#মেঘে ঢাকা আকাশ
পর্ব ৬
#আমিনুর রহমান
স্পৃহা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“কি হয়েছে বলুন তো? আর এভাবেই বা তাকিয়ে আছেন কেন?”
তার মানে মিলিকে বলা কথাগুলো স্পৃহা শুনতে পায়নি। তাই আমিও ওই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম।
“কিছু হয়নি তো। আপনার দিকে তাকানো যাবে না এরকম কোন রুলস আছে নাকি? থাকলে বলতে পারেন,আমি মেনে চলব।”
আমার এরকম টেরা কথা শুনে যে স্পৃহা খুব একটা খুশি হতে পারল না সেটা বুঝলাম আমি। সে কিছুটা মন খারাপ করে বলল।
“এমনিতেই আমার বয়ফ্রেন্ডের চিন্তায় মন সবসময় খারাপ থাকে। তার ওপর আবার আপনার এরকম কথা। আপনি একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। আমি না হয় ডিপ্রেশনে আছি তাই এমন ব্যবহার করি আপনার সাথে। কিন্তু আপনি কেন আমার সাথে এমন করেন?”
আমি স্পৃহার কথার প্রতি উত্তরে বললাম।
“আমি ভাই সবসময় ডিপ্রেশনে থাকি। আমি ডিপ্রেশন থেকে দূরে থাকতে চাইলেও ডিপ্রেশন আমাকে ছাড়ে না। আপনার পেছনে এমনিতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে আমার। আর সম্ভব না। আমরা দুজন দুজনের রাস্তায় চলে গেলেই বেটার হবে। কেউ কারো যেহেতু প্রয়োজনে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই,সো আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো৷ আমার জীবনটা আপনার মতো এতো সুখের না,এতো বিলাসিতার না। আমার অতীত শুনে হয়তো আপনার হাসি পেয়েছে,তবে আমি জানি আমার অতীত কতটা কষ্টের।”
তখন স্পৃহা বলল।
“প্রয়োজন নেই মানে? আমি একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে এই ব্যস্ত শহরে আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজব? ওর ফোন খোলা থাকলে তো কোন সমস্যাই হত না। আর আপনাকে তো আমি বলেছি,আপনি যেতে পারবেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার দেখা হচ্ছে। আর টাকার কথা বলছেন? সব টাকা দিয়ে দিবো আপনাকে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অনেক দামি দামি জিনিস ব্যাগের ভিতর নিয়ে এসেছি। এগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আপনি হিসাব করে রাখেন সব দিয়ে দিব আমি।”
আমি কিছু বললাম না,দেখতে দেখতে ২৪ ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো,বাট অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না। বাঁধ্য হয়ে আমাদেরকে একটা বাসা নিতে হবে। মেয়েটা কাবিন নামা সাথে করে নিয়ে এসেছিল। সে হয়তো জানতো এমন কিছু হবে,এটার দরকার হতে পারে। তাই ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিল। আর সেটার কারণেই ঢাকা শহরের বুকে একটা বাসা ভাড়া পেলাম দুজন। আমি যে শুধু স্পৃহার জন্য বাসাটা নিয়েছি তা না৷ এখানে আমারও লাভ আছে। আমার থাকার জন্য একটা জায়গা দরকার ছিলো,এর থেকে ভালো জায়গা হয়তো আমি পেতাম না। তাই এটাকেই বেছে নিয়েছি। কারণ বেঁচে থাকার জন্য একটা চাকরি দরকার,অন্তত আমার মতো মানুষদের। কারণ আমার আগেপিছে কেউ নাই। আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে যেতাম চাকরির খোঁজে। অনেক পরিচিত বন্ধুদের কাছে বলেও রেখেছি একটা চাকরির কথা। কিন্তু কেউ সেরকম কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আজকাল অন্য কারো জন্য কেউ শ্রম দিতে চায় না,কারো কাছে অনুরোধ করে নিজের মর্যাদা কমাতে চায় না। আমার পরিচিত একজন মানুষ আছে সে যদি তাঁর ওপরের জনের কাছে শুধু একটা সুপারিশ করে,রিকুয়েষ্ট করে আমার চাকরির জন্য তাহলে হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা সে করবে না,এতে নাকি তাঁর মান কমে যাবে।
বাসা নেওয়ার পর একমাস চলে গেলো। এই একমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। আপন মানুষগুলো পর হয়ে গিয়েছে,পর মানুষগুলো হয়তো কিছুটা হলেও আপন হয়েছে। সেদিন বাবাকে সাহস করে ফোন দিয়ে বললাম।
“কেমন আছ বাবা?”
বাবা আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। কেটে দেওয়ার আগে শুধু বলল।
“ফোন দিয়েছিস কেনো? আজ আমার মেয়ের বিয়ে। ভুলেও তুই ফোন দিস না। আমরা তোকে ভুলে গিয়েছি। তুইও আমাদেরকে ভুলে যা। এটাই তোর জন্য ভালো হবে।”
বাবা ফোন রেখে দেওয়ার পর নিজের অজান্তেই কেঁদে দেই আমি। এমন কান্না আর কতদিন করতে হবে জানা নেই। আজ আমার আদরের বোনটার বিয়ে অথচ আমি তাঁর সামনে নেই। সেও কি তাহলে তাঁর ভাইয়ের কথা ভুল গেছে? ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। খারাপ মানুষকে কেউ মনে রাখে না,মনে রাখলেও ঘৃণা করার জন্য মনে রাখে। আমাকে তো আর আমার বোন ঘৃণা করতে পারবে না৷ তাই হয়তো ভুলে গিয়েছে। বাবা তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গিয়েছে কিন্তু মা কি করে আমাকে ভুলে গেলো? কোন মা কি তাঁর সন্তানকে কখনো ভুলতে পারে? আমার মা কিভাবে পারল? এসব কথা মনে হতেই কান্নাটা আরও বেড়ে যায়। আজ আমার কান্না করার দিন,আজ আমার দুঃখের দিন,আজ আমার একা হয়ে যাওয়ার দিন। আমার কান্না থামানোর কেউ নেই,আমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার কেউ নাই।
স্পৃহা কি আমার চোখের পানি মুছে দিতে পারে না? এই একমাসে তো সে আমার অনেক কাছে এসেছে৷ আমাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে। আমি না আসলে আমার আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে যেত। তবে দিনশেষে তাঁর বয়ফ্রেন্ডের জন্য তাঁর মন খারাপ থাকত। তারপরেও তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটার অনেক উন্নতি হয়েছে। সত্যি বলতে আমার ভালো থাকার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন। হোক সেটা ভালোবাসার মানুৃষ কিংবা ভালো লাগার মানুষ। এই পৃথিবীতে একা একা ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকার জন্য কাউকে দরকার। কিন্তু আমার তো ভালো থাকার জন্য কেউ নেই। তাহলে আমি ভালো থাকব কিভাবে? এতকিছুর পরেও অন্য আট-দশটা মানুষের মত আমারও যে একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আবার মনে হয় এই পৃথিবীতে সব মানুষের ভালো থাকা হয় না। কিছু মানুষ অকারণেই খারাপ থাকে৷ আমি হয়তো সেই খারাপ থাকা মানুষগুলোর মাঝে একজন।
হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম আমার পেছনে স্পৃহা দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখের পানিটা মুছে তাঁর দিকে তাকাতেই সে একটা হাসি দিলো। মনে হলো এই হাসিটার জন্য আমার খারাপ থাকাটা চলে গেলেও খুব বেশি অবাক হব না। আমি তাঁর হাসিটা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। আমার মুগ্ধতার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাহলে সে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলিয়েছে? বয়ফ্রেন্ডকে না পেয়ে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যাকে বিয়ে করেছে তাকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে? এমন হলে খারাপ হয় না। আমার ভালো থাকার জন্য একজন মানুষ আমি পেয়ে গেছি। তাঁর জড়িয়ে ধরাতে কেমন যেন ভিতরটাতে “ভূমিকম্প” সৃষ্টি হলো। আমিও যখন তাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম ঠিক তখনই সে আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা পেছন দিকে সরে গেলো। তারপর বলল।
“জানেন আজ আমি অনেক খুশি। হয়তো পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটাও আমি। ওর সাথে কথা হয়েছে আমার। একসপ্তাহ পরেই আমাদের দেখা হচ্ছে। ওর ফোনটা হারিয়ে গিয়েছিল,যার কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা,মোবাইল সব ওর কাছ থেকে নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে যাওয়ার সময় ওকে আহত করেছিল। যার কারণে ও এতদিন হাসপাতালে ছিল। আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। আমি জানতাম আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার সাথে এমনটা করতে পারে না। ওর প্রতি আমার অনেক বিশ্বাস ছিল,আজ সেটা সত্য হয়েছে। আর কেউ না জানুক আমি তো জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে। একসপ্তাহ পর আপনি চলে যেতে পারবেন। তবে চলে যাওয়ার আগে ওর সাথে আপনাকে দেখা করাতে চাই। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। আপনার প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
স্পৃহার কথা শুনে খুব খারাপ লাগল। এই খারাপ লাগার কারণটা আমার কাছে জানা নেই। আমি অভিনয়ের হাসি হেসে বললাম।
“শুভকামনা আপনার জন্য। সবশেষে তাকে পেয়েই গেলেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক এটাই চাই।”
কথাগুলো বলেই আমি বারান্দায় চলে গেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মন খারাপের কথাটা আকাশকে বললাম কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। এমন সময় দেখলাম কে যেন ফোন দিয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ বলল।
“স্যার,আমি অবনি। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। সেদিন আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি সব সত্য জেনে গিয়েছি। মা যে এমন একটা মিথ্যা অপবাদ আপনাকে দিতে পারে আমি ভাবিনি। আপনি একবার আমাদের বাড়িতে আসুন। মায়ের কঠিন একটা অসুখ বেঁধেছে। হয়তো এটা তাঁরই পাপের শাস্তি। মরার আগে সে একটাবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চায়।”
আমার অবনিকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বললাম।
“এখন এসব বলে কি লাভ? এসব বললেই তো আর সবার কাছে আমি আগের মত হব না। আমার নিজের,আমার পরিবারের যে অসম্মানটা হয়েছে সেটা তো আর ফিরে পাব না। সবাই আমাকে তো খারাপ ছেলে হিসেবেই জানে। এখন তো আমার নির্দোষ হওয়ার ইচ্ছা নেই। যদি সম্ভব হয় আমার বাবা মাকে সত্যটা জানিও। পৃথিবীর সবাই আমাকে খারাপ ভাবুক আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু অন্তত দুইটা মানুষ জানুক আমি এমন কাজ করি না,এমন কাজ করতে পারি না।”
কথাগুলো বলে ফোনটা রেখে দেই। কারণ এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এমনকি নিজেরই নিজেকে বড্ড বিরক্ত লাগছে।
চলবে…………
পর্ব ৭- ১৬