কনে বদল পর্ব ১৯
অফিস থেকে দ্রুত বের হলাম। মতিঝিল থেকে শ্যামলি কতটুকু আর পথ? এ পথটুকুই আজ যেন কত দূর মনে হচ্ছে! ড্রাইভার কে বারবার তাড়া দিচ্ছি। পল্টন এসেই গাড়ি জ্যামে পড়ল। এসির মধ্যে বসেও দরদর করে ঘাম ঝরছে!
ড্রাইভার চেষ্টা করছে কেটে বেরিয়ে যেতে। আজ মনে হয় সব গাড়ি রাস্তায় নেমেছে! এত বড়ো গিট্টু লাগছে।
পল্টন জ্যাম পেরিয়ে শাহবাগে আবার জ্যাম! ড্রাইভার কুদ্দুছ বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে! আমাকে এত চিন্তিত বোধহয় বেচারা আগে দেখেনি। কুদ্দুছ চেষ্টা করছে যথা তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওয়া যায়।
অবশেষে বাড়িতে পৌঁছালাম। গাড়িতে এত টেনশনে ছিলাম মোবাইলে কল বেজেছে বুঝতেই পারিনি।
বাড়িতে এসে জানতে পারলাম। নীরুকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে রুবিনা। বোনটা আমার অনেক কিছু করতে শিখে গেছে!
হাসপাতালে যাওয়ার পথে আচমকা গাড়ির সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল। একজন বয়স্ক লোক।
আমি কুূূদ্দিছ কে বললাম, “দেখ তো কী চায় তাড়াতাড়ি বিদায় করে চল।”
কুদ্দুছ কাছে গেল ওকে কিছু বলছে না। আমাকে ইশারায় ডাকছে। কাছে গেলাম। লোকটার লম্বা দাড়ি, লম্বা জোব্বা পরা, দেখলে সাধুর মতো লাগে।
কাছে গিয়ে বললাম, ” আপনি কিছু বলতে চান?”
“পাঁচ হাজার টাকা দে। তোর সামনে বড়ো কঠিন বিপদ আসতাছে!”
বিপদের সময় মন কেমন দূর্বল হয়ে যায়! স্বাভাবিকভাবে অবিশ্বাস্য কাজও তখন করা হয়! এমনিতে আমি কখনো একে টাকা দিতাম। এখন কেমন একটা ভয় কাজ করছে! উনাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বললাম, “আমার স্ত্রীর জন্য দোয়া করবেন। “
হাসপাতালে এসে দেখি নীরুকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। রুবিনা বসে আছে।
ডাক্তারের বললেন, ” এ সময়টাতে মেয়েদেরকে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। আপনার স্ত্রীর হার্টের কিছু সমস্যা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত বলতে পারছি না। কিছু টেস্টের রিপোর্ট আসলে বলতে পারব।”
আমি অসহায় হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছি।
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্ত্রী কে খুব ভালোবাসেন?”
আমি কিছুই বললাম না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। আমার চোখদুটো কখন যে ভিজে গেছে! বুঝতে পারিনি।
মামা হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। আমাকে বললেন, তুই এক্ষুনি বাসায় গিয়ে সব কিছু গোছগাছ কর। আমরা বউমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাব। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
আপাতত তুই আর আমি যাব ওর সাথে। আপা আর নীরুর মা কয়েকদিন পরে আসবে। নীরুর মায়ের পাসপোর্ট করতে দুয়েকদিন সময় লাগবে। আমি ব্যবস্থা করেছি সব।
পরেরদিন আমরা সিঙ্গাপুরে রওয়ানা দিবো। নীরুর মা আমাদের বাড়িতে আসলেন ওকে দেখার জন্য। খুব অবাক হলাম চারু আসেনি! আমি বুঝতে পারছিলাম না। এ মেয়েটা এমন কেন! বোনের এমন বিপদের সময় দেখতে আসবে না!
আমার মা এবং নীরুর মা কয়েকদিন পরে আসবেন। আমি আর মামাই এখন নীরুকে নিয়ে যাবো। মামা সব কিছু কেমন করে যেন ব্যবস্থা করে ফেলেন।
এয়ারপোর্টে মা, নীরুর মা আসলেন আমার মনে হলো নীরু আশা করেছিলো চারু অন্তত এয়ারপোর্টে আসবে শেষ সময়ে। নীরুর চোখ চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তা অন্য কেউ বুঝল কি না জানি না। আমি ঠিক বুঝে গেলাম। এমন কী ঘটেছে দুইজনের মধ্যে? চারু ওকে একবারও দেখতে এলো না!
আমি নীরু পাশাপাশি সিটে বসেছি মামা বসেছেন পিছনের সিটে। নীরুকে এখন অসুস্থ লাগছে না। অনেকটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবে কেমন যেন ভয়ে আছে মনে হচ্ছে! ওকে অবশ্য তেমন কিছু বলা হয়নি। আমরা একটা রুরিন চেক-আপ করাব এবং সিঙ্গাপুরে বাচ্চা হলে ভালো হবে এমনটা ওকে বুঝানো হয়েছে।
বিমান রান শুরু করেছে। নীরু আমার কাঁধে মাথা রেখে আমার হাত ধরে শুয়ে আছে। আমি নীরুর দিকে তাকাতে পারছি না। কেন জানি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে নীরুকে আমি হারিয়ে ফেলব! এ কথা মনে হলে বুকের মাঝে কেমন একটা শুন্যতা অনুভব হয়!
নীরু ছাড়া জীবনটা ভাবতে পারি না। ও কেমন করে এতটা আপন হয়ে গেছে জানি না। নীরু আমাকে বলল, “আমার বুঝি অনেক বড়ো রোগ হয়েছে? “
আমি একটু হেসে বললাম,” না তো।”
“তাহলে তুমি এমন মনখারাপ করে আছ কেন! আমার দিকে তাকাচ্ছ না! “
নীরুকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বললাম,” দূর বোকা! তোমার কিছুই হয়নি। মামাই জোর করে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাচ্ছে। তুমি পুরোপুরি সুস্থ আছ। বুঝ না।। বংশের প্রথম নাতি হবে তা-ই একটু বাড়াবাড়ি করছে।”
মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নীরুকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তাররা প্রথমে কিছু টেস্ট দিয়েছেন। টেস্ট করার পর তারা একটা বোর্ড মিটিং করে পরবর্তী নির্দেশনা দিবেন।
আমি আর মামা হাসপাতালের পাশেই একটা হোটেলে উঠেছি। বাংলাদেশের মতো এখানের হাসপাতালে রাত থাকা যায় না। ভিজিটিং টাইমে দেখা করা যায়। বাকি সময়টাতে রোগী ওদের তত্ত্বাবধানে থাকে।
নীরুর মায়ের ভিসা হয়ে গেছে। আগামীকাল ওনারা আসবেন। নীরুর অবস্থা আগের চেয়ে আর খারাপ হয়েছে! কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। নীরুর সাথে দেখা করতে গেলে জোর করে হাসতে হয়। ও জানি কেমন করে ধরে ফেলে! বলে,” তুমি এত ভেঙে পড়ছ কেন!”
কোথায় আমি ওকে সাহস দিব ওই আমার সাহস জোগায়!
মা আর আমার শাশুড়ি এসেছেন। মামা গেছেন ওনাদের রিসিভ করতে। আমি নীরুর সাথে দেখা করতে এসেছি হাসপাতালে। ওনাদের আসার কথা জানালাম। নীরু চারু আসছে কি-না জানতে চাইল। আমি ওকে বললাম, “চারুর ভাইবা আছে সামনে। ও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছে। তা-ই এখন বিদেশে কী করে আসবে? তোমার তো এমন কিছু হয়নি। বাবু হওয়ার পর আমরা দেশে ফিরে যাব।”
আসলে আমি জানি না চারুর খবর। চারু আসতে চাইলে ব্যবস্থা করা যেত। শাশুড়ি কে আমি জিজ্ঞেস করিনি চারুর কথা। চারু আসতে চাইলে উনি নিশ্চয় বলত।
———-
চারুর এখন খারাপ লাগছে! নীরু কে দেখতে যায়নি। ও অবশ্য জানত না। নীরু এতটা অসুস্থ ওকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। মামাী কে রায়হানের মামা এসে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলেন তিনদিন আগে। তখন মামী চারুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। রায়হানদের বাড়িতে যেতে ওর ভালো লাগেনি।
এবং নীরুকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবে এটা নাকি মামীও জানত না। মামী যাওয়ার সময় চারুকে জানাল নীরুকে সিঙ্গাপুর নিয়ে গেছে। এখম মামী যাচ্ছে রায়হানের মায়ের সাথে। এখন চারুর খুব খারাপ লাগছে!
মামী একবারও বলেনি,” চারু তুই যাবি নাকি?” বলবে বা কী করে নিজেই যেখানে অন্যের উপরে যাচ্ছে! রায়হান ছেলেটা তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারত। আপা যাবেন নাকি? চলেন নীরুর ভালো লাগবে। এমন করে বললে চারু কী মানা করতে পারত! এমনিতে তো জিজ্ঞেস করে আপা কিছু লাগবে কিনা?
নায়লা এসে জিজ্ঞেস করল, “আপা, নীরু আপার এখন কী অবস্থা? “
চারু মুখে বলল, “এখন ভালো আছে।” মনে মনে ভাবছে নিজেই তো জানি না রে!
চারু বসে আছে ওদের বাগানে। বসে বসে ভাবছে মামা বেঁচে থাকলে আজ কী হতো? মামা কী ওকে রেখে বিদেশে চলে যেতে পারত! নায়লা বলল, ” আপা কফি খাবেন?”
“না রে এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।”
সকালে ঘুম থেকে উঠে চারু ভাবছে আজ একবার কাজলের অফিসে যাবে। যাবার আগে একটা কল দিয়ে খবর নেয়া দরকার। অফিসে আছে কি-না? প্রতিদিন তো আর ভাগ্য সহায় হবে না। ওইদিন না হয় পাওয়া গেছে। আজ তো নাও থাকতে পারে। মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখল একটা মেইল এসেছে নীরুর আইডি থেকে! চারু ই-মেইল পড়া শুরু করল,
আপা কেমন আছিস?
আমার ওপর খুব রেগে আছিস তাই না? তোর রাগ করাটা হয়ত ঠিক আছে। তুই যে এতটা রেগে আছিস বুঝতেই পারিনি! আমি আশা করেছিলাম আমি মা হব শুনে তুই খুশি হবি। আমাকে দেখতে আসবি। জানি না কেন তুই একবারও এলি না! এয়ারপোর্টে তোকে দেখব বলে আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম শেষ সময়ে তুই হুট করে হাজির হবি। কিন্তু তুই এলি না।
ওরা সবাই আমাকে বলে, আমার কিছুই হয়নি। আমার কেন জানি মনে হয় আমি আর বাঁচব না! মরে গেলে তোর সাথে আর দেখা হবে না!
আপা জানিস? গতকাল বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। বাবা আমাকে বলছে, তুই কেন চারুর খবর নিলি না। তোরা দুইজন আমার মেয়ে ভুলে গেলি! তুই পারতি না বড়ো বোনের কাছে ক্ষমা চাইতে?
ছোটোবেলা থেকে আমি তোকে বড়ো বোন হিসাবেই জানি। কখনো তো তোকে ফুফাতো বোন মনে হয়নি। আপন বোনের মাঝেও তো মনমালিন্য হয়, হয় না বল?
আমি জানতাম না। তুই রায়হানকে ভালোবাসতি। তোকে দেখতে এসেছিল তুই তো ওকে এত পছন্দ করিস বলিস নি তো! আমি যখন ওর সাথে কথা বলতাম তুই তো কখনো নিষেধ করিসনি? হ্যাঁ, রায়হান কে আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমি চাইনি তুই এমন করে পালিয়ে যা।
কাজলের সাথে কথা না বললে, আমি জানাতামই না রায়হানকে তুই ভালোবেসে ফেলেছিলি!
জানি আমি যে অপরাধ করেছি তার ক্ষমা হয় না। তাই তো দ্যাখ আমার কী অবস্থা হলো! ছোটোবেলা থেকে তুই আমার কত অপরাধ ক্ষমা করেছিস। এটাও না হয় ক্ষমা করে দিছ।
তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে রে আপু! জানি না তোর সাথে আর কখনো দেখা হবে কি-না?
ডাক্তার মোবাইল চালাতে নিষেধ করেছেন। রায়হান লুকিয়ে মোবাইল দিয়েছে আমাকে। লিখতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। রায়হান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি এত লিখছি? বেচারা খুব ভালো মানুষরে আপা! আমাকে কী পরিমান যে ভালোবাসে। আজ রাখিরে আপা।
ইতি
তোর ছোটো বোন নীরু।
চারুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে! মনে মনে বলছে, এ আমি কী করলাম! আমি পারলাম ওকে এতটা আঘাত করতে! সত্যি তো আমি ওকে তখন বাধা দেয়নি।
চারু এসেছে কাজলের অফিসে ও সিঙ্গাপুরে যাবে। নীরুর সাথে দেখা করতে। কাজলের নাম্বারটা বন্ধ!
অফিসের রিসিপশনের মেয়েটা ফোনে কথা বলছে। চারুকে হাতের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলল।
চারু বসে আছে ওর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। মেয়েটা দশ মিনিট ধরে কথা বলছে! চারুর মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে মেয়ের আলাপ চলবে! কয়েকবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা কথা বলেই যাচ্ছে!
পনেরো মিনিট পরে ফোন রেখে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, “কাকে চান?”
“কাজল অফিসে আছে। “
“না, ম্যাডাম ঢাকার বাহিরে আছেন।
“ওর নাম্বারটা বন্ধ পাচ্ছি! কোনো কন্টাক্ট নাম্বার আছে?”
“আমি জানি না। আপনি বড়ো স্যারের সাথে কথা বলতে পারেন।”
রুয়েল সাহেবের পাশেই একটা রুমে বসেন ইসমাইল সাহেব। ফিট বডির অধিকারী লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মিষ্টি হেসে বললেন, “কাজল আপনার কী হয়?”
“জি, বান্ধবী। “
“ও, আচ্ছা বসুন। চা না কফি কোনটা চলবে? বান্ধবীর খোঁজে নিতে এসেছেন! খুব ভালো।”
লোকটা মনে হয় বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন। চারুর একটু বিরক্তি লাগছে! ঠোঁটে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “ধন্যবাদ। আমার কাজলের সাথে কন্টাক্ট করাটা খুব দরকার। “
ওরা যে হোটেলে উঠেছে তার নাম্বারটা দিলেন। ইসমাইল সাহেব। “এই নাম্বারে যোগাযোগ করেন। “
“অসংখ্য ধন্যবাদ।”
কাজলের হোটেলে ফোন দিলো চারু। কাজল পত্রিকার একটা কাজে এখন চট্টগ্রাম আছে।
হ্যালো কাজল।
“কি রে চারু তুই! কী খবর বলতো। মনে হচ্ছে খুব ইমারজেন্সি কিছু? “
“হ্যাঁ,তোর নাম্বার বন্ধ কেন! নীরু খুব অসুস্থ! ওকে দেখতে যেতে হবে। আমার ভিসা লাগবে। ” এক টানা কথাগুলো বলল চারু।
“আগামীকাল তো শুক্রবার সব আ্যমবাসি তো বন্ধ। আচ্ছা আমি রুয়েলের সাথে কথা বলছি চিন্তা করিছ না। আমি আজই ঢাকা আসব।”
“তুই দ্রুত ব্যবস্থা কর।”
কাজল রুয়েল কে বলল চারুর ব্যাপারটা। রুয়েল তার এক বন্ধু আছে। রাজন নামে। ওর কাছে অসম্ভব বলতে কোনো কথা নাই! রাজন জানাল পাসপোর্ট টা পাঠিয়ে দে দেখি কী করা যায়।
চলবে —
® নাবিল মাহমুদ