কনে বদল পর্ব ২০
নীরুর ডাইরিটা নিয়ে আমি বসে আছি ছাদে। দশ বছর ধরে ডাইরিটা আমার কাছে আছে কখনো পড়ার ইচ্ছেই হয়নি! আমার হাতে ছাতা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ডাইরিটা আমি পড়িনি আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না। ডাইরিতে নিশ্চয় নীরু সম্পর্কে এমন কিছু আছে যা জানলে ওকে আমি ঘৃনা করব। নীরু এমনটা বলেছিল আমায়! ও জানে না ভালোবাসার মানুষ কে কখনো ঘৃনা করা যায় না। সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি নীরু।
ভালোবাসলে তার দোষ-গুন সহ ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসার মানুষের দোষগুলো লুকিয়ে রাখতে হয়। তোমার ডাইরি আমি কাউকে পড়তেও দিতে পারব না নীরু। আমি চাই না পৃথিবীর কেউ তোমাকে ছোটো ভাবুক।
আমি ডাইরিটার ওপর পেট্রোল ঢেলে ভিজিয়ে নিলাম। দেয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। ছাতা দিয়ে ডেকে রেখেছি যেন আগুনটা বৃষ্টিতে নিবে না যায়।
ডাইরি পুড়া ধুঁয়া চোখে লাগছে। চোখ কেমন ভিজে যাচ্ছে! সবাই ভাববে ধুঁয়ায় আমার চোখে জল এসেছে!
ডাইরিটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি ছাতাটা ফেলে দিলাম সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টিতে আমি ভিজে যাচ্ছি। পুড়া ছাইগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে।
ঝিনুক দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা আমিও বৃষ্টিতে ভিজব। আমি ওকে পাশে বসালাম। “বৃষ্টিতে ভিজলে মা বোকা দিবে না? তোমার তো ঠান্ডায় সমস্যা হয়!”
“না, তুমি মা কে বোকে দিবে। আমি আজ তোমার সাথে ভিজব।”
“আচ্ছা বসো। মা কী করে?”
“রান্না করছে। আজ তো চারু খালা মনি আসবে।”
তা-ই?
“হ্যাঁ, খালামনি আমাকে কল দিয়েছে। “
বাপ-মেয়ে ভিজে চুপসে গেছি। মেয়েটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। সামনের মাসে দশ বছরে পা দিবে! কেমন করে সময় কেটে যায়!
এই তো সেদিন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নীরুর পাশে বসে আছি। ডাক্তাররা জানালেন একটা অপারেশন করতে হবে। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় হার্টের অপারেশন করাটা বড়ো রিস্ক! কিছুই করার নেই!
মা এবং আমার শাশুড়ি উঠেছেন আমাদের হোটেলেই। সকালে সবাই হাসপাতালে দেখা করতে আসেন। এখানকার হাসপাতাল আমাদের এ সংস্কৃতিটা খুব একটা পছন্দ করেন না। আমাদের দেশে কেউ অসুস্থ হলে দল বেঁধে তাকে দেখতে যাওয়ার রিতিটা মনে হয় এ দেশে নাই! তাই একসাথে এতজন ভিজিটর দেখে ওরা বিরক্ত হয়!
“অপারেশন হওয়ার আগেরদিন নীরু আমাকে বলল,” কিছু কথা তোমাকে পুরোপুরি বলিনি। আমি চাই তুমি কথাগুলো জানো। জানি না সব জানার পর তুমি আমায় এতটা ভালোবাসতে পারবে কি-না? “
“তুমি এ কথা বলোনা তো। চুপ থাকো। ডাক্তার তোমায় কথা বলতে নিষেধ করেছেন।”
নীরু আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, “আমি সব বলতে পারিনি। অনেকবার ভেবেছি বলব কিন্তু বলতে পারিনি। তাই একটা ডাইরিতে লিখেছি। ডাইরিটা আমার ব্যাগে রাখা আছে তুমি একা একা ডাইরিটা পড়বে।” ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে! আমি ওকে চুপ করালাম। আমার দিকে চেয়ে আছে অসহায় দৃষ্টিতে! ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। জানি ও চোখে চোখ পড়লে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারব না। আমাকে কাঁদতে দেখলে ও আর বেশি দুর্বল হয়ে যাবে।
অপারেশন হওয়ার আগেরদিন চারু আসল। চারু কে দেখে নীরুর চোখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। নীরুর অবস্থা দেখে চারুর চোখদুটো ভিজে গেছে! কয়েকবার চোখ মুছল। দুইবোন নিচু গলায় কথা বলছে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। দুই বোনের মিলন দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে! নীরুকে এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে! বিপদের সময় আপন মানুষগুলো কাছে থাকলে মনের সাহস বাড়ে।
আজ নীরুর অপারেশন হবে। সকালে সবাই ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। নীরুর মা বারবার কেঁদে ফেলছেন! মামা বললেন, ” আমার মার কিছুই হবে না। আপনি এমন কাঁদছেন কেন বেয়াইন? “
মামা নীরুর মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,” তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি রে মা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ।”
নীরু মামার দিকে চেয়ে শুকনো হাসি দিলো।
অপারেশন সফল হয়েছে। নীরু এখন আই,সি,ইউ তে আছে। তিনদিন ওকে আই,সি,তে রাখার পর বেডে পাঠানো হলো।
মাসখানেক পরে ঝিনুকের জন্ম হলো এই হাসপাতালে। ঝিনুক কে দেখে সবাই খুশি! কী সুন্দর হয়েছে মেয়েটা।
ঝিনুক হওয়ার দিন আরো একটা খুশির খবর এলো চারু লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছে। মেয়েটা আমার বড়ো ভাগ্যবতী!
কিছুদিন থেকে মা দেশে ফিরলেন। চারুও ফিরে গেল আমার শাশুড়ি কে নিয়ে। আমি আর নীরু রয়ে গেলাম।
ছয়মাস পরে নীরুকে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম।
চারুর বি সি এস হয়েছে। ও এখন একজন ফরেন ক্যাডার পোস্টিং ঢাকাতে। আনোয়ারা বেগম চারুর সাথে থাকে। আমি মাঝে মাঝে যাই দেখা করতে। নীরু এখন পুরোপুরি সুস্থ। কাজল আর রিয়েলের বিয়েটা বেশ ধুমধামে হলো। আমরা সবাই গিয়েছিলাম সে বিয়েতে।
চারু বিয়ে করেছে তিন বছর আগে। ওর ডিপার্ট্মেন্টের এক কলিগের সাথে বছরখানেক প্রেম করার পর ওদের বিয়ে হয়েছে। দারুণ এক জুটি চারু আর রোহান। রোহান ছেলে হিসাবে খুব ভালো।
এত বছর ধরে নিজের কাছে রাখা ডাইরিটা আজ পুড়িয়ে বেশ ভালো লাগছে! এতদিন কেন রেখেছিলাম? নীরুর প্রতি ভালোবাসে কমে যায় কি-না দেখতে। দিনে দিনে আমার ভালোবাসা বেড়েছে!
ঝিনুক আমাকে বলল, “আব্বু বৃষ্টি তো থেমে গেছে চল নিচে যাবা না?”
“হ্যাঁ, যাবো রে মা।”
বৃষ্টিতে ভিজে এখন কেমন শীত শীত লাগছে। হঠাৎ শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি চারু দাঁড়িয়ে আছে।
“কী বাপ-মেয়ে ভিজে জবুথবু হয়ে বসে আছ?”
ঝিনুক দৌড়ে গিয়ে চারু কে ঝাপটে ধরল।” আ্য, আ্য, খালামনি এসে পড়েছে! “
চারু ঝিনুক কে গাল টিপে বলল, “কী রে কেমন আছিস? “
“ভালো। তুমি?”
“খুব ভালো আছি। আয় নিচে আয়। ভিজে কী হয়েছে দ্যাখ।” ঝিনুক কে নিয়ে চারু নিচে যাওয়ার সময় আমাকে বলল, “তুমিও দ্রুত কাপড় পাল্টে ফেল।”
নীরুও ছাদে এসেছে। ঝিনুকের দিকে কঠিন চোখে তাকাল একবার। মেয়ে পাত্তা দিলো না। সে এখন খালামনির আশ্রয় আছে।
আমার কাছে এসে বলল, “তুমি বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কী করো? “
একটা হাসি দিয়ে বললাম, ” কিছু না। আজ বৃষ্টি ভিজতে খুব ইচ্ছে হলো তাই।”
“হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?”
“জানি না।” আমি নীরুর আঁচল দিয়ে মাথা মুছার সময় দেখলাম। ডাইরির ছাইগুলো সব পানিতে মিশে গেছে। জীবনে সব কিছু জানতে হয় না। কিছু জিনিস না জেনেও জীবনটা ভালো কেটে যায়। ভালো থাকতে কিছু কথা গোপন রাখতে হয়। কী এমন ক্ষতি মুছে গেলে কিছু স্মৃতি?
সমাপ্ত
গল্পের শুরুতে শেষটা এমন চিন্তা করিনি। তখন ছিলো নীরু মারা যাবে। পরিবারের সবাই চারুর সাথে বিয়ে দিতে চাইবে কিন্তু রায়হান এবং চারু কেউই বিয়ে করতে রাজি হবে না। চারু সারাজীবন কাটাবে একা আর রায়হান মেয়েকে নিয়ে কাটাবে।
® নাবিল মাহমুদ
কোনটা ভালো সমাপ্তি জানাবেন। সবাই কে অশেষ ধন্যবাদ ।