মায়াবতী
পর্ব:৪৮
তানিশা সুলতানা
প্রিয় মানুষের থেকে পাওয়া কিছুক্ষণ সময় জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি। আজকে অথৈ পেয়েছে সেই সময়। নতুন করে চিনেছে সাগরকে। মানুষটার কেয়ার দেখেছে। হাসি দেখেছে। খুব কাছ থেকে অনুভব করেছে তাকে। এতো এতো চকলেট কিনে দিয়েছে সাগর তাকে। দুজন এক সাথে অনেক অনেক ছবি তুলেছে। ফুসকা খাইয়েছে অথৈকে। আর সর্বশেষ অথৈকে বাড়ির সামনে রেখে গেছে। অথৈ ভীষণ খুশি। এরকম জন্মদিন যেনো বারবার ফিরে আসে।
সে সাগরের সাথে বারবার জন্মদিন পালন করতে চায়। সাগরের সাথে ঘুরতে চায়।
সাগর তার অনেক সাধনার ফসল। অনেক ধৈর্য্যের বিনিময়ে পেয়েছে তাকে। শখের পুরুষ তার। এই শখের পুরুষটাকে জীবন দিয়ে আগলে রাখবে অথৈ।
_
তন্নি ইদানীং তার মধ্যে অদ্ভুত এক লক্ষণ অনুভব করছে। মাথার মাঝখানে তার একটু একটু ব্যাথা করে। খুব বেশি না। সহ্য করার মতো। সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। মুখে রুচি চলে গেছে। খেতেই ইচ্ছে করে না। একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠে। বা একটু হাঁটলেই অস্থির লাগে। আগে তো এমন ছিলো না। একা হাতে কতো কাজ করেছে তন্নি। সারাদিন না খেয়ে থেকেছে তখন তো এরকম হয় নি। তাহলে ইদানীং এমন কেনো হচ্ছে?
সন্ধার আজান দিয়েছে। কিন্তু তন্নির উঠে বসতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাবা আসতে আর খুব বেশি দিন নেই। ইতি বেগম বাড়ি ঘর গোছাচ্ছেন।
তাদের দুঃখের দিন শেষ। তারেক যে অফিসে কাজ করতো সেই অফিসে বাংলাদেশের বড় একটা কোম্পানির বস গিয়েছিলো তন্নির বাবার অফিসে। সেখানে তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছে সে। এবং তারেকে বাংলাদেশের এটা জানতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছিলো আর তাকে বাংলাদেশে তার কোম্পানিতে কাজ করার অফার দেয়। ছেলেমেয়ে ছাড়া থাকতে তারেকের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। তাই এরকম অফার পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে যায়।
তন্নিকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ইতি বিরক্ত হয়। ইদানীং কাজ চোর হয়ে যাচ্ছে সে। বাবা বাড়ি আসার কথা শুনেছে আর সাপের পাচ পা দেখে নিয়েছে।
সারাদিন কাজ করতে করতে অস্থির ইতি। ভীষণ রেগেও আছে সে। তারওপর তার ভাই তাকে কল করে বলেছে৷ তারেক বাড়ি ফিরল সমস্ত কিছু তন্নির নামে লিখে দিবে। তামিমকে কিছুই দেবেনা।
তন্নিকে খুন করতে ইচ্ছে করছে তার। এই তন্নির জন্য তার ছেলেটা বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। মায়ের সাথে মরে গেলে শান্তিতে থাকতে পারতো ইতি বেগম। কিন্তু মরলো না। ইতি বেগমের সংসারটা নষ্ট করার জন্য এই মেয়ে বেঁচে আছে। এটাই ধারণা দিয়েছে তার ভাই তাকে।
ইতি বেগমের হাতে ঝাড়ু ছিলো। সে ঝাড়ু দিয়ে বারি দেয় তন্নির পিঠে। তন্নি ব্যাথা পেয়ে লাফিয়ে বসে পড়ে। আরও একটা বারি দেয় তন্নির বা পাশের হাতে।
তন্নির চোখে পানি চলে আসে।
তৃতীয় বারি দেওয়ার আগে তন্নি ঝাড়ু ধরে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে
“মা মা*রছো কেনো আমায়?
ইতির রাগ বেড়ে যায়। সে তন্নির চুল মুঠি করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” তোর বাপ বাড়ি আসছে আর সাপের পাচ পা দেখে নিয়েছিস? কাজ করতে ভুলে গেছিস তাই না? তোকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো আমি?
তন্নি মাথায় ব্যাথা পাচ্ছে। মায়ের হাত থেকে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে।
“মা ছাড়ো প্লিজ। আমি সব কাজ করে দিচ্ছি।
ইতি চুল ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে একটা চ*র বসিয়ে দেয় তন্নির গালে। ব্যাথায় গাল দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে৷
” তুই মরলে বাঁচি আমি।
তন্নির দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে চলে যায়। তন্নি চোখের পানি মুছে নেয়। আবারও চোখ পানিতে টলমল করে ওঠে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
জীবনটা এতো কঠিন কেনো? মানুষের ভালোবাসার এতো দাম?
এই মায়ের জন্য তন্নি জীবনও দিতে পারবে কিন্তু মা? একটু ভালো করে বললেই তন্নি সব কাজ করে দিতো।
তন্নিকে এতোটাই অপছন্দ করে। মরে গেলে বোধহয় একটু শান্তি পেতো।
চোখ মুছে তন্নি রান্নাঘরে যায়। রাতের রান্না হয় নি এখনো।
অর্ণব বাসায় ফিরে অনেক বার কল করে তন্নিকে। কিন্তু কোনো রেসপন্স পায় না। ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় অর্ণব। মেয়েটা তো কল ধরতে এতো দেরি করে না। তাহলে আজকে কি হলো তার? কোথায় গেলো?
আশা বেগম অর্ণবের জন্য খাবার নিয়ে অর্ণবের রুমে আসে। আজকে তার মন ভালো। ছেলেকে সে খাইয়ে দেবে। কতোদিন খাইয়ে দেওয়া হয় না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। তার লম্বা চওড়া সুদর্শন ছেলেটা ইদানীং মিইয়ে যাচ্ছে। তার গোলগাল ফর্সা মুখখানা খানিকটা কালো হয়ে গেছে।
খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে কি অর্ণবের? তার আদরের বাচ্চার। কাল থেকে স্বামীকে বারণ করে দেবে ছেলেকে অফিসে নিতে। আল্লাহ অনেক দিয়েছে। তার একটা রাজপুত্র বসে বসে খেলে এতো ধনসম্পদ ফুরাবে।
আশা অর্ণবের পাশে গিয়ে বসে৷ অর্ণব মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আশা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
” আব্বা কাল থেকে তোকে আর অফিসে যেতে হবে না। আল্লাহ আমাদের অনেক দিয়েছে। তুমি তোর জীবনটা রাজার হালে পার করতে পারবি।
অর্ণব মায়ের হাতে চুমু খায়।
“মাম্মা আমার ছেলেমেয়ে? পাপা আমাদের জন্য এতোটা করেছে। আমারও তো উচিত আমার বেবিদের জন্যও কিছু করে রাখা।
আশা ছেলের কথায় মুগ্ধ হয়। কিন্তু মানতে কষ্ট হয়। তার আদরের রাজকুমার কষ্ট করবে?
অর্ণব উঠে বসে।
” খাইয়ে দাও জলদি। তোমার বউমাকে দেখতে যাবো।
আশা কিছু বলে না। চুপচাপ ভাত মেখে তুলে ধরে ছেলের মুখের সামনে।
রাত আটার দিকে অর্ণব তন্নির বাড়ির সামনে পৌঁছায়। অনেক দিন পরে আসলো এই দিকে। মনে হচ্ছে রাস্তাঘাট কেমন পাল্টে গেছে। সত্যিই পাল্টে গেছে। গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। রাস্তার কাজ চলছে। তাই অচেনা অচেনা লাগছে।
তামিমকে দেখতে পায় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের বাড়ির পাশেই দোকান। অর্ণব তামিমের কাছে যায়।
অর্ণবকে দেখেই তামিম বলে ওঠে
“আমার নাম তামিম।
শালাবাবু না।
অর্ণব হেসে ফেলে। কোলে তুলে নেয় তামিমকে।
” তুমি আমার শালাবাবু
“না না
আমি শালাবাবু হবো না।
আপি বলেছে শালা মানুষ বকা দিয়ে বলে।
” তোমার আপি বলদ। সে এসবের কিছু বোঝে না।
“আমার আপি ঠিক তুমি ভুল। আমাকে শালাবাবু ডাকলে আমি পুলিশকে বলে দিবো। এটাও বলবো তুমি আমায় কিডন্যাপ করতে চেয়েছো।
অর্ণব বড়বড় চোখ করে তাকায় তামিমের দিকে। এই পিচ্চি বলে কি?
এরই মধ্যে দরজার সামনে পৌঁছে যায়। তাই আর কথা বাড়ায় না অর্ণব। তামিমকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়।
ইতি বেগম বসে বসে শাক কাটছে৷ অর্ণব এক গাল হেসে বলে
” শাশুড়ী মা ভালো আছেন?
ইতি গম্ভীর চোখে তাকায় অর্ণবের দিকে। তারপর কাঠকাঠ গলায় বলে
“আমি কারো শাশুড়ী না। এই নামে ডাকবা না আমায়।
” ঠিক আছে। তারেক মিয়ার বউ ইতি বেগম আমার বউ কোথায়?
ইতি কটমট চোখে তাকায়। কেমন বেয়াদব এই ছেলে।
“বেয়াদব ছেলে।
” যেমন শাশুড়ী তেমনই তো জামাই হবে তাই না? ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মনে হয় চিনি বা মধু উৎপন্ন হতো না। তাই আমার শাশুড়ীর মুখে তার মা মধু দিতে পারে নি।
ইতি কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁড়ায়। অর্ণব এক দৌড়ে তন্নির রুমে চলে যায়।
চলবে
স্যাড এন্ডিং দিবো না এটা কনফার্ম থাকো।