নিজের মৃত্যু নিয়ে স্ট্যাটাস মৃত্যু
নুসরাত রীপা
একটু আগে আমি মারা গেছি।
অবশ্য আমি যে মারা গেছি এটা বুঝতে আমার বেশ কয়েক মিনিট সময় লেগেছে।
লাগবেই তো।
নিরোগ সুস্থ দেহী মানুষ আমি। সারাদিন অফিস শেষে কফি শপে এক বন্ধুর সাথে খানিক আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলাম। শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এক মগ কফি হাতে বারান্দায় বসবার পরই হঠাৎ আমার মনে হলো নিশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। জোরে শ্বাস নিতে চাইলাম। বুকটা যেন চাপ হয়ে আছে। ঘরে এসে এসিটা চালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘড়িতে সোয়া নয়টা বাজে। একটু হাত পা ছড়িয়ে শুলে হয়তো ভালো লাগবে।
কিন্তু কী যেন হলো। মনে হলো আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারাটা শরীর প্রকান্ড একটা ঝাঁকি খেল। তারপর আর কিছু মনে নাই।
যখন চোখ মেললাম তখন শরীর টাকে বেশ হালকা লাগছে। কী হয়েছিল? মনে পড়লো শরীরটা খারাপ লাগছিল। তারপর? তারপর কি আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম?
ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখলাম নটা কুড়ি। মানে মাত্র পাঁচ মিনিট আমার জ্ঞান ছিল না। হঠাৎ জ্ঞান হারানো ভালো লক্ষণ নয়। কালই একবার ডাক্তার দেখাতে হবে। শরীরের ব্যাপারে গাফিলতি করা যাবে না।
আমার বন্ধু সায়েম ডাক্তার। বেশ নাম ডাক আছে। এখুনি তাকে ফোন দিয়ে কাল যাবো জানিয়ে রাখি। আমি মাথার পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়েই মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিম শীতল স্রোতের বয়ে যাওয়া অনুভব করলাম। মোবাইলটা আমি হাত দিয়ে ধরতে পারছি না! আমার হাত মোবাইল ভেদ করে সরে যাচ্ছে। লাফিয়ে উঠে বসলাম। বালিশটা টেনে সরাতে চাইলাম। নাহ্। ঐ একই অবস্থা।
ভয়ে আমার তৃষ্ণা পেল। বিছানা থেকে নামলাম। আরেহ কী আশ্চর্য! আমার পা মেঝে স্পর্শ করছে না। আমি বাতাসে ভাসছি!
বিছানার দিকে তাকাতেই আমার চোখ স্থির হয়ে গেল।
আমার শরীর বিছানায় পড়ে আছে!
এ কী করে সম্ভব?
নিজের দিকে তাকালাম। আমার শরীর তো আমার সাথেই। তাহলে ওটা কী?
সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। বারান্দা, রান্নাঘর, ড্রইং, ডাইনিং সব এক এক করে দেখলাম। সব ঠিক ঠাক আছে। টেবিলে কাচের ঢাকনার নিচে প্রণ ভূনা, পুঁইশাক দিয়ে শুটকির তরকারি দেখা যাচ্ছে। একটা প্রণ তুলে মুখে দেবো ভেবে ঢাকনা তুলতে গিয়ে আবার ঐ একই সমস্যায় পড়লাম। আমার আঙুল কিছু ধরতে পারে না। আমার আঙুল যেন আঙুল নয়, নিরেট বস্তুও নয়। যেন কেবল একটা অবয়ব!
ঘড়িতে নটা বাইশ।
বিছানায় এসে বসলাম। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। স্বপ্ন দেখছি নাকী?
না স্বপ্ন নয়। সব সত্যি- পাশ থেকে কেউ বলল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা কেউ একজন দাঁড়িয়ে। কাপড়টা সাদা হলেও জেল্লাদার।
কে আপনি? কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
সে বলল, আমি ফেরেশতা।
আপনি ফেরেশতা? প্রমাণ কী?
আমার দিকে ভালো করে দেখ।
দেখলাম। তার পিঠে অপরূপ কারুকাজ করা ডানা গোটানো।
বললাম, আপনি আমার বাসায় কেন?
কারণ একটু আগে তুমি মারা গেছো। আমি তোমাকে পরকালে নিতে এসেছি।
আমি মারা গেছি?
হা।
কিন্তু আমার তো কোনো অসুখ ছিল না—-
কোথাও লেখা আছে মরার জন্য অসুখ লাগে? এই পৃথিবীতে কাটানোর জন্য তোমার প্রতি বরাদ্দ সময় শেষ। এখন তোমাকে পরপারে যেতে হবে। চলো।
আমি সযত্নে সাজানো আমার বাসাটার দিকে তাকালাম। বুকসেল্ফ ভরা বই। নতুন কেনা ড্রেসদুটো এখনো ড্রইং রুমের সোফার ওপর প্যাকেট সহ পড়ে আছে। আমার দামী মোবাইলগুলো বিছানায়,বালিশের পাশে।একটা তে রিং বাজছে। কে কল দিচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। মোবাইলটা উল্টে আছে।
আমি চারিদিকে করুন চোখে তাকাচ্ছি। মাত্র চারমাস আগে ফ্ল্যাটটা কিনেছি। আহা বারান্দায় কত যত্ন করে একগাদা বিদেশি ফুলগাছ লাগিয়েছি। বাসাটা পুরোপুরি সাজানোই হয়নি এখনো। কত প্ল্যান ছিল!
ফেরেশতা বলল, চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আজকের রাতটা থাকি?
আরে না। অনুমতি নেই। এসো আমার হাত ধর।
ফেরেশতা তার হাত বাড়িয়ে দিল।
হাতটা ধরতে গিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা আমারর শরীর টা চোখে পড়লো। চর্চিত হাত,পা মুখমন্ডল। নিয়মিত স্পা করা রেশমি চুল ছড়িয়ে আছে। কিন্তু স্থির। নিশ্বাস প্রশ্বাস নেবার চিহ্ন নেই।
সেদিকে তাকিয়ে ভারি কণ্ঠে বললাম, ঐ যে আমার শরীর —
ওটা থাক। কাল লোকজন এসে ওটা মাটি চাপা দেবে।
ওটা আমারর সাথে যাবে না?
না। একটু পরই ও থেকে পচা গন্ধ বেরোবে। ওরকম নশ্বর কিছু পরকালে নেওয়ার হুকুম নেই।
আমি খুব দামি পারফিউম ইউজ করি।
পরকালে পারফিউম এর সুবাস নেওয়ার হুকুম নেই। এসো। আর দেরি করা যাবে না। আমার হাত ধর।-বলতে বলতে ফেরেশতা আমার হাত ধরলেন।
আমি তার সাথে ভাসতে ভাসতে ছাদ ভেদ করে আকাশের দিকে চলে যাচ্ছি। এত দ্রুত আমি উপরের দিকে উঠছি যেন চোখের পলক ফেলার আগেই লক্ষ মাইল পার হচ্ছি।
তবুও আমি নিচের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছি।ঐ যে নিচে বিন্দুর মতো আমার দেহ পড়ে আছে। বাসাটা আস্তে আস্তে ধোঁয়াটে হয়ে আসছে।
ইস আর কটা দিন যদি পৃথিবীতে থাকতে পারতাম—-
.