মৃত জীবন
———
আবিরকে আমি ভিডিওতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। আমার চোখে মুখে প্রেম খেলা করে যাচ্ছিলো। সে প্রেমে কোন উত্তাপ ছিল না, উচ্ছ্বাস ছিল না। ঠিক যেন শেষ বিকালের আবির রাঙা প্রেম। খুব ইচ্ছা করছিল, ওকে ছুঁয়ে থাকি। কি হয় ছুঁয়ে থাকলে? কিন্তু মনকে বোঝাচ্ছিলাম, ওকে ছুঁয়ে থাকার অধিকার আমি হারিয়েছি।
আবিরকে আমি ছেড়ে এসেছি এক বছর আগে। শুধু আবিরকে নয়। আমার ছেলে আনানকেও ছেড়ে এসেছি। আনানের বয়স তখন ছয় বছর। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। একঘেয়েমি জীবন আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছিলো। বিয়ের পর থেকেই সংসারের সব দায় দায়িত্ব আমার ছিল। আবির সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল তার ক্যারিয়ার নিয়ে। আমাদের কে ছেড়ে ছুড়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর পড়া পড়তো। পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে ব্যস্ত ছিল প্রাকটিস নিয়ে। আমাদেরকে সময় দেওয়ার সময় কোথায় ? একবারও ভাবতো না, ডাক্তারী পাশ করে আমি সম্পূর্ণ বেকার হয়ে বাসায় বসে আছি। না বি সি এস করার জন্য একটু পড়ার সুযোগ পাই, না কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মত সুযোগ আছে। ছেলেকে কে দেখবে ? সংসার কে দেখবে ? আমার মা বাবা বেঁচে ছিলেন না। তাই আমাকে সাপোর্ট করারও কেউ ছিল না। তেমন ভালো কাজের লোকও পাইনি, যার উপর চোখ বন্ধ করে বাচ্চাকে ফেলে রাখা যায়। ক্যারিয়ার নিয়েও এত বেশি হতাশা ছিল না। বেশি হতাশা ছিল, আবির আমাকে সময় দেয় না, তাই। আমার বাবাকে দেখেছি, কতটা রোমান্টিক ছিল। সব বিবাহ বার্ষিকীতে আম্মুর জন্য ফুল নিয়ে আসতো, গিফট নিয়ে আসতো। অথচ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী কবে, আবিরের মনেও থাকে না। বাচ্চা হওয়ার পরে ওর ভিতরে কোনদিন বাচ্চা নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস দেখিনি। আমার বাবা আমার জন্য কত কিছু করতো। গল্প নাটকেও তো দেখেছি, বাবারা বাচ্চার ব্যাপারে কত কেয়ারিং হয়। অথচ আবিরকে দেখে মনে হয়, বাচ্চার ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথাই নেই। বাচ্চাকে কখনোই পাঁচ মিনিট সময় দেয় না।
আমার খুব মন খারাপ থাকতো সব সময়। ওকে বলতাম, ” আমাদেরকে একটু সময় দাও। ” ও বিরক্ত হয়ে বলতো, ” আমার সময় কোথায়? ” সংসার জীবনটা অর্থহীন লাগতো। নিরানন্দ জীবনটাকে বোঝা মনে হতো। সাইকিয়াট্রিস্টও দেখিয়েছি অনেকবার। কোন লাভ হয়নি। বরং আমার ভিতরে সুইসাইডাল টেন্ডেসি এসেছিল।
সে বার আমাদের বাসায় আমার শ্বশুর শাশুড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। প্রতিবারই ওনারা আসলে আবিরের সাথে আমার একটু ঝগড়া হতো। আমি যতই মন প্রাণ দিয়ে তাদের সেবা যত্ন করার চেষ্টা করি না কেন, আবিরের মনে হতো, ঠিক তার মন মতো সেবা যত্ন হচ্ছে না। আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও আবিরের মন পাওয়া যেত না। আবির আমাকে দিয়ে বাবা মায়ের সেবা করিয়ে বেহেস্ত হাসিল করতে চাইতো। এই নিয়েই মাঝে মাঝেই আমার সাথে বেঁধে যেত। সে বার মুখ ফুটে বলেছিলাম, ” আমি যতই করি, তোমার মন ওঠে না। এতই যদি বেহেস্ত পেতে চাও, তাহলে বাবা মায়ের সেবা যত্ন নিজে করো। ” আবির ভীষণ ক্ষেপে যেয়ে আমাকে একটা চড় মেরেছিল।
আমি ঐ মুহুর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই জীবন আর রাখবো না। রেল স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্লাটফর্ম টা একটু নিরিবিলি হলেই কোন ট্রেন দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বো। হঠাৎ আমার পাশে এসে এক মহিলা বসলেন। বললেন,
– আমি আগের ট্রেনটা পাঁচ মিনিটের জন্য মিস করেছি। অনেকক্ষণ থেকেই তোমাকে ফলো করছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি খুব বিপদের মধ্যে আছো। সমস্যাটা কি আমার সাথে বলা যায়?
– আমার কোন সমস্যা নেই।
– দেখো, আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম। মানুষের মন কিছুটা বুঝতে পারি। তুমি নিঃসংকোচে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। অনেক সময় দুঃখ কষ্ট গুলো শেয়ার করলে মনটা হালকা হয়। তখন ঠান্ডা মাথায় সব কাজ করা যায়।
মহিলাটার ভিতরে কেমন জানি একটা সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। খুব আপন আপন একটা ভাব ছিল। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে, এত আপন করে কেউ আমার সাথে কথা বলেনি। আমি একে একে আমার সব দুঃখ কষ্টগুলো তার সাথে শেয়ার করলাম। এমনকি আজ আত্মহত্যা করতে এসেছি, সেটাও বললাম। তিনি বললেন,
এক সময় আমিও তোমার মত ভুল করেছিলাম। আমার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে, আমি আমার স্বামীকে খুব মিস করতাম, এখন ও করি।
– আমি তো মারাই যাবো। মিস করার সুযোগ নেই।
– তুমি চলে গেলে তোমার বাচ্চার কি হবে?
আমি জেদের সাথে বললাম,
– সে আমি জানি না। আমি এ জীবন আর রাখবো না।
তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– আচ্ছা এক কাজ করা যাক। ধরে নাও, তোমার এ জীবনের মৃত্যু হয়েছে। ধরে নাও, এই মুহূর্ত থেকে তোমার নতুন এক জীবন শুরু হলো। তুমি বলেছিলে, তুমি ডাক্তার। আমার নিজস্ব একটা এনজিও আছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করি। কাউকে বাসস্থান দিয়ে, কাউকে খাওয়া দিয়ে, কাউকে চাকরি দিয়ে বিপদগ্রস্ত মেয়েদের সাহায্য করে আমার এনজিও। আমার প্রতিষ্ঠানে একজন ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। তুমি ইচ্ছা করলে সেখানে চাকরি নিতে পারো। আমি বাড়িতে একাই থাকি, ইচ্ছা করলেই আমার সাথে থাকতে পারবে।
আমার কি হলো জানি না। তার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। সে তার সাথে আমার টিকিট ও কাটলো। আমি চলে এলাম তার সাথে সিলেটে। প্রথম প্রথম আনানের জন্য ভীষণ কষ্ট হতো। আস্তে আস্তে এনজিও এর কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা শুরু করলাম। নীলা আপু জোর করলেও বেতন নিতাম না। সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের সেবা করে এক ধরনের তৃপ্তি পেতাম। ওরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। নীলা আপু ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।
আজ বিকালে আমি আর নীলা আপু চা খাচ্ছিলাম। নীলা আপু বললেন,
– দেখো মৌ, কি সুন্দর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মা হীন একটা বাচ্চাকে এই ভদ্রলোক কি সুন্দর করে মানুষ করছেন।
উনি ওনার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। হঠাৎ মোবাইলে আবির আর আনানকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। ভিডিও তে দেখি –
আবির সকাল বেলা চুমু খেয়ে আনানের ঘুম ভাঙাচ্ছে। ছেলেকে ব্রাশ করিয়ে নাস্তা খাওয়াচ্ছে। যত্ন করে স্কুল ব্যাগটা গোছাচ্ছে, টিফিন ভরে দিচ্ছে। এর পর ছেলেকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ছেলেকে গোসল করিয়ে খাওয়া দাওয়া করালো। ঘুম পাড়ালো। বিকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলে কে গুছিয়ে নিয়ে গেল চেম্বারে। চেম্বারের সাথেই খেলনা দিয়ে সাজানো একটা কাঁচের ঘর। আনান সেখানে বসে পড়ছে। আবির মাঝে মাঝেই এসে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবার যেয়ে রোগী দেখছে। চেম্বার শেষ করে বাসায় এসে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। বিছানায় যেয়ে আবির সাইড টেবিলে রাখা আমার ছবিটা নিয়ে নিজে একটা চুমু খেলো তারপর আনানের হাতে দিলো। আনান ছবিটা নিয়ে একটা চুমু খেলো তারপর ছবিটা বুকে জড়িয়ে রেখে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
আমি কাঁদছি। আমি হাওমাও করে কাঁদছি। নীলা আপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন। মানুষ এতটা বদলায় ? কিভাবে? আমার মৃত জীবনে হঠাৎ করে প্রানের সঞ্চার হলো। আমার খুব ইচ্ছা করছে, আমার স্বর্গে ফিরে যাই। ঐ স্বর্গে আমার কি একটু জায়গা হবে ?