#মেঘে ঢাকা আকাশ
পর্ব ১০
#আমিনুর রহমান
অবনির ফোন কেটে দিয়ে যে আমি মিলিকে ফোন দিব সেই সুযোগটা অবনি আমাকে দিচ্ছে না। ফোন কেটে দেওয়ার পরেও সে বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়েই অবনির ফোনটা ধরলাম আর রাগান্বিত কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললাম।
“তোমার সমস্যা কোথায়? বারবার কেটে দেওয়ার পরেও কেন এত ফোন দিচ্ছো? মানুষের সমস্যা থাকতে পারে না? আর আমি তো তোমাকে বলেছি আমি তোমার বাসায় যেতে পারব না। আমি তোমার মাকে সেদিন থেকেই অনেক ঘৃণা করি যেদিন যে আমার ওপর সে মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল। সে মৃত্যু পথযাত্রী বলে আমি তাঁর কাছে যাব সে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিব এতটা ভাল মানুষ না আমি। আমি এখনো ওইদিনটির কথা ভুলিনি। যেদিন তুমি আর তোমার মা আমাকে অপমান করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলে। তুমি আমাকে অন্তত এই রিকুয়েষ্টটা করো না,করলেও আমি রাখব না। সত্যি বলছি আমি তোমার মাকে মন থেকেই ঘৃণা করি। সে বেঁচে থাকতেও তাকে ঘৃণা করব,মরে গেলেও করব। তাঁর প্রতি আমার ঘৃণাটা বিন্দুমাত্র কমবে না। কখনো না,কোনদিন না।”
আমার কথাগুলো যে অবনির ভিতরটাকে আঘাত করল,ক্ষতবিক্ষত করল সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সেজন্যই হয়তো অবনি বিষন্ন কণ্ঠে আমাকে বলল।
“স্যার,মানুষ তো ভুল করলে স্বয়ং আল্লাহও তাকে ক্ষমা করে দেন সে যদি মন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। আপনাকে যে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল তাঁর শাস্তি হিসেবে সে এমন একটা রোগে আক্রান্ত হয়েছে যে বেঁচে থাকতেও নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। তাঁর কাছে কেউ যেতে চায় না,তাকে সবাই দূর থেকে দেখেই চলে যায়। আল্লাহ তাকে তাঁর পাপের শাস্তি দিয়েছে। সে মরার আগে একটাবার আপনার সাথে দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায়। আপনার দু’হাত ধরে ক্ষমা চাইতে চায়। আপনি কি তাকে সেই সুযোগটা দিবেন না? আপনি তো এতটা নিষ্ঠুর কখনো ছিলেন না। আমার মায়ের বেলায় কেন তাহলে এমন করছেন? একবার ভিতরটাকে প্রশ্ন করুন আপনি কি কাজটা ঠিক করছেন?”
অবনির কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হলো। রাগে গরগর করতে করতে আমি বললাম।
“তুমি হয়তো এটাও জানো না পৃথিবীতে সব ভুলের ক্ষমা হয় না। তোমার মায়ের খালাতো ভাইয়ের মান মর্যাদা অনেক ওপরে,তাঁর পরিবারের সমাজে অনেক কদর আছে। এলাকার সবাই তাদেরকে অনেক সম্মান করে,কেউ তাদের সম্পর্কে কখনো খারাপ বলতে পারেনি। তাই তোমার মা চায়নি তাঁর কারণে পুরো পরিবারটা সবার কাছে হাসির পাত্র হোক। তোমার মা নিজের মানসম্মান নিয়ে কখনো ভাবেনি,কারণ তোমাদের তেমন কেউ ছিলোই না,যারা তোমার মায়ের এমন কাজে অপমানবোধ করবে। তোমার মা তাঁর আপনজনদের সম্মান নিয়ে ভাবল,তাদের পরিবার নিয়ে ভাবল। কিন্তু সে একটাবারও ভাবেনি,আমারও মানসম্মান আছে,আমারও পরিবার আছে,তারাও অপমানিত হতে পারে। তাঁর আপনজনদের অপমান যাতে না হয় সেজন্যই তোমার মা এমনটা করেছে আমি অনেকটা পরে হলেও বুঝতে পেরেছি। অন্য কারো সাথে কুকর্ম করার পর সেটা আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। এটাকে তুমি ক্ষমা করতে বল? এটা ক্ষমা করার মতো কোন কাজ না। দুনিয়ার আর সবাই পারলেও আমি পারব না।”
আমার এমন কথা শুনে অবনি কেঁদে দিল,কাঁদতে কাঁদতে বলল।
“স্যার পৃথিবীর কোন মেয়ে কি নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কিছু শুনতে পছন্দ করবে? তাঁর ভালো লাগবে? আমি তো এসব জানি। তাহলে কেন শুধু শুধু আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন আমার মা একজন খারাপ মানুষ। অন্য একজন ছেলের সাথে পরকীয়াতে লিপ্ত ছিল। হাজার খারাপ হলেও তো সে আমার মা। আমি তাঁর খারাপটা শুনতে পারি না। মরার আগে তাঁর একটাই ইচ্ছে আপনার সাথে কথা বলবে সে। মেয়ে হিসেবে তো একজন মায়ের জন্য এটা করতেই পারি,না? হোক না সে খারাপ,তবুও তো মা। আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি করতেন বলেন?”
অবনির এমন নীরব আত্মসমর্পণে খারাপ লাগল আমার। তবে আমি নরম হলাম না। আমি তাকে বললাম।
“আমার মা এমন কিছু করলে তাকে কোনদিন আমি মা বলে পরিচয় দিতাম না। তুমি হয়তো জানো না একটু আগে আমি আমার জন্মদাতা বাবার সাথে কতটা খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার মায়ের সাথেও কথা বলিনি। কারণ কি জানো? শুধুমাত্র তারা আমার খারাপ সময়ে আমার পাশে থাকেনি,আমাকে বিশ্বাস করেনি। যেখানে নিজের বাবা মায়ের সাথেই আমি আপোষে করলাম না সেখানে তোমার মায়ের সাথে কি করে আপোষে করবো? আমি মানুষটাই এমন। সবাইকে ভালোবাসতে চাই,সবার সাথে মিশতে চাই। কাউকে কখনো ঘৃণা করতে পারি না কিন্তু যদি একবার ঘৃণা করা শুরু করি কাউকে তাহলে শত চেষ্টা করেও তাকে আর ভালোবাসতে পারি না আমি। তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। জানি না এই ঘৃণাটা কতদিন থাকবে। হয়তো সারাজীবন কিংবা একবছর। যদি আল্লাহ চায় তাহলে তোমার মা মারা যাওয়ার আগেই তাঁর প্রতি আমার ঘৃণাটার সমাপ্তি হতে পারে। তবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই বলছি আমাকে আর ফোন করে অনুরোধ করো না। আমি তোমার অনুরোধ রাখতে পারব না।”
অবনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমাকে অনুরোধ করে কিন্তু আমি তাঁর অনুরোধ রাখি না। অপমান অবহেলা একজন মানুষকে কতটা নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে সেটা বোধহয় আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। সময়ের ব্যবধানে আমিও যে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছি সেটা আজ খুব করে বুঝতে পারলাম। আগে এমন ছিলাম না আমি,সত্যি বলছি এতটা পাষাণ কখনোই ছিলাম না আমি। কিন্তু আমার খুব কাছের মানুষগুলোই আমাকে এমন বানিয়েছে। সবার দুঃখে আমার ভিতরটা কেঁদে উঠতো। কিন্তু এখন আর কাঁদে না। এখন মনে হয় এগুলো সব অভিনয়, নিজের প্রয়োজনে সবাই সবার কাছে নত হয়। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো কাছে নত হয় না। অবনির মা যদি কঠিন অসুখে আক্রান্ত না হত তাহলে হয়তো সে আমার কাছে কখনোই ক্ষমা চাইতো না। আমার বাবা মা যদি সত্যিটা না জানতে পারতো তাহলে তারাও হয়তো আমাকে ফোন দিত না। তাই এসব মানুষের প্রতি আমার ভিতরটাতে আর কোন মানবতা কাজ করে না। অবনি প্রতিারের মতো এবারও হতাশ হয়ে ফোন রেখে দেয়।
আমি মিলিকে ফোন দিলাম কিন্তু তাঁর ফোন ওয়েটিং। অনেকবার ফোন দেওয়ার পর মিলি ফোন ধরল। ফোন ধরে তিরস্কারের সুরে বলল।
“আজ কি রবি পশ্চিম দিকে উঠেছিল নাকি? তুমি আমাকে নিজ থেকে ফোন দিলে? আমি আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে কথা বলছিলাম। তাই তোমার ফোনটা ধরতে পারিনি।”
আমিও তিরস্কৃত কণ্ঠেই মিলিকে বললাম।
“আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড না। কাজেই আমার কাছে তোমাকে এসব না বললেও চলবে। তোমার যার সাথে ইচ্ছে তাঁর সাথে কথা বলতে পারো। এটার জন্য আমাকে বলা মানে আমাকর অপমান করা। কারণ তুমি আমার থেকে অনেক কিছু লুকাতেও পারে। জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধটা তুমি আমার কাছ থেকে হাইড করেছ।”
আমার কথা শুনে মিলি অনেকটা বিষ্ময় প্রকাশ করে বলল।
“কি বলতে চাচ্ছো তুমি সরাসরি বল। আমি তোমার কাছ থেকে কিছু লুকাইনি। আমি এখন আমার এক খালার সাথে কথা বলছিলাম। এটাই সত্য।”
আমি তখন মিলিকে বললাম।
“আমি এটার কথা বলিনি। আচ্ছা সত্য করে একটা কথা বলবে তুমি আমাকে?”
মিলি আমার প্রশ্নের জবাবে বলল।
“কি কথা বল।”
তখন আমি কোন সংকোচ না করে সরাসরি তাকে বললাম।
“তুমি কি কখনো সেক্স করেছো? প্রেমিক হিসেবে তোমার কি অশুদ্ধ ছেলে পছন্দ না? যারা তোমাকে মন থেকে ভালোবাসে তাদেরকে তুমি খুব ভালোবসে কোনদিন জড়িয়ে ধরেছো কি? ধর নাই,অথচ যারা তোমাকে মন থেকে ভালোবাসেনি,ভালোবেসেছে শুধু তোমার দেহকে তাদের কে তুমি নিজের সমস্ত কিছু সপে দিয়েছো। তাদের সাথে বিছনায় রাত কাটিয়েছো। অথচ যে মানুষটা তোমাকে মন থেকে ভালোবাসলো তাঁর ঠোঁটে কোনদিন ভালোবেসে একটিবারের জন্য অমৃতের স্বাদ নিতে দাওনি। অথচ অন্য কাউটে ঠিকই অমৃতের সাগরে নামিয়ে দিয়েছ তুমি। এগুলো কি সত্য না? এগুলো কি তুমি করো নাই? হাসান নামের কোন ছেলের সাথে কি তুমি নিজের বিছানা শেয়ার করো নাই? একসময় তোমার গর্ভে হাসানের অবৈধ সন্তানও বেড়ে উঠেছিল। তখন তুমি কি করলে? সেই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল। এসব কি তুমি করো নাই?”
আমার কথা শুনে মিলি একবারের নীরব হয়ে গেল। কোন কথায় সে বলছে না৷ সে হয়তো কখনো ভাবেনি তাঁর এই গোপনীয় জঘন্য কাজগুলো আমি একদিন জেনে যাব। প্রায় দুইমিনিট হয়ে যাওয়ার পরেও যখন সে কোন কথা বলল না তখন আমি বললাম।
“কি হল? খুব অবাক হলে তুমি? আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম যখন তোমার সম্পর্কে এমন কিছু শুনেছিলাম। আমি বিশ্বাস করেছিলাম না কিন্তু যখন তোমার খুব কাছে অন্য একজন ছেলেকে দেখলাম তখন আর বিশ্বাস না করে থাকতে পারিনি৷ বিশ্বাস কর তোমাকে হাসানের যতটা কাছে দেখেছি ওতটা কাছে আমিও মনে হয় কখনো যাইনি। এতটাই শ্রদ্ধা করতাম তোমাকে কিন্তু তুমি মনে হয় এসব শ্রদ্ধা থেকে নিজের সেক্সুয়াল সুখটাকেই বড় করে দেখেছিলে। কেন করলে আমার সাথে এমন মিথ্যা অভিনয়? শুধু মাত্র আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তাই তো? কিন্তু তুমি কি জানো এসব জানার পরে তোমার জন্য আমার মনে ভালোবাসা তো দূরের কথা তোমাকে ঘৃণা করতেও আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। আমার লজ্জা হয় আমি তোমার মত একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। আমি কিছু না করেও তোমার কাছ থেকে চরিত্রহীনের অপবাদ পেয়েছিলাম,তবুও আমি চুপ করেছিলাম কিন্তু তুমি এরকম একটা কাজ করার পর সেটা চাপিয়ে রেখে নিজেকে দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা মনে করতে। কিন্তু জানো কি সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। দেরিতে হলেও মানুষের সামনে আসে। হাসান খুব একটা ভালো ছেলে না। খোঁজখবর নিয়ে দেইখো তোমার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করার ভিডিওটা তাঁর কাছে আছে নাকি। প্লেবয় রা এরকম করে। হয়তো এখন জানতে পারবে না কিন্তু পরে ঠিকই জানতে পারবে। কিংবা কে জানে তোমার সুন্দর ভিডিওটা একদিন ভাইরাল হয়ে যাবে।
আমার কথা শুনে মিলি অপরপাশ থেকে খুব কাঁদতে থাকে কিন্তু ততক্ষণে আমি ফোনটা রেখে দিয়েছি কারণ আমার যা বলার ছিল আমি মিলিকে বলেছি। এখন নিজেকে কিছুটা হলেও হালকা মনে হচ্ছে।
পেছনে তাকাতেই দেখি স্পৃহা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এত রাতেও মেয়েটা জেগে আছে আমার বিশ্বাস হল না। তাহলে কি স্পৃহা আমার সব কথা শুনে ফেলেছে? মিলিকে হাসান সম্পর্কে যা বললাম সব কি স্পৃহা শুনে ফেলেছে? সেজন্যই এমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি অন্য কোন কারণে।
চলবে……………