#অপয়া
মৌকে যেদিন বিয়ে করে প্রথম ঘরে আনলাম সেদিনই একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল, সেই রাতেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো। বিয়ে বাড়ি পরিণত হলো প্রায় মরা বাড়ীতে, আর আমি ভাবতেও পারিনি আমার আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে স্বয়ং মা পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করবেন যে মৌ অপয়া। অথচ বিয়েটা তাদের পছন্দ মতোই হয়েছে, হ্যাঁ বাবার কিছুটা অমত ছিল অবশ্য ।
যাই হোক সেদিন রাত থেকে হসপিটালে ছোটাছুটি করেই কয়েক দিন কেটে গেল, বাবা কে বাঁচানো গেল না। উল্টোদিকে মৌ এর নামের আগে অপয়া শব্দটা জুড়ে গেলো।
একদিন কাজ করার সময় ওর হাত থেকে পড়ে কাচের জগ ভেঙে গেল, খালাম্মা হই হই করে ছুটে এলেন, একি করলা তুমি বৌমা সংসারে বিপদ ডেকে আনবে নাকি, বিধির বিধান সেই সন্ধ্যা তেই খবর এলো বড় খালা ছাদে কাপড় তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেললো
আমি কিছুতেই মাকে বুঝাতে পারলাম না এগুলো কুসংস্কার ছাড়া আর কোন কিছুই না। মা ,চাচী ,ফুপু সবাই একমত এই মেয়ে এক নাম্বারের অপয়া।
মৌ সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকে ওর এই বিমর্ষ চেহারা দেখে আমার কিছুই ভালো লাগেনা, এর মাঝে আরেক ঘটনা ঘটলো, ছোট বোনটা কে দেখতে এলো বর পক্ষ। মৌ ওদেরকে খাবার সার্ভ করতে গেল, হঠাৎ অসাবধানতায় বরের মামার গায়ে শরবত পড়ে গেল, যদিও বরপক্ষ অতি বিনয়ের সাথে বললো এটা কোন ঘটনাই না কিন্তু আমার বাড়িতে এটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল।
বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি, সত্যি কথা বলতে কি তুলনা মূলক ভাবে আমার বোন একটু খাটো এর আগেও এই কারণে ওর আরো দুটো বিয়ে ভেঙে গেছে। কিন্তু এবার সব দোষ এলো মৌ এর ঘাড়ে।
ওর নিঃশব্দ কান্নার আর্তনাদ প্রায় রাতেই শুনতে পাই, কিন্তু আমি ভীষণ ভাবে আপসেট কোনভাবেই ফ্যামিলিকে বুঝাতে পারছি না।
দিনে দিনে ওর প্রতি মানসিক অত্যাচার বাড়তেই থাকলো, আমার মায়ের এমন রূপ আমি কখনো দেখিনি, পান থেকে চুন খসলেই যা খুশি তাই বলেন।
আবার আমার ছোট বোনকে দেখতে এলো বর পক্ষ। মা, চাচী সবাই মিলে মৌকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল, শুধু আমি জানি ওই সময় ওর মনে কি ঘটছিল? এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সত্য বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। বিয়ে ঠিক হবার পরে, আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো যতদিন না পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছে মৌ এই বাড়ীতে পা রাখতে পারবে না। একলা ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, তবুও ওর জন্য আমাকে এত টুকু করতেই হবে।সৃষ্টি কর্তা না করুন যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তাহলে হয়তো আবার ওর ঘাড়ে দোষ চাপাবে।
দেখতে দেখতে সানজানা মানে আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেল, মৌ বাড়ি ফিরে এলো সবকিছু চলতে লাগলো আগের নিয়মে। দিন পনেরো পরে সানজানা তার বর রিফাতকে নিয়ে বেড়াতে এলো, মৌ খুব আগ্রহ ভরে অনেক রান্না করলো। অনেকদিন পর দেখলাম ও নিজেকে পরিপাটি করছে। রিফাতকে ও সরাসরি দেখেনি, চুপি চুপি আমার সব সময় অগোছালো থাকা মৌ কে একটু গোছানো অবস্থায় দেখে আমার খুব মায়া লাগছিল। এমন সময় মা এসে বললেন,
-দেখ জামাই আসছে, তোর বউ যেন ওই ঘরে না যায়
-এটা কেমন কথা মা?
-আমি যেমন বলেছি তেমন এই নিয়ে আর কোন কথা হবে না।
মুহূর্তে ওর মুখটা কালো অন্ধকার হয়ে গেল, আমি ওর দিকে তাকানোর মত সাহস পেলাম না কিংবা হয়তো সেই যোগ্যতা আমার নেই। আমি আস্তে করে উঠে চলে গেলাম।
খাবার টেবিলে রিফাত বলে উঠলো,
-ভাইয়া ,ভাবি কোথায় ?বিয়ের সময়ও তো দেখলাম না।
আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকলাম
-ওর কথা বাদ দাও আমার হয়ে উত্তর দিলো সানজানা
-কেন ,কি হয়েছে, উনি কি অসুস্থ?
-ও অসুস্থ না কিন্তু আমাদেরকে অসুস্থ করবে ও একটা অপয়া, হয়তো তোমার দিকে তাকাবে তারপর তোমার একটা কিছু হয়ে যাবে, আমি এসব একদম চাইনা।
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো, খাবারের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে আমি উঠে চলে গেলাম।
রুমে ফিরে দেখলাম মৌ কাঁদছে, মানে পুরোটাই ও শুনেছে। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
-রিফাতকে দেখতে ছবির মতোই?
-হ্যাঁ আমি এককথায় উত্তর দিলাম
-সানজানা ওকে খুব ভালবাসে তাই না ?
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস এর শব্দ শুনতে পেলাম, খুব খারাপ লাগছিল।
আনুমানিক রাত সাড়ে বারোটার দিকে ফোন এলো হসপিটাল থেকে। সানজানা আর রিফাত ফিরে যাবার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, অ্যাক্সিডেন্টে সানজানার তেমন একটা কিছু হয়নি কিন্তু রিফাতের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা সবাই ছুটে গেলাম, সানজানা হসপিটালের মেঝেতে বসে আকুল হয়ে কাঁদছে, রাতটা ছিল ভয়াবহ, যেন শত সহস্র বছর দূরে ভোর। ভোর হলো, সূর্য উঠলো কিন্তু রিফাত চলে গেলো। সানজানা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁদতে লাগলো।
ওকে নিয়ে এলাম আমাদের বাড়িতে, মাত্র পনেরো দিনের সংসার আমার বোনের। কিন্তু কেমন যেন হয়ে গেছে, উল্টাপাল্টা কথা বলে, অনেক সময় চিনতে পারেনা। একজন ডাক্তারও দেখালাম, উনি বললেন হঠাৎ পাওয়া শক থেকে এরকম করছে, সবাই মিলে সময় দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু সানজানা নিজেকে একলা রুমে সবসময় বন্দী করে রাখে। খাওয়ার সময় অনেক ডাকাডাকি করে দরজা খুলতে হয়।
খাবারের টেবিলে বসে ক্রমাগত মা মৌকে গালিগালাজ করে যাচ্ছিলেন।
এই প্রথম মৌ কথা বললো,
-মা আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?
-তোমার চোখে লাগে না, তুমি আসার আগে আমার সংসার টা কি ছিল আর এখন আমার সংসারটা কি হয়েছে? আমাকে বিধবা করেছো আমার মেয়েটাকে বিধবা করেছো আর কি চাও তুমি?
-মা তুমি চুপ করবে? মাঝখান থেকে আমি বলে উঠলাম
-তুই চুপ কর, জিজ্ঞেস কর তোর বউকে কি চায়? আর কি দিলে ওর মন ভরবে আর কতটা খেলে ওর মন ভরবে? এই বলছিস না কেন তুই, ডাইনী কোথাকার ,কি চাস বল এখন বলবি, মা কেমন যেন পাগলের মত করছিলো।
-আমি চাই আপনি খাবার টা শেষ করুন আর চুপ করুন, কানে বড্ড লাগছে।
-লাথি মারি তোর ওই খাবারে আমি, মা চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলো।
-আমি খুবই দুঃখিত মৌ, বুঝতেই পারছো সানজানার এই অবস্থায় মায়ের মাথা ঠিক নেই, প্লিজ কিছু মনে করো না। আমি মাকে গিয়ে বুঝাচ্ছি, তিনি ঠিক বুঝবেন আমি খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
-খাবার শেষ করো, সকালে না হয় কথা বলো এখন উনি রেগে আছেন ।মৌ আমার হাত শক্ত করে ধরলো, আসলেই তো , আমি আবার বসে গেলাম।
সকাল বেলা মা নাস্তার টেবিলে আসলো না, জানি মৌ গিয়ে ডাকলে মা রেগে যাবে তাই নিজেই উঠে গেলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর মা দরজা খুললেন না, বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙতে হলো। চোখের সামনে দেখলাম আমার মা মাটিতে পড়ে আছে। ড্রাইভার এর সাহায্যে ধরাধরি করে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছালাম, বেঁচে আছে আমার মা কিন্তু খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থা। অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে, ডাক্তার বললেন উনার ব্রেইন হেমারেজ হয়েছে সোজা ভাষায় যেটাকে বলে স্ট্রোক। আর আপনারা আনতে অনেক দেরি করেছেন খুব সম্ভবত উনি রাতেই স্ট্রোক করেছেন। আমার মায়ের বামপাশ পুরোপুরি প্যারালাইসিস হয়ে গেল আর কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেলো।
এক বিকেলে সূর্য যখন অস্তগামী হঠাৎ আমার মনে পরলো মৌ মাকে শেষ কথাটা খাবার টেবিলে বলেছিলো আমি চাই আপনি চুপ করুন, এর মানে কি? সেই রাতে ও আমার হাত ধরে আটকেছিলো যেন মায়ের ঘরে না যাই, বিয়েতে বাবার মত ছিল না, সেই রাতেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো কারণ কি, বাবা সারাজীবন খুব healthy life lead করেছেন। রাতের সুনসান নিরবতায় free road এ রিফাত কেন এক্সিডেন্ট করবে? আমার মাথায় অনেক গুলো প্রশ্ন ঘুরছিল।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলাম, চা হাতে মৌ, কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।
– কোন প্রশ্ন করো না আর কোন উত্তর খুঁজতে যেও না, অপয়া ভেবো না, ভালোবাসি তোমাকে, তোমার কোন ক্ষতি হোক চাই না। হিমশীতল চোখে মৌ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর এই চোখ আমি আগে কখনো দেখিনি । প্রচন্ড ভয়ের একটা স্রোত যেন আমার শিড়দাড়া বেয়ে নেমে গেলো।