ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে সামনে একটা ট্রল এল, বাংলাদেশে নাকি মেয়েরা স্বামীরা ঘুমিয়ে থাকলে তাদের মানিব্যাগ থেকে টাকা সরায়। এটা পড়ার সাথে সাথেই মনে পড়ল গতকাল রাতে পিয়ালের মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার কচকচে নোট টা সরানোর কথা। বিছানার নিচে রেখেছিলাম, তোশকটা উল্টেই টাকাটা পেয়ে গেলাম।
ছেলেকে কোলে তুলে গোসল করাতে নিয়ে গেলাম। আধা গোসল করে গায়ে সাবান মেখে আর গায়ে পানি নিবেনা জেদ ধরল। এদিকে চুলায় ভাত বসানো, যখনই গায়ে পানি দিতে যাচ্ছি হাত পিছলে সরে যাচ্ছে। মেজাজটা খুব গরম হল দিলাম কষিয়ে দুইটা থাপ্পড়। কাঁদতে কাঁদতে ঠিকই গোসল সেরে বেরিয়ে এল। দুপুরে খাওয়াতে বসে বাঁধল আরেক বিপত্তি বলল মাছ দিয়ে খাবেনা,নিয়ে এলাম ডাল দিয়ে। দু গাল মুখে দিয়ে বলল ডাল দিয়েও সে খাবেনা প্রচন্ড বিরক্তি চেপে দুধ দিয়ে ভাত মেখে নিয়ে আসলাম। এবার সে দৌড়তে শুরু করল মিনিট পনের পেছনে ছুটে বাগে না পেয়ে প্লেট টা রেখে নিজে দু গাল খেয়ে নিলাম,ঘড়িতে তখন দুপুর চারটা। খেয়ে উঠতে উঠতে আসরের আজান পড়ল। বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড় গুলা ঘরে তুলে ভাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল হল ছেলেটা গেল কই। বাথরুম, বারান্দা, ডাইনিং ঘুরে এসে দেখি সে সোফার এককোণায় দিব্বি গুটি সুটি দিয়ে ঘুম। কোলে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। এমন ক্ষুধা পেটে কিভাবে ঘুম পায় কি জানি। কপালের চুল গুলো সরিয়ে চুমু খেলাম, পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। গোসলের সময় এমন রেগে গেলাম, কেন যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা, আর বাচ্চার গায়ে হাত তুলবনা এমন প্রতিজ্ঞা শত বারের মত করতে করতে কখন যেন ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
রাতে পিয়াল বাড়িতে ফিরেই থমথমে মুখে জানতে চাইল আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়েছ?
আমি মন দিয়ে ছেলে খাওয়াতে লাগলাম আর টিভিতে সিরিয়াল দেখতে লাগলাম।
পিয়াল এবার একটু উঁচু গলায় বলল,কি বলছি কানে যাচ্ছেনা আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়েছ?
বললাম,হ্যাঁ। বুঝতেই যখন পারছ আবার জানতে চাইছ কেন?
পিয়াল অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশীই রেগে গেল, কেন অযথা এমন কর তোমার যা লাগে তা কি আমি কিনে দেইনা? তাহলে টাকা সরাও কেন?
আমি চুপ করে রইলাম।
পিয়াল রাতে খাবার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। থালাবাসন পরিস্কার করে, ছেলের খেলনা গুছিয়ে রেখে আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে পায়চারী করতে লাগলাম। ঘুমতে তার মিনিমাম আরো তিরিশ মিনিট লাগবে। পিঠটা লেগে আসতে লাগল। ইচ্ছা হচ্ছিল বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু মন চাইলে কি আর তা হয়!
ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় মোড়ায় এসে বসলাম। নিস্তব্ধ নগরীতে অন্ধকারে আলোর ঝলকানী যেন। বেশ হালকা বাতাস। আমি পিঠটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে বসি।
আমি চারুলতা। নাহ্ আমি কারো গল্পের চারু নই আমাকে সবাই লতা বলেই জানে। স্কুল কলেজে বেশ জনপ্রিয় মুখ ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে। পিয়াল আর আমি দুজনেই চাকুরী করি তখন। ছিমছাম ছোট সাজানো সংসার। আমার ফোকাস তখন ক্যারিয়ারে। দুজনে সারাদিন অফিস করি দিন শেষে বাসায় ফিরে একসাথে ভাল সময় কাটাই, খাই দাই ঘুমাই ছুটির দিনে একটু আধটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। হাতে টাকা,সময় সবই আছে। সেই সাথে আছে মানুষের গন্জনা। সংসারে মন নাই, সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা নেই হইহই করে নাকি আমি টাকার পেছনে ছুটছি। সময়ে অসময়ে পিয়ালও দু চারটা শুনিয়ে দেয় বেশ। আমারো মন কেমন করে ভাবি তাই তো এবার নতুন কেউ আসুক। তবে আমার যে তেমন ব্যাকআপ নেই। মা চলে গিয়েছেন বহু আগে, শাশুড়ী শয্যাশায়ী। পারবতো সবটা সামলাতে। আল্লাহর ইচ্ছায় এর মাঝেই আমি কনসিভ করি। পিয়াল তো খুশিতে অস্থির। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। সারাটা দিন একা। দিনের বেলায় আমার সাথে থাকার জন্য একজন বয়স্ক মহিলাকে রাখা হল। দিন গুনে গুনে এক দিন আমি সত্যি সত্যিই মা হলাম। সব ভুলে সন্তানের প্রতি মন দিলাম। সময়ের সাথে অফিসের ছুটি ফুরিয়ে এল। পিয়ালের কাছে সে কথা তুলতেই বলা হল, চাকরি টা ছেড়ে দাও। কিন্তু আমি যে স্বাবলম্বী হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারলামনা। পিয়াল বোঝাল সে ভাল বেতনের চাকরি করে, আমার সব চাহিদা পূরনে সে সক্ষম। স্বামীর সম্পদে আমার হালাল হক আছে। আমি চাওয়া মাত্রই যখন সবটা পাব তখন আর চিন্তা কি। তাছাড়া সন্তান সবার আগে সন্তান কে স্যাক্রিফাইস করে ক্যারিয়ার নয়। আমিও মেনে নিলাম। নতুন মা আবেগে ভাসছি।
কিছু দিন যেতে না যেতেই বুঝলাম একহাতে বাচ্চা সামলানো অতটা সহজ নয়। বাঁধা লোক পেলাম না। ছুটা বুয়া আসে দু ঘন্টার জন্য সারাদিন ছেলের পেছনে ছুটে,সংসার সামলে নিজের জন্য দু দন্ড সময় পাইনা। আর চাকরী! বেশ করেছি ছেড়েছি। সন্তানের জন্যই তো ছেড়েছি।
কিন্তু এই আমারই হঠাৎ হঠাৎ তালসামলাতে না পেরে মনে হয় এই সন্তানের জন্যই আমাকে আমার ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। ওর জন্যই আমার সব এলোমেলো হয়ে গেল। এখন আর আমি চাইলেও দুটো দিন বেড়িয়ে আসতে পারিনা। বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা। কি যে হয় মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমার সব হতাশা রাগ ছেলেটার ওপর চাপিয়ে দেই। একটু বিরক্ত করলেই ওকে কষে দুটো মার দিয়ে নিজের রাগকে প্রশমিত করি। বাচ্চাটা আমার ভীষন দুষ্টু আসলেই কি শুধু আমার বাচ্চাটা দুষ্টু নাকি আসলেই আমি আমার ব্যর্থতার জন্য ওকে দায়ী করে এই সেই উছিলায় শাস্তি দেই।
নাহ্ আর ভাবতে পারিনা, দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমার হাত শূন্য। এখন আর মাস শেষে হাত ভর্তি থাকেনা। চাইলেই আমি দু পয়সা বেহিসেবী খরচ করতে পারিনা,পারিনা কারো কাছে হাত না পেতে,কারো তোয়াক্কা না করে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে খরচ করতে। পিয়াল আমি চাওয়া মাত্রই সব দেয় সত্যি। তবে চাইলেই আমি ওকে না বলে দু পয়সা খরচ করার ক্ষমতা রাখিনা। ঐ যে আমি যে স্বাবলম্বী ছিলাম। আমার কোথায় যেন বাঁধে। এক দিন দু দিন টাকা না বলেই নিলাম, পিয়াল ও চেপে গেল। কিন্তু আজকাল আর মেনে নিতে পারেনা। গত পরশু হাজার খানেক টাকা চাইলাম। হ্যাঁ দরকারেই চেয়েছি কিন্তু আমার কেন টাকার দরকার এই কৈফিয়্যত দিয়ে প্রতিবার টাকাটা নিতে আমার ভাল লাগেনা। আবার আমি না বলে টাকা নিলে পিয়ালেরও সেটা ভাল লাগেনা। কি এক অদ্ভুত সংকট তাইনা?
বাংলাদেশের মেয়েরা স্বামী ঘুমিয়ে থাকলে মানিব্যাগ থেকে টাকা সরায়। আচ্ছা সরিয়ে এরা কি করে? নিশ্চয়ই আমার মত তারাও প্রয়োজনে,শখ পূরণে খরচ করে। আজ চাকুরীটা থাকলে কি আমার এটার দরকার পড়ত? হয়তবা না। অথচ আমার সেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি মনের এক কোণে আক্ষেপকে কবর দিয়ে সংসারী হয়েছি,মা হয়েছি সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে একহাতে সবটা সামলাছি। স্বাবলম্বী সেই আমি বুঝি ঘরে বসে সবটুকু দিয়ে সংসার করাটাও এতটা সহজ নয়। মাঝে মাঝেই মনে হয় দিন শেষে আমি হেরে যাচ্ছি। কোন কাজ ঠিকঠাক না হলেই অযোগ্য খেতাব পাচ্ছি, সন্তানকে রুটিন মাফিক হাজার চেষ্টা করে খাওয়াতে ঘুম পাড়াতে না পারলেই মা হিসেবে পরাজিত হচ্ছি, দু চার পয়সা খরচের টাকা সরিয়ে কারো বিরক্তির কারনও হচ্ছি।
তবুও এমন ক্লান্তি শেষে মনে হয় বেশ আছি। আমিতো আমার দায়িত্বের সবটাই পালন করছি, নিজেকে বন্চিত করলেও সবার জন্য সবটা করার প্রচেষ্টাতো চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। প্রতিদান পাই বা না পাই প্রত্তুরেতো বলতে পারব তোমাদেরকে ভালবেসে আমি চারুলতা গৃহিনী হয়েছি।
লতার সংসার
#ছোটগল্প
#তারানা_তাবাসসুম