#ফাবিয়াহ্_মমো .
হারিকেনের আলোয় অন্ধকার কেটে গেছে। দেয়ালে-দেয়ালে হলুদ বর্ণের আলো। মাহতিম পিঠের ব্যথাটা ভুলে গিয়ে মেহনূরকে বাহুডোরে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক সামনের দেয়ালে দুটো মানবমূর্তির ছায়া পরলো, দুটো দেহের সাথে দুটো স্বচ্ছ হৃদয়ের আলিঙ্গন কালো ছায়ায় ভেসে উঠেছে। দৃশ্যটা হারিকেনের আলোয় আরো সুন্দর, আরো মোহময় দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ছোট্ট মুখটা জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। আশ্লেষে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় বললো,
– কাঁদার কিছু নেই, চুপ করো।
মাহতিমের পিঠটা খামচাতে গিয়ে হঠাৎ থামলো মেহনূর। ব্যান্ডেজটার কথা মনে পরতেই পিঠের বাঁদিকটা আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো। নির্যুত্তর মেহনূরের ভাবভঙ্গি দেখে তাকে ছেড়ে দিলো মাহতিম, বুকের কাছ থেকে মুখটা তুলে উন্মত্তের মতো ভেজা চোখদুটোয় চুমু খেলো। ঠোঁটের চাপ পেয়ে বন্ধ চোখের পাপড়ি চুয়ে গাল বেয়ে অশ্রু পরলো মেহনূরের। অতিশয় উষ্ণ অনুভূতিতে গভীর শ্বাস নিলো সে। ঈষৎ লজ্জায় আঁখিজোড়া খুলার শক্ত সাহস দেখালো না। মাহতিম চোখদুটো ছেড়ে দিয়ে সরাসরি মুখের দিকে তাকালো, থুতনির নিচে ডানহাতের তর্জনী রেখে মুখ উঁচু করলো। হারিকেনের হলুদাভ আলোয় পুরো মুখটা নরম চোখে দেখতেই নিঃশব্দে হাসলো মাহতিম। ফর্সা গালের উপর লজ্জার আবরণটা গাঢ় করে লেগেছে, চোখাচোখি হবার ভয়ে চোখদুটো এখন বন্ধ। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই চট করে গলার কাছে চোখ পরলো। গলার ছোট্ট তিলতুল্য কালো বিন্দুটা সোনালী আলোয় চমৎকার লাগছে। চুম্বকের মতোই মৃদ্যু-মৃদ্যু টানছে। বুকের ভেতর আদুরে অনুভূতিটা প্রবল হলো তার, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ডেরায় রাখাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। ভেবেছিলো সকালের মনোরম মূহুর্তের মতো এবারও মেহনূর তাকে কাছে টেনে নিবে, কিন্তু সময়ের পরিধি তাকে অধৈর্য করে ছাড়লো। তখনই হাতটা নির্বিকারে মেহনূরের থুতনি ছেড়ে পিঠের মখমল ব্লাউজটায় হাত রাখলো। নিজের সমস্ত সীমাবদ্ধতা ভেঙ্গেচুড়ে মেহনূরের গলার কাছটায় ডুবলো মাহতিম। ক্ষুদ্র লোলিত তিলতুল্য কালো বিন্দুটায় ওষ্ঠদ্বয়ের ভার ঠেকিয়ে গাঢ় চাপ বসিয়ে দিলো। স্পর্শকারীর মোহমন্ত্রে সাথে-সাথে শিউরে উঠলো মেহনূর, মানুষটার নেভি ব্লু শার্টটা আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে চেপে ধরলো সে। সৌম্য পুরুষের বলশালী হাতদুটো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। বিমুগ্ধ স্পর্শ, কাঁপা-কাঁপা অনুভূতি, মনের ভেতর উত্থাল ঢেউয়ের ধুকপুকনি সবটাই মেহনূরকে নিস্তেজ করে ফেললো। মূহুর্ত্তের ভেতর অনুভব করলো সে নিজের অস্তিত্বে নেই, মাহতিমের অশান্ত-অস্থির-অবাধ ছোঁয়ায় বিহ্বল হয়ে শেষ। বিভোর-মোহাচ্ছন্ন মেহনূর হঠাৎ গলায় কাছে ছোট্ট ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো, ভুলবশত মাহতিমের পিঠটা পাঁচ আঙ্গুলে চেপে ধরলো সে। সাথে-সাথে পালটা ব্যথায় চোখ কুঁচকে খুবই আস্তে ‘ আহ্ ‘ করলো মাহতিম। আর্তনাদের ছোট্ট শব্দটা মেহনূরের কান এড়িয়ে গেলো না। দ্রুত শার্টটা ছেড়ে দিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রাখলো মেহনূর। ততক্ষণে মাহতিম নিজের ব্যথাহত চেহারা পালটে নিয়েছে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে শান্ত গলায় বলল,
– ভয় পেয়েছো? কিছু হয়নি। আমি ফিট আছি। টেনশন কোরো না।
অপলক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। তাকে অবুঝ অপরাধীর মতো দেখাচ্ছিলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
– আপনি চমৎকার মিথ্যা বলতে পারেন। এই গুণ কি ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়েছিলো?
মৃদ্যু করে হাসতে গিয়ে রুমের অন্যপাশটায় চলে গেলো মাহতিম। মেহনূরের কথাটা এমন ভাবে অগ্রাহ্য করলো যেনো এসব প্রশ্ন শুনে সে অভ্যস্ত।দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে মানুষের উপস্থিতি আছে কিনা একবার দেখে নিলো মাহতিম, কেউ নেই দেখে দ্বারের পাল্লাদুটো বন্ধ করতে নিলো। বন্ধ করার ঠিক আগ মূহুর্তে একবার মুখ ঘুরিয়ে পিছু তাকালো সে, দরজার ছিটকিনিটা তুলতে-তুলতে মেহনূরের দিকে ফের আপাদমস্তক চোখ বুলালো। ঠোঁটে রহস্যজনক হাসি রেখে হারিকেনের পলতেটা নিভু-নিভু করে ফেললো। রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেলেও চারপাশে ভূতুড়ে অবস্থা ধারণ করলো। বাইরে থাকা নানা ধরনের ডাক ভেসে আসছিলো, কয়েকটা কুকুরের হলেও কয়েকটা অজ্ঞাতধারী ডাক ছিলো। সময় বাড়ার সাথে-সাথে বাতাসটাও ঠান্ডা হচ্ছে, বৃষ্টি শেষে ব্যাঙের ডাকটা একাধারে শোনা যাচ্ছে। মাহতিমের চালচলন বোঝা আবারও দূর্বোধ্য ঠেকছে, কি করতে চাইছে ধরতে পারেনি মেহনূর। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলে ছিমছাম রুমটায় গুমর কন্ঠ ভেসে উঠলো,
– যদি বলি আমি তোমাকে ইউজ করতে বিয়ে করেছি, তোমার প্রতি কোনো ফিলিংসই আমার নেই, তখন তোমার রিয়েকশন কেমন হবে?
প্রশ্নটা করেই মেহনূরের পাশ ঘেঁষে বিছানায় আসলো মাহতিম। পায়ের উপর পা তুলে বেশ গম্ভীর কায়দায় বসলো। পুরো ব্যক্তিত্বের উপর আবেগান্বিত ব্যাপারটা গুড়িয়ে নিয়েছে সে, মেহনূর ভেবেই পাচ্ছেনা কিভাবে সেকেন্ডের ভেতর রূপ পালটে ফেলেছে! হাত উঠিয়ে গলার টনটন জায়গাটা স্পর্শ করলো মেহনূর, মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হলো। গলায় একদফা কামড় লাগানোর মানে কি? নাটক ছিলো? প্রশ্নটা শুনে যদিও মেজাজ খারাপ লাগছে, কিন্তু সেটাকে হজম করে ঠান্ডা ভাবে বললো মেহনূর,
– আপনি নিজ জ্ঞানে একটু আগে কি করেছেন?
মাহতিম কোনোপ্রকার অস্বস্তি ছাড়াই ভাবলেশহীন সুরে বললো,
– কি করেছি?
রাগ লাগলো মেহনূরের। কথা কি এখন ভেঙ্গে বলতে হবে? এটা কি অতিরিক্ত হচ্ছে না? এরকম অস্বাভাবিক আচরণের মানে কি? তিরিক্ষি মেজাজে বলে ফেললো মেহনূর,
– আপনি আসলে চাচ্ছেনটা কি? আমাকে কি খুলে বলবেন? আপনার কি পিঠে খুব লেগেছে?
মাহতিমের পিছনে থাকা জানালা দিয়ে আলো আসছে। সেই আলোটা সরাসরি মেহনূরের মুখে পরেছে। মাহতিম পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বললো,
– ব্যথাটা কোথায় লেগেছে সেটা কি এখনো বুঝো না?
দুই ভ্রু এক করে প্রশ্ন করলো মেহনূর,
– আপনি কি হেঁয়ালি ছেড়ে কথা বলতে পারেন না?
বাঁকা হাসিটা তীর্যক ভাবে ফুটলো। গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্বটা এমনভাবে প্রকাশ পেলো, স্তব্ধ ভঙ্গিতে নির্বাক হলো মেহনূর। মানুষটা সম্মোহনী কায়দায় দৃষ্টি ছুঁড়ে নেভি শার্টটার স্লিভ ঠিক করলো, কোনো ভাবনা-চিন্তার সময় না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক কদম এগিয়ে এসে নির্বিকার চিত্তে শাড়িতে হাত রাখলো। দৃশ্য দেখে কাঠ হয়ে গেলো মেহনূর, মুখটা জবানবন্দির মতো চুপ হয়ে গেলো। আঁচলটা ডানহাতে পেঁচিয়ে জোরে টান দিতেই শক্ত বুকের উপর ছিটকে পরলো মেহনূর। কড়া পারফিউমের সুগন্ধিটা আবারও শ্বাস টেনে অনুভব করলো সে। তার স্পর্শ ইন্দ্রিয় টের পাচ্ছে মাহতিম আনসারী থেমে নেই, আজ সে একটুও থেমে নেই। আধো অন্ধকারে পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো শাড়িমুক্ত করে ফেলেছে। বারবার ঢোক গিলে লজ্জার পরিধিটা সামাল দিচ্ছিলো মেহনূর, বুকটা ধুকধুক-ধুকধুক করে কাঁপছে। তার মখমলের ব্লাউজটা যেনো ইচ্ছে করে নাফরমানী করলো। শাড়ির শেষভাগটা মাহতিমের প্রবল টানে যখন খুলে গেলো, তখন কোমরের চিলতেখানি ফাঁকটা পরিদৃষ্ট হলো। শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলালো মেহনূর, তখনই আবছা মতোন দেখতে পেলো নেভি শার্টটার টপ বাটন খুলে ফেলছে। একটা-একটা করে বোতাম খুলতেই শার্টটাকে অদূরে ছুঁড়ে মারলো। অযত্ন শার্টটা বিছানা স্পর্শ করে ফ্লোরের উপর পরলো। মেহনূরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তার ডানহাতটা ধরলো মাহতিম, সেটা টেনে এনে ঘাড়ে রাখতেই মেহনূরকে কোলে তুললো সে। মেহনূর একটুও কাঁপলো না, ভয়ও পেলো না। চুপচাপ বাঁহাতটাও বাড়িয়ে মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরলো। মাহতিম বুঝতে পারলো আজকের পর থেকে মেহনূর কখনোই বাধা দিবেনা। সেটা হোক মনের দিক দিয়ে, অথবা অন্য কোনো মাধ্যম। বিছানার দিকে ধীরেসুস্থে এগুতে লাগলো মাহতিম, তখনই মেহনূর সহজ গলায় বলে উঠলো,
– কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?
চট করে মুখ ফেরালো মাহতিম, বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। মেহনূর কি তার ভেতরের অবস্থাটা ধরে ফেলেছে? সাংঘাতিক! এটা হওয়া উচিত নয়। কিছুদিনের মধ্যেই যেটা ঘটতে যাচ্ছে সেটা কি ওর ধরা উচিত? নিশ্বাস ফেলে হাতদুটোর সমস্ত ভর বিছানায় নামিয়ে দিলো, বালিশে শুইয়ে দিলো মেহনূরকে। পায়ের কাছ থেকে পাতলা কম্বল নিয়ে নিজেও শয্যা গ্রহণ করলো। মেহনূর চুপ নেই, সে আবারও নির্যুত্তর মাহতিমকে প্রশ্ন করে বসলো,
– আপনি নিজেকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছেন কেন? কেন টেনশনের ব্যাপারটা লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন? আমাকে বলা যাবে না? আমিতো এখন সুস্থ, আগের মতো একটুও টেনশন করি না। আপনি আমার কাছে বিরাট কিছু লুকাচ্ছেন বুঝছেন! আপনি ভালোই অভিনয় করতে জানেন।
মেহনূরের কথাগুলো দু’কানে শুনলেও মৃদ্যু ঠোঁটে হাসলো মাহতিম, একটা কথারও জবাবদিহি করলো না। মেহনূরের উপর ঝুঁকে আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দিলো, বাঁহাতটা বিছানায় চেপে ডানহাতটা বালিশের উপর উঠালো। উষ্ণ নিশ্বাসগুলো মেহনূরের মুখের উপর পরছে, ভারী-ভারী নিশ্বাসের ভার সত্ত্বেও চোখে-চোখ রাখলো মেহনূর। নির্লিপ্ত গলায় হালকা সুরে বললো,
– আপনি মিশনে আছেন?
মুখের উপর দৃষ্টিলব্ধ চোখটা স্থির রইলো, শুধু মাথাটা নাড়িয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ বোঝালো। উত্তরটা পেয়ে চোখের কপাট বন্ধ হলো মেহনূরের, বুকের শেষভাগ থেকে নিশ্বাস টেনে গভীরভাবে ছাড়লো। পুরো দৃশ্যটা নিঃশব্দে চেয়ে-চেয়ে দেখলো মাহতিম, তার বুকের নিচে চাপা পরা মানুষটা আর স্বস্তিতে নেই। আর মধ্যে সুড়সুড় করে ভয় ঢুকে গেছে, ভয়টা যেনো মুখের উপর না পড়ুক তার জন্য শ্বাসকার্য চালাচ্ছে। মাহতিম আঙ্গুলগুলো আলগা করে হাতজোড়া ছেড়ে দিলো, কাণ্ডকারখানায় চোখ খুলতে বাধ্য হলো মেহনূর। মাহতিমের নিরবতা তাকে ভীষণ ভীত করছে। এই মাহতিম তো নিরব থাকেনা। তার ব্যক্তিত্ব যতই অটল হোক, শক্ত হোক, সে মেহনূরের কাছে কঠোর হয়নি। তার নিরবতা যে তিরতির করে হিংস্রাত্মক দেখাচ্ছে এটা কে বোঝাবে? অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর স্বাভাবিক হলো মাহতিম, মেহনূরের ঠোঁটের উপর ডানহাতের তর্জনী রেখে শান্ত গলায় বললো,
– এই মিষ্টি ঠোঁটদুটোর সৌভাগ্য তোমার অজান্তেই পেয়েছি এটা জানো?
মেহনূর শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকতেই মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দিলো। ঠোঁটের উপর থেকে তর্জনী উঠালো মাহতিম, দেহের সবটুকু ভার ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠকার্যে ডুব দিলো। কিছু সময় পার করে মেহনূরের অধরজোড়া মুক্ত করলো, ঠোঁটদুটো টকটকে লালবর্ণ ধারণ করলে সেখানে দৃষ্টি রেখে উদাস গলায় বললো মাহতিম,
– এভাবে আদর করার সুযোগ নাও পেতে পারি। তোমাকে ভালোবাসি মেহনূর। এভাবে-সেভাবে-সবভাবেই ভালোবাসি। আমার দ্বারা কষ্ট পেলে আমার স্মৃতিগুলো নষ্ট করে দিও। জানি অবাক হচ্ছো, প্রচুর প্রশ্ন জেগেছে, কেনো এমন কথা বলছি তাও ভেবে পাচ্ছো না। সবসময় কিছু জিনিস না-বলাই ভালো, সবকিছু সহ্য করলেও মন কখনো সহ্য করতে পারে না। আমাদের মনটা সরল, মস্তিষ্কটা কঠিন। তোমার সবটাই সরল, কোনোটায় কঠিন নেই। আমার মনটা কঠিনই ছিলো, তুমি একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে সরল করে ফেলেছো।
মেহনূর নির্ভীক ভঙ্গিতে বললো,
– আপনি আমাকে এরকম কথা কেন বলছেন?
মাহতিম হাসতে গিয়েও মলিন হয়ে গেলো। মেহনূরের কপালটায় সবটুকু আদর মাখিয়ে চুমু খেলো, পুনরায় চোখের ভেতর দৃষ্টি ছুঁড়ে সাধারণ গলায় বললো,
– বাস্তব সত্যের চাইতে মিথ্যার কল্পনা বেশি প্রিয়।
কথাটার কোনো মর্মই মেহনূর বুঝলো না। বুঝার কথাও ছিলো না। মাহতিম যে সূদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনা রেখে কথাটা বলে দিয়েছে, সেটা সময়ের সাথে-সাথে মেহনূর ঠিকই ধরতে পারবে। তখন হয়তো আফসোসের সীমা তাকে যন্ত্রণায় ফেলে দিবে। মেহনূর গুমোটভরা মূহুর্তটা স্বাভাবিক করতে চাইলো, বালিশ থেকে একটুখানি মাথা তুলে মাহতিমকে পরশে-পরশে ছুঁয়ে দিলো। গ্লানিটুকু নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তাই করতো মেহনূর। অন্তত বুঝতে চাইতো কেনো মাহতিম শক্ত কথা বলছে। মাহতিম আক্ষেপের নিশ্বাস ছেড়ে চেষ্টা করলো স্বাভাবিক হওয়ার। দুষ্টু হাসি দিয়ে মেহনূরের মাথাটা চটান করে বালিশ থেকে উঁচুতে উঠালো। মেহনূরের গালদুটোয় ভরে-ভরে চুমু খেলো সে, হঠাৎ নিচু কন্ঠে বলে ফেললো,
– যদি আজকের পর আদর করার সুযোগ না পাই?
ভয়ে শিরদাঁড়া পযর্ন্ত কেঁপে উঠলো মেহনূরের। সমুদ্রের পানিতে হাবুডুবু খাওয়া মাহদির স্মৃতিটা ভেসে উঠতেই প্রচণ্ড ভীতু হলো। পিঠের উপর মাহতিমের ডানহাত চলছে, মখমলের ফিতাটা নির্ঞ্ঝাটে খুলে ফেললো মাহতিম। পুনরায় বালিশে মেহনূরের মাথা রেখে দিলো, মেহনূর ভয়জনিত ব্যাপারটা তুচ্ছ করতে পারলো না। তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে বললো,
– কেনো পাবেন না? আপনি এমন আজগুবি কথা কেনো বলছেন? আপনি, আপনি আজ —
অকাট্য সত্যটা বলযে দিলো না মাহতিম। মেহনূরের নাকটায় চুমু খেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
– যদি এই মিশনে ম-রে যাই, আমিতো কোনোদিন ফিরবো না।
বাকরুদ্ধ হয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলো মেহনূর। কিসের মিশন? কিসের শেষ? এই মিশন কেনো ওদের সুন্দর মূহুর্তগুলোয় ঢুকে পরলো? এইযে মাহতিম বহুদিন পর তার কাছে সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়েছে, আদরে-আদরে এক পরিপূর্ণ বন্ধনকে আহবান জানিয়েছে, সেখানে এই’ মিশন ‘ শব্দটাকে ছুড়ির মতো ধারালো শোনালো। এই শব্দটা যেনো কানদুটো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে র-ক্তাক্ত করে দিলো। আকস্মিকভাবে চোখের কপাট বন্ধ করে নাক ফুলালো মেহনূর, দুচোখের কোল ঘেঁষে নোনাজল গড়িয়ে যাচ্ছে। কেনো জানি বুকের ভেতর অশনি আভাসের কু ডাকছে।
.
রাত প্রায় চারটের ঘর পেরিয়েছে। সবকিছু নির্জনতায় তলিয়ে আছে। গ্রাম্য কুকুরের ডাক ছাড়া তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। রুমের ভেতরটা ঘুট্ঘুটে অন্ধকার, চোখের সামনে তিল পরিমাণ আলো নেই। তবুও বিড়াল-চক্ষুর মতো সবই দেখতে পাচ্ছে সুজলা। তার মাঝে-মাঝে মনেহয় তার চোখদুটো সম্ভবত অদ্ভুত জিনিস। এমন কিছু এই চোখদুটো দিয়ে দেখেছে, যা সাধারণ ব্যক্তি দেখেনি। একটা পৈশাচিক মানুষকে নানাভাবে রদবদল করতে দেখেছে। কিভাবে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে ভেতরের জান্তব শয়তানটাকে মানুষের আড়ালে রাখে সেটাও আশ্চর্যের বিষয়। এই বাড়িতে বউ হিসেবে আসার পর যেসব শব্দবাণের স্বীকার হয়েছে সেটা শুধু বাড়ির দেয়ালগুলোই জানে। বাইরের বা উঠানের গাছও বুঝি অতোটা জানে না। কিন্তু এবার যেনো উৎসাহের বীজটা অঙ্কুরিত হচ্ছে। খুব শীঘ্রই যে হেস্তনেস্ত অবস্থার চূড়ান্ত সময় ঘনাবে এ নিয়ে দ্বিধা নেই। ঠিক এই দিনটির অপেক্ষায় তিনি যুগের-পর-যুগ এ বাড়িতে কাটিয়েছেন। শুধু ভয়ের জন্য মুখ খুলেননি। স্বামীর কর্তৃত্ব যখন হারিয়ে গেলো, তখন তিনটে সন্তান নিয়ে এ বাড়িতে থাকা যন্ত্রণার ছিলো। তবুও হাড়ভাঙ্গা কষ্টে, নানা লান্ঞ্চনার শিকার হয়ে ছেলেকে তিনি বিদেশ পাঠাতে পেরেছেন, কসম করিয়ে পাঠিয়েছেন যেনো ভুলেও এ বাড়ির সাথে যোগাযোগ না রাখে। এই যোগাযোগ তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তার বিধবা মা ও ছোটো দুটো বোনের কথা চিন্তা করে আজও শাওন এমুখো হয়নি। ছেলেটা ভালোয়-ভালোয় বিদেশ থাকুক সবসময় এই প্রার্থনাগীতি গাইছেন। শানাজকে নিয়ে বড় চিন্তার একাংশটা আজ একটু আগে সেরে ফেলেছেন। ভয় একটাই, যদি মাহতিমকে কিছু করে ফেলে? ছেলেটা তাদের জীবনে শুধু রহস্য ভাঙতে আসেনি, যুগ-যুগ ধরে চলতে থাকা নিকৃষ্ট নিয়মকেও ভষ্ম করতে এসেছে। তার ভেতরকার চরিত্র সভ্য, বাহিরের আবরণটা আপনজনের কাছে নরম, কিন্তু এই ছেলের মধ্যে যেই আগুনের তেজ বিদ্যমান সেটা চাহনির মাঝে দৃশ্যমান। কেউ হয়তো চিন্তাও করতে পারছেনা মাহতিম আনসারী ছেলেটা কি পরিকল্পনায় এসেছে। মাহমুদা মেয়ের জামাইকে সরল ভাবলেও আজ সুজলার কথায় চরম বিষ্মিত হয়েছে। কথাগুলো শুনে বেচারীর মুখটা হা হয়ে গেছিলো। স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিলো। কিন্তু ভয়টা বোধহয় মেহনূরের জন্য পেয়েছিলো। কেউ আগ বাড়িয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ে ঝাঁপাতে যাবে না। সেখানে নিজ গর্ভের সন্তান বিপদের মুখের দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য একটা ধাক্কা দিলেই বিধবার খাদে পরে যাবে। সেই খাদ থেকে উঠানোর কেউ নেই, সাহস দেওয়ারও কেউ নেই। গুণে-গুণে আর বোধহয় একটা দিনই আছে। ভোরের আলো ফুটলেই রাত পযর্ন্ত শেষ সময়, এরপরই বোধহয় কাজে নামবে সে। কথার ধরনে সবটা বেফাঁস করেনি মাহতিম, খুবই চালাকির সাথে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে সবাইকে বাড়ি থেকে অনত্র যেতে হবে। বৃষ্টির অজুহাতে সাপের উপদ্রব হবে এটা নেহাতই মিথ্যা ছিলো। মাহতিম নিজেই চাইছে এ বাড়ির মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। হয়তো এতোক্ষনে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। অ-স্ত্রেশ-স্ত্রে সজ্জিত দলবলটা ছদ্মবেশে ঢুকেছে, নাকি নিজেদের বেশে ঢুকেছে এ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। আর যাই করুক খেটে খাওয়া মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। তারা তো জানে না এখানে কেউ সাধু সেজে লোকনজরে মহান হয়ে আছে। ঘড়িতে এখন কয়টা বাজে? চারটা? নাকি সাড়ে চারটা? সময়টা কেনো জানি কাটতে চাইছে না।
.
হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। জানালাটা বন্ধ করতে গিয়েও বন্ধ করলো না মেহনূর। বৃষ্টির সাথে যেই হাওয়াটা আসছে, সেটা খুবই প্রাণোচ্ছল। কম্বলটা টেনে এবার কান পযর্ন্ত ঢেকে দিলো। মানুষটা কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুমকাতুরে মুখটা দেখতে ক্লান্তি লাগে না, শান্তি লাগে। জানালা দিয়ে যেটুকু হাওয়া আসছে সেটা তার কপালে চুলগুলো থেমে-থেমে উড়িয়ে দিচ্ছে। কপালে হাত রেখে অবাধ্য চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিলো, কিন্তু নাফরমানী করে বসলো। আবারও কপালের ধারে এসে লুকোচুরি খেললো। মেহনূরের ডানহাতটি এখনো তার মুঠোর ভেতর, অন্য হাতটা মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। বুকের উপর মাথা রেখে ওম করা কাথায় গভীর ঘুম দিয়েছে। মাহতিম ওমন ভয়ংকর কথাগুলো কেন বললো? কেনো বললো কষ্ট পেলে স্মৃতি নষ্ট করতে? মানুষ কি হাজার কষ্ট পেলেও স্মৃতি নষ্ট করে? এমন বোকামি করার সাহস কারোর বুকে আছে? হঠাৎ এমন চিন্তার ভেতর ছেদ করে চাপা রিংটোন বাজছে। শব্দটা কোথা থেকে হচ্ছে সেটার খোঁজ করতেই বালিশের নিচে হাত ঢুকালো মেহনূর, বেশ বেগ খাটিয়ে ফোনটা টেনে আনলো। দেখেই বুঝতে পারলো এটা সদ্য কেনা নতুন ফোন, কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে উঠা কলটা ঠিক আননোন। আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করলো না মেহনূর, তার উপর এটা মাহতিমের ফোন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই কলটা কেটে ম্যাসেজ আসলো। মেহনূর যেই ফোনটা রেখে দিতে নিচ্ছিলো, তখনই ম্যাসেজ দেখে থেমে গেলো। যদিও অনুমতি ছাড়া ম্যাসেজ চেক করা ঠিক না, কিন্তু মাহতিমের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে মন চাইলো না। মেহনূর নিজ থেকেই ম্যাসেজটা ওপেন করে সেটা পড়তে শুরু করলো। ঠোঁটে নাড়িয়ে পড়তে-পড়তেই বিস্ফোরিত চাহনিতে থেমে গেলো সে, ঠোঁটদুটো অস্বাভাবিক হয়ে থামতেই হা হয়ে গেলো!
– আনসারী স্যার, ইউর বডিগার্ড সালেহ্ ইজ ডেড।
চলমান .
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
#ফাবিয়াহ্_মমো .
#নোটবার্তা : ক্ষমা মাফের জন্য ছোট্ট সারপ্রাইজের প্রচেষ্টা চালালাম। আমার জন্য দুয়া রাখুন।