় নীরুর মাঝে মায়ের মতো গুন রয়েছে!
সকাল সকাল মামা এসেছেন বাসায়। এসেই নীরুকে ডাকাডাকি শুরু করলেন, ” কই, আমার বউমা কই?”
নীরু আজ মেরুন রংয়ের একটি শাড়ি পরেছে। ওকে সব পোশাকে দারুণ মানায়! এ শাড়িতে মনে হয় একটু বেশি সুন্দর লাগছে! হাসতে হাসতে নীরু মামার কাছে এলো।” কেমন আছেন মামা?”
“খুব ভালো আছি রে মা। তোদের জন্য আজরাইল আমার ধারে কাছে আসবে না।”
“কেন আসবে মামা! আপনি অনেক বছর আমাদের মাঝে থাকবেন। “
“বুবু কোথায়?”
“আম্মা রুমে আছেন। চা খাবেন মামা?”
“চা খাওয়া যায়। তোমার হাতের পিঠা খাবো আজ।”
আমি বললাম, “মামা তোমাকে না ডাক্তার মিষ্টি খেতে নিষেধ করেছে?”
“রাখ তোর ডাক্তার। বউমার হাতের পিঠা খেলে সব রোগবালাই পালাবে।” মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।
“কি ব্যাপার মামা তোমাকে আজ বড্ড খুশি খুশি লাগছে?”
“তাই নাকি? সত্যি লাগছে বুঝি? “মামা রহস্যময় হাসি হাসছেন।
“কিছু আছে মনে হয়? “ঝেড়ে কাশ তো মামা।
“না রে তেমন কিছু না। “
“তোমার মুখ বলছে অন্য কথা।”
“তুই আজকাল গোয়েন্দা টোয়েন্দা পড়িস নাকি রে?”
“কথা ঘুরাচ্ছ মামা। ঘটনা কি খুলে বলো।”
কোনো ভালো খবর থাকলেই মামা এমন করে। মনে হয় কিছুতেই খবরটা বলবেন না। কিন্তু একটু পরেই নিজেই সব বলে দিবেন। মামার বেশিরভাগ সংবাদ থাকে অফিস সংক্রান্ত। আজও মনে হয় তেমন কিছু হবে। মামার এসব খবর শুনতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু খবরটা দেয়ার পর মামার চেহারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে যায়। মামার সেই হাসিমাখা মুখ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে!
নীরু চা নিয়ে হাজির হলো। চায়ের কাপ মামাকে দিয়ে পাশে বসতে বসতে বলল, “কোনো বড়ো খবর আছে মনে হয় মামা?”
মামা রহস্যময় হাসিটা হেসে বলা শুরু করেন। নীরু কৌতূহলী হয়। আমিও মনোযোগী হওয়ার ভান করি।
মামা অনেক পুরনো একটা বিল পাওয়ার খবর শুনায়। যে বিলটা পাওয়ার আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম। অসাধ্য সাধন করেছেন মামা। আমি মুগ্ধ হয়ে মামার দিকে চেয়ে থাকি!
হুট করে এসেছি নীরুদের বাড়িতে। আমি প্রায়ই এখানে চলে আসি। নীরুকেও বলি না এখানে আসার কথা। আমার খুব ভালো লাগে। নীরুর মায়ের হাসি হাসি মুখখানা দেখতে বড়ো ভালো লাগে!
দরজা খুলে আনোয়ারা বেগম কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। মুখে আন্তরিক হাসি দিয়ে বললেন,” কেমন আছ বাবা?”
“জি, ভালো আপনার শরীরটা এখন কেমন?”
“ভালো। এসো ভিতরে এসো।”
“এ দিকে একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবলাম আপনাকে একটু দেখে যাই।”
“খুব ভালো করেছ বাবা।”
আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কী খেতে দিবেন ভাবনায় পড়ে যান। আমি কাছে গিয়ে বলি। কিছুই করতে হবে না। আপনি আমার সামনে শান্ত হয়ে বসেন তো। উনি বসেন মনে হয় শান্ত হতে পারেন না!
নায়লা এসে বলল, “কেমন আছেন দুলা ভাই?”
একটু হেসে বললাম,” ভালো, তুমি কেমন আছ? “
“ভালো আছি।” মেয়েটা বেশ ভালো! আম্মার জন্য এখন এমন একটা মেয়ের খুব দরকার ছিলো।
” স্কুলে যাও নিয়মিত? ” আম্মা নায়লা কে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন।
কেমন লাজুক হাসি দিয়ে বলে, “জি।”
“যা তো মা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।” নায়লা দৌড়ে চলে যায়।
“তোমার মা কেমন আছে বাবা?”
“মা খুব ভালো আছে। আপনি তো গেলেন না দেখতে!”
“যাব বাবা”
নায়লা চা আর পিঠা নিয়ে এসেছে। আমি মাঝে মাঝে আসি তাই মনে হয় আম্মা পিঠা বানিয়ে রাখেন। আমি আম্মার জন্য বাজার করে দিই। উনি একটু মুখে শুকনো হাসি দিয়ে বলেন, “এ সব কেন আনো বাবা?”
“মা ছেলে কে বাজার করে না দিলে কে দিবে?”
ওনার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে! এ হাসিটা দেখতে আমার ভালো লাগে!
দুপুরে রান্না হয়ে গেছে। আমার জন্য আবার রান্না করতে চান আম্মা, আমি বাধা দিই। উনি একটু লজ্জিত হয়ে বলেন আজকের রান্না তেমন ভালো না বাবা।
রান্নার আইটেম খারাপ না। আলু ভর্তা,বেগুন ভাজি, মসুরের ডাল ভুনা আর ডিম ভাজি। দারুণ আয়োজন। খুব মজা করে খাচ্ছি।
আম্মা পাশে বসে আমার পাতে খাবার তুলে দিয়ে বলেন, “একটু আগে খবর দিলে ভালো কিছু রান্না করতে পারতাম। খুব কষ্ট হচ্ছে খেতে না?”
“না, না দারুণ লাগছে খেতে!”
উনি মিষ্টি করে হাসেন।
রাতে সবাইকে খাইয়ে নীরু রুমে আসে। আমি শুয়ে আছি। নীরু এসে আমার বুকের ওপর শুয়ে আমার মাথার চুল হালকাভাবে আঙুল দিয়ে টানতে টানতে বলল, “আজ বুঝি মায়ের ওখানে গিয়েছিল? “
হ্যাঁ, অদিকে একটা কাজে গিয়েছিলাম। তা-ই আম্মার সাথে দেখা করে আসলাম। নীরু আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। হাসির মানে কি? আমি বুঝি তুমি আমার মায়ের সাথে দেখা করতে গেছিলা।
নীরু কিছু বলে না। আমাকে জড়িয়ে ধরে আলত করে চুমু দেয়। এটা খুশির আদর! এই আদরটা বড্ড ভালো লাগে! ওই আদরের চেয়ে বহুগুন বেশি আনন্দ দেয় এটা!
আদুরে কন্ঠে নীরু বলে,” এই শুনো আম্মা আমাকে আগামীকাল অফিসে যেতে বলেছেন! “
“তা-ই নাকি?”
নীরুর কপালে কেমন চিন্তার ছাপ! “হঠাৎ কেন অফিসে দেখা করতে বললেন? “
“এত ভাবছ কেন! মনে হয় তোমার সাথে অফিসিয়াল কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করবেন। মা আবার অফিসের আলোচনা বাসায় করেন না।”
“কখন যেতে হবে কিছুই তো বললেন না!”
“সকালে রেডি থেকো আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
———–
কাজলের প্রস্তাবে চারু একটা টিউশনির জন্য এসেছে। একটা মেয়েকে পড়াতে হবে। মেয়েদের বাসায় এসে চারু হকচকিয়ে গেছে! মানুষ এত বড়লোক হয়! বসার রুমটা একটা ছোটোখাটো মাঠের মতো বিশাল! কী সব সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। মুগ্ধ হয়ে সব দেখছে চারু।
সোফাসেটগুলা কী নরম! বসলে মনে হয় তলিয়ে যাবে।
বসার কিছুক্ষণ পরেই একটা কাজের মেয়ে নাস্তা দিয়ে গেল সামনে। মেয়েটা চারুর সাথে কোনো কথা বলল না। একবারের জন্য চারুর দিকে তাকাল না! মেয়েটা মানুষ না রোবট? চারু বুঝতে পারে না।
চারুর কেমন অস্বস্তি লাগছে বসে থাকতে। পাশেই অনেক ধরনের ম্যাগাজিন দেখা যাচ্ছে। চারু একবার ভাবে ম্যাগাজিন নিয়ে দেখবে কিন্তু নেয় না। কেমন সংকোচ বোধহয়!
একজন সুন্দরী মহিলা আসলেন। দেখে মনে হয় বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। নীল রংয়ের একটা শাড়ি পরেছেন। মহিলা বেশ লম্বা । চারুর বিপরীত পাশে বসে বললেন, “তুমিই চারু?”
“জি।”
“কিছু মনে করো না। তোমাকে তুমি করে বলছি।”
“না ঠিক আছে।”
শিমুর বাবাই তোমার সাথে কথা বলত। এ সব ব্যাপার ওই দেখে। হঠাৎ করে ওর একটা কাজ পড়ে গেছে তাই বের হয়ে গেছে। তুমি সপ্তাহে তিনদিন আসবা। টাকা পয়সার ব্যাপারে কাজলের সাথে যেমন কথা হয়েছে। তাই পাবে। দশ হাজার।
চারুর কেমন লজ্জা লাগছে! মহিলাটি এখনো তার নাম বলেনি! এসেই ব্যবসায়িদের মতো কাটছাঁট কথা বলছেন। চারু কিছু না বলে চুপ থাকল।
মহিলাটি বললেন, “ঠিক আছে,আসো তোমাকে শিমুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
উঠে দাঁড়ালেন। চারু উনাকে অনুসরণ করে একটা রুমে ঢুকল। ওনার মতো অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। “শিমু এ হলো চারু তোমার টিচার। “
শিমু চারুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। শিমুকে চারুর খুব পছন্দ হলো।
“তুমি কি আজ থেকেই পড়াবা? না চলে যাবা।”
“না, কিছু সময় থাকি।”
“ঠিক আছে তোমরা কথা বলো।” উনি চলে গেলেন।
চারু মেয়েটির পাশে বসে বলল, “শিমু কোন ক্লাসে পড়?”
“ক্লাস সেভেন । তুমি আমায় কোন সাবজেক্ট পড়াবা?”
“তোমার কোন সাবজেক্ট কঠিন লাগে?”
“অংক।” চারু ভেবেছিল ইংরেজি বলবে।
“তা-ই গনিত বুঝি খুব কঠিন? “
“হ্যাঁ,”
“আচ্ছা বই নিয়ে এসো দেখি।”
“তুমি কি আজকেই পড়াবা! আজ তো প্রথম এলে। আজ আমরা গল্প করব কেমন?”
“আচ্ছা আজ শুধু গল্প হবে।”
ঘন্টাখানিক সময় কাটিয়ে বেরিয়ে আসল চারু। এখান থেকে ওর বাসা খুব বেশি দূরে নয়। দশ মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ। তবুও চারু একটা রিকশা নিল।
পিছনে থেকে কেউ মন হয় ওর নাম ধরে ডাকছে। চারু রিকশাওয়ালা কে থামতে বলল। হুঁকের মধ্যে দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল অনেকটা দৌড়ে আসছে লিটন।
“কি রে তুই এখানে? “
হাঁফাতে হাঁফাতে লিটন বলল, “তোর কোনো খবর নাই! ঘটনা কি বলত?”
“কোনো ঘটনা নাই রে। একটু বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আরকি।”
“তা কেমম আছিস বল?”
“ভালোই আছি। তোর কি খবর?”
“আছি আরকি। ও সেদিন রায়হান নামে একজন তোকে হলে খুঁজতে এসেছিল। “
চারু খুব অবাক হয়! রায়হান কেন ওকে খোঁজ করবে? ও কিছু সন্দেহ করেছে! নাকি নীরুর সাথে ঠিক মতো বনিবনা হচ্ছে না? না, এসবের মধ্যে এখন জড়ানো যাবে না।
“কি হলো এমন ঝিম মেরে গেলি কেন?”
“কিছু বলেছে নাকি?”
“কিছু তো বলল না। অনেক সময় ধরে তোকে খুঁজছিল।”
“আচ্ছা আজ যাই রে পরে কথা হবে।” চলেন মামা।
লিটন কিছু বলার আগেই রিকশা চলতে শুরু করেছে।
আজ কাজলের অফিস ছুটি। চারুর জন্যই বসেছিল। চারু কে ঢুকতে দেখে একটু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগল টিউশনি? “
চারু হাত মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকে গেল।
“কি রে বললি না কেমন লাগল?”
“ভালোই। মেয়ের মাটা মনে হয় খুব দেমাগী! “
“কি বলিছ! এমন তো হওয়ার কথা না। উনি তো খুব মিশুক মানুষ। “
“হয়ত হবে। আমি প্রথমদিন গেছি তাই হয়ত খুব একটা মিশতে চায়নি।”
“তা-ই হবে। এমনিতে সবার সাথে মিশে।”
মুখ মুছতে মুছতে চারু বলে,” আজ লিটনের সাথে দেখা হলো।”
“কেমন আছে ও?”
“আছে ভালোই। লিটন বলল, রায়হান নাকি আমার খোঁজে হলে আসছিল।”
“বলিস কি! ঘটনা মনে হয় কিছু হয়েছে? তা লিটন কিছু জানতে পারছে? “
“না, ওকে কিছুই বলেনি। অবশ্য বলার কথাও না।”
“রায়হান মনে হয় তোকে কিছু বলতে চায়?” বা জানতে চাচ্ছে তুই কেন চলে এলি।”
“কিছুটা কৌতুহল থাকতেই পারে।”
“দেখা করবি নাকি রায়হানের সাথে? “
“এখন না।”
“কাল তো তোর বি সি এস পরীক্ষার প্রিলির রেজাল্ট দিবে।”
চারু কেমন চিন্তায় ডুবে যায়।
“এত ভাবছিস কেন? তোর তো পরীক্ষা ভালোই হয়েছে।
“
“দেখা যাক কি হয়?”
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ