কনে বদল পর্ব ৯
আমার ঘুম ভাঙ্গলো প্রথমে। অন্যদিন নীরু খুব ভোরে উঠে যায়। আজ ওর ঘুম ভাঙ্গেনি। বাচ্চাদের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। আমি খুব সাবধানে ওর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলাম যেন ওর ঘুম ভেঙে না যায়।
ঘুমন্ত নীরুকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে! নীরুর সাথে আমার একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে । নীরুকে আমার ভালোই লাগছে। একটা টান তৈরি হয়েছে ওর প্রতি।
বারান্দায় এসে বসলাম। চারদিকে অন্ধকার এখনো সূর্য উঠেনি। কয়টা বাজে বলতে পারব না। আচ্ছা কয়টা বাজে তা দিয়ে আমি কী করব? টাইম জানাটা আমার জন্য জরুরি না তবুও মাথায় সময়ের কথা চলে আসল, কী অদ্ভুত!
হালকা বাতাস গায়ে লাগছে। একটু পরেই সূর্য উঠবে বুঝা যাচ্ছে আকাশটা হালকা লাল। একটা রাতের সমাপ্তি আর একটা দিনের শুরু। একটা শেষ হলেই অন্যটা শুরু হয়।
কখন যে নীরু এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। নীরু আমাকে পিছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আজ এত সকাল সকাল উঠে গেছ যে?”
“ঘুম ভেঙে গেল তাই।”
নীরুর শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কোনো ফুলের গন্ধ। ঠিক বুঝতে পারছি না। প্রতিটি মেয়ের শরীরে এক ধরনের গন্ধ থাকে। আচ্ছা গন্ধটা কী পরিবর্তন হয় মনের সাথে? মন ভালো থাকলে এক ধরনের গন্ধ, মন খারাপ থাকলে অন্যরকম গন্ধ।
নীরু আমার গলা জড়িয়ে ধরে আলত করে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে আমাকে?”
আমি ঘুরে নীরু দেখলাম। সত্যি খুব সুন্দর লাগছে ওকে। কেমন ফুরফুরে মেজাজ। মনে হচ্ছে খুব খুশি। এ কয়দিন কেমন মনমরা ছিল। ওকে কাছে টেনে একটা চুমু দিয়ে বললাম, “খুব স্নিগ্ধ লাগছে তোমাকে। তাজা ফুলের মতো।”
খুব মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “তুমি বসো আমি আসছি।”
একটু পরে নীরু দুইকাপ কফি নিয়ে হাজির! এই মেয়ে অন্যরকম। সবকিছু নিজের করে নিতে জানে। কেমন করে আমাকে নিজের করে ফেলল! আমি ভাবতেও পারিনি এত অল্প সময়ে ওর এত কাছাকাছি চলে যাব। অনেকটা বাধ্য হয়েই তো হানিমুনে এসেছিলাম।
“নাও তোমার কফি।”
আমি খুব অবাক হয়ে নীরুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এখন কফি পেলে কোথায়? “
নীরু একটু রহস্যময় হাসি দিল।” জানো না আমি ম্যাজিক জানি!”
“তাই তো দেখছি। “
“কফি শেষ করো তাড়াতাড়ি, আমরা সাগরের পাড় ধরে খালি পায়ে হাঁটব। “
“আচ্ছা ঠিক আছে চলো যাই।”
“কফিটা শেষ করো তারপর যাব।”
সমুদ্রের পাড়ে আমরা দুইজন হাঁটছি পাশাপাশি। নীরু আমার হাত ধরে আছে। সমুদ্র এখন অনেক শান্ত। সমুদ্রের পানি এসে পায়ে লাগছে। আমাদের মতো আর কিছু জুটি দেখা যাচ্ছে। তবে খুব বেশি নয়। আমরা এখন হাটু পানিতে নেমেছি। সকালের সমুদ্রের পানি বেশ ঠান্ডা লাগছে। নীরু বলল, “আমাকে কোলে তুলে পারে নিয়ে যাবে?”
নীরুর ওজন খুব বেশি না। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার নীরুর ওজন পঞ্চাশ কেজি হবে বলে মনে হয় না। নীরুর দেহের গড়ন ভালো। আমার চেয়ে নীরু সাত ইঞ্চি কম।
এক ঝটকায় নীরুকে কোলে তুলে নিলাম। আমার দিকে মিটমিট করে হাসছে ও। পাড়ে এনে ওকে নামালাম। অনেকটা পথ ওকে কোলে তুলে এনে হাঁপিয়ে গেছি। ও আমার চেয়ে হাসছে। “কি এতটুকুতে ক্লান্ত হয়ে গেছ! “
“দেখে হালকা ফুলকা মনে হয় ওজন তো কম না!”
বালিতে পেতে রাখা কাঠের চেয়ারে শুয়ে পড়লাম। নীরু আমার পাশে এসে বসল। কেউ বোধহয় রায়হান রায়হান বলে ডাকছে। আমি উঠে বসে শব্দের উৎসের দিকে তাকালাম একটা মেয়ে আসছে আমার দিকে। দূর থেকে ঠিক মতো চিনতে পারছি না। খুব অবাক হয়েছি এখানে কেউ আমার নাম ধরে ডাকায়।
কাছাকাছি আসার পর চিনতে পারলাম এ তো আমাদের নীলা আপু। একটা লম্বা সময় আমাদের বাড়িতে ভাড়া ছিলেন। উনাকে এখানে দেখতে কল্পনা করিনি। বিয়েতে ওনাদের দাওয়াত দেয়াছিল আসেনি।
“কি রে রায়হান কেমন আছিস? “
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“আছি ভালোই। ” নীরুর দিকে তাকাই বলল, “ও কী চারু?” বিয়ের কাডে নাম দেখেছে মনে হয়।
নীরু ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। “না আপু ও
নীরু।”
নীলা আপু কেমন করে তাকিয়ে বলল,” ও, কেমন আছ নীরু?”
“জি, ভালো।”
“তোমাদের বিয়েতে আসার খুব ইচ্ছে ছিল আসতে পারিনি। দেখা হলো বিচে! রায়হান তোরা উঠেছিস কোন হোটেলে? “
“হোটেল সিগালে।”
“তা-ই! আমরাও তো একই হোটেলে উঠেছি। তিনশো দুই নাম্বারে। তোরা?”
“দুইশো চার নাম্বার।” রুম নাম্বার বলায় আমার মনে হলো নীরু বিরক্ত হলো!
“ভালোই হলো রাতে আড্ডা দেয়া যাবে। তোর বউটা দেখতে খুব মিষ্টি রে!”
নীরু একটু হাসল।
“যাই রে রায়হান তোর দুলাভাই আবার চিন্তা করবে। বেচারে সাগরে নেমেছে এদিকে চলে এসেছি। ”
নীলা আপু চলে গেলেন। নীরু আমাকে জিজ্ঞেস করল, “উনি কে?”
“আমাদের বাসায় অনেক বছর ছিলেন।”
বুঝতে পারছি চারুর কথা বলায় নীরু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েছে! এমন পরিস্থিতি হয়ত আর হবে।
“ডাব খাবা নীরু?
ছোট একটা ছেলে বয়স দশ বার বছর হবে ডেকে ডেকে ডাব বিক্রি করছে। “এই পিচ্চি দুইটা ডাব দে।”
দুইটা ডাব দিয়ে গেল সাথে পাইপ। ডাবের পানিটা খুব মিষ্টি লাগছে খেতে। পাইপ দিয়ে ডাবের পানি খাচ্ছে নীরু। দেখতে বেশ ভালো লাগছে!
রাতে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে গেছে নীলা আপু আর ওনার হাজব্যান্ড লিটন ভাই। লিটন ভাই খুব রসিক মানুষ।
——-
বাড়িতে ঢুকেই বাগানে বসে পড়ল আমজাদ সাহেব। তাকে প্রবেশ করতে দেখে ছুটে এল আনোয়ারা।
“কী হয়েছে আপনার আর চারু কোথায়?”
“আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো।” উনাকে খুব ক্লান্ত লাগছে।
আনোয়ারা দ্রুত ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে। “এই নাও পানি। “
কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মানুষটা একা একা ফিরে এলো! চারু কি হলে নাই! তাহলে চারু কি অন্য কারো সাথে –? না সে ভাবতে পারছে না।
পানি হাতে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গা ছেড়ে বসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মুখে একটু মৃদু হাসি ফুটল। হাসি দেখে আনোয়ারার মন কিছুটা শান্ত হয়েছে।
“বুঝছ আনু আজ আমার কী যে ভালো লাগছে! “
স্বামীর হাসি দেখে নিজেও একটু হেসে বলে,”তা কীসের এত আনন্দ তোমার? আর চারু কোথায়?
“চারু আছে হলে।”
“তুমি ওরে হলে রেখে আসলা ক্যান?”
“আঃ! এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই।”
“মেয়েটাকে নিয়ে আমার সবসময় চিন্তা হতো। এত নরম সরম মেয়েটা কী করে জটিল পৃথিবীতে চলবে! আজ আমি ওর মাঝে যে আগুনটা দেখেছি তা ওকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। তুমি দ্যাখ আমাদের চারু অনেক বড়ো কিছু হবে।”
“তা না হয় বুঝলাম তুমি ওকে আনলে না কেন?”
“এখন যে ওর উড়ার সময় বাঁধলে চলবে কী করে। ও থাকুক ওর মতো করে। ওকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই।”
আনোয়ারা বুঝতে পারে না মানুষটা কী খুব কষ্টে কথাগুলো বলছে না কি খুশিতে। মুখ দেখে তিনি ধরতে পারছে না।
“আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে। আপনি গোসল করে আসেন। আমি খাবার দিই।”
আনোয়ারা কাজের মেয়েটাকে ডাকেন। “নায়লা কই রে মা?” কাজের মেয়ে ঠিক না। তারই দূর সম্পর্কের ভাগ্নী হয়। তার বড়ো ভাইজান গতকালই নায়লা কে দিয়ে গেছেন। নায়লার বাবা গ্রামে ভ্যান চালায়। মেয়েটা বেশ ভালো কাজকর্ম পারে। তিনি চিন্তা করেছেন মেয়েটাকে স্কুল ভর্তি করে দিবেন। তারা দুইজন মানুষ বাড়িতে থাকে তেমন কাজ নেই। একটা মেয়ে থাকলে টুকটাক সাহায্য করবে। মাঝে মেয়েটার সাথে গল্প করে সময় কাটবে।
নায়লা ছুটে আসে,” জি ফুফু।”
“খাবার খেতে আয়।”
আজ চারু আসবে মনে করে অনেক কিছু রান্না করেছে। আমজাদ সাহেব খেতে বসলেন।” তোমারাও বসো।”
প্লেটে ভাত দিতে দিতে আনোয়ারা বলল,” চারুর শাশুড়ি আজ কল দিয়েছিলেন।”
“কিছু বলেছে নাকি?”
“আমাদের সাথে আলাপ হয়নি একদিন বাসায় যেতে বললেন। “
“তা কবে যেতে বলেছেন?”
“ওরা পরশু ঢাকা ফিরবে তারপর সময় করে একদিন যেতে বললেন।”
“নীরুরা কেমন আছে কিছু বলল?”
“ওরা ভালোই আছে।”
আমজাদ সাহেবের মনে হচ্ছে আনোয়ারা তাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। সে ঠিক করতে পারছে না সে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করবে না কি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ