#গল্প
#একটি ডিভোর্স লেটার পর্ব ৪
তওসিফের সাথে দেখা
তওসিফের ভীষণ মেজাজ খারাপ লাগছে, সামনে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাই নাকি ক’দিন আগে তিন্নিকে ফোন করে ওর সাথে দেখা করেছে। তারপর নাকি রীতিমতো ওকে জেরা করেছে কেন তওসিফকে বিয়ে করবে। ও ভেবে পাচ্ছিল না এই মেয়ের সমস্যা কোথায়। তিন্নি ওকে বিয়ে করলে এই মেয়ের কী এসে যায়?? তিন্নি ভীষণ রাগ করেছে, ও সাফ জানিয়ে দিয়েছে ওকে যেনো কোনো ঝামেলায় জড়ানো না হয়।
গতকাল ওকে যখন ফোন করল তখন বলল ভুলে নাকি ডিভোর্স লেটারটা ওনার বাসায় চলে গেছে। এটা কী করে হলো? এই ক্যুরিয়ারের লোকটাই এই ঝামেলার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই মেয়ে চিঠিটা ফেরত না দিয়ে এখন রীতিমতো ঝামেলা করছে ওদের সাথে। নিশ্চয়ই মুনা ওকে সব বলেছে। আর কী আশ্চর্য এই মেয়েটার নামও মায়মুনা! যাই হোক, এই মেয়েটাকে ও আজ কড়া করে কথা শুনিয়ে দেবে, যাতে ওদের আর বিরক্ত না করে।
তওসিফ বিরক্ত গলায় বলে, ‘কই দিন চিঠিটা। আপনার আরো আগেই চিঠিটা ফেরত দেওয়া উচিত ছিল। আপনি সেটা না করে অনধিকার চর্চা করছেন।’
মায়মুনা লোকটাকে দেখছিল, হ্যাঁ চেহারাটা পলিশ, পোষাক পরিচ্ছদে নিপাট ভদ্রলোক লাগছে। কিন্তু তারপরও কোথাও একটা খামতি রয়ে গেছে। কথা বলার ভঙ্গিতে একটা উগ্রতা আছে। মায়মুনা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ, চিঠিটা দিতেই তো এসেছি, সেটা আপনি পাবেন। আর অনধিকার চর্চাটা আসলে করতেই হলো। ভুলক্রমে আসা চিঠির সাথে আমিও জড়িয়ে গিয়েছি। আমার শুধু এটুকু জানতে ইচ্ছে করে একটা মানুষ কেন এত সুন্দর একটা সুখী গৃহকোণ ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে। এত নিষ্ঠুর হয় কী করে মানুষ, ছোট্ট ছেলের মুখটাও যার মনে পড়ে না।’
তওসিফ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। আর মুনা যদি আপনাকে পাঠিয়ে থাকে তাহলে ও নিশ্চয়ই বলেছে কেন আমি বিয়ে করছি তিন্নিকে। আর আমি কিন্তু অতটাও নিষ্ঠুর না, আমি মুনাকে বলেছিলাম, ইচ্ছে করলে ওর মতো থাকতে পারে।’
মায়মুনা অবাক হয়ে যায়, একটা মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে গেলে কত অবলীলায় এমন একটা অসম্ভব কথা বলতে পারে। তার কাছে ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে যে সেটা সে নিজের মহানুভবতা হিসেবে ভাবছে। মুনাকে যেন সে অনেক দয়া করেছে। মায়মুনা এবার কঠিন গলায় বলে, ‘যদি মায়মুনা আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করত আর আপনাকে থেকে যেতে বলত তখন আপনি মেনে নিতেন?’
কথাটা সত্যি, ও নিশ্চয়ই মেনে নিত না, মুখে কোনো উত্তর আসে না, বরং একটা রাগ লাগতে থাকে।
মায়মুনা এবার বলে, ‘আপনাকে তো তিন্নি মেয়েটা বিশ্বাসও করে না, তার বিশ্বাস অর্জন করতে তাকে আপনার কোম্পানির শেয়ারটাও লিখে দিতে হচ্ছে। অথচ একবারও ভেবেছেন মুনা নামের মেয়েটাকে জাগতিক কোনো কিছুই দিতে হয়নি। সে আপনাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছে, ভালোবেসেছে। আপনার কাছ থেকে ও একটু মায়াই চেয়েছে, ভালোবাসা চেয়েছে।’
তওসিফের ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে, কথাগুলো সত্যি। তিন্নিই কথাটা তুলেছিল যদি ও তিন্নিকে ছেড়ে চলে যায় তখন? ওকে আশ্বস্ত করতেই বলেছিল কোম্পানির একটা শেয়ার লিখে দেবে। তওসিফ অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘সেটা স্ত্রী হিসেবে তিন্নি এমনিতেই পেত। আমি ওকে ভালোবাসি, বিশ্বাসও করি, আর ওকেই বিয়ে করব।’
মায়মুনা হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে, একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হতে পারে তাই ও ভাবছে। মুখ নিচু করে একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনি তিন্নি সম্পর্কে সব জানেন তো? ও কিন্তু খুব উচ্চাভিলাষী মেয়ে, এর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, পরিবারের সম্মতিতেই। যতটুকু জানা গেছে সেই ছেলের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ও নিজেই ডিভোর্স করে চলে এসেছিল। আপনাকে ও বিয়ে করছে শুধুই আর্থিকভাবে লাভবান হতে। মুনা কিন্তু আপনাকে শর্তহীন ভালোবেসেছিল।’
তিন্নির আগের বিয়েটা কেন ভেঙে গিয়েছিল তা অবশ্য মায়মুনা জানে না, ইচ্ছে করেই বলেছে যে আর্থিক অবস্থার জন্য বিয়েটা ভেঙেছে।
তওসিফ একটু থমকায়, তিন্নির যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল সেটা ওর জানা ছিল না। কই, কখনো তো এ বিষয়ে তিন্নি কিছু বলেনি। কিন্তু এই মেয়েটাকে এটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। মুখের বিস্ময়ভাবটা লুকিয়ে বলে, ‘সেটা আমি জানি, ওর এটা দ্বিতীয় বিয়ে, আমারও তো তাই। আর জানেন তো জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আর্থিক সচ্ছলতা, যেটা না থাকলে আপনাদের ওই তথাকথিত ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। তাই কেউ যদি আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকতে চায় তাতে কোনো অপরাধ নেই।’
মায়মুনা মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, তা অপরাধ না। কিন্তু আপনার ওই কথাটা সবার ক্ষেত্রে সত্য না। আমি যতদূর জানি আপনার বিয়ের প্রথম দিকে টানাটানির সংসারই ছিল, একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকতেন। মুনা কিন্তু তখন আপনাকে ছেড়ে যায়নি, ভালোবেসে আপনাকে আগলে রেখেছিল, আপনার সামনে এগিয়ে যাবার পথটা আরো মসৃণ করে দিয়েছে। একবার নাকি আপনার ব্যবসায় খুব ক্ষতি হয়েছিল, তখন মুনা তার বিয়ের গয়নাগুলো আপনার হাতে তুলে দিয়েছিল যাতে আপনি ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। তাই মুনা যদি তিন্নির মতো মেয়েদের মতো চিন্তা করত তাহলে কখনোই তার প্রিয় গয়নাগুলো আপনার হাতে তুলে দিত না।’
তওসিফের ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে, মুনা দেখি এই মেয়েকে সব বলে দিয়েছে। একটু আনমনা হয়ে যায়, সারজীবন আর্থিক কষ্টটা তাড়া করে বেড়াত। বাবা খুব কম বেতনের চাকরি করতেন, সারাক্ষণ টানাটানি লেগেই থাকত। তাই যখন ওর পড়াশোনা শেষ হলো তখন ও বাবার মতো চাকরিতে ঢোকেনি। ও চেয়েছিল অনেক বড়লোক হবে আর সেটা হতে গেলে যে ব্যবসা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে যে মূলধনটা চাই সেটা ওর ছিল না। এই উভয় সংকটের সময় সুযোগটা আসে, মুনার সাথে বিয়ে ঠিক হয়। মুনারা মোটামুটি সচ্ছল ছিল, তাই বিয়ের সময় একটা দাবিদাওয়া ও জানিয়েছিল। মুনার বাবা তখন খুশি মনেই ওকে ব্যবসা করার প্রাথমিক মূলধনটা দিয়ে সাহায্য করেছিল। অল্প অল্প করে উন্নতি হচ্ছিল, কিন্তু একবার হঠাৎ করেই হোঁচট খেয়ে অনেকটা ক্ষতি হয়ে যায়। সেদিনের কথাটা মনে আছে, মনমরা হয়ে বাসায় ফিরেছিল। মুনা ওর মুখ দেখেই শংকার সাথে জানতে চেয়েছিল কী হয়েছে। মুনাকে সব খুলে বলতেই ও কিন্তু মোটেই ভেঙে পড়েনি। বরং ওকে সাহস দিয়েছে, বলেছিল, তুমি ভেব না, তুমি ঠিক ব্যবসার এই ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠতে পারবে। সেদিন রাতেই বিয়ের সময় ওদের বাড়ি থেকে দেওয়া সব গয়নাগুলো ওর হাতে তুলে দিয়েছিল। মনে মনে খুব অবাক হয়েছিল মুনার এমন করে সবটুকু দিয়ে দেওয়াতে। এরপর একটা ম্যাজিক হয়, অভাবনীয় সব সাফল্য ধরা দিতে থাকে ওর ব্যবসায়।
এসব ভাবতে ভাবতে ও মাথা নাড়ে, নাহ, মনটা দূর্বল হতে দেওয়া যাবে না। তওসিফ এবার গম্ভীরমুখে বলে, ‘হ্যাঁ, মুনা আমাকে ওর বিয়ের গয়নাগুলো দিয়েছিল। কিন্তু আমি পরে ওকে তার দ্বিগুণ পরিমাণ গয়না গড়িয়ে দিয়েছিলাম। ওকে একটুও ঠকাইনি।’
হায়রে, এই লোকটা জীবনের সবকিছু অর্থ দিয়েই মাপে। মুনা যে ওকে অর্থের চেয়ে মানসিক সাপোর্টটা দিয়েছিল সেটা ও ভুলে গেল। মায়মুনা ম্লান হেসে বলে, ‘তওসিফ সাহেব, আপনি সবকিছু ধন সম্পদের নিক্তি দিয়ে মেপেছেন তাই আপনি যে মুনা আর জারিফকে ঠকাচ্ছেন সেটা চোখে পড়েনি। ওরা দু’জন মানুষ যারা আপনারই অংশ ছিল তাদেরকে জীবনের সবদিক দিয়েই ঠকালেন। আপনার ছেলে জারিফ এখনো তার বাবার জন্য অপেক্ষা করে, বাবা আসবে কোনো এক বিকেলে, ওর সাথে খেলবে। এই যে অপেক্ষা সেটা আপনি কী করে ওকে পূরণ করে দেবেন? এ তো এমন না যে আপনি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে দিলেই ও খুশি হয়ে গেল। মুনা যে আপনার বাসায় ফিরে আসার অপেক্ষায় না খেয়ে থাকে সেটা কী আপনি আপনার ওই অর্থ দিয়ে পাবেন কোথাও?
এমন অনেক ছোট ছোট সুন্দর মায়া থাকে সংসারে, মানুষ যার জন্য বেঁচে থাকে।
একটা কথা বলি, আমার বিয়ে হয়েছে ছয় বছর, এখনো একটা সন্তান হয়নি। আমাদের আকুল করা অপেক্ষা একটা সন্তানের জন্য। আর সেখানে এমন একটা মূল্যবান উপহার আপনি হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন কত সহজে, কত অবহেলায়, ভাবতেই অবাক লাগে।’
তওসিফের মুখটা এই প্রথমবারের মতো নরম হয়, ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আমি জারিফকে আমার কাছে নিয়ে আসব, তিন্নির সাথে এটা নিয়ে কথা হয়েছে। ও জারিফকে নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করবে।’
মায়মুনা ম্লান হাসে, বলে, ‘নিজের মা থাকতে ও অন্য আরেকজনের কাছে মায়ের মতো থাকবে!? হাসালেন আপনি আমাকে। আর আদালত জারিফকে মুনার কাছেই রাখার নির্দেশ দেবে। আপনি জারিফকে কখনোই পাবেন না। বাবা হিসেবে সবসময় ঘৃণিতই থেকে যাবেন।’
তওসিফ বিচলিত চোখে তাকিয়ে থাকে, কোনো কথা বলতে পারে না। জারিফের মুখটা মনে পড়ছে। একবার জন্মের পর পর খুব অসুখ হলো, ও সারাদিন জায়নামাজে ছিল। বার বার ছেলের সুস্থতা চেয়ে দোয়া করত। সেবার ছেলেটা ভালো হয়ে গেল, তখন বুঝেছিল ছেলের জন্য কেমন লাগে। সত্যিই জারিফকে ও কাছে পাবে না?
তওসিফের আনমনা ভাবটা মায়মুনা লক্ষ্য করে। ওর আর বলার কিছু নেই। শুধু আজ একটা কঠিন সত্য জেনে গেল, মানুষ মোহগ্রস্ত হলে সব ভুলে যায়।
যাবার সময় ব্যাগ থেকে সেই ডিভোর্স লেটারটা বের করে টেবিলের উপর রাখে, তারপর ধীর, শান্ত গলায় বলে, ‘ডিভোর্স লেটারটা রইল। এটা একদিন ভুল করে ভুল ঠিকানায় চলে গিয়েছিল। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা কী তার সঠিক ঠিকানায় যাবে নাকি যাবে না। সিদ্ধান্তটা আপনারই।’
কথাগুলো বলে ও ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে। দমটা আটকে আসছিল এতক্ষণ, বাইরে এসে একটা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। মায়মুনা বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবে, আচ্ছা ও কী বলবে মুনাকে আজ? তওসিফের নিষ্ঠুরতা নাকি ওর পরাজয়ের কথা? এই ক’টা দিন ক্ষীণ আশা ছিল তিন্নি অথবা তওসিফ, একজন না একজনকে ও ভুলটা বোঝাতে পারবে। কিন্তু যে মানুষ ভুলের মাঝেই সুখ খুঁজে পায় তাকে কী করে ও ঠিক পথে নিয়ে আসবে? শেষ দিকে তওসিফের মুখে একটু হলেও অনুশোচনা দেখেছে, কিন্তু তাতে কী তওসিফ ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা নেবে?
সেদিন বাসায় ফিরে আসলে ফয়সাল আগ্রহের সাথে জানতে চায় তওসিফের সাথে কী কথা হলো। মায়মুনা মন খারাপ গলা বলে, ‘ফয়সাল, প্রতিটা মানুষের নিজস্ব যুক্তি আছে, আর স্বার্থের জন্য সে যুক্তিগুলো নিজের কাজে লাগায়। এই গল্পে তিন্নির তার নিজের পক্ষে যুক্তি আছে, তওসিফের নিজস্ব যুক্তি আছে, আর মুনা আর জারিফ যেন ওদের হাতে জিম্মি। আমি জানিনা কী হবে, মুনাকেই বা কী বলব।’
ফয়সাল কাছে এসে ওর হাত ধরে সোফায় বসায়, নরম গলায় বলে, ‘মায়মুনা, তুমি মন খারাপ করো না। তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা তো তুমি করেছ। মেয়েটাকে কাল বুঝিয়ে বলো সবকিছু।’
সেদিন রাতে মায়মুনার ঘুম হয় না, একটা অস্থিরতায় ছটফট করে রাতটা কাটে। শেষ রাতে ঘুমটা আসে, স্বপ্ন দেখে, ও উঁচু একটা জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছে, ফয়সাল পাশেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু ওর হাতটা ধরছে না।
সকালে ঘুমটা ভাঙতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় স্বপ্নটার কথা মনে করে। ইশ, কী বাজে একটা স্বপ্ন দেখল। উম, মুনাকে আজ ফোন করে আসতে বলতে হবে। তার আগে জারিফের প্রিয় চকলেট কেকটাও বানাতে হবে।
সেদিন বিকেলে মুনা একাই আসে, জারিফকে ইচ্ছে করেই আজ আনেনি। মায়মুনা আজ নিজেই সংকোচে আছে। কী করে কথাটা তুলবে। কিছুক্ষণ এলোমেলো কথা চলে। মুনা যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পারে মায়মুনা আজ একটু খেই হারানো কথা বলছে। তারমানে তওসিফের সাথে দেখা করাটা মোটেই ভালো কিছু হয়নি। মায়মুনাকে সহজ করতেই ও বলে, ‘মায়মুনা, আমি বুঝতে পেরেছি, তওসিফ তোমার কথা শোনেনি। আমি জানতাম ও আর ফিরে আসবে না।’
মায়মুনা এবার আমতা আমতা করে বলে, ‘মুনা, আমি ওর সাথে কথা বলেছি। হ্যাঁ, তোমার কথাটা হয়ত সত্যি, কিন্তু জারিফের কথা বলতেই ওর চোখে অনুশোচনা দেখেছি।’
এরপর মায়মুনা ওকে সবকিছু খুলে বলে। মুনা এক দৃষ্টিতে চেয়ে শুনতে থাকে। সবশেষে বলে, ‘মুনা, আমি তওসিফকে আসার সময় বলে এসেছি, ও ইচ্ছে করলে এই ডিভোর্স লেটারটা সঠিক ঠিকানায় পাঠাতে পারে অথবা না পাঠাতেও পারে। আমরা কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারি, দেখি ও কী করে।’
মুনা কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছিল, মায়মুনার শেষ কথাগুলোতে সম্বিৎ ফিরে পায়, তারপর সোজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে, ‘না, আমি ওর জন্য আর অপেক্ষা করব না। ও ডিভোর্স লেটারটা পাঠাবে কি পাঠাবে না সেটা ওর ব্যাপার। যে মানুষ আমাকে ভালোবাসে না, তাকে আমি এভাবে ফিরে পেতে চাই না কখনো। এই ক’টা দিন আমি অনেক ভেবেছি, আমি আসলে ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা করেছি। যে অপেক্ষাতে শুধুই গ্লানি আছে, করুণা আছে। আমি জারিফকে নিয়ে আমার যুদ্ধটা শুরু করব। আমি অন্তত চাইব আমার ছেলেটা যেন বাবার মতো অমানুষ না হয়, ওকে আমি শুদ্ধ মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করব। মায়মুনা, তুমি আমার জন্য অনেক করেছ, আর একটুখানি করতে পারবে?’
কেন জানি মুনার এই দৃঢ়তাটা ওর খুব ভালো লাগে। এই কটা দিন নিজেকে তিন্নির কাছে, তওসিফের কাছে ভীষণ ছোট মনে হয়েছে, কাঙালের মতো ওদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়িয়েছে। মুনার কথাটা আজ সেই গ্লানিগুলো মুছে দিল। মায়মুনা আগ্রহের সাথে জানতে চায়, ‘বলো মুনা, আমি কী করতে পারি?’
মায়মুনা একটু ইতস্তত করে বলে, ‘তোমার অনলাইন কেকের কাজটুকুতে আমাকে সাথে নিতে পারবে? প্রাথমিক ধাক্কাটা তাহলে সামলাতে পারতাম। এরপর আমি নিজেই আমার চলার পথ তৈরি করে নিতাম।’
শেষের কথাটা মুনা বেশ জোরের সাথেই বলে।
মায়মুনার মনটা নরম হয়ে যায়, ভীষণ মায়া নিয়ে ওর হাতটা ধরে বলে, ‘অবশ্যই থাকবে তুমি আমার সাথে। আমিও একা পেরে উঠছিলাম না, এত এত অর্ডার আসে যে কুলিয়ে ওঠা যায় না। আজ থেকে তুমি আর আমি মিলে একসাথেই এই কাজটা করব।’
সেদিনের পর থেকে মুনার নতুন পথ চলা শুরু হয়, ডিভোর্স লেটারটা ওর ঠিকানায় আবার আসবে নাকি আসবে না, সেটা নিয়ে ভাবনার দিন ফুরিয়েছে। এই পৃথিবীর এক কোণে কিছু ভালো মানুষ নিজেদের মতো করে ভালো থাকার যুদ্ধটা চালিয়ে যায়।
(সমাপ্ত)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর