- মাকে নিয়ে লেখা গল্প।
- মা দিবসে মাকে নিয়ে স্ট্যাটাস।
- মাকে নিয়ে কষ্টের স্ট্যাটাস।
- মাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস
- Ma bangla golpo status
১.মাকে নিয়ে লেখা গল্প
আম্মাকে সবসময় মাছের মধ্যে খেতে দেখতাম লেজের পিসটা। সে বলত ঐটা তার প্রিয়। ভাবতাম এত কাটার দিকটা কিভাবে একটা মানুষের প্রিয় হয়। আর মুরগির মধ্যে তার নাকি গলা মাথা আর পা পছন্দ।
সে ভুল ভেঙ্গে গেলো আমার বিয়ের পর।
পারিবারিক ভাবে যৌথ পরিবারে বিয়ে হলো আমার। ৯ জনের পরিবারে সবাই নতুন। স্বামীও অপরিচিত। বিয়ের পরদিন যখন খেতে বসবো তখন শ্বাশুড়ী বলল – তুমি পরে খাও। আগে পুরুষ বেটারা খায়া নেক।
তখন সবাই খেতে বসার আগে আমার শ্বাশুড়ী বলল – মাছের মাথাটা তোমার শ্বশুর খায়। তার ঐটা পছন্দ। প্যাটা দুইটা দুই মাইয়া (আমার ননদ) পছন্দ করে। কাঁটা কম তো তাই। ঘাড়ের পাশটা বাবুরে (আমার বর) এক পিস , এক পিস দিবা অনুরে (মেঝো দেবর) , এক পিস দিবা সোহাগ রে (সেঝো দেবর) আর ঘাড় পেট মিলানো এক পিস দিবা মহসিন রে (ছোট দেবর)..
আর বাকী দুই পিছ তুমি আমি খামুনে। আমার তো কাটা বাছতে কষ্ট হয় তাও লেজটা আমিই নিমুনে।
আমি অতি ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম ঘাড় পেটের আরেক পিস টা আপনি নিয়েন। আমি লেজ খাবো।
শ্বাশুড়ী বলে উঠলো – ওহ আগে কইবা না তুমি লেজ পছন্দ করো।
আমি আসলে এমন কিছুই বলি নাই।
যাই হোক এরপর থেকে খেতে বসলেই আমার শ্বাশুড়ী বলতেন – বৌ তো লেজ পছন্দ করে।
আমি মনে মনে হাসতাম। আর লেজের মাছ খেতে বসলে মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠত আর ভাবতাম.. আম্মারও তাহলে লেজটা খেতে ভালো লাগত না। আমাদের ভাগাভগি করে দিয়ে লেজটাই তার কপালে জুটতো।
আর আমরা কখনো জিজ্ঞাসাও করতাম না আম্মা – তোমার কি সত্যিই লেজের মাছটা ভালো লাগে?
মেয়েরা হয়ত এভাবেই সেক্রিফাইস করে। খুব গোপনে। কেউ জিজ্ঞাসাও করেনা। কারো চোখেও পরে না। কেউ বুঝতেও চায়না। কেউ বুঝাতেও চায়না।
© জাকিয়া জুলিয়েট
আমার মা
আমার জন্ম ১৯৭৩ সালে।আমরা চার ভাই। আমাদের মা-বাবা স্বাধীনতার আগে স্নাতক পাশ করেছিলেন।যার কারনে ক্লাস এইট পর্যন্ত আমরা মা’র কাছেই পড়ালেখা করেছি।আমার মা মরহুমা জিয়াউন নাহার আধুনিক মন-মানসিকতার হলেও ঘরকন্নার কাজে ছিলেন অসম্ভব পটু।বাবা পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
মা’ প্রতিবছর আমাদের সবার জন্য নিজহাতে উলের পুলোভার তৈরী করতেন,চাদরও বানাতেন।একইসাথে সুঁই-সুতোর কাজও জানতেন।ছোটবেলায় দেখতাম ঘরের সব আসবাবপত্র মা’র হাতের কাজ করা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকত,সবগুলোর ডিজাইনও এক! সেসময় বাসাবাড়িতে কাজের লোকের কালচারটা জেলাশহরে তেমন একটা ছিলনা।বাজার থেকে আনা মাছ-মাংস সবই নিজের হাতে কেটেকুটে রান্নাটাও মা’কেই করতে হত।
সৈয়দপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে(তখনও ওটা কলেজ হয়নি,আমি ওখানে পড়ালেখা করেছি) মা কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলেন-সবাই বড়আপা বলে ডাকতেন।আমি খুব লজ্জা পেতাম স্কুলে যে মা’কে কি বলে ডাকব,টিচার না মা! ছেলেদের খাওয়া-দাওয়ার কষ্টের কথা চিন্তা করে আমাদের মা চাকুরীটা ছেড়ে দেন!সে আশির দশকের কথা।
ছোটবেলায় আমাদের ভাইদের সাপ্তাহিক একটা আব্দার ছিল।একটা বড় গামলায় ভাত মাখতেন,আমরা গোল হয়ে বসতাম আর মা আমাদের একেক জনকে একনলা-একনলা করে ভাত খাইয়ে দিতেন।এ-ই খাবারের স্বাদ ছিল স্বর্গীয়।এখন ভাবি,আমরা সবইতো খেয়ে ফেলতাম,তাহলে মা কি খেতেন?আমার মা’ জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে চুলার পাড়ে।কে কি খাবে তা শুনতেন, আর কিভাবে তা পরিবেশন করবেন,এ-ই ছিল চিন্তা। জেলা শহরে কোন উর্ধতন কর্মকর্তা এলে রান্না ভার পরত মা’র উপর।আমার মা’র হাতের রান্নার সুখ্যাতি ছিল অসাধারন!
১৯৮৮ সালে আমরা চট্টগ্রামে আসি।চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই।কাপ্তাই,রাংগামাটি,বান্দরবান,কক্সবাজারে আমরা চার ভাই আর মা-বাবা এ-ই ছয়জন ছিলাম ট্যুরের মেম্বার!আশ্চর্য না? আমার মা সামাজিক কাজেও পিছিয়ে ছিলেন না। চট্টগ্রাম দামপারা পুলিশ লাইনে “পুলিশ নারী কল্যান সমিতি বা সংক্ষেপে পুনাক” এর ০৫ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্য আমার মা হলেন একজন – যা ওখানে খোদাই করা আছে।
আমার বিয়ে যখন হয়, তখন বাবা চলে গেছেন ওপারে।অনেক কষ্ট করে মা’যেই মেয়েটার সাথে ২১ বছর আগে আমার গাঁটছড়া বেধে দিয়েছিলেন,তা ছিল আমার জীবনের অন্যতম আশীর্বাদ,রহমত!
২০১৬ সালের এপ্রিল মাস,আমি তখন কক্সবাজার জেলায় একটি থানায় ওসি। মা ভীষন অসুস্হ,চট্টগ্রাম ডেল্টা হাসপাতালে ভর্তি।আত্নীয়-স্বজনরা প্রায় সবাই এসেছেন। মা’কে রাখা হয়েছে লাইফ সাপোর্টে,ডাক্তাররা বলছেন ক্লিনিক্যালও ডেথ,লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার জন্য।
দুই ভাই মত দিলেও আমি বাঁধা হয়ে দাড়ালাম-মা যদি ফিরে আসেন!আসতে কি পারেন না? আমকে হাসপাতালের এমডি সাহেবের রুমে সবাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন!একপর্যায়ে আমাদের মধ্য একটু দ্বিধা-দ্বন্দের সৃস্টি হল-যা আরেকটু সময় হলে হয়ত প্রকট আকার হতে পারত।এ-র মধ্যে আমার স্ত্রী কল দিল তাড়াতাড়ি মা’র কাছে আসার জন্য।আমরা এসে দেখি মা’আমাদের ভাইদের মধ্য যেন দ্বন্দ না থাকে,সে কারনে নিজেই চলে গেছেন আল্লাহর কাছে,যেখানে বাবা অপেক্ষায় রয়েছেন।
সেদিন লাইফসাপোটটা খুলে নিলে আমার সারাজীবনে কিরকম একটা আফসোস থাকত,ক্ষোভ থাকত!আসলে মা বেঁচে থাকতেও সন্তানদের জন্য সমান,চলে যাবার সময়েও সন্তানদের মনে কষ্ট না থাকার কাজটি চুপিসারে করে গেলেন!
মা’রা এমনই হয়!
ক’দিন আগে মা-বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম খুব হাসিখুশি অবস্থায়।অনেকেই শুনে বললেন হয়ত আমি তাঁদের জন্য এমন কিছু করেছি,যার কারনে তারা এভাবে আমায় দেখা দিয়েছিলেন।
আল্লাহপাক আমার মা-বাবার মতো যারা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে,তাদের কবরের আজাব মাফ করে জান্নাতবাসী করুন আর যেই মা-বাবা বেঁচে আছেন,তাদেরকে সুস্হ আর আনন্দে রাখুন।আমিন।সুম্মা আমিন।
(আমি আসলে লেখায় পটু নই।এলোমেলো করে কিছু লেখার চেস্টা করেছি)
-মাশুক ভুইয়া,
পরিদর্শক,বাংলাদেশ পুলিশ।
২.মা দিবসে মাকে নিয়ে স্ট্যাটাস
-মা তুমি বেশিই চিন্তা কর, রোগ নেই,তাও রোগ বাড়াচ্ছো। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি বলো তুমি, গা জ্বলে, দুর্বল লাগে, ভালো লাগে না । এইটা কোন রোগ হলো? আর কত ডাক্তার দেখাবো বলো তো।
ছোট বউ উর্মি টেবিলে রাতের খাবারের জন্য প্লেট বাটি এনে সাজিয়ে রাখছে। মেঝ বউ শ্যামা রান্নাঘর থেকে সব তরকারি এনে টেবিলে রাখছে। বড় বউ অনুরাধা রান্নাঘরে সব তরকারি হাড়ি থেকে বাটিতে বাড়ছে।
রাতের খাবারের তোড়জোর চলছে। যে যেখানে থাকুক সারাদিন, রাতের খাবার টা সবাই একসাথে খেতে চায়। ছোট বেলা থেকে নীলা ওদের মধ্যে অভ্যাসটা করিয়ে দিয়েছে।
পলাশ টেবিলে এসে বসতেই বউরা মাথায় কাপড় তুলে দেয়। ছোট ছেলে তপন এসে বসল, মেঝ ছেলে তরুন মোবাইলে কথা বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসলো।
নীলাও এসে পলাশের বামের চেয়ারে বসলো। বড় ছেলে অরুন এখনো আসে নি। অরুনের ছেলে তুতুল এক সাথে খাওয়ার বায়না করে৷ সবে ক্লাস ফোরে উঠলো। পলাশের ডান পাশেই সে বসে।
অন্য নাতিরা ছোট তাই তারা আগে খেয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছে।
অরুন এসে বসতেই নীলা অধীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি রে খোকা, রিপোর্ট এলো? কি বলল ডাক্তার?
অরুন উত্তর না দিয়ে প্লেটে ভাত নিচ্ছে। নীলা চুপ হয়ে গেলো। ছোট বউ সবাইকে ভাত দিচ্ছে প্লেটে, নীলাকে দিতে এলে,দুই চামচ দেওয়ার পর নীলা বলল,
-থাক থাক, আর দিও না। খেতে ইচ্ছে করে না। কি যে হলো, কিছুই বুঝি না। দুর্বল লাগে। ডাক্তার ও কোন রোগ ধরতে পারছে না।
অরুন বলল,
– মা তোমার রোগ না থাকলে কিভাবে ধরবে বলো তো ডাক্তার? সেই কিছু ভিটামিনের ওষুধ ধরিয়ে দিলো। ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো।
তপন বলল-
– মা তুমি বেশিই চিন্তা কর, রোগ নেই রোগ বাড়াচ্ছো। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি বলো তুমি, গা জ্বলে, দুর্বল লাগে, ভালো লাগে না । এইটা কোন রোগ হলো? আর কত ডাক্তার দেখাবো বলো তো?
তরুন বলল,
– তোমার আসলে প্রতিদিন হাঁটা উচিত, ঘরে বসে থাকতে থাকতে তুমি বিরক্ত হচ্ছো।
রোজ দুধ, ডিম খাও।
নীলা চুপ হয়ে গেল, ভাতের সাথে বেগুন ভাজি মাখতে মাখতে বলল,
– খাই তো রে, হাঁটবো কি করে, হাটু যে ব্যাথা করে। একটু গেলে।
মেঝ বউ বলল- কয়েক দিন গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে।
বড় বউ অনুরাধা রান্নাঘর থেকে ইলিশ মাছে বটিটা টেবিলে দিকে এনে রাখতে রাখতে বলল-
– মা, আপনার যা খেতে ইচ্ছে করে বলবেন। বানিয়ে দেবো, কারো সাধ্য নেই যে আপনার আদেশ অমান্য করে। তাও প্লিজ এইরকম ভালো লাগে না, ভালো লাগে না, করবেন না। মানুষ জনে বলে আমরা নাকি খেয়াল রাখি না।
নীলা বলল- না, না, তোমার তো যথেষ্ট খেয়াল রাখো। আচ্ছা ঠিক আছে আমি আর বলবো না কিছু,
তরুন বলল- আহ, তোমাকে বলতে মানা করল নাকি কেউ? তুমি না বললে জানবো কি করে আমরা বল তো?
ইলিশ মাছ খাও, আজ ভালো পেলাম, আনলাম।
তরুন ব্যবসা করে, অরুন আর তপন আর ছোট বউ চাকরি করে। আজ তরুন দুটো বড় ইলিশ মাছ এনেছে।
সবার জন্য করতে গেলে কয় টুকরো আর হয়?
বড় বউ অনুরাধার এখন সংসারের গিন্নি। তাই ও সবার পাতে যাতে পড়ে তাই হিসেব করেই একটু ছোট করেই টুকরো করেছে।
বেশ স্বাভাবিক ভালো বুদ্ধিমত্তার কাজ, ছেলেরাও জানি ব্যাপারটা। ছোট বেলা থেকে দেখেই অভ্যস্ত।
অনুরাধা সবাইকে মাছ দিচ্ছে। আমাকে দিলে এলে বললাম,
– আরেক পিস দাও,
অনুরাধা একটু অন্যরকম হাসলো, তবে দিলো দুই পিস। সবাইকে দিয়ে শেষ মাছ টা তুতুল কে তুলে দিয়ে কাটা বেঁছে দিতে লাগলো। কেউ কোন কথা বলল না, কারণ এইটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
বাবা দুই পিস চাইতেই পারে।
অনুরাধাকে বললাম- বৌমা, তুমি নিলে না যে মাছ? আর নেই?
হেসে বলল-
– না বাবা, ঠিক আছে, আমার বেগুন ভাজি আর সবজিতেই খাওয়া হয়ে যাবে। আর দুপুরের ছোট মাছ একটু আছে ওতেই হবে। আপনি খান বাবা। সমস্যা নেই।
প্লেট থেকে হাত তুলে নিয়ে বললাম-
– আমাদের বাসায় এখন কয় জন ইনকাম করে বলো তো?
সাবাই তাকিয়ে আছে এখন আমার দিকে,
– চারজন। কেন বাবা?
– আমাদের বাসায় এখন চারজনেই ইনকাম করে, তাও তুমি আজকের আমাকে দুই পিস মাছ দিতে গিয়ে নিজে নিলে না।
চিন্তা করো, আমার একার ইনকামে তিন ছেলে দুই মেয়ে, আমার ভাই -বোন, মা- বাবার বিশাল সংসারে তোমার মা কত বেলা ঠিক এইভাবে নিজের পাতের মাছ টা অন্য কে তুলে দিলো।
কেউ আরেকটু চাইলে ঘরের মায়েদের বউদের নিজের টা তুলে দিতে হয়, কেউ কোন প্রশ্ন তুলি না। যেন এইটা অনাদি কাল থেকে চলে আসা নিয়ম।
তারা খেয়ে পেট তো ভরায়, তবে প্রতিবেলার এমন ভালো মাছ মাংসের টুকরো টা তুলে দিতে দিতে রয়ে যায় পুষ্টি বাকি।
এইটা অনেক গুলো বছর ধরে চলতে চলতে, শরীর বলে আমি আর পারছি না।
তখন হাজার ভিটামিন আর ভালো খাবার দিলেও হাড্ডি তা আর নিতে পারে না।
আমি তোমার মায়ের রোগ অনেক চিন্তা করে বুঝতে পারলাম,
তোমার মায়ের রোগ ডাক্তার ঠিকই ধরেছে, তোমার মায়ের ভিটামিন-এর অভাব। তাই ভিটামিন ওষুধ দেয়। কিন্তু আমাদের কাছে এইটা কোন রোগেই মনে হচ্ছে না। যেন হাস্যকর ব্যাপার।
তোমার মা আমার থেকে দশ বছরের ছোট, কিন্তু দেখো তোমার আমার চেয়ে নীলার রোগ বেশি, দুর্বলতা, গা জ্বালাপোড়া করা, হাটুর ব্যাথা,চোখের সমস্যা, চুল পড়ে যাওয়া, আরো কত কিছু।
আমিও তো তখন তোমাদের মা কে যত্ন করি নি।
কারণ মায়েদের নিজের জন্য ভালো অংশ টা না রেখে প্রতিবেলা ছেলে মেয়েদের পাতে তুলে দেওয়া ব্যাপার টা আমিও চিরচেনা ভাবেই দেখে এসেছি ।
তাই এখন তোমার জন্য না রেখে আমাকে তুমি দুই পিস মাছ তুলে দেওয়াতে কারো মনে কোন প্রশ্ন উঠে নি এখানে?
অরুনের মনে, তুতুলের মনে। কারণ ওরাও ঠিক এইটাই দেখছে।
মাছের অন্য টুকরো টা অনুরাধার পাতে তুলে দিয়ে বললাম-
তাই এখন থেকে তুমিও জামাই, শ্বশুড় আর বাচ্চাকে সব টা তুলে না দিয়ে নিজের জন্য রাখতে শেখো, বলতে শেখো,
আমিও খাবো তো।
নাহলে বয়স হলে তখন তুমিও তোমার মায়ের মত বলবে শরীর ভালো লাগে না। ছেলে তোমায় বলবে, তোমার কোন রোগ নেই, শুধু শুধু বানাচ্ছো, স্বামী বলবে, আর কত ডাক্তার দেখাবো?
তখন তুমি যতই ভালো মাছ মাংস ডিম দুধ খাও না কেন তোমার হাড্ডিতে জোর পাবে না। শরীর তা নিতে পারবে না।
তাই সবার সাথে সাথে নিজের খাবারের পুষ্টিমান ঠিক রাখো। এদেশে বয়স হলে ছেলেদের আগে মেয়েদের শরীর আগে ভেঙে পড়ে। ঠিক এই কারণে।
তাই যখন তোমার স্বামী বাচ্চাদের জন্য কিছু আনে তখন তাকে মনে করিয়ে দাও তুমিও মানুষ তোমারও সমান পুষ্টি দরকার।
সবাই চুপ হয়ে আছে। নীলার চোখ ছলছল করছে। তখন তুতুল তার পাত থেকে ডিমের অর্ধেক অনুরাধার পাতে তুলে দিলো। অনুরাধা তুতুলের কপালে চুমু এটে দিতে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ভাতে ।
মা দিবসে মায়ের ভালোবাসা জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে মায়ের পাতে ভালো টুকরোটা তুলে দেওয়ার নিয়ম হোক। যাতে আমার মা টায়, শেষ বয়সেও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। নিশ্চিত হোক মায়ের সুস্বাস্থ্য।
মায়ের_সুস্বাস্থ্য
দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
…..
৩.মাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস
আমার মা হারিয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ করেই। আমি তখন খুব ছোট।
সেদিন বৃষ্টি ছিলো। মা গিয়েছিলেন মামার বাসায়। আমি পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলাম।
‘সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো-‘
মা যাবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি একটুক্ষণ পরেই চলে আসছি। তুই কবিতাটা মুখস্থ করে ফেলিস।’ আমি তাই কবিতাটা মুখস্থ করছিলাম। সকাল, দুপুর। কাজলা দিদি আমার মুখস্থ হয়ে গেল। কিন্তু মা তখনও ফিরলেন না।
বাবা ফিরলেন সন্ধ্যায়। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে গিয়ে মায়ের না ফেরার কথা জানালাম। বাবা মামার কাছে গেলেন। মামা জানালেন, মা আসেননি তাদের বাড়ি। বাবা আর কিছু না বলে চুপচাপ বাসায় এসে শুয়ে পড়লেন।
আমি সারারাত মায়ের অপেক্ষায় জেগে রইলাম। মা ফিরলেন না।
পরদিনও মা ফিরলেন না। তার পরদিনও। তার পরদিনও। মা যেন হারিয়ে গেছেন পৃথিবীর বুক থেকে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, মা যেন সবার মন থেকেও হারিয়ে গেলেন।
বাবা দুতিনদিন মাকে খুব খুঁজলেন, এরপর হাল ছেড়ে দিলেন। কেন যে দিলেন, বুঝলাম না। মায়ের প্রতি তার মমতা কি ঐ ক’দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো, না অন্যকিছু? জানতে পারিনি তখন।
জানলাম তিন মাস পর। এক সন্ধ্যায় বাবা এক অচেনা মহিলাকে নিয়ে এসে বললেন, ‘ইনি তোমার নতুন মা। ইনাকে সালাম করো।’
আমি তাকে সালাম না করে সোজা ঘরে গিয়ে দরজা আটকে কাঁদতে লাগলাম। বাবা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালেন, কিন্তু দরজা খুললাম না। যখন খুললাম, বাবা তখন প্রচন্ড মারলেন। এতো মারলেন যে, শেষমেষ অচেনা মহিলাটি বাবার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘এই কি করছেন? মেরে ফেলবেন নাকি ছেলেটাকে?’
বাবার সাথে সেদিন থেকে আমি কথা বলি না।
বাড়িটা আমার কাছে নরকের মতো হয়ে গেল। এখানে কাউকেই যেন চিনি না। যতক্ষণ বাড়ি থাকি, নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকি। বাইরে বের হলে সোজা মামার বাসায় চলে যাই।
মামা-মামি দু’জনেই আমাকে অনেক আদর করেন। মামা খুব দুঃখ করেন তার বোনটির জন্য। মাঝেমাঝে আমার সামনেই কেঁদে ফেলেন। মামীও কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ এতো সুন্দর ছেলেটাকে ফেলে কই যে আমার বোনটা হারায় গেলো? কই যে চলে গেল? কত সুন্দর করে ভাবি বলে ডাকতো মেয়েটা। আর ডাকবে না।’
মামা-মামীর কান্না দেখে আমারও কান্না পায়। আমার কাঁদতে ভালো লাগে না। আমি তখন রিংকুর সাথে খেলি। রিংকু আমার মামাতো বোন। আমার সমবয়সী প্রায়।
ছোট থেকেই আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম। মা হারিয়ে যাবার পর আরো কাছাকাছি হলাম দুজন। আমি সারাদিন খেলি রিংকুর সাথে। ধানক্ষেতে ছুটে বেড়াই। দিঘীতে নেমে শালুক তুলি। প্রচন্ড বৃষ্টির পর মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে ব্যাঙ ধরতে বেরোই। আমাদের সারাদিন এমন ভাবেই কাটে।
এক দুপুরবেলা। আমি আর রিংকু মামার বাড়ির পিছে সুপুরি বাগানে নতুন ঢিবিটার উপর বসে খেলছি। মায়াবী নির্জন দুপুর, সূর্যের কড়া রোদ বাগানের ফাঁক গলে এধারে ওধারে পড়ে অদ্ভুত এক কল্পলোক তৈরি করেছে। আশেপাশে কেউ নেই।
খেলতে খেলতে রিংকু হঠাৎ বললো, ‘একটা জিনিস দিবো তোকে। নিবি?’
আমি বললাম, ‘কি জিনিস?’
‘চোখ বন্ধ কর।’
আমি চোখ বুজলাম। রিংকু কি দেয়, তা দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। হঠাৎই, ঠোঁটে অদ্ভুত এক স্পর্শ পেলাম। আমার সর্ব ইন্দ্রিয় যেন কেঁপে উঠলো সে স্পর্শে।
আমি চোখ মেলে বললাম, ‘রিংকু। এটা কি?’
রিংকু কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে কেবল লাজুক মুখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
পরদিন, মামা ভীষণ জোরে চড় মারলেন আমার গালে। চিৎকার করে বললেন, ‘বেয়াদব। এই বয়সেই এসব। কাল বাড়ি ফেরার পথে তোদের দেখে লজ্জায় তো আমার মাথা কাটা গেলো। আর যেন কোনোদিন তোকে আমার বাড়ি আসতে না দেখি।’
আমি মাথা নামিয়ে ভেজা চোখে মামার বাড়ি থেকে চলে এলাম। রিংকুর দিকে ফিরেও তাকালাম না।
তারপর কিছুদিন আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। সারাদিন নিজের ঘরে থাকি। নতুন মহিলাটা আমার খাবার দিয়ে যায়, পানি দিয়ে যায়। মাঝেমাঝে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার কি হয়েছে, বলোতো?’
আমি উনাকে কিচ্ছু বলি না। উনাকে আমার অসহ্য লাগে।
কিছুদিন পর বাবা জানালেন আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকার এক রেসিডেনসিয়াল স্কুলে আমার পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। নতুন মহিলাটি সাথে সাথে বললেন, ‘দরকার কি? এতো ছোট মানুষ। ঢাকায় গিয়ে একা একা থাকবে কিভাবে?’
বাবা বললেন, ‘থাকতে পারবে। সারাজীবন আমরা ওকে কোলে নিয়ে বেড়াবো নাকি? একা থাকা শিখতে হবে না?’
পরদিন আমি ট্রেনে চেপে ঢাকায় রওনা দিলাম। যদিও বাড়িটা আমার নরকের মতো লাগতো, তবুও যাবার সময় খুব খারাপ লাগছিলো আমার। এ বাড়িতে আমার সব ছিলো। আমার মা ছিলো, বাবা ছিলো। ছুটির দিনের খুনসুটি ছিলো, একসাথে বসে গল্প করা ছিলো। বৃষ্টির দিনের খিচুড়ি ছিলো, ঈদের দিনের আনন্দ ছিলো।
এখন যদিও কিচ্ছু নেই। তবু, মায়ের ঘ্রাণ ছিলো। আজ থেকে তাও পাবো না।
ট্রেনে বসে খুব কান্না পাচ্ছিলো। মায়ের কথা মনে পড়ছিলো, বাবার কথাও মনে পড়ছিলো। আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকাচ্ছিলাম। রিংকুর কথাও মনে উঁকি দিচ্ছিলো। আমি জোর করে রিংকুর মুখটা সরিয়ে দিলাম মন থেকে।
এরপর, ঢাকা। টানা দশ বছর রইলাম ঢাকায়। এরমধ্যে একবারও বাড়ি আসিনি। ছুটির দিনগুলোতে ঢাকাতেই থাকতাম, নইলে কোনো বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে চলে যেতাম। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো না একবারও, ইচ্ছে করলেও সে ইচ্ছেটাকে পাত্তা দিতাম না।
বাড়ি ফিরলাম দশ বছর পর।
এই দশবছরে কত কি যে বদলে গেছে। আমার নিজের বাড়ি, নিজের এলাকাকেই যেন আমি চিনতে পারছিলাম না। শুধু একটা জায়গা একইরকম আছে, রিংকুদের বাড়ির পিছে সুপুড়ির বাগানটা। আমি যেমন দেখেছিলাম ছোটবেলায়, ঠিক যেন তেমনই আছে বাগানটা।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। রাত নেমেছে ততক্ষণে। জায়গাটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল, এখানে ওখানে দু’চারটে জোনাকি আলো জ্বালিয়ে উড়তে লাগলো। ঝিঁঝিঁদের অবিরাম সঙ্গীত বাজতে লাগলো চারদিকে।
আমি অপেক্ষা করি রিংকুর।
রিংকু ফেরে দশটা নাগাদ। আমার ডাক শুনে সে ভীষণ চমকে যায়। ভীত হরিণীর মতো সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি আবার বলি, ‘আমিরে রিংকু। চিনতে পারিস নি?’
রিংকু এবার আমাকে চিনতে পারে। অবাক হয়, ভয়ও পায়। ভয় পাওয়া গলায় আমাকে বলে,’তুই? কখন আসলি? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
আমি হাসিমুখে বলি, ‘ভয় পাসনা। আমি জানি, তোর বিয়ে। তোর বদনাম করে বিয়ে ভাঙার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। শুধু কয়েকটা কথা জানাতে এসেছিলাম তোকে।’
রিংকুর ভয় তবুও কাটে না। বলে, ‘এখানে কেন? বাসায় এসে বল।’
‘না, বাসায় না। এখানেই বলতে হবে।’
‘তাহলে তাড়াতাড়ি বল। যেতে হবে আমায়।’
‘আচ্ছা, বলছি। তুই তো জানিস আমার মা হারিয়ে গেছে। কেমনে হারিয়ে গেছে, জানিস?’
‘না, জানি না।’
‘তবে বলি, শোন। এই দশ বছর অনেক খোঁজ-খবর নিয়েছি আমি, অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সবকিছুই এখন পরিষ্কার আমার কাছে। আজ এখানে এসেছি সবকিছুর হিসেব চুকাতে।’
রিংকু ভয় পায়, ‘মানে?’
‘বলছি। মা হারিয়ে যায় কবে, জানিস তো?’
‘হু।’
‘আমি ভেবেছিলাম মা মারা যাবার পরই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু না। বাবা আর নতুন মায়ের বিয়ের সার্টিফিকেট আমি দেখেছি। উনাদের বিয়ে হয়েছিলো মা হারিয়ে যাওয়ার এক মাস আগে। বাবা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। নতুন মায়ের কিছু করবার ছিলো না। গরীব ঘরে মানুষ তিনি, চাচাদের কাছে মানুষ হয়েছেন। উনাদের গ্রামে গিয়ে উনাকে বাবার পছন্দ হয়, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আপদ বিদেয় করতে পেরেছে ভেবে উনার চাচারাও তড়িঘড়ি করে নতুন মায়ের সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে দেয় কোনো খোঁজখবর না নিয়েই। বাবা এই বিয়ের কথা মায়ের কাছে গোপন রাখে।
কিন্তু মা কোনোভাবে টের পেয়ে যায়। মা ঠিক করেন, বাবাকে ডিভোর্স দিবেন, আর মামলা করবেন বাবার নামে। বাবা ভয় পেয়ে যান। এমনিতে জেলে যাবার ভয়, তার উপর তার চাকরি হারাবার ব্যাপারটাও নিশ্চিত। তিনি ঠিক করেন, মায়ের মুখ বন্ধ করা লাগবে, যেকোনভাবেই হোক।
যেদিন মা হারিয়ে যায়, সেদিন আমরা জানতাম বাবা বাসায় ছিলেন না, অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা ভুল। বাবা ঐদিন ছুটি নিয়েছিলেন অফিস থেকে। অনেকেই তাকে এলাকাতেও দেখেছে। মা বাড়ি থেকে বের হতেই বাবা তার পিছু নেয়। পিছু নিয়ে এই সুপারির বাগান পর্যন্ত আসেন।’
রিংকু শিউরে ওঠে। ফিসফিস করে বলে, ‘ফুফাই তাহলে খুন করেছেন ফুফুমণিকে?’
আমি বলি, ‘না।’
‘না?’
‘হু। বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে মামলা চালানো, আমাকে নিয়ে আলাদা থাকা, এসব কিছুর জন্যই মায়ের অনেক টাকার দরকার ছিলো। তুই হয়তো জানিস না, নানা মারা যাবার সময় দক্ষিণ পাড়ার ধানী জমিটা মাকে দিতে বলেছিলেন। মামাই ঐ জমিটা ভোগদখল করতেন। পরে, টাকার দরকার হওয়ায় মা মামাকে বলেন জমিটা তাকে দিয়ে দিতে। মামা রাজি হলেন না। ঐ জমি থেকে অনেক টাকার ধান আসে মামার। মামা এর বদলে কিছু টাকা দিতে চাইলেন মাকে। মা ঐ টাকা নিতেই সেদিন এই বাগানে আসেন।
কিন্তু এখানে এসে টাকার অংক দেখে মা রেগে যান। মামা যে টাকা মাকে দিতে চেয়েছিলেন, তার চাইতেও কম টাকা নিয়ে এসেছিলেন। জমিটার দাম ছিলো এর থেকে অনেক অনেক বেশি। এই নিয়ে মা আর মামার ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়া চলতে চলতেই মামা এখানে পড়ে থাকা একটা কাঠ দিয়ে মায়ের মাথায় জোরে বাড়ি মারে। মা তখনই মারা যায়।’
রিংকু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, ‘তুই মিথ্যা বলছিস। আব্বা এমন কাজ করতেই পারেন না।’
‘নারে। আমি মিথ্যা বলি নাই। তিনি এটা করেছেন, এবং তিনি নিজের মুখেই এটা স্বীকার করেছেন। আর তাছাড়া, এ ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলো। কে জানিস?’
‘ফুপা?’
‘হ্যাঁ। বাবা মার পিছুপিছু এখানে এসে পুরো ঘটনাটি দেখেন। কিন্তু কাউকে কিছু না বলেই খুশিমনে বাড়ি ফিরে যান। তার আর চিন্তা কি? আপদ তো বিদেয় হয়েছে। মামাও মায়ের লাশটা এ বাগানে পুঁতে ফেলেন।’
আমি নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলে গেলাম। গলাটা একটুও কাঁপলো না। আমি তো এখন আর দশ বছর আগের সেই ছোট ছেলেটা নই, এখন রক্ত টগবগে তরুণ, খুনের নেশায় রক্ত কিলবিল করতে থাকে…
রিংকু হঠাৎ কান্না থামালো। কিছু যেন বুঝতে পেরেছে। ভয় পাওয়া গলায় ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তুই এ গ্রামে কেন এসেছিস?’
‘বলেছি না, হিসেব চুকাতে।’
‘কি হিসাব?’
‘প্রথমে বাবার হিসাব। নতুন মাকে বিয়ে করবার সময় বাবার প্রচুর টাকার দরকার ছিলো। সংসারের হিসেব থেকেও সেই টাকা নিতে পারছিলেন না, মা টের পেয়ে যাবেন বলে। শেষে ঘুষ খেয়ে তার অফিসের একটা প্রোজেক্ট পাস করে দেন। এই প্রোজেক্টের কথা মনে হয় তুই শুনেছিস। গত সপ্তাহে এক জায়গায় মাটি ডেবে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেলো না, এটা ছিলো সেখানে আবাসন তৈরির প্রোজেক্ট। এটা নিয়ে এখন বেশ তুলকালাম হচ্ছে। আমি বাবার বিরুদ্ধে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ তার অফিসে দাখিল করে এসেছি। এখন তদন্ত হচ্ছে বাবাকে নিয়ে। তার চাকরিটা যাবে শিগগির। মামলা হবে, জেলও হয়ে যেতে পারে। এই বৃদ্ধ বয়সে এতো ধকল তিনি কিভাবে সামলান, তা দেখা যাবে।’
রিংকু চোখের জল মুছে বললো, ‘আর আমার বাবা?’
আমি কিছু বলি না।
‘বল। আমর বাবার সাথে কি করেছিস।’
আমি শুধু বলি, ‘দক্ষিণ পাড়ার ধানী জমিটা আছে না? ওটার নিচে কাল খুঁজে দেখিস।’
রিংকু চিৎকার করে ওঠে। আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি, রিংকুর দিকে ফিরেও তাকাই না। দশবছর আগে যেভাবে এসেছিলাম।
এতো প্ল্যান করেও শেষমেষ রিংকুকে সব বলে দিলাম কেন? কি জানি! মনে হয় মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিলো, তাই। যদিও, এতে কোনো সমস্যা হবে না। কাগজে-কলমে আমি আছি শরীয়তপুর। আমি যে এখানে এসেছিলাম, কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।
রিংকুকে একটা কথা বলা হয়নি। সেই নির্জন দুপুরবেলায় আমরা যে ঢিবিটার উপর বসে খেলছিলাম, সেটা কি ছিলো তখন বুঝতে পারিনি। ওটা ছিলো আমার মায়ের কবর। মামা মাকে খুন করে ঐখানেই তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর মা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন, চিরদিনের জন্য।
গল্প- নিরুদ্দেশ
লেখা- সোয়েব বাশার
.
৪.মাকে নিয়ে কষ্টের স্ট্যাটাস
আমার মা কখনো আমার দেয়া শাড়ি ঈদে পরেন না।
আমি গত পাঁচ বছর ধরে খেয়াল করেছি। নিজে কষ্ট পেয়েছি কিন্তু মা-কে কখনো বলিনি। আজকে যখন গ্রামের ঈদগা-তে এসে নামাজ পরেছি তখনো আমার মনে এই ব্যাপারটা খচখচ করছিলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম মা এইবারও আমার দেয়া শাড়ি পরবেন না। মায়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমি নিয়মিত উনার খোঁজ খবর নেই। উনার সঙ্গে আমার ছোট ভাই রতন থাকে এবং উনি ঈদে ওর দেয়া শাড়ি পরেন। রতনের শাড়ির চাইতে আমার শাড়ি অনেকগুণ দামী। কিন্তু মা ওরটাই পরবে। এর আগে এই ব্যাপারটা আমি আমলে নেইনি। আমার বউ, রতন অথবা রতনের বউ ওরা কেউ খেয়াল করেছে বলে আমার মনে হয় না। আমি সবসময় ভেবে নিয়েছি এক ঈদে ওরটা পরবে অন্য ঈদে আমারটা পরবে। কিন্তু মা গত পাঁচ বছরের কোন ঈদে আমার দেয়া শাড়ি পরেন নাই।
গ্রামে আমার ইজ্জৎ সম্মান অনেক বেশী। আমি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। আজকে ঈদের জামাতের শেষে সবাই আমার কাছে আবদার করেছে যে মসজিদে এসি লাগিয়ে দিতে। আমিও কথা দিয়েছি আমি আপাতত দুইটা এসি দিবো। কোরবানির ঈদের সময় দুইটা দিবো।
গ্রামের মানুষ আমাকে সম্বর্ধনা দিতে চায়। আমি এই গ্রামের গর্ব। আমি যতই না না করিনা কেন তারা শুনবে না।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসেও আমাকে তোষামোদি করে। আমার ভালোই লাগে। শহরে এই সম্মানটা পাওয়া যায় না। শহরে এক বাড়ির লোক অন্য বাড়ির লোককে চিনে না। তাই প্রতি ঈদে আমি আমার বউকে নিয়ে গ্রামে আসি। সকালবেলা এসে আবার বিকেল বেলা চলে যাই। সন্ধ্যায় ঢাকায় আমাদের পার্টি থাকে।
আমার আদরের ভাই রতন কিন্তু মেধাবী ছাত্র। ডাক্তার। কিন্তু গ্রামেই পরে আছে। আমার ব্যাপারটা খুব ছেলেমানুষি মনে হয়। কতজন কত নীতি কথা বলে কিন্তু আসলেই কি এই ধরনের নীতি কথা দিয়ে পেট চলে। ও কি ওর সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছে? গ্রামে কি সেই সুযোগ সুবিধা আছে? না আছে টাকা, না আছে আনন্দের উপকরণ, না আছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধে। রতনকে বললেই সে হাসে।
আমার বউ এই ঈদে আমার সঙ্গে গ্রামে আসেনি। তার গ্রাম তেমন পছন্দ না। তার চাইতে পছন্দ দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া। আমিও তাকে জোর করিনি। যেটাতে সে আনন্দ পায় না তা জোর করে করার কোন অর্থ হয় না।
আমি আমার মায়ের হাতের খিচুড়ি গরুর মাংস খুব পছন্দ করি। গ্রামে সবার সঙ্গে দেখাশুনা করে, এই বাড়ি, সেই বাড়িতে কিছু নাস্তা পানি খেয়ে দুপুরে মায়ের হাতের খিচুড়ি আমার অমৃত লাগে। মা আমার সঙ্গে বসে আমাকে বেড়ে বেড়ে খাওয়ায়।
আমি আমার মনের কষ্টের কথা গোপন করতে পারি না।
আমি মা-কে বললাম
মা একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারি না। তুমি প্রতি ঈদে রতনের দেয়া শাড়ি পরো। তোমার কি আমার দেয়া শাড়ি পছন্দ হয় না। তাহলে আমাকে বলতে আমি তোমার জন্য অন্য ডিজাইনের কয়েকটা শাড়ি নিয়ে আসতাম।
মা আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে
তুই ব্যাপারটা খেয়াল করেছিস? আমি ভেবেছি খেয়াল করিস না।
না মা আমি প্রতি ঈদেই খেয়াল করি। খুব আগ্রহ নিয়ে খেয়াল করি তুমি আমার শাড়ি পরেছো কিনা? কিন্তু তুমি আমার শাড়ি পরো না। কারণ কি মা? তুমি রতনের সঙ্গে থাকো দেখে? রতন অথবা ওর বউ কি কখনো কিছু বলেছে?
না বাবা না। ওরা কখনো কিছু বলেনি। বাবা স্বপন। তুই জীবনে অনেক সফল হয়েছিস। খুব উঁচু পদে চাকরি করিস। তোর অনেক টাকা। ঢাকা শহরে তোদের আলি-সান বাড়ি। বউ-মা, আমার নাতি, নাতনি হর হামেশা দেশ বিদেশ ঘুরে। আমি ফেসবুকে তোদের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি। তুই গ্রামের অনেক মানুষকে অনেক সাহায্য করিস। আমাকে, রতনের পরিবারকে অনেক উপহার দেস, টাকা পয়সা পাঠাস। তোর অনেক নাম, অনেক সুনাম। তোর ক্ষমতা আছে মানুষকে সাহায্য করার।
মা আমি বড়লোক আর রতন বড়লোক না দেখে তুমি ওর শাড়ি পরো?
না বাবা তাও না। আসলে তুই এত ধনী। কিন্তু সবাই জানে তুই ঘুষ খাস। তোর সম্পত্তির উৎস হচ্ছে ঘুষ। তুই গ্রামে অনেক সাহায্য করিস, অনেক টাকা পয়সা দেস। কিন্তু সবাই আড়ালে তোকে ঘুষখোর স্বপন বলে। বাবা এই কথা আমার কানে আসে। আমি খুব দুঃখ পাই, কষ্ট পাই। কিন্তু আমি জানি আমার কথায় তুই পরিবর্তন হবি না। তুই, আমার বউ মা, নাতি নাতনী এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিস। তোর মনে আছে বাবা তোর বাবাও ইঞ্জিনিয়ার ছিলো। কিন্তু আমরা কি সাধারণ জীবন যাপন করতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে এক অন্য ধরনের আত্মতৃপ্তি ছিলো। তোরা কি আনন্দে থাকতি খুব স্বল্প জিনিসে। সেই চরিত্র পেয়েছে তোর ভাই রতন। গ্রামে থাকে। মানুষজনের মধ্যে থাকে। তুইতো জানিস না বাবা রতন আমার অনেক যত্ন নেয়। আমার ঈদের চাঁদ দেখা খুব পছন্দ দেখে প্রতি চাঁদ রাতে আমাকে পুকুর ধারে খোলা জায়গায় নিয়ে যায়। আমরা সবাই একসঙ্গে ঈদের চাঁদ দেখি। চাঁদ রাতে খিচুড়ি আর মুরগীর গিলা, কলিজা রান্না করে রতন। কি যে অমৃত লাগে বাবা। রতন তোর মত সাহায্য মানুষজনকে করতে পারে না। কিন্তু এই যে দেখে আমাদের খাদিজার জামাইকে বাজারে দোকান করে দিয়েছে। রানুর ভাইকে হাসপাতালে চাকরি দিয়েছে। এই মানুষগুলোও যেন আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছে।
আমি আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি।
মা বলে যাচ্ছে।
তোর বাবা কখনো ঘুষ, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। তুই সমাজের চোখে অনেক সফল বাবা। সবখানেই তোর জয় জয়কার। কিন্তু আমি প্রতি ঈদে রতনের পরিশ্রমের টাকায় কেনা কম দামের শাড়ি-ই পরি। তোর বাবা ঘুষ, দুর্নীতিকে জিততে দেন নি। আমি তার স্ত্রী হয়ে কিভাবে তাকে জিততে দেই।
আমি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠি। গাড়ি গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। দূরে দেখতে পাচ্ছি রতন, ওর বউ, বাচ্চারা এবং আমার মা দুইটা রিক্সা করে এই গ্রাম ওই গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছে। তারা কি প্রাণ খুলে হাসছে।
হটাত আমার নিজেকে খুব পরাজিত মনে হচ্ছে। আমি নিজে সারাক্ষণ অসুখী থাকি। আমার স্ত্রী রত্না দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ডাক্তার বলেছে সে তীব্র বিষণ্ণতার রোগী। নানান দেশ ঘুরেও তার মধ্যে তীব্র বিষণ্ণতা। আমার ছেলেটা মাদকাসক্ত। আমার মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে আবার ফেরত এসেছে। কেউ জানে না আমি নিজেও বিষণ্ণতার ওষুধ খাই।
আমার সঙ্গে গাড়িতে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছে।
সে বলে যাচ্ছে
ভাই চারদিকে আপনার জয় জয়কার।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি
আজকে আমি জানি আমি দুনিয়ার সবচাইতে পরাজিত মানুষ।
ঈদের_শাড়ি
আমিনুলের_গল্প_সমগ্র
5.ma bangla golpo status
আমি কোনোদিন বাবাকে মায়ের গায়ের উপর হাত তুলতে দেখিনি। আজ হাত তুললেন। সম্ভবত মায়ের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেছে। কিন্তু মায়ের চোখে পানি নেই। মায়ের অগ্নিচোখ। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করছেন। অথচ বাবার ছলছলে চোখ। বাবা ভেজা গলায় বললেন,
“উঠতে বসতে যে জোছনার খোটা দেও, সে আজ মরে গেছে। এবার খুশি তো? এখন থেকে অন্তত আমাকে রেহাই দেও।”
জোছনা নামটা আমি আজ প্রথম শুনিনি। আগেও বহুবার মায়ের মুখে শুনেছি। মা বাবার সাথে একটু রেগে গেলেই জোছনার নাম উঠে। আমি দুয়েকবার জানতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে, কে এই জোছনা? মা মুখে ভেংচির আকৃতি এনে ভাষাকে বিকৃতি করে বলেছিল,
“তোর বাপের নাঙ লাগে। আমারে বিয়ে করার আগে জোছনার লগে তোর বাপের পিড়িত ছিল।”
বাবা মাথা নিচু করে সেদিন আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। বুঝাই যাচ্ছে, নিজের ছেলের সামনে তিনি বেশ অপমানিত হয়েছেন।
বাবার জন্য আমার বড্ড মায়া লাগে। মায়ের এই অকথ্য ভাষার প্রতিবাদ বাবা কোনোদিন করেননি। কিন্তু আজ প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা ছিল সজোরে একটি থাপ্পড়। বিগত এত বছরের রাগ ক্ষোভ বাবা একটি থাপ্পড়ে কমাতে পেরেছেন তো? আমি দুপুরের খাবার খেতে বসেছি, মা তরকারি দিচ্ছিলেন। বাবা এলেন হঠাৎ ঘরে। তখনি মায়ের হুংকার!
“আমারে ঘুমে রাইখা কাউরে কিছু না কইয়া জোছনার কাছে গেছিলা? কইয়া গেলে কী হইতো? না করতাম আমি? এত বছরেও না কইরা ফিরাইতে পারছি?”
বাবা এগিয়ে এলেন। কষে থাপ্পড় দিয়ে জোছনার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করলেন। এমতাবস্থায় আমার গলা দিয়ে আর ভাত নামবে না। বাবা ঘর থেকে চলে গেলেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, মৃত্যু সংবাদ শুনে রাগ একটু কমেছে। আমি খাবার রেখে নলকূপে হাত ধুয়ে ফেলেছি। মনটা কেমন খারাপ লাগছে। বাবা যে আজ আড়ৎ এ যাবেন না, বুঝাই যাচ্ছে। তার চেয়ে ভালো আমি আড়ৎ এ গিয়ে বসি। কাস্টমারকে চাউল দিতে দিতে মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা যাবে।
রাত তখন বারোটা হবে। আমি বই পড়ছিলাম। হুমায়ূন স্যারের ‘মিশির আলি সমগ্র।’ বইয়ের ‘তন্দ্রা বিলাস’ আমার দুই চোখের তন্দ্রা কাটিয়ে দিলো। দরজায় ঠকঠক। দরজার ওপাশ থেকে বাবার গলার শব্দ।
“শাওন, ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
আমি কোনো জবাব না দিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাবা ঘরে ঢুকে আমার বিছানায় বসতে বসতে বললেন,
“ঘুমাসনি এখনো! তোর সাথে গল্প করতে এলাম। বাপ-বেটার গল্প অন্য কারো শুনতে হয় না। তাই এখন এলাম। তোর সমস্যা হবে না তো?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
“না বাবা। আমার আরো ভালো লাগছে যে তুমি এসেছো। আজ এই ঘরেই ঘুমাও। মায়ের ব্যবহারে মন খারাপ করে থেকো না।”
বাবা পা তুলে আয়েশ করে বসলেন। ইশারায় আমাকে চেয়ার টেনে কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমি কাঠের চেয়ার নিয়ে বাবার মুখোমুখি বসলাম। বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোর অনেক কিছু জেনে রাখা দরকার। আমি তোকে জানাতে চাই। আগেও জানাতে চেয়েছি, সাহস হয়নি। ভেবেছি তোর মা যেমন অকথ্য ভাষায় কথা বলে, হয়তো তোর জানা হয়ে যাবে। কিন্তু তুই জানিস না কিছুই। শুধু একটি নাম জানিস, জোছনা। তুই এই নামটি তোর মায়ের মুখে শুনেছিস। যতবার শুনেছিস আমি লজ্জা পেয়েছি। বলতে পারিনি কিছু। আজ বলব।”
আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার গল্প শুনছি। যে নাম নিয়ে মায়ের অকথ্য ভাষা, বাবার লজ্জা পাওয়া। অজানাকে জানতে অবশ্যই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বাবা একনাগারে গল্প বলছেন। লুকায়িত এক গল্প।
“তোর মায়ের মুখে জোছনা নাম শুনে হয়তো ভেবেছিলি, আমার অন্য কারো সাথে কোনো সম্পর্ক আছে। সত্য হলো, জোছনার সাথে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই। জোছনা আমার বিয়ে করা প্রথম স্ত্রী ছিল। তোর দাদা দাদি পছন্দ করে বিয়ে করিয়েছেন। তোর দাদার বাড়ির কাছেই। আমরা যে এত বছর ধরে তোর দাদা দাদিকে রেখে শহরে থাকি, তার একটি কারণ এই জোছনা। তোকে নিয়ে যে প্রতিবার তোর দাদার বাড়ি যেতাম, আমি তোর সাথে সাথেই থাকতাম। যেন আমাদের গ্রামের কারো কাছ থেকে এই বিষয়ে কিছু শুনতে না হয়। তোর খারাপ লাগতে পারে শুনলে। তোর দাদা-দাদি মারা যাওয়ার পর গ্রামে খুব একটা যাই না। তোর মা সব জানে। তবুও তোকে বলেনি, যে আমি আগেও একটি বিয়ে করেছিলাম। আমার আর জোছনার একটি সন্তানও আছে। নাম ফাল্গুনী। তোর সৎ বোন ফাল্গুনীর মতো তোর নামটাও বাংলার বারো মাসের একটা নাম। গ্রামে আমরা শ্রাবণ মাসকেই শাওন মাস বলি। তোর মা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। সে যাই হোক। জোছনার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর সে পরবর্তীতে আবার বিয়ে করে এক স্কুল মাস্টারকে। তোর দাদার বাড়ি থেকে কয়েকটা গ্রাম পরে। আট বছর সংসার করলেও আর কোনো সন্তানাদি হয়নি। স্কুল মাস্টার মারা গেলেন চার সালের বন্যায়। আমি সব খোঁজই রাখতাম। রাখার কারণ ফাল্গুনী, আমার মেয়ে। আমি তাকে আমার কাছে রাখতে পারিনি। মাস্টার মারা যাওয়ার পর সেই সংসারে টানাটানি অবস্থা। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। কয়েকটা সংসার চালানোর তৌফিক দিয়েছেন। আমি প্রতি মাসেই যাই সেই এলাকায়। কাউকে দিয়ে খবর পাঠালে ফাল্গুনী আসে। বাবা বলে এসে জড়িয়ে ধরে। কতশত বায়না তার। আমি আসার পথে পুরো মাসের খরচ দিয়ে আসি ফাল্গুনীর হাতে। তোর মা এসব জানে। আমি গোপন করি না তোর মায়ের কাছে। আমি ফাল্গুনীর জন্মদাতা। সে আমার কাছে মেয়ে হিসেবে পাওনা। আমি তা দেবই। আমি ফাল্গুনীর মায়ের সাথে দেখা করি না। দেখা করাটা বেমানান। লোকে মন্দ বলবে। তাই লোক মারফত ফাল্গুনীকে ডেকে আনি। আর এখন তো নরসিংদী সরকারি কলেজেই অনার্স শেষ করবে এই বছর। এখন তো কলেজে গেলেই মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি।
কিন্তু ঐ যে, আমি তোর মায়ের কাছে কোনোকিছু লুকাই না। তোর মা মনে করে আমি হয়তো ফাল্গুনীর মায়ের সাথেও দেখা করি। এজন্যই রাগের মাথায় দুই চারটে কথা শোনায়। এতে আমার খারাপ লাগে না। শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু তুই…. ”
“বাবা এক মিনিট…..”
আমি বাবাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“এত বড়ো জীবন ঘটিত বিষয়টা মায়ের কাছেও লুকিয়ে রাখো না। তাহলে আমি শুনলে কী সমস্যা বাবা?”
বাবা উত্তরে বললেন,
“আসলে আমি চেয়েছিলাম তুই বড়ো হলে সব বলব। তোর মানসিক বেড়ে উঠাতে মস্তিষ্কে কোনো প্রভাব পড়ুক, সেটা চাইতাম না। কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম, যথেষ্ট বড়ো হয়েছিস। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে আর পড়লি না। ফাল্গুনী শুনেও কষ্ট পেয়েছে। ওহ হ্যাঁ, ফাল্গুনী কয়েকবার বলেছিল তোকে সব জানাতে, আমি সাহস পাইনি। তবে বিশ্বাস কর, ফাল্গুনীর মায়ের সাথে আমি দেখা করতাম না কখনো। কিন্তু আজ মৃত্যু সংবাদ শুনে না গিয়ে থাকতে পারিনি। তার উপর তোর মায়ের এমন কথাটুকু সহ্য হয়নি। তাই…”
আমার কোনো ভাই-বোন নেই, এমন একটি আক্ষেপ ছিল সবসময়। আজ বাবার মুখে শুনলাম আমার একটি বোনও আছে। আমার বড়ো আপু। নাম ফাল্গুনী। কোনোদিন দেখিনি। বাবা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটো ছলছল। জোছনা নামের মানুষটির জন্য বাবার চোখে পানি। থাকাটা স্বাভাবিক। আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম,
“তোমাদের ছাড়াছাড়ি কেন হয়েছিল বাবা?”
বাবা দেয়াল থেকে দৃষ্টি আমার দিকে দিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“যে মানুষটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, তার সম্পর্কে কিছু না বলাই উত্তম। এতটুকু জেনে নে, আমাদের মনের মিল ছিল না। তবে বুঝতে একটু দেরি হওয়াতে সাড়ে চার বছর সংসার টিকেছিল। পরে আর টিকেনি। ফাল্গুনীকেও নিয়ে গেছে, আমার কাছে কোনোভাবেই রাখতে পারিনি। জোর করলে হয়তো পারতাম। আইনে গেলে ফাল্গুনীকে রাখতে পারতাম। থানা পুলিশ করে কোর্টে গিয়ে এতসব করতে ইচ্ছে হয়নি।”
আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই বাবা কীভাবে যেন প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মেঘনা দিয়ে এক ট্রলার ভর্তি চাউল আসার কথা। মুন্সিগঞ্জ বাজারের পরিচিত পাইকারদের থেকে কিনেছি। সন্ধ্যায় আসার কথা। রাত নয়টা অবধি বসেছিলাম, আসেনি। দোকানের আওলাদের কাছে নাম্বার আছে। সকালে আড়ৎ এ গিয়ে একটু খোঁজ করিস তো। আসলে রশিদ দিবে, টাকা দিয়ে দিস।”
কথাটুকু বলে বাবা উঠলেন। উঠে সাথে সাথে চলে গেলেন না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে আবার বললেন,
“রাত একটা বেজে যাচ্ছে। জেগে থাকিস না, ঘুমিয়ে পড়। সকালে আড়ৎ এ যাবি।”
বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি চেয়ার আগের জায়গায় নিয়ে এলাম। আজ আর ‘তন্দ্রা বিলাস’ পড়ে শেষ করা হবে না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
.
ঠিক এক সপ্তাহ পরে বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আমি আড়ৎ এ ছিলাম। খবর পেয়ে ছুটে এসেছি বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। কেউ মারা গেলে পরিচিত সবাই শেষ দেখা দেখতে আসে। মা বিলাপ করে কান্না করছেন। মায়ের মুখেই শুনতে পেলাম, সকালে শুধু বলেছিলেন বুকটা ব্যথা করে। মা ভেবেছেন খাওয়ার পর হয়তো এমনিতেই ব্যথা করছে। তাছাড়া ব্যথা ততোটা বেশিও না। কিছু না বলে বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। আমার মাথার উপর বটগাছের ছায়া ছিলেন। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। এত বড়ো পৃথিবীতে নিজেকে একা লাগছে। আমার দুই চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়ছে। সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলেন এলাকার কয়েকজন। মানুষের সামনে কান্না করাটা অন্যসময় হলে লজ্জাকর পরিস্থিতী হতো। কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে না। শুধু পানি পড়ছে। এক এক করে সব আত্মীয় স্বজন এলো। শেষ বিদায়ের আয়োজন চলছে। বরই পাতার গরম পানি বসানো হয়েছে। কবর খুঁড়তে লোক গেছে কবরস্থানে। পাশের বাড়ির একজন আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন কাফনের কাপড় কিনতে। এ যেন এক অনুষ্ঠান চলছে। শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান।
বাবা মারা যাওয়ার মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি আড়ৎ এ বসে আছি। বাবার অবর্তমানে দায়িত্ব বেড়ে গেছে। হঠাৎ আমার অবচেতন মনে ক্ষানিকটা ধাক্কা লাগল। ফাল্গুনী!
আমার একটা মাত্র বোন। বাবার মেয়ে। তাকে তো খবর দেওয়া হয়নি। আমার কাছে তো ফোন নাম্বারও নেই। বাড়িও চিনি না কোন গ্রামে থাকে! বাবাকে শেষ দেখা হয়নি তার। এটা তো তার প্রতি মস্ত বড়ো অন্যায় হয়েছে। মায়ের কাছে কি আপুদের বাড়ির ঠিকানা আছে? না, মা’কে কিছু বলা যাবে না। দাদার বাড়ির কেউ কি জানে?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল, বাবা বলেছিলেন ফাল্গুনী আপু নরসিংদী সরকারী কলেজ থেকে এবার অনার্স শেষ করবেন। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একটা বড্ড ভুল হয়ে গেল। আপুকে বাবার মৃত্যু সংবাদ জানানোটা দরকার ছিল।
নরসিংদী সরকারি কলেজের দক্ষিন দিকে অনার্স ভবন। আমার পরিচিত কেউ নেই এখানে। অনার্স ভবনের সামনে অনেকেই আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সবাই বয়সে আমার বড়ো। একসাথে তিন চারজন কথা বলছে দাঁড়িয়ে। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। জানতে চাইলাম, অনার্স শেষ বর্ষের ফাল্গুনী নামের কাউকে চিনে কি-না! সাথে সাথে একজন ডানদিকে তাকিয়ে একটু গলাটা উঁচিয়ে বলল,
“এই ফাল্গুনী, তোকে কেউ খুঁজতে আসছে।”
আমার চোখদুটো যেন অপেক্ষা সইছে না। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। আমার তিন চার বছরের বড়ো হতে পারে। দেখতে খুবই সুন্দর। ইচ্ছে করছে এখনি চিৎকার করে বলি, আপু আমি তোমার একমাত্র ভাই শাওন। কিন্তু বলতে পারিনি। আমার গলার স্বর কি ভেজা? বুঝতে পারছি না।
“আমাকে খুঁজছ? কে তুমি?”
আপুর কথায় কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আসলে কে আমি? পরিচয়ের শুরুটা কীভাবে করব? মুখ ফুটে বললাম,
“আপু, আপনার সাথে কিছু কথা আছে। খুব জরুরী। একটু এদিকে আসবেন?”
অনার্স ভবনের সামনে দুর্বা ঘাসে শীতল পাটির মতো বিছানা পাতা। আমি আর আপু ঘাস মাড়িয়ে মাঠের মাঝখানটায় গেলাম। আপুর কৌতূহলী চোখ। হঠাৎ বললাম,
“আমি চিনিশপুর থেকে এসেছি। আমার নাম শাওন।”
কথাটুকু বলে আপুর দিকে তাকালাম। আপু নির্বাক। চোখের পলক পড়ছে না। চোখদুটো ভিজে উঠল আমার সামনে। আরেকটু এগিয়ে এসে আপু আমার কাঁধে হাত রাখল। তারপর মাথায়, তারপর গালে। এই স্পর্শ কত শীতল, কত মায়ায় ভরা। টলমল চোখ, ভেজা গলায় আপু বলল,
“তোমাকে দেখার ইচ্ছে ছোটোবেলা থেকে। আমার একটা ভাই আছে, আর তাকে আমি কখনো দেখিনি। এই কষ্টটা আমার অনেক বছরের। কত বড়ো হয়ে গেছো তুমি।”
আমার দৃষ্টি নিচের দিকে। ইচ্ছে করছে নিজের চোখের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার চোখ থেকে এখন যেন কোনো পানি না পড়ে। আমি শত বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি আটকাতে। আটকাতে আর পারলাম কই! এরই মধ্যে আপু আবার বলল,
“বাবা মারা যাওয়ার দিন গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। আড়ৎ থেকে আওলাদ নামের কেউ একজন ফোন করেছিল। তোমাদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিলাম। বিশ মিনিটের মতো ছিলাম। সবাই কান্না করছে। মানুষের ভীড়ে আমিও বাবার মুখখানি শেষবারের মতো দেখে নিয়েছি। দেখে কান্নাও করেছি। কিন্তু কেউ জানে না আমি কে!
তোমাকেও খুঁজেছি। জিজ্ঞেস করিনি কারো কাছে। কে কবর খুঁড়তে গেল, কে বাজারে গেল! এসব বলার সময় শুনলাম তোমার নাম। কেউ একজন বলছে শাওন কাফনের কাপড় কিনতে গেছে। আমি আর সেখানে থাকিনি, চলে এসেছি।”
মাথা তুলে তাকাতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু চোখের পানি লুকাতে পারব না। টপ করে নিচে পড়বে। আপু আমার থুতনি ধরে মাথাটা উপরের দিকে তুললেন। টপ করে চোখের পানি আপুর কব্জিতে পড়ল। আপু আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন। বড়ো বোনের বুঝি এত মমতা থাকে? এত আদর থাকে?
আপু আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথার চুল নাড়িয়ে বললেন,
” তুমি ছোটো হলেও এখন তোমার দায়িত্ব অনেক। মায়ের দিকে খেয়াল রেখো।”
আমি আড়ৎ থেকে আসার সময় বিশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছি পকেটে ভরে। টাকাটা বের করে আপুর হাতে দিয়ে বললাম,
“আমি এখন আর ছোটো নই আপু। অনেক বড়ো হয়েছি। মায়ের খেয়াল যেমন রাখতে পারব, তেমনি আপুর জন্যও এই ভাইটি আছে।”
আপু একটু চমকালেন বোধ হয়। তারপর টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,
“আমি তোমার চেয়েও বড়ো। এখন আমার টাকা লাগবে না। মামার বাড়িতে থাকি এখন।”
আমি টাকা ফেরত না নিয়ে বললাম,
“টাকা নিতেই হবে। আপুর সব দায়িত্ব এখন থেকে তার ভাইয়ের। বাবা শুধু আমার একার নয়, তোমারও বাবা। তোমারও অধিকার আছে। আমাকে শুধু আপু ডাকতে দিও, বঞ্চিত করো না।”
অনার্স ভবনের মাঠের দুর্বা ঘাস সাক্ষী হচ্ছে দুই ভাই বোনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির। ঘাস মাড়িয়ে সামনে এগুচ্ছি। আড়ৎ এ যেতে হবে। আড়ৎ থেকে বাড়িতে। মা কয়েকদিন ধরে মনমরা থাকে। মায়ের কাছাকাছি থাকাটা দরকার। গল্প করা দরকার। সব দায়িত্ব এখন আমাকেই পালন করতে হবে। রিকশায় উঠে কিছু দূর এসে পেছন ফিরে দেখি, আপু তখনো আমার চলে আসা দাঁড়িয়ে দেখছে। যেন ভাইকে বিদায় দিতে মন চাচ্ছে না।
আকাশে মেঘ জমেছে। গুড়মুড় শব্দ হচ্ছে। এক পশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না।
সমাপ্ত…
গল্প: সংসর্গ
লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,
,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ