মায়াবতী পর্ব ৫১
তানিশা সুলতানা
তন্নিকে এই সময় এই বাড়িতে দেখে আশা বেগম কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু তন্নির চোখে মুখ দেখে বলার সাহস হয় না। বরং এগিয়ে গিয়ে তন্নির গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে
“কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেনো? চোখে মুখের এমন অবস্থা কেনো?
তন্নি মাথা নিচু করে ফেলে। কিছু বলতে পারে না। আশা বেগম অর্ণব আর অথৈয়ের দিকে তাকায়। ওদেরও মুখ থমথমে।
” কি হয়েছে তোদের? মন খারাপ কেন সবার?
তন্নি বলে ওঠে
“আন্টি আমি কয়েকদিন আপনাদের সাথে থাকতে চাই। থাকতে দিবেন?
” হ্যাঁ থাকো। এতে পারমিশন নিতে হবে কেনো? কিন্তু তোমার বাবা মা বাড়িতে আসছে কাল?
অর্ণব সোফায় বসতে বসতে বলে
“কালকের টা কাল দেখা যাবে। ওর রেস্ট দরকার। অথৈ রুমে নিয়ে যা ওকে।
অথৈ মাথা নারিয়ে তন্নির হাত ধরে। তন্নি অর্ণবের দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে যায় অথৈয়ের দিকে। তন্নি যেতেই আশা বেগম অর্ণবের পাশে বসে। কাঁধে হাত রাখে অর্ণবের। অর্ণব মায়ের বুকে মাথা রাখে। দুই হাতে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
” মাম্মা আমি মায়াবতী অসুস্থ। ডাক্তার ধারণা করছে তার ক্যান্সার হয়েছে। গতকাল রিপোর্ট বের হবে। আমি কি করবো মাম্মা?
আশা বেগম চমকে ওঠে। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। এইটুকু মেয়ের মহামারী অসুখ।
“আব্বা কি বলছিস তুই?
অর্ণব মায়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলে
” মাম্মা দোয়া করো আমার মায়াবতীর যেনো কিছু না হয়। আমি বাঁচবো না ওকে ছাড়া। আজকে ওর মুখটা দেখেই আমার পৃথিবী থেমে যাচ্ছে। ওর কিছু হলে বাঁচাতে পারবে না আমাকে। আমাদের বাঁচাও মাম্মা। আমরা মরতে চাই না। কদিন হলো বলো দুনিয়াতে এসেছি?
আশা বেগমের চোখেও পানি চলে আসে। ছেলেকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই তার। কিছুই বলতে পারছে না সে। শুধু হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ছেলের মাথায়। এই মেয়েটার কিছু হলে তার ছেলে মেয়ে বাঁচবে না এটা সে আগেই বুঝে গেছে।
“আব্বা কাঁদিস না। তোর মায়াবতীর কিছুই হবে না। আল্লাহ আমাদের সহায় হবে।
__
তন্নি শুয়ে আছে। মাথায় চিনচিনে ব্যাথা করছে। এতোদিন সে ভয় পায় নি। ভেবেছে এমনিতেই শরীর খারাপ। কিন্তু এখন অর্ণব আর অথৈয়ের মুখ দেখে সে ভয় পাচ্ছে। মরে যাওয়ার ভয়টা তাকে জেঁকে ধরেছে। প্রতি সেকেন্ডে মনে হচ্ছে এই বুঝি নিশ্বাসটা বেরিয়ে যাবে। আজকে একটা জিনিস খেয়াল করলো তার হাত পায়ের রগ গুলো নীল হয়ে গেছে।
অথৈ জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তন্নির সাথে ভালো করে কথা বলছে না সে।
” অথৈ
অথৈ চমকে তাকায় তন্নির দিকে। চোখ দুটো তার ছলছলে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে দৌড়ে তন্নির কাছে আসে
“কিছু বলবি? খারাপ লাগছে?
তন্নি অথৈয়ের হাত ধরে
” কাঁদছিস কেনো? আমি ঠিক আছি তো। বিশ্বাস কর আমার খুব বেশি খারাপ লাগছে না। তুই প্লিজ কাঁদিস না।
ডাক্তার কি বলেছে আমি বাঁচবো না?
উনি মিথ্যে বলেছে। আমি বাঁচবো। আমার কিচ্ছু হবে না।
অথৈ তন্নিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে
“তোর যদি দুইটা কিডনি বাদ হয়ে যায়। আমি আমার কিডনি দিয়ে দিবো তোকে। তোর শরীরে যদি র*ক্ত না থাকে আমি আমার অর্ধেক র*ক্ত দিয়ে দিবো। আমি তোর কিচ্ছু হতে দিবো না। তোকে সুস্থ করে তুলবোই আমি। তোকে ছাড়া আমি বাঁ*চ*বো না তন্নি।
তন্নি অথৈয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তারও কান্না পাচ্ছে। তবুও ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখেছে। সে কাঁদলে অথৈ আরও ভেঙে পড়বে। তাকে শক্ত থাকতে হবে।
পরের দিন তারেক দেশে আসে। অর্ণব তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যায়। আসার সময় দুজন মিলে রিপোর্ট আনবে তন্নির। অর্ণব সবটা জানিয়েছে তারেককে। তারেক বিশ্বাসই করতে পারছে না। যাকে ভালো রাখার জন্য দেশ ছাড়লো সেই ভালো নেই?
হাসপাতালের রিসিপশনে বসে আছে দুজন। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
ডাক্তার রিপোর্ট চেক করছে। চেক করা শেষেই হাতে আসবে।
অর্ণব তাকায় এক পলক তারেকের দিকে। মুখটা তার শুকনো। কপালে চিন্তার ছাপ। অর্ণব ওনার কাঁধে হাত রাখে।
” বাবা কিছুই হবে না। ভরসা রাখুন প্লিজ।
তখনই ডাক্তারের চেম্বার থেকে ডাক আসে। আল্লাহ নাম নিয়ে ভেতরে ঢোকে দুজন। ডাক্তার রিজুয়ান দুই হাতে মাথা চেপে বসে আছে। তার সামনে রাখা কয়েকটা রিপোর্ট। সব গুলোই দেখা শেষ তার।
অর্ণব চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তার হাত পা কাঁপছে।
“ডাক্তার
ডাক্তার তাকায় অর্ণবের দিকে। তারেককে চোখের ইশারায় বসতে বলে। তারেকও বসে পড়ে।
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে থাকে
” তন্নির মাথায় দীর্ঘ বার আঘাত পেতে পেতে সেখানে কালো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। এবং সেটা পঁচতে শুরু করে দিয়েছে। সেখান থেকে ক্যান্সারের উৎপত্তি। সে এখনো চলতে পারছে এটা বড় ভাগ্যের জোরে।
স্তব্ধ হয়ে যায় অর্ণব। দুই কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। চোখ খুললেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
তারেক কাঁপছে। তার এইটুকুনি মেয়ের শরীরে এতোবড় রোগ বাসা বেঁধেছে? কি করবে সে?
সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে
“আমার শরীর থেকে যা যা লাগে সব নিয়ে আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দিন ডাক্তার। যত টাকা লাগে আমি দিবো।
রিজুয়ান তাচ্ছিল্য হাসে।
” আঘাত তো আর একা একা পায় নি? আর পেলেও ডাক্তার কেনো দেখান নি? এতো কেয়ারলেস বাবা আপনি? মেয়ে এতোদিন যাবত অসুস্থ সেটা খেয়ালই করেন নি? কেমন বাবা আপনি? মেয়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই?
তারেক মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে। কি জবাব দেবে সে?
অর্ণব বলে ওঠে
“আমরা ওকে বিদেশে নিয়ে যাবো?
” হাসপাতালে ভর্তি করুন। বিদেশে যেতে হলে বলবো আমরা।
__
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অর্ণব তারেককে কিছু না বলে চলে যায় উল্টো দিকে। গাড়ি রেখে দৌড়েই চলে যায় সে। তারেক ডাকতে গিয়ে পারে না।
অর্ণব নিধির বাড়ির সামনে এসে থামে। হাসপাতাল থেকে বেশি দূরে না বাড়িটা।
নিধি বাড়ির সামনের রাস্তায় কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলো।
অর্ণব নিধির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিধি চমকে ওঠে। এলোমেলো অর্ণবকে সে আগে কখনো দেখে নি। দুই চোখ ভর্তি পানি টলমল করছে অর্ণবের।
“তুমি এখানে?
অর্ণব নিধির পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। স্তব্ধ হয়ে যায় নিধি সহ আশেপাশের সবাই।
অর্ণব কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে
” আমার তন্নি কখনো কোনো পাপ করে নি। আমি করেছি। হয়ত তোমাকে ঠকিয়েছি আমি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও নিধি। আমার পাপের জন্য আমার তন্নি অসুস্থ। আমাকে ক্ষমা করো নিধি। আমার তন্নিকে বাঁচিয়ে দাও। তাকে কোনো অভিশাপ দিও না।
নিধির চোখে পানি চলে আসে। সে অর্ণবকে ধরে দাঁড় করায়। দুই হাতে চোখের পানি মুছে দেয়
“তুমিও কোনো পাপ করে নি অর্ণব। তোমার তন্নির কিচ্ছু হবে না।আমি অভিশাপ দেয় নি।
অর্ণব নিধির হাত কপালে ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে।
” আমার তন্নি ভালো নেই৷ কালকে তাকে হাসপাতালে এডমিন করাতে হবে। দোয়া করো আমার তন্নির জন্য। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না।
আশেপাশের সবার চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটা কতো লাকী। তার জন্য একটা ছেলে এইভাবে কান্না করে দোয়া চাইছে৷ তার তন্নি ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?
এতো ভালোবাসা কখনেই তন্নিকে যেতে দিবে না। অর্ণব তার ভালোবাসা দিয়েই ভালো করে তুলবে তার তন্নিকে।
“আমি দোয়া করবো অর্ণব। তাহাজ্জুদ পড়বো তন্নির জন্য। তোমার তন্নি তোমাকে একা করে কোথাও যাবে না। আমি কালকে দেখে আসবো তন্নিকে। তুমি কান্না করিও না। আল্লাহ এতোটা নিষ্ঠুর হবে না। ভরসা রাখো।
তন্নি বাবার কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তন্নিকে দেখতে চৌধুরী বাড়িতেই এসেছে তারেক। ইতিও এসে খবর পেয়ে। তারেক তাকে বলেছে তন্নির সমস্যার কথা। সেই থেকে ইতি অস্থির হয়ে আছে। ছোট বেলা থেকে কম আঘাত করে নি তন্নির মাথায়। একবার পর একটা আঘাত করেছে। এবং কড়া ভয় দেখিয়েছে যাতে বাবার কাছে না বলে। সেই আঘাতেই তন্নি আজকে ম*রার পথে। সবটার জন্য দায়ী ইতি বেগম। মা সে কখনোই হয়ে উঠতে পারে নি। চেষ্টাও করে নি। মানুষও হতে পারে নি তিনি।
মানুষ হলে কখনোই এভাবে আঘাত করতে পারতো না?
তন্নি বাবার বুক থেকে মাথা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে
” আমি আর কোনো কিছুতেই শান্তি পাই না বাবা। তোমার বুকের মধ্যেও শান্তি পাচ্ছি না। আমাকে একটু শান্তি এনে দাও না বাবা। আমি যে বড্ড ক্লান্ত।
অথৈ তন্নির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। তন্নির কথা শুনে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সে সহ্য করতে পারছে না। তেড়ে যায় ইতি বেগমের দিকে। আজকে তাকে জবাব দিতে হবে।
চলবে
আমি রোগ বা চিকিৎসা সম্পর্কে খুব ভালে জানি না। ভুল হলে বলে দিবেন। বা এই রোগের চিকিৎসা কি সেটা কেউ জানলে ইনবক্সে বলিয়েন প্লিজ।