আজ উর্মির নবম বিবাহ বার্ষিকী। সারাদিন অনেক খাটাখাটনি করে স্বামী রাসেলের পছন্দের অনেক খাবার রান্না করেছে সে।
ওদের পাঁচ বছরের ছেলেটা বারবার প্রশ্ন করছে ,
-আম্মু তুমি সন্ধ্যা বেলায় সেজেছো কেন ?
মুচকি হেঁসে উর্মি বললো,
-তোমাকেও তো নতুন জামাকাপড় পরিয়েছি বাবা
-আমি তো তাই বলছি , এত রাতে কেন?
উর্মি হাসলো, উত্তর দিলো না। এই বয়সে বাচ্চাদের মনে প্রশ্নের সমাহার থাকে।
বারো বছর আগে রাসেলের সাথে উর্মির পরিচয়। সময় খুব নিষ্ঠুর, এত দ্রুত বয়ে যায়! এক যুগ পার হয়ে গেছে । তিন বছরের ভালোবাসা পরিণয়ে রুপ নিলো যদিও শশুর শাশুড়ি রাজী ছিলেন না তবুও ছেলের জেদের কাছে হার মেনেছে। অবশ্য বিয়ের কিছুদিন পরেই উর্মি তাদের মন জয় করে নিতে পেরেছে। এখানে সুশীল সমাজ হয়তো বলবে মেয়ে সব ছেড়ে আসে আবার তাকেই কেন মন জয় করতে হবে বরং সকলে তাকে সাপোর্ট করবে কিন্তু উর্মি ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখেছে। রাসেলের মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল ছেলের জন্য সুন্দরী একজন বৌমা আনবেন, সারা বাড়ি সেই বৌ নূপুরের শব্দে মাতিয়ে রাখবে। সেখান উর্মির মতো শ্যামবর্ণ, খাটো একটা মেয়েকে একমাত্র ছেলের জন্য মানতে তাদের সমস্যা হতেই পারে। প্রত্যেক বাবা মা এর সন্তান নিয়ে স্বপ্ন থাকে, তাই উর্মি নিজে থেকেই তাদের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ কাল্পনিক সুন্দরী বৌমার কথা শাশুড়ি নিজেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে উর্মির সাথে গল্প করেছেন। এখন তাদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো ।
-উর্মি, মা চলো আমরা কেকটা কেটে ফেলি
-কি যে বলো না মা , রাসেল তো আসেই নি
রাহেলা বেগমের মুখে শুকিয়ে গেল
-ও আগে আসুক তারপর কাটবো
উর্মির শশুর ইকবাল হোসেন বললেন,
-আসলে রাসেল ফোন করেছিল, অফিসের জরুরী কাজে ওকে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে, অবশ্য তোমার জন্য গিফট রেখে গেছে।
উর্মির মুখটা কালো হয়ে গেলেও প্যাকেটটা খুললো।সেখানে একটা নীল রঙের শাড়ি, লাল নীল মেশানো চুড়ি সাথে একটা তাজা গোলাপ। প্যাকেটটা খুলে উর্মি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো, যতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক তারপরেও এই ধরনের গিফট বাবা-মায়ের সামনে খোলা কেমন যেন, ফুলটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? এত বছরেও রাসেলের পাগলামি কমেনি, লজ্জায় উর্মির মুখ লাল হয়ে গেল। রাসেলের সব সময় নীল রং পছন্দ , অধিকাংশ গিফট ই নীল রঙের থাকতো, জামা কাপড় কিনতে গেলেও সব সময় নীল রং পছন্দ করতো, উর্মি মাথা নত করে বলতো
– আমি শ্যামলা বর্ণের মেয়ে নীল রং পরলে আরো কালো দেখায়। রাসেল ওর মাথায় হাত রেখে বলতো,
– তোমাকে সব রঙেই খুব সুন্দর ভাবে মানায় কিন্তু নীল রংটা আমার বিশেষ পছন্দ আর এটাতে তোমাকে আরো অনেক বেশি সুন্দর লাগে, তুমি সেটা জানো না।
পরদিন বিকেল বেলা ইকবাল সাহেবের বাড়িতে তার বোন সায়রা এলেন , পেশায় তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আগের দিনের সমস্ত ঘটনা শুনে রাগে চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
-ভাইয়া ভাবি তোমাদেরকে কতবার বলেছি আমি, উর্মিকে আসল সত্যটা ফেস করতে দাও নয়তো ও কোনদিন সুস্থ হবে না । আজীবন একটা ভ্রমের মাঝে থেকে যাবে।
-মেয়েটা শুধুমাত্র রাসেলের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে এখন যদি হঠাৎ করে সত্য টা জানতে পারে তাহলে যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে। রাহেলা ক্ষীণকন্ঠে বললেন।
-তাই বলে মিথ্যার উপরে বেঁচে থাকবে! আমি কোনমতেই মানতে পারলাম না, আজ আমি নিজেই কথা বলবো, ও কি অফিস থেকে ফিরেছে?
এমন সময় কলিং বেল বাজলো।
-আরে ফুপি তুমি কখনো এসেছো, কি খেয়েছ? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো উর্মি
-তোমার সাথে কথা আছে এখানে একটু বসো
-মা তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তারপরে আমরা চা নাস্তা খেতে খেতে কথা বলি, রাহেলা বলে উঠলেন
উর্মি ফ্রেস হতে চলে গেল
-প্লিজ সায়রা এসব নিয়ে ওর সাথে কথা বলো না
-ভাবি থামো আমি আর এসব মানবো না । এমন সময় উর্মি এসে উপস্থিত হলো
-রাসেল কোথায় উর্মি?
-ফুপি ও তো একটু চট্টগ্রাম গিয়েছে
-তাই একটু ফোন দাও তো
-এখন তো বোধহয় মিটিংয়ে আমি একটু আগে ফোন দিয়েছিলাম, ফোনটা বন্ধ, কেন ফুপি?
-তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে
-ফুপি তোমার জরুরী কথা পরে শুনবো। আজকে একটা শুভ সংবাদ দিচ্ছি , আমার প্রমোশন হয়েছে। রাসেলকে টেক্সট করে দিয়েছি। ও সময় মত দেখে নেবে আর রাতের বেলা বাবা মায়ের সাথে বাইরে খেতে যাবো সঙ্গে তুমিও যাবে আর কোন কথা শুনবো না।
সায়রা একটু আনমনা হয়ে বললো,
– তোমরা যাও, আমাকে একটু চেম্বারে যেতে হবে।
সবাই মিলে রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়িতে এসেছে। খুব মজা হয়েছে, অনেক ছবি তোলা হয়েছে।
কাপড়চোপড় না বদলেই রাহেলা বেগম স্বামীর পাশে অন্ধকার বারান্দায় গিয়ে বসলো।
-আমাদের ছেলেটার এরকম অকালে চলে যেতে হলো কেন বলো তো রাহেলা ?ইকবাল সাহেব মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলেন। রাহেলা নিজেও অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না।
চার বছর আগে উর্মি আর রাসেলের বিবাহ বার্ষিকীতে রাসেলের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। খুব জোরে বাইক চালিয়ে ও যখন ফিরে আসছিল তখন একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায়, রাসেল সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ওর হাতের প্যাকেটটা ছিটকে গিয়ে পড়ে। ওখানে ছিল নীল রঙের একটা শাড়ি, লাল নীল রঙের চুড়ি আর একটা তাজা গোলাপ। খবর পেয়ে যখন সবাই গেল উর্মি তখন অজ্ঞান, বেশ কিছুদিন ওকে হসপিটালে রাখতে হয়েছিল। তারপর কি জানি কি হলো নিজের মনে ভেবে নিতে লাগলো রাসেলের অস্তিত্ব এখনো আছে, রাসেল ওর মনের মধ্যে বাসা বেঁধে নিয়েছে, আসল সত্যটা রাহেলা কিংবা ইকবাল সাহেব কেউ আর ওকে বলতে পারছে না, এমনকি প্রতি বছর বিবাহ বার্ষিকীতে উনারা দুজনেই রাসেলের নাম করে ওকে একই রকম গিফট দেয়। উর্মির মধ্যে অন্য কোন মানসিক সমস্যা নেই। এমনিতে সে অফিস করছে, বাজার করছে, বাচ্চার যত্ন নিচ্ছে, শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে নরমাল ব্যবহার করছে শুধু রাসেল বসবাস করছে তার মাথার মধ্যে। নিকষ কালো অন্ধকারে রাহেলা আর ইকবাল সাহেব দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
ওদিকে উর্মি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রাসেলের ছবির দিকে তাকালো, চোখ থেকে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো। মনে পড়লো রাসেল তাকে বলেছিল,
– মা-বাবা হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না একটু মানিয়ে নিতে হবে। জানোই তো আমি একমাত্র সন্তান, একমাত্র ভরসা স্থল আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের। তুমি যদি কয়েকদিন উনাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারো দেখবে তোমাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখবেন ।
উর্মি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, মনে মনে বললো
-তোমার বাবা-মা এখন আমার বাবা-মা রাসেল। সমস্ত সত্য আমি খুব ভালো করে জানি কিন্তু আমি তাদেরকে ছেড়ে কখনোই যেতে চাই না। যদি সে সময় আমি সব ঘটনা মেনে নিতাম তাহলে হয়তো তারা যে পরম স্নেহে আমাকে আগলে রেখেছেন আমার জীবনে উনারা অবশ্যই তোমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে চাইতেন। কখনোই চাইতেন না একা একা একটা পুরো জীবন আমি কাটিয়ে দেই। তোমার বাবা-মায়ের এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। দুজন বৃদ্ধ মানুষকে আমি কখনোই অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে তার চেয়েও বড় কথা প্রচন্ড হতাশা আর একাকিত্বের মাঝে রেখে অন্য কারো সাথে সুখে সংসার করতে পারবো না আমি যে তাদের মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছি ।
Kobitor কবিতর