গায়ে হলুদের গোসল করা শেষ হতেই ভাবি আমার কানে কানে বললো,
” তোর বয়ফ্রেন্ড বারবার কল দিচ্ছে। ছেলেটা কি জানে যে তোর অন্য যায়গা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? ”
আমি কিছু না বলে চুপচাপ গামছা দিয়ে চুলের পানি মুছতে লাগলাম। ভাবি আমার হাতটা ধরে বললো,
” আমি জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কিছু করার নেই। তুই তো তোর বাবা আর ভাইকে ভালো করে চিনিস। তাদের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো কথা যায় না। ”
আমি বললাম ” তোমার কিছু করতে হবে না ভাবি৷ আমার কপালে যা আছে তাই হবে। ”
ভাবির সামনে থেকে নিজের রুমে এলাম। এসে দেখি তুমিও অনেকবার কল করেছ। তারপর তোমাকেই আগে কল দিলাম। কারণ আমি ভালো করে জানতাম তুমি আমাকে পালাতে সাহায্য করবে। আমি তোমার এই সাহায্য সারাজীবন মনে রাখবো ইমাদ।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে নোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে। আর নোরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইমাদ। ঠান্ডায় ইমাদের কাঁপুনি ধরে গেছে। একটা শীতের চাদর নিয়ে এসেছে সেটাও নোরা নিয়ে গেছে। নোরা বাসা থেকে পালানোর সময় কোনো শীতের কাপড়ও আনতে পারে নাই।
ইমাদ বললো ” তোমার বয়ফ্রেন্ডকে তাড়াতাড়ি কল দিয়ে আসতে বলো। ঠান্ডায় আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে ভাই। তোমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের হাতে তুলে দিয়ে আমি বাসায় যাবো। ”
” বাসায় যাবে মানে? তোমার সঙ্গে না কথা ছিল আমাদের সঙ্গে ঢাকা যাবে। তারপর সেখানে পৌঁছে দিয়ে তুমি আবার খুলনায় ব্যাক করবে। এরকমই তো কথা ছিল ইমাদ, তাই না? “
” হ্যাঁ ছিল, আর সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু কথা ছিল সেটা ভুলে গেছ? তুমি সঙ্গে করে কোনকিছু নিয়ে আসো নাই কেন? ”
” তুমি বুঝতে পারছ না কেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান, আজকে গায়ে হলুদ গেছে, কালকে বিয়ে হবে। তাই এখন যদি দেখে আমি সবকিছু ব্যাগ ভর্তি করে বাসা থেকে বের হচ্ছি তাহলে বের হতে দিবে? তাছাড়া রাহাতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। রাহাত বলেছে আমি এক কাপড়ে বের হলেই চলবে৷ ”
” তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কল দিয়েছ? ”
” দিচ্ছি তো বারবার কিন্তু কেন যে রিসিভ করছে না কে জানে। পাঁচ মিনিট আগে মেসেজ দিয়ে বললো যে, আমি একটু ব্যস্ত, পরে কল দিচ্ছি। আমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আর সে নাকি ব্যস্ত মানুষ। “
” বাহ বাহ, যার বিয়ে তার খবর নাই আর আমি ইমাদ বেকুবের মতো তোমাকে নিজের শীতের চাদর দিয়ে একা শীতে কাঁপছি। ”
” আর একবার চাদরের খোঁটা দিলে আমি কিন্তু তোমার চাদর তোমাকে ফিরিয়ে দেবো। ”
~
~
রাত ১০:২৬ মিনিট।
ইমাদ আর নোরা এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। যে বাসে তাদের ঢাকা যাবার কথা ছিল সেই বাস আরো ঘন্টা খানিক আগে চলে গেছে। নোরার বয়ফ্রেন্ড রাহাত এখনো আসেনি। রাহাতের নাম্বার অন আছে কিন্তু সে কল রিসিভ করছে না। নোরা বেশ কিছু মেসেজ করেছে কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসেনি।
নোরার কাছে গিয়ে ইমাদ বললো,
” একটা কথা বলবো? “
বিমর্ষ মুখে ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নোরা। নোরার এমন অসহায় মুখ দেখে ইমাদের মায়া লাগে। সে আবার চুপ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। নোরা তখন ইমাদের কথা শোনার জন্য নিজেই প্রশ্ন করে,
” কি বলবে বলো। তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না? তুমি কি চলে যাবে? “
” আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? রাহাত সাহেব তো এখনো আসছে না। এদিকে রাত অনেক হয়ে গেছে। তোমার বাসা থেকে আমাকে অনেকবার কল করেছে। ”
” রাহাতের নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নাহলে এভাবে সবকিছু প্ল্যান করে কল রিসিভ করবে না কেন। ”
” আমি বলি কি, তুমি বাসায় ফিরে যাও। ”
” কেন? আরেকজনকে বিয়ে করার জন্য? ”
” এছাড়া উপায় কি বলো তো? বাসায় হয়তো এখনো কাউকে তেমন বলেনি৷ কাল সকাল হলে সবাই জেনে যাবে তোমার পালানোর কথা। যেই বাড়িতে বিয়ে ঠিক হয়েছে তারাও জেনে যাবে বিয়ের কনে পালিয়ে গেছে। তখন আর ফিরে গিয়ে কিন্তু লাভ হবে না নোরা। ”
” আর যদি রাহাত কল করে বলে যে নোরা তুমি সামান্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারলে না। তখন কি জবাব দেবো তাকে? “
” তাহলে কী করবে এখন? ”
” এক কাজ করি, তোমার সঙ্গে তোমার বাসায় যাই চলো। আজকের রাতটা তোমার বাসায় নাহয় কাটিয়ে দেবো। তারপর সকালের আগেই রাহাত কল দিবে এটা শিওর। ”
” কিন্তু আমি ব্যাচেলর থাকি। সেখানে তোমাকে নিয়ে রাখা যাবে না। ”
” তাহলে কোই যাবো? ”
” আচ্ছা দেখি ব্যবস্থা করা যায় নাকি। ”
ইমাদ তার মোবাইল বের করে এক বন্ধুর কাছে কল করে। নোরা নিজের মোবাইল বের করে রাহাতের নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু রাহাত রিসিভ করে না। ইমাদ কথা শেষ করে বললো,
” আমার একটা ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে? সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। ওদের নিজেদের বাসা আছে সেখানে থাকতে পারবে। ”
নোরা কিছু বলার আগেই তার মোবাইলে রাহাত মেসেজ করে। মেসেজে একটা ঠিকানা দেওয়া আছে। ঠিকানা দিয়ে তার নিচে লিখেছে,
আমি হঠাৎ করে একটা ঝামেলায় পড়েছি নোরা। তুমি তো জানো আমি টুকটাক রাজনীতি করি। তুমি তোমার ফ্রেন্ড ইমাদকে নিয়ে একটু কষ্ট করে রূপসা নদীর এপাড়ে আসো৷ খেয়াঘাট থেকে নেমে নিচের নাম্বারে কল দিও। একটা ছেলে গিয়ে তোমাকে আর ইমাদকে নিয়ে আসবে। আমি এখানে একটা গ্রামের বাড়িতে আছি। তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আসো।
নোরা উচ্ছসিত হয়ে ইমাদের কাছে সবকিছু বললো। ইমাদ বিরক্ত হয়ে বললো,
” কনকনে শীতের রাতে এখন নদীর ওপাড়ে যেতে হবে? কেন সে এসে নিয়ে যায় না কেন। ”
” তুমি যাবে না? না গেলে বলো আমি একা একা চলে যাবো সমস্যা নেই। এই লোকটা আমাকে রাহাতের কাছে নিয়ে যাবে। ”
” একাই চলে যাবে? ”
” হ্যাঁ, কারণ আমার তো রাহাত ছাড়া আর কোনো স্থান নেই তাই না। তুমি নিজেই আজকের রাতটা শুধু রাখতে পারবে না একটু আগে বললে। তবুও যতটুকু করেছ তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ”
” চলো। ”
স্টেশন থেকে বের হয়ে ওরা ইজিবাইকে উঠে বসে। তারপর ইজিবাইকে চড়ে সোজা রূপসা ঘাটে। শীতের রাতে এগারোটা বাজতেই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। একটা বিভাগীয় প্রধান শহরে এরকম দৃশ্য অবাক হবার মতো। তবে নিস্তব্ধ এই রাতের শহর খুব একটা খারাপ লাগে না।
রূপসা নদী পার হয়ে রাহাতের পাঠানো সেই নাম্বারে কল করে নোরা। লোকটা ঘাটেই দাঁড়িয়ে ছিল, নোরা আর ইমাদের কাছে এসে দাঁড়াল।
” এখান থেকে কতদূর? ” প্রশ্ন করে ইমাদ।
” বেশি দুরে না, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। বাসায় যেতে বেশি সময় লাগবে না। ”
নোরা বললো,
” তুমি কি সঙ্গে যাবে? নাকি ম্যাসে ফিরে যাবে। ”
” যাবো। ”
কালো রঙের একটা প্রাইভেট কারে করে তারা রওনা দিল। গাড়ির মধ্যে আরেকজন আছে, তিনি হচ্ছেন ড্রাইভার। রাহাতের পাঠানো লোকটা আর ড্রাইভার বসেছে সামনে। নোরা আর ইমাদ পিছনে বসে আছে। নোরা বললো,
” আপনার নাম কি ভাই? “
” আমার নাম কবির হাওলাদার। ”
” আপনার সঙ্গে যেহেতু গাড়ি আছে তাহলে আপনি গাড়ি নিয়ে আমাকে আনতে যাননি কেন? “
” গাড়ি নিয়ে যেতে হলে সেই ব্রিজ ঘুরে তারপর যেতে হবে। সেজন্য আপনাদের ঘাট পার হয়ে আসতে বলেছি। ”
” রাহাত কি সেই বাড়িতেই আছে? ”
” না, তিনি কাজি আনতে গেছে, আপনাদের আজ রাতেই বিয়ে হবে। তারপর এই গাড়িতে করেই সকাল হবার আগে ঢাকায় রওনা দিবেন। ”
ইমাদ একমনে তার মোবাইল টিপছে। নোরা তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
” ইমাদ শুনছো, আজ রাতেই আমার বিয়ে। ”
~
~
রাত ০১ঃ৪৫ মিনিট।
প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে একটা রুমের মধ্যে বসে আছে নোরা ও ইমাদ। রাহাত এখনো আসেনি। কবির নামের লোকটা একটু পরপর এসে খবর নিয়ে যাচ্ছে। খাবারের ব্যবস্থা করেছে, ইমাদ ও নোরা একসঙ্গে খাবার শেষ করেছে।
খাবার শেষ করে নোরা শাড়ি পরার জন্য ইমাদকে রুম থেকে বের করে দিল। কবির নামের লোকটা বউ সাজার জন্য যা যা দরকার সবকিছু দিয়ে গেছে। রাহাত এলেই নাকি বিয়ে হবে। আবার কোনো ঝামেলা হলো কিনা কে জানে।
ইমাদ বাহিরে আছে, শীতের চাদরটা এখন ইমাদ জড়িয়ে রেখেছে। নোরা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা বিদেশি সোয়েটার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নোরা যেহেতু শাড়ি পরবে তাই সবকিছু এখন বাদ।
ড্রইং রুমে ওপাশে আরেকটা রুম আছে। সেই রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে ইমাদ। ইমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কবির হাওলাদার।
” ইমাদ বললো, সকাল হবার আগেই লাশগুলো কীভাবে সরানো যায় কিছু ভেবেছ? ”
কবির বললো, ” কোনো চিন্তা করবেন না ভাই। আপনি মেয়েটাকে মারার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করে দেবো। ”
” রাহাতের লাশ কোথায়? ”
” পাশের ঘরেই আছে, ফ্লোরে যেসব রক্ত ছিল সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। ”
” আমি নোরাকে খুন করার পরে এখানে কিন্তু এক মুহূর্তও থাকবো না। তুমি আর সবুজ দুজন মিলে লাশ গুম করে তারপর আসবে। ”
” ভাই একটা কথা বলি? ”
” বলো! ”
” মেয়েটাকে মেরেই ফেলবেন তাহলে এভাবে শাড়ি পরিয়ে বউ সাজানোর দরকার কি? শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়। ”
” যে যন্ত্রণা দুই বছর ধরে বুকের ভেতর বাসা বেঁধে আছে সেই যন্ত্রণা সহজে শেষ হয় না। বিয়ের সাজে সজ্জিত অবস্থায় নোরাকে যখন খুন করবো তখন পুরনো সব কষ্ট আমি ভুলে যেতে পারবো। ”
” শাড়ি পরে বের হলেই কি খুন করবেন? ”
” দেখি কি করা যায়। ”
ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইমাদ আর কবিরের সব কথা শুনে ফেললো নোরা। সে ইমাদের কাছে এসেছিল কিছু একটা নিতে। শাড়ি এখনো পরেনি। ইমাদের সমস্ত কথা শুনে শরীর কাঁপতে লাগলো নোরার।
নোরা বিড়বিড় করে বললো ” রাহাতকে ইমাদ খুন করে ফেলেছে? কিন্তু কেন? ”
কবির যেহেতু বলেছিল রাহাতের লাশ পাশের রুমে আছে তাই নোরা নিঃশব্দে পাশের রুমের খোঁজ নিল। ফ্ল্যাটের মধ্যে মোট তিনটা রুম এবং একটা ড্রইং ডাইনিং আছে। এক রুমের বারান্দায় ইমাদ ও কবির দাঁড়িয়ে আছে। আরেক রুমে নোরা ছিল। তাই বাকি আরেকটা রুমের মধ্যে গেল নোরা। দরজা বাহির থেকে ভেড়ানো ছিল। রুমের মধ্যে গিয়ে একটা সাদা রঙের বস্তা দেখতে পেল।
নোরা সেই বস্তার মুখ খুলে দেখে সেখানে একটা মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে কেটে রাখা হয়েছে। নোরার হাত-পা শীতের রাতে আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে জমে গেল।
নোরার হঠাৎ মনে হলো তাকে তো পালাতে হবে। নাহলে ইমাদ তাকেও মেরে ফেলবে। পিছন ফিরে তাকাতেই নোরা দেখল দরজার সামনে ইমাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কবির হাওলাদার। নোরার হাত-পা কাঁপতে লাগলো।
ইমাদ তার পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে নোরার হাতে দিল। মোবাইলটা রাহাতের, রাহাতের মোবাইলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নোরা।
ইমাদ বললো, ” রাহাত সাহেবকে বিকেলেই বন্দী করে আনা হয়েছে। তুমি যখন তার কল রিসিভ করোনি তখন তিনি আমাকে কল করেন। আমি তাকে কৌশলে এখানে নিয়ে আসি মিথ্যা বলে। আর সন্ধ্যা থেকে যেসব মেসেজ রাহাতের মোবাইল তোমার মোবাইলে গেছে সেগুলো সব কবির তোমাকে দিয়েছে। ”
নোরা কাঁদতে কাঁদতে বললো ” তুমি ওকে কেন খুন করলে? ”
ইমাদ তার হাতের সিগারেটে আরেকটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,
” শুধু সে নয়, তোমাকেও খুন করবো। যাও সুন্দর করে শাড়ি পরে আসো৷ ”
~ চলবে….
|
গল্পঃ-
#ল্যাম্পপোস্টের_অচেনা_রূপ।
#পর্বঃ- ০১.
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
#ল্যাম্পপোস্টের_অচেনা_রূপ.
#পর্ব:- ০২
ইমাদ নোরাকে লাল শাড়িতে বউ সাজিয়ে কেন খুন করতে চায় সেটাই বুঝতে পারছে না নোরা। বেশ কিছু সময় সে ইমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ইমাদ বললো,
” দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করো না নোরা। তুমি তাড়াতাড়ি বউ সেজে আসো, তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। তারপরও যদি কিছু দরকার হয় তাহলে ডাক দিও। “
নোরা একটুও নড়লো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে চোখের দৃষ্টি সাদা বস্তাবন্দি রাহাতের লাশের টুকরোর দিকে।
নোরা সেদিকে তাকিয়ে ইমাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” আমাকেও খুন করে এভাবে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে দিবে তাই না? ”
” না তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। ”
” কি ব্যবস্থা? ”
” এতো অধৈর্য কেন তুমি? তোমাকে তো সবকিছু জানানো হবে। যাও তাড়াতাড়ি শাড়ি পরো। ”
ইমাদ আবার কবিরকে বললো,
” ওর কাছ থেকে মোবাইল দুটো নিয়ে আয় কবির। এতক্ষণ তো নোরা কিছু জানতো না তাই নিজে থেকে কাউকে করতো না। কিন্তু এখন তো নোরা বুঝতে পেরেছে তাই কল দিয়ে বলে দিবে। ”
কবির সামনে এগিয়ে এসে নোরার হাত থেকে রাহাতের মোবাইলটা নিয়ে গেল। নোরার নিজের মোবাইলও তার হাত ছিল, সেটাও হাত থেকে ছিনিয়ে নিল কবির।
ইমাদ নোরার ডান হাতটা ধরে টেনে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারপর পাশের রুমে গিয়ে বিয়ের শাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
” ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হবে। আমি ৩০ মিনিট পরে দরজা খুলে যেন দেখি তুমি বউ সেজে খাটে বসে আছো। ”
নোরা তাকিয়ে রইল নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগা এই মানুষটার দিকে। যে মানুষটার হাতে হয়তো আগামীকাল সকাল হবার আগেই তার মৃত্যু হবে। অথচ নোরা এই ইমাদের একটা নাম দিয়েছিল ল্যাম্পপোস্ট।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট যেমন কোনো স্বার্থ ছাড়া মানুষের পথচলার জন্য উপকার করে। ইমাদও ঠিক তেমনিভাবে নোরার জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে সাহায্য করতো। নোরা তার জীবনে যতগুলো মানুষের সন্নিকটে এসেছে তাদের সবার মধ্যে ইমাদ ছিল সবচেয়ে আলাদা। অথচ তার সেই সাহায্যের ” ল্যাম্পপোস্টের অচেনা রূপ ” আজ তাকে অবাক করছে খুব।
নোরা বললো,
” যদি শাড়ি না পরি, যদি তোমার কথা মতো কাজ না করি তাহলে কি করবে? মেরে ফেলবে! তুমি তো আমাকে এমনিতেই মেরে ফেলবে, তাহলে শাড়ি পরে আর কি হবে। মেরে ফেলো, এতো নাটক করার কি আছে? ”
ইমাদ আরেকটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট হাতে নিয়ে বললো,
” ৩০ মিনিট পর যদি তৈরি না হও তাহলে প্রতি পাঁচ মিনিটের জন্য তোমার হাতের একটা করে আঙ্গুল কাটা হবে। ”
ইমাদ রুম থেকে বের হয়ে দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিল। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারও এসে হাজির হয়েছে।ড্রাইভারের নাম জামসেদ, ইমাদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
” কবরস্থানের সবকিছু রেডি হয়েছে? ”
জামসেদ বেশ গর্বের সঙ্গে বললো,
” জ্বি ভাই আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই সব করা হয়েছে। শীতের রাতে সহজে ঘর থেকে কেউ বাহিরে আসে না। আর কবরস্থানে যাবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ”
” ঠিক আছে চলো, কবরস্থান থেকে ঘুরে আসি৷ তারপর ফিরে এসে বাকি কাজ করবো। ”
কবির পিছন থেকে বললো,
” আমি কি বাড়িতে থাকবো নাকি সঙ্গে আসবো? ”
” তুমি কবরস্থানে গিয়ে কি করবে? এখানে নোরা একা একা আছে, তার যদি কিছু দরকার হয় তাহলে তখন পাবে সে কোথায়? “
” দরকার হলেই তো হবে না ইমাদ ভাই। এতো রাতে কিছু চাইলেই তো এনে দিতে পারবো না। তাছাড়া আপনি কবরস্থানে গেলে আমি কি দরজা খুলবো নাকি বলেন? ”
ইমাদ খানিকটা ভাবলো, তারপর বললো,
” না খোলার দরকার নেই। ভিতরে তো অনেক কিছু আছে, দেখা গেল ভারি শক্ত কিছু একটা নিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করবে। তুমি দরজা খুলতেই আঘাত করবে মাথায়। ”
” ঠিক আছে তাহলে খুলবো না। ”
কবিরকে রেখে জামসেদ ও ইমাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। চারিদিকে ঘনঘন কুয়াশায় ছেয়ে গেছে সম্পুর্ণ গ্রাম। বাড়ি থেকে বের হয়েই রাস্তা দিয়ে খানিকটা সামনে গিয়ে মাঠের মধ্যে নেমে গেল দুজনেই। কবরস্থানে যেতে গেলে মাঠ থেকে যদি যায় তাহলে মানুষের সামনে পরার সম্ভবনা নেই। কিন্তু রাস্তা দিয়ে গেলে কেউ না কেউ সামনে আসতেই পারে, যদি আসে?
— — — — — — — — — — —
প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে রোমানদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। সৈকতের হাতে একটা ব্যাঙ, দুটো তাবিজ ও একটা গামছা। এগুলো তাদের একটা কবরের মধ্যে ফেলতে হবে। সৈকত তাই দাঁড়িয়ে আছে রোমানের অপেক্ষায়। একা একা এতো রাতে সৈকত কবরস্থানে কিছুতেই যেতে পারবে না। তাই তারা দুজন মিলে যাবে।
ছোট্ট একটা ক্ষীণ আলো আসছে এগিয়ে। সৈকত বুঝতে পারলো রোমান বাসা থেকে বের হয়েছে। বিড়বিড় করে বললো ” শালা এতক্ষণে বাসা থেকে বের হবার হলো। ”
কাছে এসেই রোমান বললো,
” সবকিছু ঠিকঠাক এনেছিস তো? ”
” তোর কি মনে হয় আমি ফেলে আসবো কিছু? কাজটা তো আমার তাই না? তোর কাজ হলে নাহয় বুঝতাম। ”
” তোর কি মনে হয় এগুলো করলে তুই তানিয়ার মা-বাবাকে রাজি করাতে পারবি? ”
” রাজি না হয়ে যাবে কোই? কবিরাজ তো ভালো করেই বলে দিল যদি ব্যাঙ, গামছা পড়া, আর তাবিজ দুটো পুরনো কবরের মধ্যে ফেলতে পারি তাহলে কাজ হবে। ”
” দেখ সৈকত, এসব কবিরাজ আমার একদম বিশ্বাস হয় না ভাই। সব টাকা খাবার ধান্দা, এসব কবরের মধ্যে ফেললে মানুষ কীভাবে রাজি হবে বল তো আমাকে? ”
” তোকে বিশ্বাস করতে হবে না। তুই শুধু আমার সঙ্গে চল, আমিই যা করার করবো। ”
” কবরের মধ্যে কীভাবে ফেলবি? কবর খুড়তে হবে নাকি অন্য কোনো বুদ্ধি আছে? ”
” একটা শাবল নিছি সঙ্গে। শুধু কবরের মধ্যে প্রথমে ঢুকাবো। তারপর কবরের বাঁশ চিরে যখন ভিতরে চলে যাবে তখন তো ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হবে। তারপর ছিদ্রটা বড় করবো, সেই ছিদ্র দিয়ে ভিতরে ফেলে দেবো। ”
” দেখা গেল কবরের লাশ তোর শাবল টেনে ধরলো তখন কি করবি সৈকত? টেনে ধরে যদি বলে, কিরে তোদের জন্য মরেও শান্তি নেই নাকি। ”
” ফাজলামো করিস না তো, এমনিতেই মনের মধ্যে ভয় লাগছে। বেশিক্ষণ কিন্তু দেরি করবো না। ”
” ঠিক আছে চল চল। ”
গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে নির্জন এ স্থানটা। এখানে আশেপাশে বহুদূর কোনো বাড়িঘর নেই। যাদের এই কবরস্থান, তাদের সর্বশেষ পদচারন ছিল বছর দশেক আগে। বাড়ির মালিক ৮৬ বছর বয়সে যখন মারা গেল তখন তাকে এই কবরস্থানে কবর দিয়ে আনাগোনা শেষ হয়েছে। যারা উত্তরসূরী বেঁচে আছে তারা সবাই ঢাকার বাসিন্দা।
সৈকত ও রোমান দুজনেই কবরস্থানে ঢুকলো। কবরস্থানে ঢুকেই একটা বিশাল গর্ত খোঁড়া দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজনেই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ভয় পেল রোমান। বাতি বন্ধ করে রোমান বললো,
” এখানে কবর খুঁড়েছে কে? ”
এক অন্ধ আরেকজন অন্ধের কাছে পথের কথা জিজ্ঞেস করলে যেমন হয়। সৈকত বললো,
” আমি কীভাবে জানবো? সন্ধ্যা বেলা যখন দেখে গেলাম তখন তো কিছু ছিল না। তাহলে এই রাতের মধ্যে গর্ত এলো কীভাবে? ”
” আমি ভেবেছিলাম তুই খুঁড়েছিস মনে হয়। ”
” আমি কেন খুঁড়বো? “
” চল পালিয়ে যাই, আমার কেমন ভয় লাগছে। চারিদিক কতো নির্জন, যদি কোনো মানুষও হয় তাহলে আমাদের কিন্তু মেরে ফেলবে। রাতের অন্ধকারে কবর খুঁড়েছে এ-র মানে হচ্ছে তারা নিশ্চয়ই অবৈধ কিছু করবে। সেখানে আমাদের সাক্ষী হিসেবে কোনদিন বাঁচিয়ে রাখবে না। ”
” ওটা কি রে? মানুষের কণ্ঠ তাই না? ”
মোবাইলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে ইমাদ ও জামসেদ। ইমাদের কথা শুনেই চমকে গেছে সৈকত।
রোমান বললো, ” তাই তো, মানুষ মনে হয়! “
” ওরা তো এদিকেই আসছে, চল পালাই। ”
” পালানোর দরকার নেই, কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি ওরা কি করতে চায়। ”
” মরার জন্য নাকি? চল ভাই। ”
দুজন মিলে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে পিছনে যেতে লাগলো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ রোমানের, কারণ সে একটা খাদের মধ্যে পরে গেল। সম্ভবত কোনো ভাঙ্গা কবর কিংবা শেয়ালের গর্ত হতে পারে। কবরস্থানের পুরোটা বিভিন্ন ছোটছোট ঝোপঝাড় আর লতাপাতা দিয়ে আবৃত। সেখানে কোথায় গর্ত ছিল সেটা তাদের জানার কথা নয়। এদিকে ইমাদ ও জামসেদ কবরস্থানের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। সৈকত চাইলেও তখন মোবাইলের বাতি ব্যবহার করতে পারছে না। অন্ধকারে তাদের সেই মোবাইলের আলো দেখে ফেলবে তারা।
রোমান বললো,
” দোস্ত পা মনে হয় ভেঙ্গে গেল রে। আমাকে ধর। “
সৈকত ফিসফিস করে বললো,
” তুই কোনো কথা বলিস না। চুপচাপ একটু বসে থাক রোমান ওরা কবরস্থানে এসে গেছে। আমিও ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকি। নাহলে দুজনেই মরে যেতে পারি। ”
রোমানের পায়ে প্রচুর ব্যথা করছে তবুও রোমান মুখে হাত চেপে ধরে বসে আছে। ইমাদ ও জামসেদ তাদের সেই খুঁড়ে রাখা গর্তের কাছে এসে দাঁড়ালো।
ইমাদের কাছে কল করেছে কবির।
ইমাদ বললো,
” কবির বলো। ”
” ভাই কাজি সাহেবকে পাওয়া যায়নি৷ তবে এক হুজুরকে ধরে আনা হয়েছে, সে বিয়ে পড়াতে পারে। কিন্তু তার কাছে কাবিনের কাগজপত্র নেই। ”
” তাতেই চলবে, কাবিনের কাগজপত্র দিয়ে আমার কাজ কি কবির? নোরা বউ সাজলে আমি তাকে বিয়ে করবো তারপর আমাদের বাসর হবে। আমি তো তার সঙ্গে সংসার করবো না। ”
” ভাই মেরেই তো ফেলবেন, তাহলে আবার বিয়ের কি দরকার। সকাল কিন্তু হয়ে যাচ্ছে প্রায়। বেশি দেরি করলে তখন কিন্তু লাশ নিয়ে বিপদ হবে। ”
” আমি কি নোরার সঙ্গে অবৈধভাবে মেলামেশা করবো নাকি। সেজন্য তো বিয়ে করে বউ বানিয়ে নেবো। তুমি চিন্তা করো না, আমরা আসছি৷ ”
ইমাদ কল কেটে দিল। অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবির মনে মনে বললো ” শালা ফাজিল, খুন করবে তাতে দোষ নেই, অবৈধভাবে মেলামেশা করলে দোষ। ”
~
~
~ চলবে…..
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
#ল্যাম্পপোস্টের অচেনা রূপ পর্ব ৩ (শেষ)
কবিরের সঙ্গে কথা শেষ করে ইমাদ তার সঙ্গের জামসেদকে বললো,
” এখানে লাশ পুতে রাখলে কেউ জানবে না তো আবার? ”
” কি যে বলেন ভাই! এই ছাড়া বাড়িতে পুরনো কবরস্থানে দিনের বেলাতেই মানুষ ভয়ে আসে না। এটা একদম নিরাপদ। তাছাড়া,,! ”
” তাছাড়া কি? ”
” আমরা লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে তারপর মাটিচাপা দিয়ে মাটির উপর লতাপাতা দিয়ে দেবো। কেউ যদি ভুল করেও আসে তবুও এখানে যে গর্ত খোঁড়া হয়েছে সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। ”
” কদিন পরে তো গর্তের উপর লতাপাতা শুকিয়ে যাবে তখন যদি দেখা যায়? ”
” ততদিনে কেউ বুঝবে না ভাই। আর কবরস্থান কেউ খুঁড়বে না। আর ওই ছেলে মেয়ে দুজন তো এই গ্রামের না তাই সন্দেহ করবে না। ”
ঠিক তখনই ইমাদের মোবাইলটা আবারও শব্দ করে কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো কবির আবারও কল করেছে।
” হ্যাঁ কবির। ”
” ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। ”
” কি হয়েছে? ”
” ওই মেয়ে তো রুমের মধ্যে ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। ”
আৎকে ওঠে ইমাদ!
” কি বলো এসব? নোরা আত্মহত্যা করতে চায় কেন? তুমি ওকে আটকাও। ”
” ভাই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন ভাই, ফাঁস নিলেই কিন্তু মরে যাবে। আপনার আর বিয়ে করা হবে না। ”
” তুমি দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করো আমি এখনই আসতেছি। যেভাবেই হোক দরজা ভেঙ্গে ওকে থামাও। দরকার হলে চড়থাপ্পড় লাগাও। তবুও যেন মরতে না পারে। ”
কল কেটে দিয়ে ইমাদ আর জামসেদ কবরস্থান থেকে বের হয়ে গেল। জামসেদ বললো,
” ভাই কি হয়েছে? ”
” নোরা নাকি রুমের মধ্যে গলায় ফাঁস দেবার চেষ্টা করছে। মেয়ে মানুষ আর ভালো হবে না। একটু পরে তো এমনিতেই মারতাম, তাহলে আগেই মরার জন্য লাফালাফি কিসের। ”
” ভাই মরলে কিন্তু আপনার পাপ কম হবে। তখন সব পাপা হবে ওই মেয়ের নামে। আত্মহত্যা করার জন্য যেই পাপা হয় সেই পাপা হবে। ”
ইমাদ কিছু বলে না কিন্তু বিরক্ত হয়েছে খুব। মনের বিরক্ত সে মনের মধ্যেই রাখলো৷ দ্রুত পা চালিয়ে মাঠের ভেতর থেকে হাঁটতে লাগলো।
জামসেদ ও ইমাদ কবরস্থান থেকে যাবার পাঁচ মিনিট পরেই সৈকত ফিসফিস করে রোমানের নাম ধরে ডাকলো৷
” রোমান, এই রোমাইন্না কোই তুই? ”
” আমি তো কবরের মধ্যে। ”
” ওরা চলে গেছে, তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়। ওদের পিছন পিছন যেতে হবে রে, ওরা কাকে যেন খুন করে এখানে লাশ লুকাবে৷ সেজন্য এখানে এসে গর্ত করেছে। ”
” আমার তো পা মচকে গেছে মনে হয়। আমি কীভাবে যাবো বল তো? ”
” তাহলে তুই থাক আমি যাই। দেখি লোকজন খবর দিয়ে ধরতে হবে তো নাহলে ওরা খুন করবে। তোর চাচার কাছে কল করতে হবে। ”
” আমি থাকবো মানে? এই বাগানের মধ্যে পুরনো কবরস্থানে ভাঙ্গা কবরের মধ্যে থাকবো নাকি? তাহলে তো আর আমাকে পেতে হবে না। সকালে এসে মাটিচাপা দিয়ে যাবি। ”
” কবরস্থানে আবার ভয় কিসের? একদিন মরলে তখন তো এভাবেই কবর দিয়ে রেখে যাবে। আর সেই সময় কীভাবে থাকবি? ”
কথা বলতে বলতে রোমানকে টেনে তোলে সৈকত। অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে দুজন মিলে কবরস্থান থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে চলতে থাকে।
↓
↓
কবির তখন মোবাইলে বলেছিল যে বিয়ে পড়াতে পারে এরকম একজনকে আনা হয়েছে। আসলে কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। সেরকম একজন পাওয়া গেছে, তাই তাকে নিয়ে আসা যায় কিনা এটা বোঝার জন্য কবির বাড়িয়ে বলেছিল। মূলত যাকে পাঠানো হয়েছে সে এখনো আসেনি। তবে বলেছে কাজি পাওয়া যাবে না।
বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে কবিরের নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকে ইমাদ। কিন্তু সমস্ত বাড়ি নিশ্চুপ, কোথাও কেউ নাই।
ইমাদ একটু ঘাবড়ে গেল, কিন্তু তবুও সতর্কতার সঙ্গে চারিদিকে উঁকি দিল। রাহাতের লাশ সেখানে সেভাবেই পড়ে আছে। কিন্তু কবিরের থাকার কথা ছিল বাহিরে, সে নেই কেন।
ইমাদ এবার জানালা দিয়ে নোরা যে রুমে ছিল সেই রুমে উঁকি দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু রুমের মধ্যে অন্ধকার, নোরা বাতি বন্ধ করে রেখেছে। ইমাদ মোবাইলে বাতি জ্বালিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু তেমন কিছু পেল না। একটা টর্চ এনে চেষ্টা করা হলো তবুও ব্যর্থ হয়ে গেল ইমাদ।
” দরজা খোলা ইমাদ ভাই। ” দরজার সামনে থেকে জানালো জামসেদ।
” কি বলো, ভেতরে যাওয়া যাবে? ”
” হ্যাঁ যাবে, আসেন। ”
” তুমি আমার পিছনে থাকো, কবির কোথায় গেল কে জানে? নোরার রুম অন্ধকার কেন। ”
টর্চ হাতে নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো ইমাদ। ভেতরে ঢুকেই সে দরজার দু’দিকে টর্চ ধরলো কারণ নোরা যদি আক্রমণ করতে চায় তাহলে দরজার কাছেই লুকাবে।
ঠিক এখানেই ইমাদের ভুলটা হলো।
চারিদিকে লাইট দিয়ে খুঁজে রুমের মধ্যে কিছু পাওয়া গেল না। রুমের বাতি জ্বালিয়ে দিল ইমাদ। জামসেদ তখন ওয়াশরুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কবির। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
কিছুক্ষণ আগে নোরা যখন দিকবিদিকশুন্য হয়ে মরতে চাচ্ছিল। তখন কবিরের রুমের মধ্যে প্রবেশ করার আগ্রহটা নোরার মাথায় একটা বুদ্ধি এনে দেয়। কবির দরজা ধাক্কাতে ব্যস্ত ছিল, নোরা তখন নিচে নেমে আসে৷ কবির যদি আবারও জানালার কাছে যেত তাহলে হয়তো দেখতে পেত নোরা নেমে গেছে। কিন্তু কবির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো।
নোরা খাটের পাশে একটা ফুলদানিতে রাখা ফুল দেখে সেই ফুলটা বের করলো। তারপর ফুলদানি হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ডান হাত দিয়ে ফুলদানি শক্ত করে ধরে প্রস্তুতি নিয়ে বাম।হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল। উপরে ও মিডেলে দুটো ছিটকিনি ছিল।
ইমাদ কবিরকে সতর্ক করেছিল যে দরজা খুলে দিলে নোরা আঘাত করবে। কিন্তু কবিরের সেই কথা মাথায় ছিল না। নোরার কাছে মাত্র তিন সেকেন্ড যথেষ্ট ছিল একটা আঘাত করার জন্য। যা হবার হবে, মরতেই তো হবে তাহলে একটু রিস্ক নিতে দোষ কি?
দরজা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে রুমের মধ্যে ঢুকতেই মাথা লক্ষ্য করে ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে নোরা। নোরার ভাগ্য ভালো তবে কবিরের ভাগ্য যথেষ্ট খারাপ।
এক আঘাতেই কবির ফ্লোরে পড়ে গেল। নোরার তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তখন ফুলদানি হাতে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। কিছুক্ষণ পরে নিস্তেজ হয়ে যায় কবির। নোরা কবিরের দেহটা টেনে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে রাখে। তারপর রুমে ফ্লোরের রক্ত বিছানার চাদর দিয়ে মুছে চাদরটা খাটের নিচে রেখে বাতি বন্ধ করে বের হয়ে যায়। বের হবার সময় দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
বাড়ির ভিতর থেকে বের হতেই প্রানের মধ্যে বেঁচে থাকার আশার আলো দেখতে পেল নোরা। কিন্তু তখনই সামনের দিক থেকে কাউকে আসতে দেখে লুকিয়ে গেল সে। ইমাদ আর জামসেদ! নোরা চুপচাপ লুকিয়ে থাকে, ইমাদ আর জামসেদ বাড়ির ভিতর ঢুকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নোরা আবার হাঁটতে শুরু করে। কিছুটা সামনে গিয়ে সে গতিপথ পরিবর্তন করে কারণ রাস্তায় যদি কেউ ইমাদের সঙ্গের থাকে। তাই নোরা ডানদিকে মাঠের মধ্যে নেমে যায় আর তখনই দেখা হয় সৈকত ও রোমানের সঙ্গে। সৈকতের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে রোমান। মুখোমুখি হতেই নোরার গলা শুকিয়ে গেল। রোমান ও সৈকত দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা বুঝতে পারছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা একটা মেয়ে।
রোমান বললো ” দোস্ত এতো রাতে মেয়ে মানুষ আসলো কীভাবে? এই কে আপনি? ”
নোরা বুঝতে পারছে না তার কি করার উচিৎ। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখের উপর মোবাইলের আলো ফেললো সৈকত।
” কে আপনি, আগে তো কখনো দেখিনি! ”
নোরা বুঝতে পারলো এরা আর যাই হোক কিন্তু ইমাদের লোক নয়।
নোরা বললো, ” এখান থেকে খুলনা শহরের মধ্যে যাবার রাস্তাটা কোনদিকে বলতে পারেন? ”
” রাস্তা থেকে মাঠের মধ্যে নেমে আপনি রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছেন নাকি? ” বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো রোমান।
কিন্তু সৈকত বললো, ” এই শীতের মধ্যেও আপনি ঘামছেন। আর আপনার ওড়নায় রক্ত কিসের? আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন। ”
নোরা এবার হাতজোড় করে বললো, ” ভাই আমি বড় একটা বিপদের মধ্যে আছি। আমার এক বন্ধু আমাকে ষড়যন্ত্র করে নিয়ে এসেছে। ও আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুন করেছে, আমাকেও খুন করতে চায়। ”
রোমান বললো ” দোস্ত এদের জন্যই কি কবরস্থানে কবর খুঁড়েছে ওরা? ”
” হতে পারে। ”
” ভাই আপনারা কার কথা বলছেন? ”
” আমরা কবরস্থানে দুটো লোককে দেখেছি। তারা একটু আগে এদিকেই এসেছে। আচ্ছা এখন কথা বলে সময় নষ্ট করবো না। আমি রোমানের চাচাকে কল করেছি, এখনই পুলিশ চলে আসবে, আপনি চলুন। ”
নোরা এক মুহূর্ত ভাবলো যাবে কি যাবে না। পরে অবশ্য যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ সে না গেলে ওই বাড়ি এরা হয়তো চিনবে না।
নোরা বললো ” ওরা মনে হয় বাড়ির ভিতর আছে। আমি ওদের যেতে দেখেছি। ”
” তাহলে সেখানেই ধরতে হবে। রোমান তুই চাচার কাছে আবার কল দে তো। ”
↓
↓
↓
সকাল আটটা।
মা-বাবা ও পুলিশের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে নোরা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। রোমানের পায়ের ব্যথা বেড়েছে বলে সে বাড়িতে চলে গেছে। রাহাত ইমাদের লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আহত কবিরকেও নিয়ে গেছে সেখানে। শুধু অক্ষত ছিল জামসেদ, তাকে আপাতত হাজতে রাখা হয়েছে।
ইমাদ পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নিজেই নিজের গলায় ছুড়ি চালিয়েছে। তবে মৃত্যুর আগে জামসেদকে বলেছে ” তোমরা তো বেশি দোষ করো নাই, তোমাদের শাস্তি কম হবে। পুলিশের কাছে ধরা দাও। আমাকে পেলে ফাঁসি দিবে। ”
পুলিশের সবকিছু জবানবন্দি দিয়ে সৈকতের কাছে বিদায় নিয়ে নিজের মা-বাবার সঙ্গে বাসায় রওনা দিল নোরা। ইমাদের জঘন্য আচরণের কোনো কারণ জানতে পারলো না। রাহাতকে ইমাদ খুন করলো কেন সেটাও জানা গেল না। তবে নোরা নিজের মনে মনে বহুদিন আগের একটা ঘটনা কারণ হিসেবে ভাবছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি জোড়ালো কারণ নয়।
ঘটনাটা ছিল ” নোরার সঙ্গে ইমাদের এরকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাহাত মানতে পারতো না। আর সে কারনেই ইমাদকে অনেক অপমান করেছিল রাহাত। তখন আবার নোরা ইমাদের এক বন্ধুর কাছে জানতে পেরেছিল ইমাদ ওকে পছন্দ করে। কিন্তু ইমাদকে জিজ্ঞেস করাতে সে অস্বীকার করে। তারপর থেকে আবার সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। রিফাত আর ঝামেলা করেনি। কিন্তু সেই অপমান ইমাদ নিজের মধ্যে পুষে রেখেছিল কিনা সেটাই ভাবছে নোরা।
সারারাতের পরিশ্রম আর ঠান্ডায় নোরার শরীরে জ্বর এসে গেল। সে তার মায়ের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। ব্যস্ত শহরের হাজারো মানুষ পেরিয়ে তারাও চলছে আপন আলয়ে।
ইমাদের উপর নোরার করা সন্দেহের সত্যতা প্রমাণিত হয় কবির সুস্থ হবার পর। কবিরের কাছে যখন নোরা জিজ্ঞেস করলো ইমাদ কেন করেছিল এমনটা। তখন কবির ঠিক সেই পুরনো ঘটনাই নোরার কাছে বললো। কবিরের মুখে শুনে সেদিন আবার নোরা ভাবতে লাগলো, পৃথিবীতে কত মানুষ কতকিছুই তো ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু সবাই পারে না কেন। কেন পুষে রাখে মনে, গোপনে।
সমাপ্ত।
মোঃ সাইফুল ইসলাম।