নয়নে লাগিল নেশা ১১
#WriterঃMousumi_Akter.
কুয়াকাটার সী-বিচে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তিক।হাতে কোল্ড ড্রিংক্স। স্পিড বোটে উঠে মাঝ সমুদ্রে গেল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অথৈ পানিতে আবিষ্কার করল– সমুদ্রের এই গভীরতা নিছকই সামান্য তার ভালোবাসার গভীরতার কাছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আচ্ছা, বলো তো কার গভীরতা বেশি? তোমার না কি রজনীগন্ধার প্রতি আমার ভালোবাসার?”
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসা কথাটা আজীবভাবে উত্তর দিয়ে গেল কানে কানে, “প্রান্তিক চৌধুরী, তোমার ভালোবাসা সমুদ্রের গভীরতার চেয়েও গভীর। নীল আকাশের চেয়েও বিশাল। ফিরে যাও তোমার রজনীগন্ধার কাছে। রজনীগন্ধা সুবাস ছাড়া তোমাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।”
প্রান্তিকের মন ছুটল। তাকে এখনি ফিরতে হবে। এখনি রজনীগন্ধার কাছে যেতে হবে।এক্ষুনি মানে– এক্ষুনি। লাস্ট সাতদিন ভিডিয়ো কলে প্রতিদিন রজনীকে দেখেছে সে। অন্তু সারাক্ষণ রজনীকে ফলো রেখেছে।এই সাতদিন অন্তুর উপর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল এটাই যে, রজনীকে দেখেশুনে রাখা। রজনী ভাবছে– প্রান্তিক তাকে ভুলে গিয়েছে; অথচ প্রান্তিক দূরে থেকেও রজনীকে দেখতে ভুল করেনি।একবার মন বদল হয়ে গেলে কি আর ভুলে যাওয়া যায়? প্রান্তিক তীরে এসে শ্রাবণকে খুঁজে চলেছে। শ্রাবণের দেখা নেই। এইদিকে শ্রাবণ আসার সময় ফোন আনতে ভুলে গিয়েছে। ফোনও নেই। খুঁজে পাবে কীভাবে? মাত্রই তো ছিল এখানে। শ্রাবণকে না পেয়ে সমুদ্রের পাড়ে বসে বালুতে লিখল, “ইউ আর মাই লাইফ রজনীগন্ধা।”
________
শ্রাবণ শামুক-ঝিনুকের মালার দোকানে গেল। ঝিনুকের তৈরি একটা পায়েল কিনল।সে জানে– প্রিয়তা এই সামান্য জিনিসে ভীষণ খুশি হবে। খুশিতে উন্মাদ হয়ে বলবে, “এটা আমার লাইফের সব থেকে দামি গিফট। জীবনে অনেক গিফট পেয়েছি কিন্তু এটার মতো এত আনন্দ আগে হয়নি।”
হ্যাঁ প্রিয়তা এমনই করে। শ্রাবণের দেওয়া সামান্য উপহারকে অনেক বেশি দামি মনে করে। আসলে মেয়েরা মন থেকে কাউকে ভালোবাসলে এত বেশি ভালোবাসে যে সব উজাড় করে দিতে চায়। একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো চাহিদা থাকে না। কোনো বাড়ি-গাড়ি-গহনা কিছুর চাহিদা থাকে না।কিন্তু এই কয়দিনে মহারানি কী পরিমান রেগে আছে সেটাই ভাববার বিষয়। ব্রেকাপ করে দিবে কি না আল্লাহই জানে। শ্রাবণ ভীষণ চিন্তিত হয়ে ভাবছে– “মহা অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু কী করতাম! সম্বন্ধীকে সামলাতে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।এইদিকে আবার তার বোনকে সামলানো সো টাফ। ভদ্রলোকের বোন আমার গর্দা* ন না নেয়। হয় বোন না হয় ভাই কবে যে কার হাতে প্রাণ যা*বে।”
কিছুক্ষণের মাঝে শ্রাবণ ফিরে এলো। প্রান্তিক বলল, “কই গেছিলি?”
“এই একটু এইদিকে ভাই।”
“জিএফ-এর সাথে কথা বলতে?”
“না ভাই।”
“আরে, থাকলে আমার ফোন দিয়ে কথা বল। সমস্যা কী?”
শ্রাবণ বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল প্রান্তিকের দিকে। মনে মনে বলল, “নাহ ভাই, কোনো সমস্যা নেই। নামটা বললে এই গভীর সমুদ্রে আমার শ্রাদ্ধ করে যাবেন।”
প্রান্তিক বলল, “বুঝেছি, তুই সিঙ্গেল। এখন ফিরতে হবে।”
“চলুন ভাই।”
“আগামিকাল প্রিয়তার জন্মদিন। মনে আছে তোর?”
শ্রাবণ আমতা আমতা করে বলল, “খেয়াল ছিল না ভাই।”
“প্রিয়তা জানলে তোর বারোটা বাজাবে। ওর জন্মদিন ভুলে গেলে ওর রাগ হয়।”
শ্রাবণ মনে মনে বলল, “আপনার বোনের জন্মদিন ভুলে গেলে আপনার বোন খবর করে ছাড়বে, ভাই। আমি যদি বলি আপনার বোনের রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার খবর আমি জানি তাহলে আপনি আমার খবর করে ছাড়বেন। আছি এক মাইনকার চিপায়।”
_________
রাত ৮ টায় প্রান্তিক আর শ্রাবণ বাসায় ফিরল। ডায়নিং-এ ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে মাহবুব আর আঞ্জুমান চৌধুরী।ছেলের বাড়ি থেকে গায়েব হওয়া এই প্রথম বার নয়। তাদের ছেলে প্রকৃতিপ্রেমী। মাসে দু’একবার মাঝ রাতে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে ঘুরে আসার অভ্যাস আছে। প্রান্তিককে দেখে আঞ্জুমান এগিয়ে এসে বলল, “মায়ের কথা কি মনে পড়েছে আমার ছেলের?”
প্রান্তিক আঞ্জুমানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ মাই সুইট আম্মু, তোমাকে ভুলতে পারি আমি!”
“এভাবে আর পাম দিলে কাজ হবে না, এইবার বউমা এনে তোমাকে বেঁধে রাখব।তাহলে আর এভাবে হুটহাট বাইরে যেতে পারবে না।”
“বউমা দেখতে চাইলে মুনসুর আলীর মেয়েকে নিয়ে এসো আম্মু।” –বলেই প্রান্তিক হনহন করে নিজের রুমে প্রবেশ করেই ওয়াশরুমে ঢুকল।
মাহবুব চৌধুরী বলল, “শ্রাবণ, মুনসুর আলীর মেয়ে কেমন?”
“অনেক ভালো চাচা।”
“দেখি কথা বলে আসব। ছেলের বিয়ে এবার দিতেই হবে।”
শ্রাবণ প্রান্তিকের মা-বাবার সাথে কথা বলে চারদিক চোখ বোলাল প্রিয়তার জন্য।চারদিকে কোথাও প্রিয়তা নেই। সবার অলক্ষে শ্রাবণ প্রিয়তাকে খুঁজছে। নিশ্চয়ই অভিমানিনী ছাদে আছে। শ্রাবণ নির্ভয়ে ছাদে পা রাখল। প্রিয়তা বুঝতে পারল ছাদে কেউ এসেছে। আর সে শ্রাবণই হবে। শ্রাবণের পারফিউমের গন্ধ প্রিয়তার মুখস্থ। অভিমানে ঘুরেও তাকাল না প্রিয়তা। শ্রাবণ গুটি গুটি পায়ে গিয়ে প্রিয়তার ঘাড়ে হাত রাখল। প্রিয়তা ঘুরে তাকালো না। শ্রাবণ প্রিয়তাকে তার দিকে ঘোরাল। প্রিয়তার চোখ ভরা পানি। পানিতে কাজল লেপ্টে গিয়েছে। শ্রাবণের হৃদয় ব্যাথিত হলো।প্রিয়তার মতো চোখের পানি ফেলতে পারছে না কিন্তু হৃদয় জ্বলে যচ্ছে। প্রিয়তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “জা’ন, স্যরি বলার সাহস নেই আমার। মাফ চাওয়ারও সাহস নেই। এই অপদার্থকে প্লিজ লাস্ট চান্স দাও। ছেড়ে যেয়ো না।”
প্রিয়তা শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি? তুমি এত নিষ্ঠুর কেন শ্রাবণ? তুমি কি জানো না, আমার কষ্ট হয় তোমার জন্য? তোমাকে ফোনে না পেলে ভয়ংকর যন্ত্রনা হয় আমার। তোমাকে না দেখলে ঘুম হয় না আমার। তুমি এসব জেনেও আমাকে কেন কষ্ট দাও?”
শ্রাবণ প্রিয়তাকে বুকে টেনে নিল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, স্যরি পা’গলি।”
প্রিয়তা শ্রাবণকে ধাক্কা মেরে বলল, আর কখনো কথা বলব না তোমার সাথে।”– বলেই নিচে চলে গেল। শ্রাবণ বলল, “যা ধারনা করেছিলাম তা-ই।”
_____________
পরের দিন সকাল থেকে চৌধুরী বাড়ি টুকটাক সাজানো হচ্ছে। ঘরোয়াভাবে পালন করা হবে প্রিয়তার জন্মদিন। সকাল থেকে শ্রাবণ, অন্তুবেলুন দিয়ে বাড়ি সাজাচ্ছে।প্রিয়তার রঙিন বেলুন খুব পছন্দের। প্রান্তিক হুকুম দিয়েছে তার বোন যেন খুশি হয় সেভাবেই সাজাতে।
বাড়ির সবার এত সাজগোজের মাঝে প্রিয়তা কালো রঙের থ্রি পিছ পরে বেরিয়েছে।
প্রান্তিক অবাক হয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস এখন?”
প্রিয়তা হেসে বলল, “আমার বেষ্টিকে আনতে যাচ্ছি, ভাইয়া। কলেজের নতুন বেষ্টি। যাকে তোমার জন্য চয়েস করেছিলাম।”
“কলেজে গিয়ে লেখাপড়া না করে ঘটকালি করা হচ্ছে!”
“বাহ রে! ভাইয়ের জন্য তো ঘটকালি করবই
যা তোর বান্ধবীকে নিয়ে আয়। আমি তো আর বিয়ে করতে পারছি না। শ্রাবণের সাথে বিয়ে দিয়ে দিব।”
প্রিয়তা রাগী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বাইরে বের হলো। প্রান্তিক, শ্রাবণ আর অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ও রেগে গেল কেন রে?”
অন্তু বলল, “আম গাছে জাম দিচ্ছেন তাই।”
“মানে?”
“আপনার জন্য ঠিক করা পাত্রী শ্রাবণকে দিচ্ছেন।”
প্রান্তিক বলল, “আমার জন্য ঠিক করা মেয়েকে আমি পেয়ে গিয়েছি। তোদের ভাবিকে দ্রুত ঘরে আনতে হবে। ওই মায়াবিষ্ট হরিণী চোখ দু’টো আমাক এলোমেলো করে দেয় বাজেভাবে।”
চলবে….