বিয়ের আট মাস পর আমরা হানিমুনে যাচ্ছি, জানি বিষয়টা হাস্যকর। আমাদের বিয়েটা হয়েছিল বেশ অনাড়ম্বর ভাবে। দুজনেই যেহেতু চাকরি করি তাই আর সেভাবে সময় করা হয়নি। অনেকদিন পর দুজনের ছুটি ম্যানেজ করা গেছে একসাথে। আমি খুব খুশি মনে নিজের লাগেজ গুছিয়েছি সাথে আসিফেরটাও। আসিফ আমার স্বামী, আমি খুব ভালোভাবে জানি ও খুবই অগোছালো, এটা নেবে তো সেটা নেবেনা তাই নিজেই ওর দায়িত্বটা নিয়ে নিয়েছি। এতদিন পর সময় করতে পেরে আসিফ নিজেও খুশি। তা ছাড়া প্রতিদিন একই রকম জীবন যাপন করতে করতে আমরা ভীষণ রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, একটা ছুটির ভীষণ দরকার। এটাকে হানিমুন না বলে একান্তে ছুটি কাটানোও বলা যেতে পারে।
আমি একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করি আর আসিফ একজন ডাক্তার। দুজনই ব্যস্ত থাকি তারপরেও আমার চেয়ে আসিফের ব্যস্ততা টা আরো একটু বেশি তাই নিজেই সবকিছু ব্যবস্থা করলাম। দুজনের কর্মক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন তাই সময় মেলানো ভীষণ মুশকিল, যাক অবশেষে হলো।
আমরা ঘুরতে যাচ্ছি মালদ্বীপে এর আগে ইন্ডিয়া ছাড়া আমি কোথাও যাইনি। আমি হালকা সাজগোজ করে নিচ্ছি । একটু পরেই আমার পাশের রুম থেকে কোকানোর শব্দ পেলাম, যেন কেউ ব্যথায় ছটফট করছে। আসিফ দৌড়ে গেল আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। গিয়ে দেখি আমার একমাত্র ননদ মিতু পেট চেপে ধরে শুয়ে আছে আর গোঙাচ্ছে ইতোমধ্যে আমার শাশুড়িও চলে এসেছে। মিতু ব্যথায় কুকরে আছে, কথাই বলতে পারছে না। আসিফ দ্রুত এম্বুলেন্স কল করলো এবং হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়া হলো যেহেতু আসিফ একজন ডক্টর তাই খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি আমাদেরকে করতে হলো না। সকালের মধ্যেই আমরা সমস্ত কাগজপত্র হাতে পেয়ে গেলাম। আসিফ নিজেই দেখে বললো রিপোর্ট সব ঠিক আছে, মিতু একদম সুস্থ।
-ভাইয়া আমি যেহেতু সুস্থ আছি তাহলে আমাকে বাড়ি নিয়ে যা
-আচ্ছা ঠিক আছে আমি কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিচ্ছি
আমরা বাসায় চলে আসলাম।
-নাফিসা আমি খুব দুঃখিত, দেখো এতদিন পর সময় ম্যানেজ করলাম অথচ কি হতে কি হয়ে গেল এখন আবার টিকেট ম্যানেজ করা, হাবিজাবি অনেক যন্ত্রণা করতে হবে
আমি একটু হেসে মাথা নাড়লাম।
– তুমি কিছু চিন্তা করো না, আজ যেহেতু তোমার ছুটি চলো বাড়িতে রান্নাবান্না করি সবাই মিলে একটা পিকনিক পিকনিক ভাব হবে।
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, আমি পোশাক বদলাতে এলাম।
-কি ব্যাপার নাফিসা কোথাও যাচ্ছ নাকি? আসিফ বলে উঠলো
-শুধু আমি না তুমিও যাচ্ছ রেডি হও
-কিন্তু কোথায়?
-যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানেই
-এত তাড়াতাড়ি তুমি কিভাবে সবকিছু ম্যানেজ করলে!
-করেছি, আমি মৃদু হেসে বললাম।
আমি আর আসিফ যখন ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি শাশুড়ি আর ননদ কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো,
– তোমরা আজ যাচ্ছো! তোমাদের তো গতকাল যাওয়ার কথা ছিল?
-মিতু তো এখন সুস্থ মা , যেতে সমস্যা কোথায়? তোমরা ভালো থেকো আর ফোন করো । আসিফ উত্তর দিয়ে দিলো, আমরা বের হয়ে গেলাম।
কিছুদিন পর আমার জন্মদিনে এলো। সাধারণত আমি জন্মদিন পালন করি না কিন্তু বিয়ের পরে এটাই আমার প্রথম জন্মদিন। আসিফের খুব ইচ্ছা সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করি মানে ওর পরিবার আর আমার পরিবার আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সকালে উঠে রান্না বান্নার আয়োজন শুরু করলাম ভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল শুক্রবার। হঠাৎ আমার শাশুড়ির ফোনে একটা ফোন এলো।
-শোনো বৌমা, তোমার রাহেলা খালা ফোন করেছিল। আমাকে একটু ওর বাড়িতে যেতে হবে। ওর মেয়ে রিয়া আছে না, ওকে দেখতে আসবে, সাথে মিতুকে ও নিয়ে মেতে বলেছে। মন খারাপ করো না, তোমার জন্মদিন তো পরের বছরও করা যাবে তাই না? তোমার বাসায় একটু ফোন করে বলে দাও
আমি হাসি মুখে মাথা নাড়লাম,
-মা, আমিও যাই আপনার সাথে?
-না না বৌমা , তুমি বৌ মানুষ, দাওয়াত ছাড়া যাবে কেন?
মা আর মিতু ফিরে এলো সাতটার পরে, আসিফ আনতে গিয়েছিল। অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে থাকলো।
-কি ব্যাপার বৌমা এসব কি?
– মা, আমি আর আমার দুই বোন মিলে বাড়িঘর সাজিয়ে ফেলেছি।
আসিফ হাসিমুখে বললো,
– আরে নাফিসা তুমি না দুপুরে আয়োজন করেছিলে?
-মা ছাড়া তো আর জন্মদিন পালন হবে না তাই ভাবলাম রাতেই সেরে নেই। কেন যেন মায়ের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
সময়ের চাকা গড়ালো, একসময় আমি জানতে পারলাম আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসছে, সবাই ভীষণ খুশি হলো। তখন আমার ছয় মাস চলছে।
এক রাতে শুয়ে শুয়ে আসিফ আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে, আসিফ খুব ভালো একজন স্বামী তবে মানুষটা বেশ বোকা ।
-নাফিসা চলো তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে রেখে আসি
-কেন বলতো? আমি একটু হেসে বললাম
-ওখানে গেলে তোমার যত্ন বেশি হবে তাই।
-আমি কখন বললাম এখানে কেউ আমার যত্ন করছে না?
-আসলে আমি অতো শুধু ভেবে বলিনি
-মা তোমাকে বলতে বলেছেন তাই না? আমি মুখ টিপে হেসে বললাম
-তুমি কেমন করে বুঝে যাও বলোতো? আসিফ যেন ম্যাজিক আবিষ্কার করে ফেলেছে
-আচ্ছা আসিফ বলোতো যত্নের জন্য আমাকে কেন আমার বাবার বাড়িতে যেতে হবে? এখানে তোমার মা আছে, বোন আছে তারা কেন আমার যত্ন ঠিকমতো করতে পারবেনা বলে তুমি ধারণা করছো?
-দেখো নিজের মা যেভাবে দেখে আমার মা কি সেভাবে পারবে? আর তাছাড়া হয়তো তোমার অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করবে , অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করবে যেটা তুমি আমার মাকে বলতে পারবে না কিন্তু তোমার মাকে অনায়াসে বলতে পারবে।
-বিষয়টা আরেকটু অন্যভাবে দেখি আমরা, কেন এতদিন পরেও উনি আমার মা হয়ে উঠতে পারেননি বলোতো, কেন আমি ওনার কাছে সহজ ভাবে বলতে পারবো না বলোতো, কেন সব মেয়ে গর্ভবতী অবস্থায় নিজের মায়ের কাছে চলে যায় বলোতো?
-এটাই তো হয়ে আসছে
-হয়ে আসছে বলেই কি এই নিয়ম আমাদেরকে সারাজীবন মেনে নিতে হবে? আর তাছাড়া চিন্তা করো তো তুমি নিজেই একজন ডাক্তার। আমার যদি কোন ইমারজেন্সি হয় তখন কি বিষয়টা এখানে থেকেই সমাধান করা খুব বেশি সহজ হবে না?
আসিফ এবার একটু ভাবলো,
– তুমি ঠিক বলেছো
-আসিফ, তুমি বড্ড বেশি সহজ সরল তাই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা তুমি দেখতে পাও না।
-মানে?
-মানে তোমার মনে আছে আমরা যেদিন মালদ্বীপ যাব ঠিক তার আগ মুহূর্তেই তোমার বোনের পেটে ব্যথা শুরু হলো কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়লো না আর আমি মুহূর্তেই পরের দিনের টিকিট ম্যানেজ করে ফেলেছিলাম, যেখানে সর্বক্ষণ আমি তোমাদের সাথেই ছিলাম, তোমার অবাক লাগে নি ? আসিফ আমি টিকিট করেছিলাম পরের দিনের, আমি জানতাম এরকম কিছু একটা হবেই হবে । মনে কিছু নিও না, আমার জন্মদিনের দিন তোমার খালাতো বোনকে কেউ দেখতে আসেনি, মা চাননি ঘটা করে আমার জন্মদিন পালন করা হোক তাই আমি নিজেই অনুষ্ঠান রাতের বেলা রেখেছিলাম, এই বাড়িতে বলেছিলাম যে অনুষ্ঠানটা দুপুরবেলায় এবং সত্যি সত্যিই আমি সাকসেসফুল হয়েছিলাম। তোমার চোখে কি এসব পড়ে না? এখন আমি গর্ভবতী বলে আমাকে আমার বাবার বাড়িতে চলে যেতে হবে কারণ সেখানে আমার যত্ন হবে এই হচ্ছে অজুহাত । আসল কথা হচ্ছে আমি তোমার সংসার যে শ্রম দেই এখন সেটা দিতে পারছিনা কাজেই আমি এখন একটা জড় বস্তু। শোনো আসিফ বিয়ের রাতে তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার মাকে যেন আমি নিজের মায়ের মতো করে দেখি আমি অনেক চেষ্টাও করেছি কিন্তু সত্যি বলতে কি সেটা কখনোই সম্ভব হয়নি। উনি যদি আমার এই গর্ভকালীন সময়ে যত্ন নিতে না পারেন তাহলে উনি আবার কেমন করে আমার নিজের মা হলেন, আমি তো তাকে শাশুড়ির চোখেই দেখবো, তাই না? তোমার কথা মতো কাল বাবার বাড়ি চলে যাব কিন্তু তুমি আর কখনোই আমাকে বলবে না তোমার পরিবারকে আমার পরিবার হিসেবে ট্রিট করতে। যারা আমাকে আপন ভাবে না আমি তাদেরকে আপন ভাবতে পারবো না। তোমার বোন নিজেও একদিন শ্বশুরবাড়িতে যাবে এবং সত্যি বলতে কি এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হয়তোবা তোমার বোনকে মোকাবেলা করতে হতে পারে । বলতে অসুবিধা নেই আমি বুদ্ধিমতি মেয়ে তাই আমার সাথে কখনো বাকযুদ্ধ হয়নি, কিন্তু তোমার বোন অতটাও বুদ্ধিমতি না । তুমি সব সময় বাড়িতে থাকো না, আমি বলছি না কেউ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে কিন্তু তার মানে এই না যে তারা আমাকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে মনে করে যেন আমি দূরের কেউ। তাহলে তোমার সংসার আমি কি করে নিজের সংসার বলে মেনে নেব? কেমন করে তোমার মা তোমার বোন আমার মা আমার বোন হবে? সবচেয়ে কঠিন সত্য কি জানো একজন নারীর দুঃখের উৎস হচ্ছে আরো এক বা একাধিক নারী। আমি যে তোমাকে ঘটনাগুলো বললাম তার মধ্যে একটাও কি তোমার মনের মধ্যে কোন প্রশ্ন তৈরি করেনি?
আসিফ চুপ করে থাকলো
-কেন করেনি জানো, কারণ তারা তোমার পরিবার। তুমি তাদেরকে অন্ধের মত বিশ্বাস করো কিন্তু যে মেয়েটা তার পুরো পৃথিবী ছেড়ে শুধুমাত্র তোমার কাছে এসেছে তার ঠিকঠাক যত্ন কি তুমি নিতে পেরেছ ? সে যে নিজের পরিবার ছেড়ে আসলো তুমি কি তাকে আরেকটা পরিবার দিতে পেরেছ? তুমি শুধু শিখেছো সরি বলতে, আমি ক্লান্ত আসিফ।
আসিফের কপালে সূক্ষ্ম একটা ভাঁজ পরলো । সে সারাক্ষণ বাইরেই থাকে সংসারের অত খুঁটিনাটি সে কখনোই খেয়াল করেনি।
সে নাফিসাকে পেয়ে খুশি । নাফিসা কখনো তাকে কোন অভিযোগ করেনি, তাকে কখনো চিরাচরিত বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্ব দেখতে হয়নি কিন্তু সে কোনদিন এটাও খেয়াল করেনি নাফিসা নিজে তার পরিবারে এসে খুশি কিনা? হয়তো যুগের পর যুগ ধরে এরকম অসংখ্য নাফিসারা মিথ্যে অভিনয় করে যাচ্ছে।