কনে বদল পর্ব ১৭
নীরুকে নিয়ে বের হলাম। এখন আমিই গাড়ি চালাচ্ছি। ড্রাইভার কে নিয়ে তো লং-ড্রাইভে যাওয়া যায় না। যদিও আমি ভালো গাড়ি চালাতে পারি কিন্তু মা কখনো আমাকে গাড়ি চালাতে দেন না। এটা বোধহয় সব মায়েরাই করে। অন্য মায়ের সন্তান গাড়ি চালাবে তার সন্তান না!
“কোথায় যাবে নীরু?”
“জানি না। তুমি ঠিক করো। “
এই নীরুকে একটু অন্যরকম লাগছে! ও তো এমন না। ওর সব কিছু থাকে খুব গোছানো! হেয়ালিপনা ওর মধ্যে নাই। নাকি মেয়েরা একেক সময় একেক রকম আচরণ করে? কাট কাট মেয়েটাও কোনো সময় ভীষণ রকমের রোমান্টিক হয়।
“আশুলিয়ার দিকে যাই চলো।”
“চলো যাই। তুমি এতটা পথ গাড়ি চালাবে!”
“কেন ভরসা হয় না বুঝি?”
“তা হবে না কেন? খুব হয় বরং নিজের চেয়ে বেশি তোমার ওপর হয়।”
“তা-ই!”
“হুঁ মশাই তাই।”
গাড়ির গতি খুব বেশি না। মৃদু গতিতে গাড়ি চালাচ্ছি। খুব বেশি গতি আমার পছন্দ না। আজ নীরু খুব বেশি কথা বলছে না! কেমন একটু চুপচাপ ! মনে হচ্ছে কোনো কিছু বলতে চায়। সেটা হয়ত খুব খুশির খবর হবে। ঠোঁট টিপেটিপে হাসছে! কী হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না। কেন জানি জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
“কিছু খাবা নীরু?”
“হ্যাঁ, খাবা। “
“কি খাবা বলো?”
নীরু আমাকে আলত করে জড়িয়ে ধরেছে। কাঁধে মাথা রেখে বলছে,” সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাও, বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন!”
“খুব ভয় করে নাকি?”
“এতদিন করত না, আজ একটু একটু ভয় করছে!”
“আজ হঠাৎ ভয় বাড়ল কেন?”
“জানি না!” নীরু কেমন একটু লজ্জা পেলো মনে হয়! মুখটা লুকিয়ে বলল,” আচার খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”
“আচার! কীসের আচার বলো? “
“তেতুল আচার। আজ অনেকগুলো তেতুল কিনবা।”
“হঠাৎ তেতুল খাওয়ার এত শখ হলো যে?”
“এ সময় সবার টক খেতে ইচ্ছে করে।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। প্রচুর গরম পড়েছে, গরমে টক খেলে খুব আরাম হয়।”
নীরু আমার দিকে কেমন বাঁকা চোখে তাকাল! বুঝলাম না কি এমন বললাম? যে এমন করে তাকাল!
হুট করে একটা ট্রাক শাই করে সামনে দিয়ে গেল। নীরু ভয়ে চোখ বন্ধ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। খুব অবাক হলাম ওর এমন আচরণে! আমি কিছু বললাম না। ওকে সময় দিলাম ঠিক হওয়ার জন্য।
আমরা আশুলিয়া বেড়িবাধে এসে পৌঁছেলাম। দুই ধারে সবুজ গাছে সারি। মাঝে সবুজ ঘাসের রাস্তা অপরুপ সবুজের সমারোহ। এখানে আসলে মনটা কেমন শীতল হয়ে যায়। নীরুর খুব ভালো লাগছে জায়গাটা।
নীরুর চোখেমুখে কেমন খুশির ঝিলিক! আমায় বলল, “খুব সুন্দর একটা জায়গা!”
“হ্যাঁ, চলো এদিকটায় বসি।”
ঘাসের ওপর বসে আছি দু’জনে। আমার একটা হাত নীরুর হাতে ধরা। কেমন আদুরে গলায় ও বলল, “তুমি কি সত্যি বোঝনি? “
“কীসের কথা বলছ, বলো তো?”
“বলছি তোমার দায়িত্ব বাড়ছে।”
“একটু তো বাড়বেই তোমাকে কাজ বুঝাতে হবে। “
“আঃ! অফিসের কথা বলছি না।”
“তাহলে কী বলছ?”
নীরু কেমন মিটমিট করে হাসছে। ওর হাসি দেখে আমি বুঝে ফেললাম। তবুও কিছু বললাম না। বেচারি খবরটা দেয়ার আনন্দ নেক।
“হাসছ যে! কী হয়েছে না বললে বুঝব কী করে?”
“তুমি এত বোকা কেন! সব কিছু বলতে হয় বুঝি? বোঝ না! তুমি বাবা — হবে।”
আমার কেমন লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি না! বাবা হব শুনে একটু আনন্দ লাগছে! ফিলিংসটা ঠিক বুঝতে পারছি না। খবরটা মা কে দিতে হবে। মা খুব খুশি হবেন।
————
রাত এখন বারোটা বাজে। আনোয়ারা বেগম শুয়ে পড়েছেন অনেকক্ষণ। ডাকাডাকিতে গেট খুলে দিলো নায়লা। সে চারুকে চিনতে পারল না। হইচই শুনে আনোয়ারা বেগম জেগে উঠলেন। নায়লা কে হাঁক দিয়ে বললেন, “কে এসেছে রে মা?”
উঁচু গলায় নায়লা জবাব দেয়, “চিনি না ফুফু।”
আনোয়ারা উঠে আসেন। তিনি হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন চারুর দিকে। হাসিখুশি মানুষটা কেমন মরা পাতার মতো শুকিয়ে গেছে! চারুর বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে ওঠল! ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, “মামা কোথায়? “
“তুই এসেছিস চারু! তোকে কত খোঁজ করলাম কোথায় ছিলি তুই? ” আনোয়ারার গলা ধরে এসেছে। চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে!
চারুর চোখ ভিজে গেছে! কেমন ঝাপসা লাগছে চারপাশ। “মামার কী হয়েছে বলো মামী!”
“তোর মামা নেই!”
হুট করে চারু ঢলে পড়ল মাটিতে। মুখলেছ সাহেব দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলেন। কাজল ছুটে এসেছে।
আনোয়ারা বেগম ভয় পেয়ে গেছেন। “কী হয়েছে আমার মেয়ের?”
মুখলেছ সাহেব বললেন, ” মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে!”
চারুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আনোয়ারা বেগম আসতে চেয়েছিল সাথে উনাকে আনা হয়নি। কাজল আর মুখলেছ সাহেব নিয়ে এসেছেন।
ডাক্তার বললেন, “দেখুন হঠাৎ করে বড়ো আঘাত পাওয়ায় সহ্য করতে পারেনি! তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে! সমস্যা নাই ঠিক হয়ে যাবে।”
কাজল বলল, “স্যার কোনো বড়ো ধরনের কিছু হয়নি তো?”
“না তেমন কিছু হয়নি। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে।
সময় এখন কত ঠিক বলা যাচ্ছে না। কাজল বা মুখলেছ সাহেব কেউই ঘড়ি দেখছে না। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। চারুকে সেলাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি!
কাজল বলল, “আংকেল আপনি চলে যান অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি রাতটা থাকি সকালে কেউ আসলে যাব।”
“মেয়েটা কে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না মা। মেয়েটা বড়ো অসহায়! বড্ড ইমোশনাল আর বোকা, কিন্তু অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে!”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। “
“চলো নিচে থেকে চা খেয়ে আসি। আর চারুর মামি কে একটা কল করে সব জানিয়ে দাও। “
“জি, কথা হয়েছে ওনার সাথে। খুব কান্নাকাটি করছে!”
হাসপাতালের বাহিরে একটা চায়ের দোকানে থেকে মুখলেছ সাহেব দুই কাপ চা নিয়ে এলো।
চায়ের কাজল কে দিয়ে বললেন, “তা তোমার চাকরি কেমন চলছে মা?”
“চলছে ভালোই।”
মুখলেছ সাহেব চায়ে চুমিক দিলেন। অনেকদিন রাস্তার চা খাওয়া৷ হয়নি। চাটা খেতে খারাপ না। এরা কী করে যেন খুব ভালো চা বানায়!
চারুর জ্ঞান ফিরল সকালে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পাশে বসে আছে নীরু। একবার তাকিয়ে চোখটা সরিয়ে নিলো। সকালে খবর পেয়ে রায়হান আর নীরু চলে এসেছে।
নীরু চারুর মাথায় হাত রেখে বলল, “কেমন আছিস রে আপা?”
নীরুর হাতটা সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে চারুর। কিন্তু পারছে না! না চাইলেও অনেক কিছু আমাদের সহ্য করতে হয়!
চারু কিছু বলল না। নীরুর দিকে নীরব হয়ে তাকিয়ে রইল।
আনোয়ারা বেগম এসে পাশে বসলেন। তিনি চারুর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “এখন কেমন লাগছে?”
চারু ওনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিলো। একজন নার্স এসে বলল, ” আপনরা সবাই মিলে ঘিরে রেখেছেন কেন! এখন বাহিরে যান সবাই। রোগিকে একা থাকতে দেন।”
মুখলেছ সাহেব চারুর কাছে এসে বললেন, “আমি এখন যাইরে মা। আবার আসব। এত বেশি চিন্তা কোরো না কেমন?”
চারুর চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! কেমন অসহায় দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার দিকে তাকাতে মুখলেছ সাহেবের কষ্ট হচ্ছে! তিনি দ্রুত উঠে চলে গেলেন। কাজল ওনার সাথে বেরিয়ে গেল।
অনেকদিন পর চারুকে দেখলাম। মামার সাথে গিয়ে দেখেছিলাম। সেই চারু আর এই চারু এক নাই! চারু এখন অনেক শুকিয়ে গেছে! আমার দিকে একবারও তাকায়নি চারু! অবশ্য না তাকানোই স্বাভাবিক।
এ মেয়েটা ভালো সময়গুলি কেমন খারাপ করে দেয়! চারুর সাথে আমার কোনো কথা হলো না।
তিনদিন হাসপাতালে কাটিয়ে আজ ফিরবে। মুখলেছ সাহেব তার নাতনীকে নিয়ে এসে দেখা করে গেলেন। কাজল প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে রাতে চলে যায়।
নীরু বাড়িতে আছে তিন ধরে। আনোয়ারা বেগম হাসপাতালে ছিলেন দুইদিন। আজ চারু বাড়িতে আসবে। আনোয়ারা বেগম চারুকে নিয়ে বাড়িতে আসলেন।
চারু রুমে বসে আছে। নীরু রুমে ঢুকে পাশে এসে বসে বলল, “কেমন আছিস আপা?”
নীরুর দিকে না তাকিয়ে বলল, “আছি ভালেই। তোর কী খবর?”
“তুই কী আমার রেগে আছিস আপা?”
“না তো! তোর ওপর রাগ করার মতো কিছু ঘটেছে কি?”
“আমার দিকে তাকাচ্ছিস না! হাসপাতালেও আমার সাথে কথা বললি না?”
“নীরু তুই কি কিছু বলবি?”
“তুই আমার সাথে কথা বলতে চাছ না তা-ই না আপা?”
“তা না। আমার মাথা ব্যথা করছে! তোর কিছু বলার থাকলে বল।”
“আমাকে চলে যেতে বলছিস!”
চারু কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। নীরুর খুব খারাপ লাগল! সেধে এসে কথা বলল ও। অথচ আপা ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলো! এটা তো তাড়িয়ে দেওয়ার মতোই। চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে যাওয়া। মানে ভাগ এখান থেকে তোর সাথে কথা বলব না! ভদ্রভাবে বলা আরকি!
নীরু চেয়েছিল ওর মা হওয়ার খবরটা চারুকে দিবে। শুনে হয়ত চারু খুশি হবে। চারু ওকে কোনো পাত্তাই দিলো না! কষ্টে নীরুর চোখে পানি এসে গেল!
চারু চলে যাবে আবার। শুনে আনোয়ারা চারুর কাছে এসে বললেন,” তোর কোথাও যাওয়া হবে না। এখন থেকে এখানেই থাকবি। যা করার এখানে থেকেই করবি।”
আনোয়ারার এমন কঠিন রুপ চারু আগে দেখেনি। কিছু বলার সাহস বা ইচ্ছে হলে না। অনেক কষ্ট দিয়েছে মানুষগুলো কে! আর না।
বাগানে বসে কফি খাচ্ছে চারু। পাশে নায়লা বসে আছে। নায়লার সাথে কেমন ভাব হয়ে গেছে চারুর। মেয়েটা টুকটুক করে প্রশ্ন করছে চারুকে।
“তুমি কি এখানে থাকবা?”
“হুঁ।”
“খুব ভালে হবে।”
নীরু এসে চারুর পাশের চেয়ারে বসে নায়লা কে বলল, “আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয় যা।”
নায়লা উঠে চলে গেল। চারু তেরছা চোখে নীরুকে দেখে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।
নীরু বলল,” শুনলাম তুই আবার চলে যেতে চাছ?”
চারু কোনে জবাব দিলো না। ওর নিজের মতো করে কফি খাচ্ছে। এখানে নীরু আছে তা যেন ও খেয়াল করেনি এমন একটা ভাব।
“কি কথা বলছিস না কেন!”
“তুই কিছু বলতে চাইলে বল। এত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার কিছু নাই।”
“আমাকে দেখেই তো চলে যেত চাচ্ছিস? তুই কেন যাবি। আমিই চলে যাচ্ছি তুই থাক।”
“তুই অযথা কথা কেন বলছিস! কাজের কথা থাকলে বল।”
নায়লা কফি নিয়ে আসল। “এই নাও আপা তোমার কফি।”
চারু উঠে দাঁড়াল। “তুই কি আর কিছু বলবি? আমি রুমে যাচ্ছি।”
চারু একটুও সময় দিলো না। নীরুকে কিছু বলার। নায়লাও চারুর পিছনে পিছনে চলে গেলো! নীরুর কোনো দাম নেই এদের কাছে!
এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না নীরুর। ও রায়হান কে কল দিলো। রায়হান ওকে এখানে তিনদিন আগে রেখে গেছে।
—–
এ সময় নীরুর কল! ইদানীং নীরুর মেজাজ খুব একটা বুঝতে পারি না। এই ভালো আবার এই খারাপ। ডাক্তার বন্ধু বলল, এ সময় মেয়েদের মনমেজাজ যখন-তখন খারাপ হয়ে যা। একটু খিটখিটে থাকে। ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যেতে পারে।”
“হ্যালে নীরু কেমন আছ?”
“ভালো না।”
“ভালো না কেন! মনখারাপ বুঝি না শরীরটা ভালো লাগছে না?”
“মনটা খারাপ! “
“মন খারাপ কেন?”
“জানি না। কিছুই ভালো লাগছে না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। “
“তা-ই? কাজ শেষে তোমাদের বাড়িতে আসব কেমন?”
“না, তুমি এক্ষুনি এসে আমাকে নিয়ে যাও।”
“আচ্ছা আমি আসছি। “
বুঝলাম না। নীরু হুট করে চলে আসতে চাইছে কেন? খুব উৎসাহ নিয়েই তো থেকে গেল। এখন কি এমন হলো? চারুর সাথে কোনো ঝামেলা বাধলো নাকি!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ